চিকিৎসাধীন কেউ শঙ্কামুক্ত নয়

বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে এসি বিস্ফোরণে হতাহত ৩৮ জনকে ঘটনার পরপরই শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের কারও শতভাগ দগ্ধ, কারও শ্বাসনালী, কারও হাত-পা ঝলসে গেছে। দগ্ধদের হাসপাতালে ভর্তির পর শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় পরপারে পাড়ি জমায় শিশু জুয়েল। এরপর রাতে ও সকালে অন্যদের মৃত্যু হয়। মৃতের তালিকায় রয়েছেন মসজিদের মুয়াজ্জিনও। গতকাল ভোর থেকে কিছুক্ষণ পরপরই এক এক জনের মৃত্যুর সংবাদ আসতে থাকে। এভাবে এক এক করে ২০টি তাজা প্রাণ ঝরে যায় গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত। এ ঘটনায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৮ জন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিকিৎসাধীন থাকা সবারই ডিপ বার্ন রয়েছে। শতাংশের হিসেবে কোন রোগীর কতটুকু বার্ন হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। তবে কেউ শঙ্কামুক্ত নন। গত শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে মসজিদের ভেতরে থাকা প্রায় ৫০ জনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হুড়াহুড়ি করে বের হওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তাদের মধ্যে দগ্ধ অবস্থায় ৩৮ জনকে উদ্ধার করে রাতেই শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্ল­াস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২০ জন। তারা হলেন- মনির (৩০), ফরিদ (৫৫), শেখ ফরিদ (২১),আবুল বাসার মোল্লা (৫১), শামীম হাসান (৪৫), আলি মাস্টার (৫৫), কেনান (২৪), নজরুল ইসলাম (৫০), রিফাত ওরফে সিফাত (১৮), আবদুল আজিজ (৪০), নিজাম (৩৪), নাদিম (৪৫), হান্নান (৫০), আবদুস সাত্তার (৪০), জুলহাস উদ্দিন (৩০), আমজাদ (৩৭), ইমাম আবদুল মালেক (৬০), ইমাম হোসেন (৩০), মামুন (২৩) ও ইমরান (৩০)। এদের প্রত্যেকের ৩০ শতাংশ থেকে শতভাগ দগ্ধ হয়েছে। তাদের নিয়ে শঙ্কিত পরিবারগুলো। না জানি কখন আবার চলে যাওয়ার খবর আসে। দগ্ধের পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রত্যেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ও এইচডিইউতে রাখা হয়েছে। তাই স্বজনরা চাইলেও সেখানে যেতে পারছেন না। প্রিয় মানুষের ক্রান্তিকালে সেবা করার সুযোগটুকু পর্যন্ত স্বজনরা পাচ্ছেন না।

ভর্তির পর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছিলেন, ৩৮ মুসল্লিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের সবারই ডিপ বার্ন রয়েছে। তবে শতাংশের হিসেবে কোন রোগীর কতটুকু বার্ন হয়েছে তা তাৎক্ষণিক বলা যাচ্ছে না। তবে কেউ শঙ্কামুক্ত নন। গতকাল সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধদের স্বজনরা হাসপাতালের সামনে ভিড় করছেন। কেউ বাবার সন্ধানে, কেউ স্বামীর সন্ধানে কেউবা সন্তানের সন্ধানে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। ইনস্টিটিউটের নিচের ফ্লোরে স্বজনদের বসতে দেয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে একজন করে স্বজন দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের রোগীদের শনাক্ত করার জন্য। কেউ কেউ ছবি দেখালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভেতরে দেখে এসে তার স্বজনের অবস্থান নিশ্চিত করছেন। কেউ কেউ প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদটি শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন। আইসিইউতে স্বজনের খোঁজ না পেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে রাখা লাশের সারির কাছে নিয়ে যাওয়া হয় অপেক্ষমাণ অনেককে। কেউ কেউ তার প্রিয়জনকে লাশের সারির মধ্যে শনাক্ত করেই কান্নায় বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।

হাসপাতালে ৩৮ জনকে ভর্তি করানো হলেও তাদের সন্ধানে এসেছেন প্রায় শতাধিক স্বজন। তারা নিচ তলায় বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসে এক একজনের মৃত্যুর সংবাদ দিচ্ছিন। মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতাল পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। কে কাকে সান্ত¡না দিবে, সেই ভাষা কারো জানা নেই। এ যেন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ১২ জনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহতদের মরদেহ গ্রহণ করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক। জানাজা শেষে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন ইউএনও। একে একে সবার মরদেহ মাঠে রাখা হয়েছে। জানাজা শেষে সবার মরদেহ দাফন করা হবে। এরই মধ্যে এক শিশুর জানাজা শেষ হয়েছে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে শিশুটির জানাজা শেষ হয়। পরে কেঁদে কেঁদে শিশুটিকে দাফনের জন্য নিয়ে যান স্বজনরা। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ।

এর আগে বিকেল থেকে একে একে নিহতদের মরদেহ ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় নিয়ে আসা হয়। ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বোমওয়ালার বাড়ির খেলার মাঠে নিহতদের জানাজার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে অনেকগুলো খাটিয়া। গোসল ও জানাজা শেষে মরদেহ দাফনের জন্য প্রস্তুত স্থানীয়রা। একসঙ্গে এতগুলো মানুষ মারা যাওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাদের মৃত্যুতে পুরো এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই সঙ্গে গতকাল এলাকার সব দেকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোল বইছে। স্বাধীনতার পর থেকে তল্লাবাসী এতো লাশ আর কখনো দেখেননি।

রবিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৬ মহররম ১৪৪২, ২০ ভাদ্র ১৪২৭

