বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ভাবনা

ড. জাহাঙ্গীর আলম

বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।’ [১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। তখন বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। ছিল অর্থের অভাব। খাদ্যের অভাব। বঙ্গবন্ধু এ পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন জেল থেকে বের হয়ে এলাম, তখন আমি শুধু সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না, শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। [১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]। অপর এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তখন বাংলাদেশে এলো খরা। তারপর হলো দুনিয়াজোড়া ইনফ্লেশন। ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে দুনিয়া ঘুরতে হয়েছে। খাবার বাইরে থেকে আনতে হয়েছে। গ্রামে গ্রামে পৌঁছাতে হয়েছে। সারা দুনিয়ায় যে ইনফ্লেশন হয়ে গেল তাতে শুধু আমাদের নয়, সব দুনিয়ায় যারা উন্নত দেশ, তাদের সবারই মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এলো এক ভয়াবহ বন্যা (১৯৭৪)। এত বড় বন্যা আমাদের জীবনে আমি দেখিনি। তখন খাবার ছিল না। ৫,৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং সেখানে রিলিফ অপারেশন চালানো হলো। বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে নিজের যা কিছু ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাঁচাতে পারলাম না সবাইকে। ২৭ হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল।’ [১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]। দেশের এই অভাব অনটনের মধ্যেও চারপাশে ছিল দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিভেদ ছিল। বিচারহীনতা। গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাস। ছিল কালোবাজারি তাতে সাধারণ মানুষের জীবন ছিল অতিষ্ঠ, দুর্বিষহ। এই অবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সামাজিক পরিবর্তনের কথা ভাবেন। দেশের চলমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। এটাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেন ‘সিস্টেম চেইঞ্জ’ হিসেবে। এটি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্ল­ব। প্রথম বিপ্ল­ব ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ সংগ্রামের পূর্ণতায় তার দ্বিতীয় বিপ্লবের শুরু।

বঙ্গবন্ধু এ বিপ্লবের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে, ‘পুরোনো রীতি, যেটা মানুষের মঙ্গল করে না সেই রীতি বদলানোর মতো সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন। ... পুরানো মত এবং পথ যদি দেশের মঙ্গল করতে না পারে সে মত এবং পথের পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করার অধিকার বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। নতুন বিপ্লব যখন আপনি বলছেন তখন এই বিপ্ল­বের মাধ্যমে জাতির জন্য একটা নতুন জিনিস, নতুন সিস্টেম আপনাকে গড়ে তুলতে হবে। যে সিস্টেম আজকে আমরা দেখি সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কালোনিয়াল সিস্টেম। এতে দেশের মঙ্গল হতে পারে না। এটাতে আমরা কনভিন্সড। ব্রিটিশ যে সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করার জন্য যে সিস্টেম দেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে চালু করে গিয়েছিল সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করার নামই বিপ্লব।” [১৯৭৫ সালের ৬ জুন প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

স্বাধীনতার পর প্রথমে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করেন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে। এগুলো হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন শোষিতের গণতন্ত্র। তিনি সমাজতন্ত্র চেয়েছেন। সেই সঙ্গে চেয়েছেন জনগণের ভোটাধিকার। তিনি মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র চাননি। চীনের কমিউনিস্টদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠারও পক্ষপাতি তিনি ছিলেন না। তিনি গণতন্ত্র রেখেছেন। সেই সঙ্গে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন। সম্পদের কেন্দ্রীয় ভবন রুখতে চেয়েছেন। আবার সম্পদ সৃষ্টির জন্য ব্যক্তি মালিকানাকেও অটুট রেখেছেন। তিনি ব্যাংক-বীমা, বৃহৎ ও ভারী শিল্প জাতীয়করণ করেছেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায় গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আবার জমির মালিকানা অক্ষুণœ রাখারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার মধ্যে ছিল একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার সংকল্প। সেটি ছিল নিজস্ব প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নিজস্ব আঙ্গিকে। তিনি বলেছেন ‘এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলছি সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোন জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোন ইজম চলে না। এদেশে, কোন দেশে চলে না। আমার মাটির সঙ্গে আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।’ [১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। রাজনীতিতে তার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু ছিল না। তিনি বলেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে আসতে পারবে না, আমরা তা হতে দেব না। বাংলাদেশকে ভালোবাসব না, বাংলার মাটিকে ভালোবাসব না, বাংলা ভাষা ভালোবাসব না, বাংলার কালচারকে ভালোবাসব না, আমরা চলতে দেব না।”

