আদর্শ রক্ষায় আপসহীন মানুষ এম. আব্দুর রহিম

চিত্ত ঘোষ

এম. আব্দুর রহিম। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় তিনি নেতৃত্বের আসনে থেকে দিনাজপুরের মানুষকে যুগিয়েছেন সাহস-অনুপ্রেরণা-উদ্দীপনা। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় আসীন স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতনের শিকার ও কারাবরণ করতে হয়েছে অনেকবার। আদর্শ ও নীতিবোধকে অটুট-সমুজ্জ্বল রেখে রাজনীতিকে মানুষের সেবা-কল্যাণ আর মঙ্গলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজসেবায় ছিলেন একনিষ্ঠ। মহাপ্রলয়ে পাহাড় ভেঙে পড়লেও তার ব্যক্তিসত্তাজুড়ে আদর্শের পর্বত ছিল অটুট।

দিনাজপুর সদর উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে ১৯২৭ সালের ২১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এম. আব্দুর রহিম। বাবা মরহুম মো. ইসমাইল সরকার ও মা মরহুমা দরজ বিবি।

তিনি ১৯৫০ সালে আইএ ১ম বর্ষে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। পরে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আবার ১৯৫৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৬০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজপুর বারে আইন পেশা শুরু করেন।

ছাত্র অবস্থায় এম. আব্দুর রহিম পাকিস্তানবিরোধী স্বাধীকার আন্দোলনে যুক্ত হন। রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সব কর্মসূচিতে সক্রিয়তার স্বাক্ষর রাখেন। কলেজের শহীদ মিনার নির্মাণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগ সরকারের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের একজন তরুণ কর্মী হিসেবে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি দিনাজপুর অঞ্চলে ৬ দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরূদ্ধে দায়েরকৃত ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লিগ্যাল এইড কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এম. আব্দুর রহিম অ্যাডভোকেট। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের নেতিবাচক দিক বিশ্লেষণ করে ১৯৭০ সালে ‘ধর্মের মুখোশ’ এবং ‘৫ম সংশোধনীর মজেজা’ নামে তার রচিত গ্রন্থ দুটি ব্যাপক সাড়া জাগায়।

১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ আর দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে তিনি ভারতের পতিরাম, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মানুষের পাশে থেকে তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে কাজ করেন।

১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার পর গোটা দেশকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১টি বেসামরিক জোনে ভাগ করা হয়। মুজিবনগর সরকার এম. আব্দুর রহিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর জোনাল চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও ভারতের পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এম. আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনা শাসক সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় দিনাজপুর গোরে শহীদ বড় ময়দানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে এ অঞ্চলের মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্ণেল শমসের সিংয়ের নেতৃত্বে একটি চৌকস সামরিক দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

বিজ্ঞ আইনজীবী ও জনদরদী রাজনীতিক এম. আব্দুর রহিম সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন না করতে খন্দকার মোস্তাক জোর আপত্তি তুললে তখন এম. আব্দুর রহিম ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক ও জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনই আমাদের লক্ষ্য। এছাড়া বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল ধরে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, শোষন, বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শোষনমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, জনকল্যাণকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ফসল আজকের বাংলাদেশ। তাই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করতে আপত্তি উত্থাপন করাটাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করার সামিল। তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাই সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের ঐক্যমত্যে পৌঁছতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যখন সভাপতি, এম. আব্দুর রহিম কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তখন সহ-সভাপতি হিসেবে দল গঠনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে ভয়াবহ মাইন বিস্ফোরণে সাত শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। সে সময় এম. আব্দুর রহিম- এর নেতৃত্বে নিরলসভাবে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে হত্যা ও ৭ই নভেম্বর জাতীয় ৪ নেতাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যার পরবর্তী সামরিক শাসকদের কোন প্রলোভনই তাকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এমন আদর্শবান, সৎ, নিরহংকারী, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনীতিবিদের সংখ্যা খুব বেশি নেই। এম. আব্দুর রহিম ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৫ সালে চাঞ্চল্যকর কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা ও বলিষ্ঠতা তাকে দিনাজপুরের গণমানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তিনি ইয়াসমিন হত্যা ও ধর্ষণ মামলাগুলো নিরলস পরিশ্রম এবং নিবিড়ভাবে তদারকি করেন। ফলশ্রুতিতে দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে একজন সাহসী মানুষ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুর বিশেষ আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে দোষী প্রমাণিত ৩ পুলিশ এএসআই মইনুল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ চালক অমৃত লাল বর্মন কে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়।

জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তাকে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনীতিকে মানুষের সেবা-কল্যাণ আর মঙ্গলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজসেবায় ছিলেন একনিষ্ঠ। দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে তিনি কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৪-মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৬ সালের ১৭ জুন চিরিরবন্দর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের মরহুম শাহ্ আব্দুল হালিমের কন্যা নাজমা বেগমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এম. আবদুর রহিম। তিনি দুই পুত্র ও চার কন্যার জনক। বড় ছেলে ইনায়েতুর রহিম বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ছোট ছেলে ইকবালুর রহিম দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ। চার মেয়ে ডা. নাদিরা সুলতানা জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তা, ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক, নাফিসা সুলতানা এবং নাজিলা সুলতানাসহ সন্তানরা শিক্ষা জীবন শেষে সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

বিস্তীর্ণ হৃদয়ের এবং বর্ণাঢ্য জীবনের আলোকিত মানুষ এম. আব্দুর রহিম ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। ওইদিন জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং সংসদ সদস্যবৃন্দ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এম. আব্দুর রহিমের প্রতি দিনাজপুরবাসীর যে অসীম শ্রদ্ধা তা ৫ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে দিনাজপুরের স্মরণাতীতকালের তার বিশাল জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহণে লক্ষ্য করা যায়। জানাজার পর জালালপুরে পারিবারিক গোরস্তানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

এম. আব্দুর রহিম মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অকুতোভয় সৈনিক। দিনাজপুরের রাজনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে তার অনন্য অবদানের কথা দল মত নির্বিশেষে দিনাজপুরবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে।

আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থাকা এম. আব্দুর রহিম অ্যাডভোকেট মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অকুতোভয় সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সর্বচ্চো সম্মান ‘স্বাধীনতা পদকে’ (মরণোত্তর) ভূষিত করেন।

আজ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ জননেতা এম. আব্দুর রহিমের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে দিনাজপুরবাসী তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]

chittaghosh2010@gmail.com

শুক্রবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৪ মহররম ১৪৪২, ১৮ ভাদ্র ১৪২৭

আদর্শ রক্ষায় আপসহীন মানুষ এম. আব্দুর রহিম

চিত্ত ঘোষ

এম. আব্দুর রহিম। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় তিনি নেতৃত্বের আসনে থেকে দিনাজপুরের মানুষকে যুগিয়েছেন সাহস-অনুপ্রেরণা-উদ্দীপনা। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় আসীন স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতনের শিকার ও কারাবরণ করতে হয়েছে অনেকবার। আদর্শ ও নীতিবোধকে অটুট-সমুজ্জ্বল রেখে রাজনীতিকে মানুষের সেবা-কল্যাণ আর মঙ্গলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজসেবায় ছিলেন একনিষ্ঠ। মহাপ্রলয়ে পাহাড় ভেঙে পড়লেও তার ব্যক্তিসত্তাজুড়ে আদর্শের পর্বত ছিল অটুট।

দিনাজপুর সদর উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে ১৯২৭ সালের ২১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এম. আব্দুর রহিম। বাবা মরহুম মো. ইসমাইল সরকার ও মা মরহুমা দরজ বিবি।

তিনি ১৯৫০ সালে আইএ ১ম বর্ষে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। পরে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আবার ১৯৫৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৬০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজপুর বারে আইন পেশা শুরু করেন।

ছাত্র অবস্থায় এম. আব্দুর রহিম পাকিস্তানবিরোধী স্বাধীকার আন্দোলনে যুক্ত হন। রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সব কর্মসূচিতে সক্রিয়তার স্বাক্ষর রাখেন। কলেজের শহীদ মিনার নির্মাণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগ সরকারের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের একজন তরুণ কর্মী হিসেবে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি দিনাজপুর অঞ্চলে ৬ দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরূদ্ধে দায়েরকৃত ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লিগ্যাল এইড কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এম. আব্দুর রহিম অ্যাডভোকেট। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের নেতিবাচক দিক বিশ্লেষণ করে ১৯৭০ সালে ‘ধর্মের মুখোশ’ এবং ‘৫ম সংশোধনীর মজেজা’ নামে তার রচিত গ্রন্থ দুটি ব্যাপক সাড়া জাগায়।