এক এক করে ঝরছে প্রাণ

চিকিৎসাধীন কেউ শঙ্কামুক্ত নয়

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে এসি বিস্ফোরণে হতাহত ৩৮ জনকে ঘটনার পরপরই শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের কারও শতভাগ দগ্ধ, কারও শ্বাসনালী, কারও হাত-পা ঝলসে গেছে। দগ্ধদের হাসপাতালে ভর্তির পর শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় পরপারে পাড়ি জমায় শিশু জুয়েল। এরপর রাতে ও সকালে অন্যদের মৃত্যু হয়। মৃতের তালিকায় রয়েছেন মসজিদের মুয়াজ্জিনও। গতকাল ভোর থেকে কিছুক্ষণ পরপরই এক এক জনের মৃত্যুর সংবাদ আসতে থাকে। এভাবে এক এক করে ২০টি তাজা প্রাণ ঝরে যায় গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত। এ ঘটনায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৮ জন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিকিৎসাধীন থাকা সবারই ডিপ বার্ন রয়েছে। শতাংশের হিসেবে কোন রোগীর কতটুকু বার্ন হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। তবে কেউ শঙ্কামুক্ত নন। গত শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে মসজিদের ভেতরে থাকা প্রায় ৫০ জনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হুড়াহুড়ি করে বের হওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তাদের মধ্যে দগ্ধ অবস্থায় ৩৮ জনকে উদ্ধার করে রাতেই শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্ল­াস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২০ জন। তারা হলেন- মনির (৩০), ফরিদ (৫৫), শেখ ফরিদ (২১),আবুল বাসার মোল্লা (৫১), শামীম হাসান (৪৫), আলি মাস্টার (৫৫), কেনান (২৪), নজরুল ইসলাম (৫০), রিফাত ওরফে সিফাত (১৮), আবদুল আজিজ (৪০), নিজাম (৩৪), নাদিম (৪৫), হান্নান (৫০), আবদুস সাত্তার (৪০), জুলহাস উদ্দিন (৩০), আমজাদ (৩৭), ইমাম আবদুল মালেক (৬০), ইমাম হোসেন (৩০), মামুন (২৩) ও ইমরান (৩০)। এদের প্রত্যেকের ৩০ শতাংশ থেকে শতভাগ দগ্ধ হয়েছে। তাদের নিয়ে শঙ্কিত পরিবারগুলো। না জানি কখন আবার চলে যাওয়ার খবর আসে। দগ্ধের পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রত্যেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ও এইচডিইউতে রাখা হয়েছে। তাই স্বজনরা চাইলেও সেখানে যেতে পারছেন না। প্রিয় মানুষের ক্রান্তিকালে সেবা করার সুযোগটুকু পর্যন্ত স্বজনরা পাচ্ছেন না।

ভর্তির পর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছিলেন, ৩৮ মুসল্লিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের সবারই ডিপ বার্ন রয়েছে। তবে শতাংশের হিসেবে কোন রোগীর কতটুকু বার্ন হয়েছে তা তাৎক্ষণিক বলা যাচ্ছে না। তবে কেউ শঙ্কামুক্ত নন। গতকাল সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধদের স্বজনরা হাসপাতালের সামনে ভিড় করছেন। কেউ বাবার সন্ধানে, কেউ স্বামীর সন্ধানে কেউবা সন্তানের সন্ধানে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। ইনস্টিটিউটের নিচের ফ্লোরে স্বজনদের বসতে দেয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে একজন করে স্বজন দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের রোগীদের শনাক্ত করার জন্য। কেউ কেউ ছবি দেখালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভেতরে দেখে এসে তার স্বজনের অবস্থান নিশ্চিত করছেন। কেউ কেউ প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদটি শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন। আইসিইউতে স্বজনের খোঁজ না পেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে রাখা লাশের সারির কাছে নিয়ে যাওয়া হয় অপেক্ষমাণ অনেককে। কেউ কেউ তার প্রিয়জনকে লাশের সারির মধ্যে শনাক্ত করেই কান্নায় বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।

হাসপাতালে ৩৮ জনকে ভর্তি করানো হলেও তাদের সন্ধানে এসেছেন প্রায় শতাধিক স্বজন। তারা নিচ তলায় বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসে এক একজনের মৃত্যুর সংবাদ দিচ্ছিন। মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতাল পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। কে কাকে সান্ত¡না দিবে, সেই ভাষা কারো জানা নেই। এ যেন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ১২ জনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহতদের মরদেহ গ্রহণ করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক। জানাজা শেষে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন ইউএনও। একে একে সবার মরদেহ মাঠে রাখা হয়েছে। জানাজা শেষে সবার মরদেহ দাফন করা হবে। এরই মধ্যে এক শিশুর জানাজা শেষ হয়েছে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে শিশুটির জানাজা শেষ হয়। পরে কেঁদে কেঁদে শিশুটিকে দাফনের জন্য নিয়ে যান স্বজনরা। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ।

এর আগে বিকেল থেকে একে একে নিহতদের মরদেহ ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় নিয়ে আসা হয়। ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বোমওয়ালার বাড়ির খেলার মাঠে নিহতদের জানাজার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে অনেকগুলো খাটিয়া। গোসল ও জানাজা শেষে মরদেহ দাফনের জন্য প্রস্তুত স্থানীয়রা। একসঙ্গে এতগুলো মানুষ মারা যাওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাদের মৃত্যুতে পুরো এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই সঙ্গে গতকাল এলাকার সব দেকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোল বইছে। স্বাধীনতার পর থেকে তল্লাবাসী এতো লাশ আর কখনো দেখেননি।