মসজিদে বিস্ফোরণ : মৃত্যু ২৫

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১২ জন

নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিতে গ্যাস লিকেজ থেকে এসি বিস্ফোরণ ঘটে দগ্ধ ৩৭ মুসল্লিদের একে একে জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। গতকাল রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মৃতু্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। চিকিৎসাধীন দগ্ধ আর ১২ জন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাদের নিয়েও শঙ্কা কাটছে না চিকিৎসকদের। ২৫ জনের লাশ ইতোমধ্যে হস্তান্তর শেষ করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কর্তৃপক্ষ। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এসব লাশ বুঝে নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় দাফন শেষ করেছেন স্বজনরা। এদিকে এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বজনদের নির্ঘুম রাত কাটছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শনিবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে মারা যান শামীম হাসান। গতকাল সকালে মো. আলী মাস্টার (৫৫) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রাত পর্যন্ত মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতরা হলেন মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জ কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মো. রিফাত (১৮), গার্মেন্ট কর্মী মো. রাসেদ (৩০), হুমায়ুন কবির (৭০), গার্মেন্ট কর্মী ইব্রাহীম বিশ্বাস (৪৩), জুয়েল, সাব্বির (২১), মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৮) ও তার সন্তান জুনায়েদ (১৭), চাকরিজীবী মো. জামাল আবেদিন (৪০), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন (১২), জয়নাল (৫০), কাঞ্চন হাওলাদার, গার্মেন্ট কর্মী নয়ন, ৭ বছরের শিশু জুবায়ের, ওয়ার্কশপ শ্রমিক রাসেল (৩৪) মো. বাহাউদ্দিন (৫৫), মো. মিজান (৪০), মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৫৫), শামীম হাসান, নাদিম হোসেন (৪৫) ও মো. আলী মাস্টার (৫৫) ও আবুল বাশার (৫১)।

শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. হোসাইন ইমাম বলেন, রোগী তো সব চলে যাচ্ছে, তাদের তো ধরে রাখতে পারছি না। যেখানে বাঁচার আশা করার কিছু নেই, এর থেকে বড় হতাশার কিছু থাকতে পারে না! দগ্ধদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। হাত-পা সব পোড়া, একটা ক্যানুলা দেয়ার অবস্থা পর্যন্ত নেই। বেশিরভাগ মানুষের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের ড্রেসিং করে র‌্যাপ-আপ করতে একটা মানুষের কমপক্ষে আধা ঘণ্টা সময় চলে যায়। স্বল্প সময়ে দগ্ধদের একে এক মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘শনিবার সারাদিন হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু প্রতি মিনিটে শুনছি, স্যার ওমুক নাই, স্যার আরেকজন মারা গেছেন, স্যার এই রোগী মারা গেছেন। শনিবার রাতে গুনে গুনে ২০ জন রোগী মারা গেল। হয়ত আগামী কয়েকদিনে আমরা আরও কিছু মানুষকে হারিয়ে ফেলব। ‘আমরা তো খুব সহজে বলে ফেলি, আজ (শনিবার রাত) পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছে, কাল সংখ্যাটা হয়তো আরও বাড়বে। বেঁচে যে থাকবে, বাঁচার যে আশা আসলে কারও নেই। আমরা হিসাব করে রেখেছি, চারজন রোগীর ৫০ শতাংশের নিচে বার্ন কিন্তু তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এখন যে কথা বলছে, আমি জানি আগামী তিন দিন পর সে কথা বলতে পারবে না, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারবে না।’

হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ ঘটনায় দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকা রোগীর মধ্যে এখন ১২ জন আছেন। তারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, সবার অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালী, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে ৪ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানান, যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকেরই শ্বাসনালীসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। প্রত্যেকের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দগ্ধ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবধরনের সেবা দিতে চিকিৎসরা ব্যাপক শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ২৫ জন মারা গেছেন। বাকি ১২ জনকে সুস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসকরা।

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১২ মুসল্লি

যে ১২ জন চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে ছয়জন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসাধীন ১২ জনের কেউ শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও ১২ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তারাও শঙ্কামুক্ত নয়। দগ্ধ ১২ জনের মধ্যে ৬ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাধীন ১২ জন হলেন- ইমরান (৩০), মামুন (২৩), আমজাদ (৩৭), আ. সাত্তার (৪০), হান্নান (৫০), আ. আজিজ (৪০), রিফাত (১৮), নজরুল ইসলাম (৫০), মো. কেনান (২৪), মনির ফরাজী (৩০), শেখ ফরিদ (২১) ও মো. ফরিদ (৫৫)। তাদের মধ্যে ফরিদ, মনির ফরাজী, কেনান, আজিজ, আমজাদ ও আবুল বাশারকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