দেশের মানুষের শান্তি, সম্প্রীতি, সমৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু সিস্টেম পরিবর্তনের কথা বলেছেন। সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন বা সিস্টেম চেইঞ্জ বলতে বঙ্গবন্ধু ‘জুডিশিয়াল সিস্টেম’-এর পরিবর্তন চেয়েছেন। ‘এডুকেশন সিস্টেম’ নতুনভাবে বিন্যাস্ত করতে তৎপর হয়েছেন। তার ভাষায় ‘কেরানি পয়দা করে লাভ হবে না, মানুষ পয়দা করতে হবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তিনি উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। তিনি দুর্নীতিকে নির্মূল করতে চেয়েছেন প্রাত্যহিক জীবন থেকে। কৃষিতে, কল ও কারখানায় তিনি উৎপাদন বাড়াতে বলেছেন। স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন ‘যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচতে পারে। ... দিস ইজ আওয়ার সেকেন্ড রিভ্যুলিউশন। এই রিভ্যুলিউশন এর অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এর অর্থ অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। [১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

সে ক্ষেত্রে তিনি পাঁচটি কর্মসূচি দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে অধিক উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি নির্মূল। এ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। কল-কারখানা, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। কলে-কারখানায় সব জায়গায় বিশেষ করে খাদ্য-শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির উপর তিনি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন। উদার সহায়তা দিয়েছেন কৃষি উন্নয়নের জন্য। স্বাধীনতার পর প্রতি বছর গড়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টন খাদ্য-শস্য আমদানি করতে হতো বিদেশ থেকে। কিন্তু সেই আমদানি সবসময় সহজসাধ্য ছিল না। সেই জন্য তিনি কৃষির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা। তিনি বলেছেন, ‘কি করে আমরা বাঁচবো, যদি ধরুন, বছরে ২০ লাখ টন খাবার ডেফিসিট হয়? এই তিন বছর পর্যন্ত গড়ে এর চেয়ে অনেক বেশি খাবার আনতে হয়েছে। প্রথম আনতে হয়েছে ৩০ লাখ টন। ধরুন যদি প্রত্যেক বছর গড়ে ৫৪০ লাখ মণ খাদ্য আনতে হয় বিদেশ থেকে, কোথায় পাওয়া যাবে, কে দেবে? জাহাজ ভাড়া কোথায়? ২০ থেকে ৩০ লাখ টন প্রতি বছর আমাদের আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে এই তিন বছর। বন্ধু রাষ্ট্ররা সাহায্য করেছে। গ্রান্ট দিয়েছে, ‘লোন’ দিয়েছে, তাই খাবার, আনছি। খাবার দেয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রেরা কতকাল দেবে? এই পরনির্ভরতা হ্রাসের জন্য তিনি আধুনিক চাষাবাদের ওপর গুরুত্ব দেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেন। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি ভূমি সংস্কারের নীতিমালাও ঘোষণা করেন। পর্যায়ক্রমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল স্বনির্ভরতা অর্জন এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তিনি বলেন, ‘যে মানুষ ভিক্ষা করে, তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও তেমন ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক। সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি ছিল স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ওই পরিকল্পনায় বিদেশি সাহায্যর ওপর নির্ভরশীলতা ৬২ শতাংশ থেকে ১৯৭৭-৭৮ সালের মধ্যে ২৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কৃষি ও কলে-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর রাশ টেনে ধরতে হবে। নতুবা মানুষের খাবার জুটবে না। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছরে ৩০ লাখ লোক বাড়ে, তাহলে ২৫/৩০ বছরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না হালচাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সেই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল­্যানিং করতে হবে।