১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ আর দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে তিনি ভারতের পতিরাম, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মানুষের পাশে থেকে তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে কাজ করেন।

১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার পর গোটা দেশকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১টি বেসামরিক জোনে ভাগ করা হয়। মুজিবনগর সরকার এম. আব্দুর রহিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-১ এর জোনাল চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও ভারতের পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এম. আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনা শাসক সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় দিনাজপুর গোরে শহীদ বড় ময়দানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে এ অঞ্চলের মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্ণেল শমসের সিংয়ের নেতৃত্বে একটি চৌকস সামরিক দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

বিজ্ঞ আইনজীবী ও জনদরদী রাজনীতিক এম. আব্দুর রহিম সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন না করতে খন্দকার মোস্তাক জোর আপত্তি তুললে তখন এম. আব্দুর রহিম ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক ও জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনই আমাদের লক্ষ্য। এছাড়া বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল ধরে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, শোষন, বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শোষনমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, জনকল্যাণকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ফসল আজকের বাংলাদেশ। তাই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করতে আপত্তি উত্থাপন করাটাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করার সামিল। তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাই সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের ঐক্যমত্যে পৌঁছতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যখন সভাপতি, এম. আব্দুর রহিম কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তখন সহ-সভাপতি হিসেবে দল গঠনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে ভয়াবহ মাইন বিস্ফোরণে সাত শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। সে সময় এম. আব্দুর রহিম- এর নেতৃত্বে নিরলসভাবে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে হত্যা ও ৭ই নভেম্বর জাতীয় ৪ নেতাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যার পরবর্তী সামরিক শাসকদের কোন প্রলোভনই তাকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এমন আদর্শবান, সৎ, নিরহংকারী, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনীতিবিদের সংখ্যা খুব বেশি নেই। এম. আব্দুর রহিম ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৫ সালে চাঞ্চল্যকর কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা ও বলিষ্ঠতা তাকে দিনাজপুরের গণমানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তিনি ইয়াসমিন হত্যা ও ধর্ষণ মামলাগুলো নিরলস পরিশ্রম এবং নিবিড়ভাবে তদারকি করেন। ফলশ্রুতিতে দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে একজন সাহসী মানুষ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুর বিশেষ আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে দোষী প্রমাণিত ৩ পুলিশ এএসআই মইনুল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পিকআপ চালক অমৃত লাল বর্মন কে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়।

জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তাকে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনীতিকে মানুষের সেবা-কল্যাণ আর মঙ্গলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজসেবায় ছিলেন একনিষ্ঠ। দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে তিনি কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৪-মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৬ সালের ১৭ জুন চিরিরবন্দর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের মরহুম শাহ্ আব্দুল হালিমের কন্যা নাজমা বেগমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এম. আবদুর রহিম। তিনি দুই পুত্র ও চার কন্যার জনক। বড় ছেলে ইনায়েতুর রহিম বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ছোট ছেলে ইকবালুর রহিম দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ। চার মেয়ে ডা. নাদিরা সুলতানা জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তা, ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক, নাফিসা সুলতানা এবং নাজিলা সুলতানাসহ সন্তানরা শিক্ষা জীবন শেষে সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

বিস্তীর্ণ হৃদয়ের এবং বর্ণাঢ্য জীবনের আলোকিত মানুষ এম. আব্দুর রহিম ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। ওইদিন জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং সংসদ সদস্যবৃন্দ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এম. আব্দুর রহিমের প্রতি দিনাজপুরবাসীর যে অসীম শ্রদ্ধা তা ৫ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে দিনাজপুরের স্মরণাতীতকালের তার বিশাল জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহণে লক্ষ্য করা যায়। জানাজার পর জালালপুরে পারিবারিক গোরস্তানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

এম. আব্দুর রহিম মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অকুতোভয় সৈনিক। দিনাজপুরের রাজনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে তার অনন্য অবদানের কথা দল মত নির্বিশেষে দিনাজপুরবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে।

আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থাকা এম. আব্দুর রহিম অ্যাডভোকেট মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অকুতোভয় সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সর্বচ্চো সম্মান ‘স্বাধীনতা পদকে’ (মরণোত্তর) ভূষিত করেন।

আজ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ জননেতা এম. আব্দুর রহিমের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে দিনাজপুরবাসী তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী]

chittaghosh2010@gmail.com