দগ্ধদের দেখতে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী :

এদিকে গতকাল দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ১২ জনকে দেখতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। গতকাল বেলা ১২টার দিকে দগ্ধ রোগীদের খোঁজ-খবর নিতে যান তিনি। দগ্ধ রোগীদের দেখতে গিয়ে ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৭ জন রোগীকে এখানে ভর্তি করা হয়। এখানকার চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো প্রায় সব রোগীরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। আশা করছি, কিছু রোগী বেঁচে যেতে পারেন। তবে বেশিরভাগের অবস্থাই ভালো না। ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও সমন্বয়কসহ সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক এদের খোঁজখবর নিচ্ছেন ও পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে এদের সবাইকে সারিয়ে তোলা।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই ঘটনায় ফতুল্লা থানায় অবহেলাজনিত ধারায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে যদি কারও গাফিলতি থাকে তাহলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় বার্ন ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে। শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে সজ্জিত পোড়া রোগীদের হাসপাতাল। বিদেশি চিকিৎসকরাও এখানে এসে ট্রেনিং দিয়েছেন। আগেতো এই চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিল না। এখানে আগুনে পোড়া সবধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।’

ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিদের ২০ হাজার ও আহতদের আপাতত ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। এখানে কোন রোগীর চিকিৎসার জন্য যদি কোন ওষুধ বা টাকা-পয়সার প্রয়োজন হয় তাহলে তারা ডা. সামন্তলাল সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা নিতে পারবেন। আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকব। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে, হতাহতদের পরিবারকে কী পরিমাণ সহায়তা দেয়া হবে। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেব।

স্বজনদের কণ্ঠে বিচার দাবি :

এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বজনদের নিঘুম রাত কাটছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের এক করিডোর থেকে অন্য করিডোরে। ইতোমধ্যে যে ২৫ জন মারা গেছেন তাদের স্বজনদের চোখে কোন ঘুম ছিল না, ছিল না খাওয়া দাওয়া। নিহত এবং দগ্ধ হয়ে এখনও বেঁচে থাকাদের স্বজনদের কণ্ঠে এক বাক্য, এ ঘটনায় যাদের গাফিলতি ছিল তাদের বিচার হতে হবে। কোনভাবেই যেন কেউ ছাড় না পায়। তিতাস গ্যাস, মসজিদ কমিটি যে বা যাদের গাফিলতি ছিল, যারা গ্যাসলাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণের সময় দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন, গ্যাস লাইন লিকেজ হওয়ার পর বলার পরও কেন লাইন ঠিক হয়নি, কেন ঘুষ চাওয়া হয়েছে, ঘুষের জন্য লাইন ঠিক করতে না পারার বিষয়টি মসজিদ কমিটি কেন প্রশাসনকে জানায়নি সব বিষয় তদন্ত করে বিচার চান স্বজনরা।

গতকাল সকাল আটটায় মারা গেছেন মোহাম্মদ আলী নামে এক শিক্ষক। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করায় তাকে সবাই জানেন এবং চেনেন ‘আলী মাস্টার’ হিসেবে। ইনস্টিটিউটের লবিতে মামাতো ভাই রিয়াদের কাঁধে মাথা রেখে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আলী মাস্টারের মেঝ ছেলে রাসেল। বার্ন ইউনিটের ভেতরে দগ্ধদের আর্তনাদ। তিনি বললেন, আমাদের বাসার পাশেই মসজিদ। আব্বা এখানেই প্রতিদিন নামাজ পড়তে যেতেন। চেষ্টা করতেন সবার আগে যেতে। শুক্রবারও গিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে বার বার বলছিলেন, ‘আমার গায়ে মলম দাও, জ্বলে যাচ্ছে পুরো শরীর। আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে আব্বা চলে গেলেন। জানি না তাকে হারানোর এই শোক আমরা কিভাবে সইবো? আলী মাস্টারের ভাগিনা রিয়াদ বলেন, মসজিদ কমিটি আগেই তিতাস গ্যাসকে গ্যাস লিক হওয়ার কথা অবগত করেছিল। তারা লিখিত অভিযোগ না দেয়ার কারণে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তারা ৫০ হাজার টাকা ঘুষও চেয়েছিল। ‘তিতাস ঠিকমতো ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা ঘটতো না। এতগুলো মানুষের মৃত্যু হতো না। আমরা এর বিচার চাই। ’