প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্ল­বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মহকুমা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তিনি ৬১টি জেলা প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রত্যেকটিতে নিয়োগ দেন একজন করে জেলা গভর্নর। তারা হবে জনগণের সেবক, শাসক নয়। এ প্রশাসন হবে জনকল্যাণের সহায়ক। তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। তাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। সে কাউন্সিল ডেকে আলোচনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে গভর্নরদের। এক বছর পর থানা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে থানায় যে প্রধান ব্যক্তি হবেন তার নাম হবে থানা প্রশাসক। তিনি বলেন, ‘এ শাসন ব্যবস্থা হয়েছে জনগণের, জনগণের মঙ্গলের জন্য। জনগণ যাতে সোজাসুজি শাসন ব্যবস্থার ফল ভোগ করতে পারে তার জন্যই এই সিস্টেম করা হয়েছে। সোজাসুজি, যাতে কোন রকম কোন অসুবিধা তাদের ভোগ করতে না হয়। সবকিছুই যেন জনগণের সামনে নিয়ে যাওয়া যায়। ইডেন বিল্ডিংস বা গণভবনের মধ্যে আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা রাখতে চাই না। আমি আস্তে আস্তে গ্রামে, থানায়, ইউনিয়ন, জেলা পর্যায়ে এটা পৌঁছিয়ে দিতে চাই, যাতে জনগণ সরাসরি তাদের সুযোগ-সুবিধা পায়।’

বঙ্গবন্ধুর জেলা কাউন্সিল/থানা কাউন্সিল হলো উন্নয়নকামী স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ হলো মূল কথা। স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করবে সরকার। সেখানে জনগণও চাঁদা দেবে। তাদের কল্যাণে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। সুতারাং স্থানীয় উন্নয়নে সর্বসাধারণকে উদ্যেগী করতে হবে। তাদেরক দেশ গঠনে, রাস্তাঘাট নির্মাণে উৎসাহী করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন ‘শুধু সরকারি অর্থে জনগণের মঙ্গল হয় না, উন্নতির কাজ হয় না। জনগণকে একতাবদ্ধ করতে হবে। আপনাদের জনগণকে মবিলাইজ করতে হবে। সেজন্য জনগণের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে। সেই অনুপ্রেরণা সৃষ্টির দায়িত্ব থাকবে পার্টির এবং অ্যাডমিনিস্ট্রিশনের, গভর্নরের জয়েন্টলি। সরকার যদি দেয় ৫০ হাজার টাকা আপনি কাজ করবেন সেখানে পাঁচ লাখ টাকার। মানুষকে বললে বাংলার মানুষ ‘না’ বলে না। বাংলার মানুষ যদি বুঝে যে এই কাজে তাদের উন্নতি হয় তবে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ’ [১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

দেশ গঠনে ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সবার সহায়তা চেয়েছেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। সে জন্য তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল নামে একটি জাতীয় দল গঠন করেন। দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী সব নাগরিক এ দলের সদস্যপদ লাভের যোগ্য। সব বিভেদ-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার জন্য এ দলের সৃষ্টি। এর ৫টি শাখা। একটি শ্রমিকদের অঙ্গদল, কৃষকদের একটি, যুবকদের একটি, ছাত্রদের একটি এবং মহিলাদের একটি। আওয়াম মানে জনগণ। আওয়ামী লীগ মানে জনগণের দল। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যুক্ত করেছেন কৃষক ও শ্রমিকদের নাম। যাতে দলের কমিটি সর্বজনীনতা পায়। এর সঙ্গে দেশের ছাত্র, যুবক, শিক্ষিত সমাজ ও কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট করে সবার কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন। অনেকে তখন ভেবেছেন এটা একদলীয় সরকার। প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। এখানে গণতন্ত্র আছে। জনগণের ভোট আছে। দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন। জনগণ যাকে ভাল মনে করবেন তাকে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। এভাবে ১৯৭৫ সালে সিলেট-৬ এবং ময়মনসিংহ-২৮ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে যথাক্রমে ৪ জন ও ৩ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ওই নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় বহন করে সরকার। প্রার্থীদের পরিচিতি সভা ও প্রচারের আয়োজন হয় সরকারিভাবে। তাতে নির্বাচনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় বাকশাল ছিল তখনকার প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি ছিল দেশ গড়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমঞ্চ।

বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে বঙ্গবন্ধু চিহ্নিত করেন দুর্নীতি। এটি নির্মূল করা দ্বিতীয় বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন স্থানে ‘করাপশন’ উৎখাত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড এগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মোবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করপেশন বদ্ধ করা যাবে না। এবং সেই সঙ্গে সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। ঘুণে ধরা সিস্টেম দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যায় না। এই সিস্টেম করাপশন পয়দা করে এবং করাপশন চলে। এই জন্য আমার দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। দেশের জনগণকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। ... একটা কাজ আপনাদের করতে হবে। গণ-আন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, যে সুদখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিক বয়কট করতে হবে।’ [১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]। জেলা গভর্নরদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘তোমরা যারা ৬১ জন লোক আছ, তোমাদের স্থান ছোট হয়ে গেছে। তোমরা ইচ্ছা করলে সেখানে এরিয়ার মধ্যে করাপশন বন্ধ করতে পার। আমি বিশ^াস করি, তোমরা পারবে। অন্য কাজ কর বা না কর কিন্তু এটা কর। থানায় এসে যেন মানুষ বসতে পারে। তাদের যেন পয়সা দিতে না হয়। সাবরেজিস্টার অফিসে আসলে যেন পয়সা দিতে না হয়। কোর্টে আসলে যেন পয়সা দিতে না হয় এবং তাদের যেন হয়রানি না হয়।’ এ রকম আরও অনেক উদ্ধৃতি আছে বঙ্গবন্ধুর দুর্নীর্তির বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘সমাজ ব্যবস্থায় ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই। যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি, আপনাদের সমর্থন আছে।’

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের এজেন্ডার প্রতি জনগণের পূর্ণ সমর্থন ছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল দেশের জনগণ। তার শোষিতের গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী ছিল দেশের মানুষ। কিন্তু তা মেনে নেয়নি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। অলক্ষ্যে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন মাত্র ১৩১৪ দিন। আর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য তিনি পেয়েছিলেন ২৩৩ দিন। এর মধ্যে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় উন্নতি হচ্ছিল। অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ক্রমেই সুদিন আসছিল বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনে। হাসি ফুটে উঠছিল তাদের মুখে। নিশ্চিন্তায়, নিরুপদ্রবে রাতে ঘুমাতে পারছিলেন গ্রামের মানুষ। এমন সময় নেমে এলো ১৫ আগস্টের অমানিশা। দেশি-বিদেশি শত্রুদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনীর একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বুলেটের আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। তাকে হত্যা করে সপরিবারে। কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা যায়নি। তার ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি আজও প্রাসঙ্গিক। তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ভাবনা আজও আমাদের চিত্তকে নাড়া দেয়। তার রাজনৈতিক দর্শন আজও অম্লান। থাকবে চিরকাল।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ; অপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ]

alamj52@gmail.com

image
আরও খবর

শনিবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৫ মহররম ১৪৪২, ১৯ ভাদ্র ১৪২৭

বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ভাবনা

ড. জাহাঙ্গীর আলম

image

বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।’ [১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। তখন বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। ছিল অর্থের অভাব। খাদ্যের অভাব। বঙ্গবন্ধু এ পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন জেল থেকে বের হয়ে এলাম, তখন আমি শুধু সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না, শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। [১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]। অপর এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তখন বাংলাদেশে এলো খরা। তারপর হলো দুনিয়াজোড়া ইনফ্লেশন। ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে দুনিয়া ঘুরতে হয়েছে। খাবার বাইরে থেকে আনতে হয়েছে। গ্রামে গ্রামে পৌঁছাতে হয়েছে। সারা দুনিয়ায় যে ইনফ্লেশন হয়ে গেল তাতে শুধু আমাদের নয়, সব দুনিয়ায় যারা উন্নত দেশ, তাদের সবারই মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এলো এক ভয়াবহ বন্যা (১৯৭৪)। এত বড় বন্যা আমাদের জীবনে আমি দেখিনি। তখন খাবার ছিল না। ৫,৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং সেখানে রিলিফ অপারেশন চালানো হলো। বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে নিজের যা কিছু ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাঁচাতে পারলাম না সবাইকে। ২৭ হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল।’ [১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]। দেশের এই অভাব অনটনের মধ্যেও চারপাশে ছিল দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিভেদ ছিল। বিচারহীনতা। গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাস। ছিল কালোবাজারি তাতে সাধারণ মানুষের জীবন ছিল অতিষ্ঠ, দুর্বিষহ। এই অবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সামাজিক পরিবর্তনের কথা ভাবেন। দেশের চলমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। এটাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেন ‘সিস্টেম চেইঞ্জ’ হিসেবে। এটি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্ল­ব। প্রথম বিপ্ল­ব ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ সংগ্রামের পূর্ণতায় তার দ্বিতীয় বিপ্লবের শুরু।

