সংসদ সদস্য বলার পরও

পাবনায় অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি

পদ্মা ও যমুনার ২৪টি পয়েন্টে চলছে বালু তোলার মহোৎসব

পাবনা জেলার পদ্মা ও যমুনা নদীর ২৪টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন এক কোটি টাকার বালু উত্তোলন করা হচ্ছে অবৈধভাবে। বালুর টাকা ভাগ হচ্ছে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে।

পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. ফিরোজ কবির বলেছেন, ‘এই বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে একাধিকবার বলেছি, কিন্তু হতাশাজনক হলেও সত্য যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।’ তিনি আরও বলেন ‘জনপ্রতিনিধি হিসাবে বারবার বলার পরও বালু উত্তোলন বন্ধ না হওয়ায় আমি বিব্রত এবং ক্ষুব্ধ।’

সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে রেজ্যুলেশন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু বালু উঠছেই।’

এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহীনুজ্জামান নিজেই বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটের হোতা। তিনি প্রতিদিন বালু উত্তোলনকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা পান। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার আগেও তার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। মাত্র দু’বছরেই তিনি বালুর টাকায় কোটিপতি বনে গেছেন।

সুজানগর উপজেলার সাতবাড়ীয়া ইউনিয়ন থেকে নাজিরগঞ্জের হাসামপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার এলাকায় শতাধিক ড্রেজার দিয়ে অবাধে বালু তোলা হচ্ছে। এসব এলাকায় গেলে বালু উত্তোলনের মহোৎসব দেখে চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। সমস্ত নদী জুড়ে চায়না ড্রেজার আর ড্রেজার। শুধুমাত্র নাজিরগঞ্জেই ৩২টি চায়না ড্রেজার কাটার দিয়ে বালু কাটা হচ্ছে। আর অবৈধভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন করে স্তূপাকারে রাখায় অত্রাঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে এর ফলে জনজীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এলাকার কৃষকরা। অবাধে বালু উঠনোর ফলে পদ্মার ভাঙনে কৃষিজমি ও বাড়িঘর হারিয়ে হাজার খানেক কৃষক সর্বহারায় পরিণত হয়েছে। কৃষকরা যেমন ফসলি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তেমনি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে সরকারের নদী শাসনের ১২ কোটি টাকার প্রকল্প কোন সুফলে আসছে না। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় নদীপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ কৃষক।

সরকারিভাবে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও বা বালু মহালে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা না থাকলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা প্রশাসনের দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বালু উত্তোলন করছে।

সুজানগর উপজেলার গোয়ারিয়া, সাতবাড়িয়া, নাজিরগঞ্জ, বরখাপুর, লক্ষ্মীপুর, চর ভবানিপুর, চর সুজানগর, নারুহাটি, কামারহাট, মহব্বতপুর, হাসামপুর, ভাটপাড়া, বিলমাদিয়া, মামুদিয়া, বিজলীচর, বালিয়াডাঙ্গি, সদর উপজেলার দোগাছি, ভাঁড়ারা এবং সাদুল্লাপুর ইউনিয়ন এলাকার ভবানীপুর, চর সদিরাজপুর, চর ঘোষপুর এরাকায় পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বছরের পর বছর। ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী, সাড়া ও রূপপুর ইউনিয়নের চররূপপুর, দাদাপুর এলাকায় পদ্মা নদীতে খুবই ভালো মানের বালু পাওয়া যায় হেতু এখানকার বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেপরোয়া। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং হার্ডিঞ্জ রেল সেতু ও লালন শাহ সেতুর উজান এবং ভাটিতে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বেড়া উপজেলার নাকালিয়া, চর নাকলিয়া, চর সাড়াশিয়া, রাকশা, সিংহাসন এলাকায় যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন হচ্ছে। এসব এলাকায় প্রায় দেড়শ’ শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মেশিনে নৌকায় করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সুজানগর থানার ওসি মো. বদরুদ্দোজাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না।’ পাবনা সদর থানার ওসি মো. নাসিম আহমেদ বলেন ‘আমি পদ্মা নদীর ওসব এলাকায় যায়নি। অতএব জানি না।’ ঈশ্বরদী থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, তার এলাকায় পদ্মা নদীতে আগে বালু উঠত। গতকাল নৌপুলিশ কর্তৃক মামলা দায়ের করার পর আর বালু উত্তোলন হচ্ছে না।’

এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ওসিরা সবই জানেন অথচ না জানার ভান করছেন। কারণ এই বালু উত্তোলন সিন্ডিকেটের সঙ্গে জেলা পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত। সঙ্গত কারণেই ওসিরা মিথ্যা কথা বলছেন। তারা সবই জানেন।’

সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রওশন আলী বলেন, ‘বালু উত্তোলন হচ্ছে, তবে আমরা খুব শীঘ্রই এটি বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি।’

পাবনা সদর, ঈশ্বরদী, সুজানগর এবং বেড়া উপজেলার ২৪টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতি ঘনফুট বালুর মূল্য ৪ টাকা হিসেবে এক কোটি টাকা। একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এই বালু উত্তোলন করছে।

প্রতিদিন বালু ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নগদ ২৫ লাখ টাকা দিচ্ছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ অবৈধ বালু উত্তোলনে কিছু সরকারি কর্মকর্তা জড়িত মর্মে তাদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে উচ্চ পর্যায়ে।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাকশি হার্ডিঞ্জ রেল সেতু এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের খুব নিকটবর্তী এলাকা থেকে (পদ্মা নদী) বালু উঠনো হচ্ছে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

বালু ব্যবসায়ীরা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা বালু উত্তোলনে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হয়রানি করে। এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে পাবনার সুজানগর, পাবনা সদর ও ঈশ্বরদী উপজেলায়।

ইতোপূর্বে নাজিরগঞ্জে যুবলীগের নেতাকর্মীরা বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ করতে সমবেত হলে তাদের পুলিশ বেধড়ক মারপিট করে এবং তাদের ৮টি মোটরসাইকেল পুলিশ আটক করে। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের ব্যর্থতায় উচ্চ আদালত গত জানুয়ারিতে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করলে প্রশাসন মাঠে নামে। গত ২৭ জানুয়ারি সুজানগরের সাতবাড়ীয়ায় ১টি, মালিফাতে ২টি, নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের মহব্বতপুর, বরখাপুর, হাসামপুর, বুলচন্দ্রপুরের ৯টি পয়েন্টে অবৈধভাবে উত্তোলিত ১২টি জব্দকৃত বালুস্তূপ ২২ লাখ ৩০ হাজার ৮শ’ টাকায় প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করে। কয়েক কোটি টাকার বালু নামমাত্র মূল্যে বালু কারবারীরাই ক্রয় করে নেয়। এরপর কিছুদিন বন্ধ ছিল বালু উত্তোলন। আবার এখন চলছে বালু উত্তোলন। যেসব পয়েন্টে বালু নিলাম হয়েছে সেখানেই নুতন করে বালু তুলে স্তূপ করা হচ্ছে। প্রশাসন কখনও যদি মাঠে নামে তাহলে তারা ওই স্তূপিকৃত বালু নিলামে কিনে নিবে।

সরকার অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসকদের

এদিকে গতকাল সরকার কর্তৃক (মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয় থেকে) সব জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নদী, জলাভূমি ও নি¤œাঞ্চল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বিপণন রোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

উক্ত নির্দেশনামায় (স্মারক নং ০৪.০০.০০০০.৫২২.৯৯.০০১.২০.৬০; তাং ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০) বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, পদ্মা রেল সেতু, সংযোগ প্রকল্প, হাইওয়ে এক্সপ্রেস প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। সাম্প্রতিক প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে যে, কতিপয় দুষ্কৃতকারী কর্তৃক অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সংলগ্ন এলাকাসমূহে এবং সরকারের বালুমহাল হিসেবে ঘোষিত নয় এমন এলাকা হতে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তাছাড়া কোন কোন অনুমোদিত ইজারাকৃত বালুমহাল হতে বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ যথাযথভাবে অনুসরণ না করে ড্রেজার ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় নদীভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে এবং সর্বোপরি চলমান গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তাবায়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সে কারণে অবৈধ বালু উত্তোলন ও বিপণন সম্পূর্ণ বন্ধ করা প্রয়োজন। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব তৌহিদ এলাহী স্বাক্ষরিত পত্রটি গতকালই ই-মেইল যোগে সব জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।

image

সুজানগরের নাজিরগঞ্জ থেকে এভাবে প্রকাশ্যেই পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে - সংবাদ

আরও খবর
জালের মতো বিছিয়ে আছে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ
তিতাস-ডিপিডিসি-মসজিদ কমিটি কার দায় কত?
এসি নিয়ন্ত্রিত সব মসজিদের বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষার নির্দেশ
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১২ জন
মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে, অবশ্যই কারণ বের হবে
করোনায় ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ৩২ জনের শনাক্ত ১৫৯২
মসজিদে বিস্ফোরণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ : দুর্ভোগে এলাকাবাসী
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি টিআইবির
অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ
‘করোনাভাইরাস বাংলাদেশে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে’
স্কুল খোলা সম্ভব না হলে অটোপাস
মিতু হত্যার আসামি রিমান্ডে

সোমবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৭ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

সংসদ সদস্য বলার পরও

পাবনায় অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি

পদ্মা ও যমুনার ২৪টি পয়েন্টে চলছে বালু তোলার মহোৎসব

বিশেষ প্রতিনিধি

image

সুজানগরের নাজিরগঞ্জ থেকে এভাবে প্রকাশ্যেই পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে - সংবাদ

পাবনা জেলার পদ্মা ও যমুনা নদীর ২৪টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন এক কোটি টাকার বালু উত্তোলন করা হচ্ছে অবৈধভাবে। বালুর টাকা ভাগ হচ্ছে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে।

পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. ফিরোজ কবির বলেছেন, ‘এই বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে একাধিকবার বলেছি, কিন্তু হতাশাজনক হলেও সত্য যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।’ তিনি আরও বলেন ‘জনপ্রতিনিধি হিসাবে বারবার বলার পরও বালু উত্তোলন বন্ধ না হওয়ায় আমি বিব্রত এবং ক্ষুব্ধ।’

সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে রেজ্যুলেশন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু বালু উঠছেই।’

এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহীনুজ্জামান নিজেই বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটের হোতা। তিনি প্রতিদিন বালু উত্তোলনকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা পান। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার আগেও তার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। মাত্র দু’বছরেই তিনি বালুর টাকায় কোটিপতি বনে গেছেন।

সুজানগর উপজেলার সাতবাড়ীয়া ইউনিয়ন থেকে নাজিরগঞ্জের হাসামপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার এলাকায় শতাধিক ড্রেজার দিয়ে অবাধে বালু তোলা হচ্ছে। এসব এলাকায় গেলে বালু উত্তোলনের মহোৎসব দেখে চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। সমস্ত নদী জুড়ে চায়না ড্রেজার আর ড্রেজার। শুধুমাত্র নাজিরগঞ্জেই ৩২টি চায়না ড্রেজার কাটার দিয়ে বালু কাটা হচ্ছে। আর অবৈধভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন করে স্তূপাকারে রাখায় অত্রাঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে এর ফলে জনজীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এলাকার কৃষকরা। অবাধে বালু উঠনোর ফলে পদ্মার ভাঙনে কৃষিজমি ও বাড়িঘর হারিয়ে হাজার খানেক কৃষক সর্বহারায় পরিণত হয়েছে। কৃষকরা যেমন ফসলি জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তেমনি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে সরকারের নদী শাসনের ১২ কোটি টাকার প্রকল্প কোন সুফলে আসছে না। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় নদীপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ কৃষক।

সরকারিভাবে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও বা বালু মহালে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা না থাকলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা প্রশাসনের দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বালু উত্তোলন করছে।

সুজানগর উপজেলার গোয়ারিয়া, সাতবাড়িয়া, নাজিরগঞ্জ, বরখাপুর, লক্ষ্মীপুর, চর ভবানিপুর, চর সুজানগর, নারুহাটি, কামারহাট, মহব্বতপুর, হাসামপুর, ভাটপাড়া, বিলমাদিয়া, মামুদিয়া, বিজলীচর, বালিয়াডাঙ্গি, সদর উপজেলার দোগাছি, ভাঁড়ারা এবং সাদুল্লাপুর ইউনিয়ন এলাকার ভবানীপুর, চর সদিরাজপুর, চর ঘোষপুর এরাকায় পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বছরের পর বছর। ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী, সাড়া ও রূপপুর ইউনিয়নের চররূপপুর, দাদাপুর এলাকায় পদ্মা নদীতে খুবই ভালো মানের বালু পাওয়া যায় হেতু এখানকার বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেপরোয়া। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং হার্ডিঞ্জ রেল সেতু ও লালন শাহ সেতুর উজান এবং ভাটিতে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বেড়া উপজেলার নাকালিয়া, চর নাকলিয়া, চর সাড়াশিয়া, রাকশা, সিংহাসন এলাকায় যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন হচ্ছে। এসব এলাকায় প্রায় দেড়শ’ শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মেশিনে নৌকায় করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সুজানগর থানার ওসি মো. বদরুদ্দোজাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না।’ পাবনা সদর থানার ওসি মো. নাসিম আহমেদ বলেন ‘আমি পদ্মা নদীর ওসব এলাকায় যায়নি। অতএব জানি না।’ ঈশ্বরদী থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, তার এলাকায় পদ্মা নদীতে আগে বালু উঠত। গতকাল নৌপুলিশ কর্তৃক মামলা দায়ের করার পর আর বালু উত্তোলন হচ্ছে না।’

এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ওসিরা সবই জানেন অথচ না জানার ভান করছেন। কারণ এই বালু উত্তোলন সিন্ডিকেটের সঙ্গে জেলা পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত। সঙ্গত কারণেই ওসিরা মিথ্যা কথা বলছেন। তারা সবই জানেন।’

সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রওশন আলী বলেন, ‘বালু উত্তোলন হচ্ছে, তবে আমরা খুব শীঘ্রই এটি বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি।’

পাবনা সদর, ঈশ্বরদী, সুজানগর এবং বেড়া উপজেলার ২৪টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতি ঘনফুট বালুর মূল্য ৪ টাকা হিসেবে এক কোটি টাকা। একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এই বালু উত্তোলন করছে।

প্রতিদিন বালু ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নগদ ২৫ লাখ টাকা দিচ্ছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ অবৈধ বালু উত্তোলনে কিছু সরকারি কর্মকর্তা জড়িত মর্মে তাদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে উচ্চ পর্যায়ে।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাকশি হার্ডিঞ্জ রেল সেতু এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের খুব নিকটবর্তী এলাকা থেকে (পদ্মা নদী) বালু উঠনো হচ্ছে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

বালু ব্যবসায়ীরা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা বালু উত্তোলনে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হয়রানি করে। এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে পাবনার সুজানগর, পাবনা সদর ও ঈশ্বরদী উপজেলায়।

ইতোপূর্বে নাজিরগঞ্জে যুবলীগের নেতাকর্মীরা বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ করতে সমবেত হলে তাদের পুলিশ বেধড়ক মারপিট করে এবং তাদের ৮টি মোটরসাইকেল পুলিশ আটক করে। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের ব্যর্থতায় উচ্চ আদালত গত জানুয়ারিতে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করলে প্রশাসন মাঠে নামে। গত ২৭ জানুয়ারি সুজানগরের সাতবাড়ীয়ায় ১টি, মালিফাতে ২টি, নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের মহব্বতপুর, বরখাপুর, হাসামপুর, বুলচন্দ্রপুরের ৯টি পয়েন্টে অবৈধভাবে উত্তোলিত ১২টি জব্দকৃত বালুস্তূপ ২২ লাখ ৩০ হাজার ৮শ’ টাকায় প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করে। কয়েক কোটি টাকার বালু নামমাত্র মূল্যে বালু কারবারীরাই ক্রয় করে নেয়। এরপর কিছুদিন বন্ধ ছিল বালু উত্তোলন। আবার এখন চলছে বালু উত্তোলন। যেসব পয়েন্টে বালু নিলাম হয়েছে সেখানেই নুতন করে বালু তুলে স্তূপ করা হচ্ছে। প্রশাসন কখনও যদি মাঠে নামে তাহলে তারা ওই স্তূপিকৃত বালু নিলামে কিনে নিবে।

সরকার অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসকদের

এদিকে গতকাল সরকার কর্তৃক (মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয় থেকে) সব জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নদী, জলাভূমি ও নি¤œাঞ্চল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বিপণন রোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

উক্ত নির্দেশনামায় (স্মারক নং ০৪.০০.০০০০.৫২২.৯৯.০০১.২০.৬০; তাং ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০) বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, পদ্মা রেল সেতু, সংযোগ প্রকল্প, হাইওয়ে এক্সপ্রেস প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। সাম্প্রতিক প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে যে, কতিপয় দুষ্কৃতকারী কর্তৃক অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সংলগ্ন এলাকাসমূহে এবং সরকারের বালুমহাল হিসেবে ঘোষিত নয় এমন এলাকা হতে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তাছাড়া কোন কোন অনুমোদিত ইজারাকৃত বালুমহাল হতে বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ যথাযথভাবে অনুসরণ না করে ড্রেজার ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় নদীভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে এবং সর্বোপরি চলমান গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তাবায়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সে কারণে অবৈধ বালু উত্তোলন ও বিপণন সম্পূর্ণ বন্ধ করা প্রয়োজন। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব তৌহিদ এলাহী স্বাক্ষরিত পত্রটি গতকালই ই-মেইল যোগে সব জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।