রহিমা বেগম এ ঘটনায় হারিয়েছে স্বামী জালহাস এবং ৬ বছরের ছেলে জুবায়েরকে। তিনি এখন পাগলপ্রায়। শনিবার ছেলে ও গতকাল তার স্বামী মারা যায়। গতকাল জুলহাস মিয়ার মরদেহ নিতে এসে তার ফুপাতো ভাই নাহিদ হাসান শাকিল বলেন, সকালে ভাতিসা জোবায়ের দাফন সম্পন্ন হয়েছে পটুয়াখালীতে। এরপর মারা গেছেন আমার ভাই জুলহাস। জানি না, ভাবি কিভাবে এই শোক সহ্য করবেন? কিভাবে তার বাকি জীবন চলবে?

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন আমজাদ। বার্ন ইউনিটের এক লবি থেকে অন্য লবিতে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত বাবা আবদুল আহাদ। ছেলের চিন্তায় তার নাওয়া খাওয়া সবকিছু ফিকে হয়ে গেছে। অসহায় এ বাবা সাংবাদিকদের বলেন আমার চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক মরদেহ বেরোচ্ছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার জমিজমা যা কিছু সব বেচে দেব, আমারে আমার ছেলে ফিরিয়ে দিন। আমার ছেলে পোশাক কারখানার গাড়ি চালাত। তার রোজগারে আমাদের সংসার চলত। আমার ছেলেরে ফিরায়া দাও।

image

নিভে যাচ্ছে দগ্ধদের জীবনপ্রদীপ। স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বার্ন ইনস্টিটিউট এলাকা -সংবাদ

আরও খবর
জালের মতো বিছিয়ে আছে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ
তিতাস-ডিপিডিসি-মসজিদ কমিটি কার দায় কত?
এসি নিয়ন্ত্রিত সব মসজিদের বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষার নির্দেশ
মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে, অবশ্যই কারণ বের হবে
করোনায় ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ৩২ জনের শনাক্ত ১৫৯২
মসজিদে বিস্ফোরণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ : দুর্ভোগে এলাকাবাসী
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি টিআইবির
অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ
পাবনায় অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি
‘করোনাভাইরাস বাংলাদেশে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে’
স্কুল খোলা সম্ভব না হলে অটোপাস
মিতু হত্যার আসামি রিমান্ডে

সোমবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৭ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

মসজিদে বিস্ফোরণ : মৃত্যু ২৫

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১২ জন

image

নিভে যাচ্ছে দগ্ধদের জীবনপ্রদীপ। স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বার্ন ইনস্টিটিউট এলাকা -সংবাদ

নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিতে গ্যাস লিকেজ থেকে এসি বিস্ফোরণ ঘটে দগ্ধ ৩৭ মুসল্লিদের একে একে জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। গতকাল রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মৃতু্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। চিকিৎসাধীন দগ্ধ আর ১২ জন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাদের নিয়েও শঙ্কা কাটছে না চিকিৎসকদের। ২৫ জনের লাশ ইতোমধ্যে হস্তান্তর শেষ করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কর্তৃপক্ষ। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এসব লাশ বুঝে নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় দাফন শেষ করেছেন স্বজনরা। এদিকে এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বজনদের নির্ঘুম রাত কাটছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শনিবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে মারা যান শামীম হাসান। গতকাল সকালে মো. আলী মাস্টার (৫৫) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রাত পর্যন্ত মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতরা হলেন মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জ কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মো. রিফাত (১৮), গার্মেন্ট কর্মী মো. রাসেদ (৩০), হুমায়ুন কবির (৭০), গার্মেন্ট কর্মী ইব্রাহীম বিশ্বাস (৪৩), জুয়েল, সাব্বির (২১), মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৮) ও তার সন্তান জুনায়েদ (১৭), চাকরিজীবী মো. জামাল আবেদিন (৪০), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন (১২), জয়নাল (৫০), কাঞ্চন হাওলাদার, গার্মেন্ট কর্মী নয়ন, ৭ বছরের শিশু জুবায়ের, ওয়ার্কশপ শ্রমিক রাসেল (৩৪) মো. বাহাউদ্দিন (৫৫), মো. মিজান (৪০), মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৫৫), শামীম হাসান, নাদিম হোসেন (৪৫) ও মো. আলী মাস্টার (৫৫) ও আবুল বাশার (৫১)।

শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. হোসাইন ইমাম বলেন, রোগী তো সব চলে যাচ্ছে, তাদের তো ধরে রাখতে পারছি না। যেখানে বাঁচার আশা করার কিছু নেই, এর থেকে বড় হতাশার কিছু থাকতে পারে না! দগ্ধদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। হাত-পা সব পোড়া, একটা ক্যানুলা দেয়ার অবস্থা পর্যন্ত নেই। বেশিরভাগ মানুষের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের ড্রেসিং করে র‌্যাপ-আপ করতে একটা মানুষের কমপক্ষে আধা ঘণ্টা সময় চলে যায়। স্বল্প সময়ে দগ্ধদের একে এক মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘শনিবার সারাদিন হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু প্রতি মিনিটে শুনছি, স্যার ওমুক নাই, স্যার আরেকজন মারা গেছেন, স্যার এই রোগী মারা গেছেন। শনিবার রাতে গুনে গুনে ২০ জন রোগী মারা গেল। হয়ত আগামী কয়েকদিনে আমরা আরও কিছু মানুষকে হারিয়ে ফেলব। ‘আমরা তো খুব সহজে বলে ফেলি, আজ (শনিবার রাত) পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছে, কাল সংখ্যাটা হয়তো আরও বাড়বে। বেঁচে যে থাকবে, বাঁচার যে আশা আসলে কারও নেই। আমরা হিসাব করে রেখেছি, চারজন রোগীর ৫০ শতাংশের নিচে বার্ন কিন্তু তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এখন যে কথা বলছে, আমি জানি আগামী তিন দিন পর সে কথা বলতে পারবে না, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারবে না।’

হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ ঘটনায় দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকা রোগীর মধ্যে এখন ১২ জন আছেন। তারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, সবার অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালী, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে ৪ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানান, যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকেরই শ্বাসনালীসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। প্রত্যেকের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দগ্ধ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবধরনের সেবা দিতে চিকিৎসরা ব্যাপক শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ২৫ জন মারা গেছেন। বাকি ১২ জনকে সুস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসকরা।

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১২ মুসল্লি

যে ১২ জন চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে ছয়জন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসাধীন ১২ জনের কেউ শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও ১২ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তারাও শঙ্কামুক্ত নয়। দগ্ধ ১২ জনের মধ্যে ৬ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাধীন ১২ জন হলেন- ইমরান (৩০), মামুন (২৩), আমজাদ (৩৭), আ. সাত্তার (৪০), হান্নান (৫০), আ. আজিজ (৪০), রিফাত (১৮), নজরুল ইসলাম (৫০), মো. কেনান (২৪), মনির ফরাজী (৩০), শেখ ফরিদ (২১) ও মো. ফরিদ (৫৫)। তাদের মধ্যে ফরিদ, মনির ফরাজী, কেনান, আজিজ, আমজাদ ও আবুল বাশারকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

দগ্ধদের দেখতে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী :

এদিকে গতকাল দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ১২ জনকে দেখতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। গতকাল বেলা ১২টার দিকে দগ্ধ রোগীদের খোঁজ-খবর নিতে যান তিনি। দগ্ধ রোগীদের দেখতে গিয়ে ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৭ জন রোগীকে এখানে ভর্তি করা হয়। এখানকার চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো প্রায় সব রোগীরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। আশা করছি, কিছু রোগী বেঁচে যেতে পারেন। তবে বেশিরভাগের অবস্থাই ভালো না। ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও সমন্বয়কসহ সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক এদের খোঁজখবর নিচ্ছেন ও পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে এদের সবাইকে সারিয়ে তোলা।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই ঘটনায় ফতুল্লা থানায় অবহেলাজনিত ধারায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে যদি কারও গাফিলতি থাকে তাহলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় বার্ন ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে। শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে সজ্জিত পোড়া রোগীদের হাসপাতাল। বিদেশি চিকিৎসকরাও এখানে এসে ট্রেনিং দিয়েছেন। আগেতো এই চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিল না। এখানে আগুনে পোড়া সবধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।’

ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিদের ২০ হাজার ও আহতদের আপাতত ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। এখানে কোন রোগীর চিকিৎসার জন্য যদি কোন ওষুধ বা টাকা-পয়সার প্রয়োজন হয় তাহলে তারা ডা. সামন্তলাল সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা নিতে পারবেন। আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকব। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে, হতাহতদের পরিবারকে কী পরিমাণ সহায়তা দেয়া হবে। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেব।

স্বজনদের কণ্ঠে বিচার দাবি :

এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বজনদের নিঘুম রাত কাটছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের এক করিডোর থেকে অন্য করিডোরে। ইতোমধ্যে যে ২৫ জন মারা গেছেন তাদের স্বজনদের চোখে কোন ঘুম ছিল না, ছিল না খাওয়া দাওয়া। নিহত এবং দগ্ধ হয়ে এখনও বেঁচে থাকাদের স্বজনদের কণ্ঠে এক বাক্য, এ ঘটনায় যাদের গাফিলতি ছিল তাদের বিচার হতে হবে। কোনভাবেই যেন কেউ ছাড় না পায়। তিতাস গ্যাস, মসজিদ কমিটি যে বা যাদের গাফিলতি ছিল, যারা গ্যাসলাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণের সময় দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন, গ্যাস লাইন লিকেজ হওয়ার পর বলার পরও কেন লাইন ঠিক হয়নি, কেন ঘুষ চাওয়া হয়েছে, ঘুষের জন্য লাইন ঠিক করতে না পারার বিষয়টি মসজিদ কমিটি কেন প্রশাসনকে জানায়নি সব বিষয় তদন্ত করে বিচার চান স্বজনরা।

গতকাল সকাল আটটায় মারা গেছেন মোহাম্মদ আলী নামে এক শিক্ষক। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করায় তাকে সবাই জানেন এবং চেনেন ‘আলী মাস্টার’ হিসেবে। ইনস্টিটিউটের লবিতে মামাতো ভাই রিয়াদের কাঁধে মাথা রেখে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আলী মাস্টারের মেঝ ছেলে রাসেল। বার্ন ইউনিটের ভেতরে দগ্ধদের আর্তনাদ। তিনি বললেন, আমাদের বাসার পাশেই মসজিদ। আব্বা এখানেই প্রতিদিন নামাজ পড়তে যেতেন। চেষ্টা করতেন সবার আগে যেতে। শুক্রবারও গিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে বার বার বলছিলেন, ‘আমার গায়ে মলম দাও, জ্বলে যাচ্ছে পুরো শরীর। আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে আব্বা চলে গেলেন। জানি না তাকে হারানোর এই শোক আমরা কিভাবে সইবো? আলী মাস্টারের ভাগিনা রিয়াদ বলেন, মসজিদ কমিটি আগেই তিতাস গ্যাসকে গ্যাস লিক হওয়ার কথা অবগত করেছিল। তারা লিখিত অভিযোগ না দেয়ার কারণে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তারা ৫০ হাজার টাকা ঘুষও চেয়েছিল। ‘তিতাস ঠিকমতো ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা ঘটতো না। এতগুলো মানুষের মৃত্যু হতো না। আমরা এর বিচার চাই। ’

রহিমা বেগম এ ঘটনায় হারিয়েছে স্বামী জালহাস এবং ৬ বছরের ছেলে জুবায়েরকে। তিনি এখন পাগলপ্রায়। শনিবার ছেলে ও গতকাল তার স্বামী মারা যায়। গতকাল জুলহাস মিয়ার মরদেহ নিতে এসে তার ফুপাতো ভাই নাহিদ হাসান শাকিল বলেন, সকালে ভাতিসা জোবায়ের দাফন সম্পন্ন হয়েছে পটুয়াখালীতে। এরপর মারা গেছেন আমার ভাই জুলহাস। জানি না, ভাবি কিভাবে এই শোক সহ্য করবেন? কিভাবে তার বাকি জীবন চলবে?

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন আমজাদ। বার্ন ইউনিটের এক লবি থেকে অন্য লবিতে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত বাবা আবদুল আহাদ। ছেলের চিন্তায় তার নাওয়া খাওয়া সবকিছু ফিকে হয়ে গেছে। অসহায় এ বাবা সাংবাদিকদের বলেন আমার চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক মরদেহ বেরোচ্ছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার জমিজমা যা কিছু সব বেচে দেব, আমারে আমার ছেলে ফিরিয়ে দিন। আমার ছেলে পোশাক কারখানার গাড়ি চালাত। তার রোজগারে আমাদের সংসার চলত। আমার ছেলেরে ফিরায়া দাও।