বঙ্গবন্ধু এ বিপ্লবের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে, ‘পুরোনো রীতি, যেটা মানুষের মঙ্গল করে না সেই রীতি বদলানোর মতো সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন। ... পুরানো মত এবং পথ যদি দেশের মঙ্গল করতে না পারে সে মত এবং পথের পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করার অধিকার বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। নতুন বিপ্লব যখন আপনি বলছেন তখন এই বিপ্ল­বের মাধ্যমে জাতির জন্য একটা নতুন জিনিস, নতুন সিস্টেম আপনাকে গড়ে তুলতে হবে। যে সিস্টেম আজকে আমরা দেখি সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কালোনিয়াল সিস্টেম। এতে দেশের মঙ্গল হতে পারে না। এটাতে আমরা কনভিন্সড। ব্রিটিশ যে সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করার জন্য যে সিস্টেম দেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে চালু করে গিয়েছিল সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করার নামই বিপ্লব।” [১৯৭৫ সালের ৬ জুন প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

স্বাধীনতার পর প্রথমে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করেন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে। এগুলো হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন শোষিতের গণতন্ত্র। তিনি সমাজতন্ত্র চেয়েছেন। সেই সঙ্গে চেয়েছেন জনগণের ভোটাধিকার। তিনি মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র চাননি। চীনের কমিউনিস্টদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠারও পক্ষপাতি তিনি ছিলেন না। তিনি গণতন্ত্র রেখেছেন। সেই সঙ্গে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন। সম্পদের কেন্দ্রীয় ভবন রুখতে চেয়েছেন। আবার সম্পদ সৃষ্টির জন্য ব্যক্তি মালিকানাকেও অটুট রেখেছেন। তিনি ব্যাংক-বীমা, বৃহৎ ও ভারী শিল্প জাতীয়করণ করেছেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায় গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আবার জমির মালিকানা অক্ষুণœ রাখারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার মধ্যে ছিল একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার সংকল্প। সেটি ছিল নিজস্ব প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নিজস্ব আঙ্গিকে। তিনি বলেছেন ‘এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলছি সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোন জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোন ইজম চলে না। এদেশে, কোন দেশে চলে না। আমার মাটির সঙ্গে আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।’ [১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। রাজনীতিতে তার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু ছিল না। তিনি বলেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে আসতে পারবে না, আমরা তা হতে দেব না। বাংলাদেশকে ভালোবাসব না, বাংলার মাটিকে ভালোবাসব না, বাংলা ভাষা ভালোবাসব না, বাংলার কালচারকে ভালোবাসব না, আমরা চলতে দেব না।”

দেশের মানুষের শান্তি, সম্প্রীতি, সমৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু সিস্টেম পরিবর্তনের কথা বলেছেন। সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন বা সিস্টেম চেইঞ্জ বলতে বঙ্গবন্ধু ‘জুডিশিয়াল সিস্টেম’-এর পরিবর্তন চেয়েছেন। ‘এডুকেশন সিস্টেম’ নতুনভাবে বিন্যাস্ত করতে তৎপর হয়েছেন। তার ভাষায় ‘কেরানি পয়দা করে লাভ হবে না, মানুষ পয়দা করতে হবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তিনি উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। তিনি দুর্নীতিকে নির্মূল করতে চেয়েছেন প্রাত্যহিক জীবন থেকে। কৃষিতে, কল ও কারখানায় তিনি উৎপাদন বাড়াতে বলেছেন। স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন ‘যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচতে পারে। ... দিস ইজ আওয়ার সেকেন্ড রিভ্যুলিউশন। এই রিভ্যুলিউশন এর অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এর অর্থ অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। [১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

সে ক্ষেত্রে তিনি পাঁচটি কর্মসূচি দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে অধিক উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি নির্মূল। এ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পদক্ষেপ হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। কল-কারখানা, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। কলে-কারখানায় সব জায়গায় বিশেষ করে খাদ্য-শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির উপর তিনি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন। উদার সহায়তা দিয়েছেন কৃষি উন্নয়নের জন্য। স্বাধীনতার পর প্রতি বছর গড়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টন খাদ্য-শস্য আমদানি করতে হতো বিদেশ থেকে। কিন্তু সেই আমদানি সবসময় সহজসাধ্য ছিল না। সেই জন্য তিনি কৃষির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা। তিনি বলেছেন, ‘কি করে আমরা বাঁচবো, যদি ধরুন, বছরে ২০ লাখ টন খাবার ডেফিসিট হয়? এই তিন বছর পর্যন্ত গড়ে এর চেয়ে অনেক বেশি খাবার আনতে হয়েছে। প্রথম আনতে হয়েছে ৩০ লাখ টন। ধরুন যদি প্রত্যেক বছর গড়ে ৫৪০ লাখ মণ খাদ্য আনতে হয় বিদেশ থেকে, কোথায় পাওয়া যাবে, কে দেবে? জাহাজ ভাড়া কোথায়? ২০ থেকে ৩০ লাখ টন প্রতি বছর আমাদের আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে এই তিন বছর। বন্ধু রাষ্ট্ররা সাহায্য করেছে। গ্রান্ট দিয়েছে, ‘লোন’ দিয়েছে, তাই খাবার, আনছি। খাবার দেয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রেরা কতকাল দেবে? এই পরনির্ভরতা হ্রাসের জন্য তিনি আধুনিক চাষাবাদের ওপর গুরুত্ব দেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেন। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি ভূমি সংস্কারের নীতিমালাও ঘোষণা করেন। পর্যায়ক্রমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল স্বনির্ভরতা অর্জন এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তিনি বলেন, ‘যে মানুষ ভিক্ষা করে, তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও তেমন ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক। সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি ছিল স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ওই পরিকল্পনায় বিদেশি সাহায্যর ওপর নির্ভরশীলতা ৬২ শতাংশ থেকে ১৯৭৭-৭৮ সালের মধ্যে ২৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কৃষি ও কলে-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর রাশ টেনে ধরতে হবে। নতুবা মানুষের খাবার জুটবে না। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লাখ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছরে ৩০ লাখ লোক বাড়ে, তাহলে ২৫/৩০ বছরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না হালচাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সেই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল­্যানিং করতে হবে।

প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্ল­বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মহকুমা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তিনি ৬১টি জেলা প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রত্যেকটিতে নিয়োগ দেন একজন করে জেলা গভর্নর। তারা হবে জনগণের সেবক, শাসক নয়। এ প্রশাসন হবে জনকল্যাণের সহায়ক। তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। তাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। সে কাউন্সিল ডেকে আলোচনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে গভর্নরদের। এক বছর পর থানা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে থানায় যে প্রধান ব্যক্তি হবেন তার নাম হবে থানা প্রশাসক। তিনি বলেন, ‘এ শাসন ব্যবস্থা হয়েছে জনগণের, জনগণের মঙ্গলের জন্য। জনগণ যাতে সোজাসুজি শাসন ব্যবস্থার ফল ভোগ করতে পারে তার জন্যই এই সিস্টেম করা হয়েছে। সোজাসুজি, যাতে কোন রকম কোন অসুবিধা তাদের ভোগ করতে না হয়। সবকিছুই যেন জনগণের সামনে নিয়ে যাওয়া যায়। ইডেন বিল্ডিংস বা গণভবনের মধ্যে আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা রাখতে চাই না। আমি আস্তে আস্তে গ্রামে, থানায়, ইউনিয়ন, জেলা পর্যায়ে এটা পৌঁছিয়ে দিতে চাই, যাতে জনগণ সরাসরি তাদের সুযোগ-সুবিধা পায়।’

বঙ্গবন্ধুর জেলা কাউন্সিল/থানা কাউন্সিল হলো উন্নয়নকামী স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ হলো মূল কথা। স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করবে সরকার। সেখানে জনগণও চাঁদা দেবে। তাদের কল্যাণে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। সুতারাং স্থানীয় উন্নয়নে সর্বসাধারণকে উদ্যেগী করতে হবে। তাদেরক দেশ গঠনে, রাস্তাঘাট নির্মাণে উৎসাহী করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন ‘শুধু সরকারি অর্থে জনগণের মঙ্গল হয় না, উন্নতির কাজ হয় না। জনগণকে একতাবদ্ধ করতে হবে। আপনাদের জনগণকে মবিলাইজ করতে হবে। সেজন্য জনগণের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে। সেই অনুপ্রেরণা সৃষ্টির দায়িত্ব থাকবে পার্টির এবং অ্যাডমিনিস্ট্রিশনের, গভর্নরের জয়েন্টলি। সরকার যদি দেয় ৫০ হাজার টাকা আপনি কাজ করবেন সেখানে পাঁচ লাখ টাকার। মানুষকে বললে বাংলার মানুষ ‘না’ বলে না। বাংলার মানুষ যদি বুঝে যে এই কাজে তাদের উন্নতি হয় তবে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ’ [১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]।

দেশ গঠনে ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সবার সহায়তা চেয়েছেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। সে জন্য তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল নামে একটি জাতীয় দল গঠন করেন। দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী সব নাগরিক এ দলের সদস্যপদ লাভের যোগ্য। সব বিভেদ-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার জন্য এ দলের সৃষ্টি। এর ৫টি শাখা। একটি শ্রমিকদের অঙ্গদল, কৃষকদের একটি, যুবকদের একটি, ছাত্রদের একটি এবং মহিলাদের একটি। আওয়াম মানে জনগণ। আওয়ামী লীগ মানে জনগণের দল। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যুক্ত করেছেন কৃষক ও শ্রমিকদের নাম। যাতে দলের কমিটি সর্বজনীনতা পায়। এর সঙ্গে দেশের ছাত্র, যুবক, শিক্ষিত সমাজ ও কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট করে সবার কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন। অনেকে তখন ভেবেছেন এটা একদলীয় সরকার। প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। এখানে গণতন্ত্র আছে। জনগণের ভোট আছে। দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন। জনগণ যাকে ভাল মনে করবেন তাকে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। এভাবে ১৯৭৫ সালে সিলেট-৬ এবং ময়মনসিংহ-২৮ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে যথাক্রমে ৪ জন ও ৩ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ওই নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় বহন করে সরকার। প্রার্থীদের পরিচিতি সভা ও প্রচারের আয়োজন হয় সরকারিভাবে। তাতে নির্বাচনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় বাকশাল ছিল তখনকার প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি ছিল দেশ গড়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমঞ্চ।

বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে বঙ্গবন্ধু চিহ্নিত করেন দুর্নীতি। এটি নির্মূল করা দ্বিতীয় বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন স্থানে ‘করাপশন’ উৎখাত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড এগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মোবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করপেশন বদ্ধ করা যাবে না। এবং সেই সঙ্গে সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। ঘুণে ধরা সিস্টেম দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যায় না। এই সিস্টেম করাপশন পয়দা করে এবং করাপশন চলে। এই জন্য আমার দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। দেশের জনগণকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। ... একটা কাজ আপনাদের করতে হবে। গণ-আন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, যে সুদখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিক বয়কট করতে হবে।’ [১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি]। জেলা গভর্নরদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘তোমরা যারা ৬১ জন লোক আছ, তোমাদের স্থান ছোট হয়ে গেছে। তোমরা ইচ্ছা করলে সেখানে এরিয়ার মধ্যে করাপশন বন্ধ করতে পার। আমি বিশ^াস করি, তোমরা পারবে। অন্য কাজ কর বা না কর কিন্তু এটা কর। থানায় এসে যেন মানুষ বসতে পারে। তাদের যেন পয়সা দিতে না হয়। সাবরেজিস্টার অফিসে আসলে যেন পয়সা দিতে না হয়। কোর্টে আসলে যেন পয়সা দিতে না হয় এবং তাদের যেন হয়রানি না হয়।’ এ রকম আরও অনেক উদ্ধৃতি আছে বঙ্গবন্ধুর দুর্নীর্তির বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘সমাজ ব্যবস্থায় ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই। যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি, আপনাদের সমর্থন আছে।’

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের এজেন্ডার প্রতি জনগণের পূর্ণ সমর্থন ছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল দেশের জনগণ। তার শোষিতের গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী ছিল দেশের মানুষ। কিন্তু তা মেনে নেয়নি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। অলক্ষ্যে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন মাত্র ১৩১৪ দিন। আর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য তিনি পেয়েছিলেন ২৩৩ দিন। এর মধ্যে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় উন্নতি হচ্ছিল। অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ক্রমেই সুদিন আসছিল বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনে। হাসি ফুটে উঠছিল তাদের মুখে। নিশ্চিন্তায়, নিরুপদ্রবে রাতে ঘুমাতে পারছিলেন গ্রামের মানুষ। এমন সময় নেমে এলো ১৫ আগস্টের অমানিশা। দেশি-বিদেশি শত্রুদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনীর একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বুলেটের আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। তাকে হত্যা করে সপরিবারে। কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা যায়নি। তার ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি আজও প্রাসঙ্গিক। তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ভাবনা আজও আমাদের চিত্তকে নাড়া দেয়। তার রাজনৈতিক দর্শন আজও অম্লান। থাকবে চিরকাল।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ; অপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ]

alamj52@gmail.com