জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১-২০০২ সালে পনেরো মাসে বিরোধী দল ও মতের যে পরিমাণ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে অতীতে কখনও তা ঘটেনি। প্রতিটি কারাগারে ধারণক্ষমতার পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি বন্দি রাখা হয়েছিল, তাদের সিংহভাগ হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থক। ধারণক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত বন্দি রাখার ফলে সমগ্র কারা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। বন্দিরা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম মানবাধিকার থেকে। চার বা ততোধিক মামলার আসামিদের ২৪ ঘণ্টা ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়, খেতে দেয়া হয় মানুষের পক্ষে গ্রহণের অযোগ্য খাদ্য ও পানীয়, শোবার জন্য অধিকাংশ বন্দিকে দেয়া হয় মাত্র এক হাত প্রশস্ত জায়গা যেখানে চিত হয়ে শোয়া সম্ভব নয়। ফাইলের বহু বন্দী রাতের পর রাত শুতে না পেরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে, যাদের স্নান দূরে থাক প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করারও ন্যূনতম স্থান নেই। এর ফলে বিপুলসংখ্যক বন্দিকে নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতার শিকার হতে হয়, যে অসুস্থতার কোন চিকিৎসা কারাগারে নেই। বাজেট স্বল্পতা ছাড়াও কারাগারে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখা হয়েছে। এই প্রচন্ড শীতে উত্তরবঙ্গের কারাগারে কম্বলের অভাবে বন্দির মৃত্যু সংবাদও পত্রিকায় দেখেছি। ১৯৯৪ সালে সংঘটিত তথাকথিত আনসার বিদ্রোহে যৌথবাহিনীর অপারেশনের পর ২৫০০ জন ব্যাটালিয়ন আনসারসহ ১৫ জন কর্মকর্তাকে কারাগারে অন্তরীণ করে তাদেরকে ডিটেনশন দেওয়া হয়েছিল। সেদিনের ঘটনায় আমিও পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। কারাগারে অবস্থানকালে আমি দেখেছি- রাজনৈতিক কারণে আটক বহু বন্দী তুচ্ছ মামলায় অভিযুক্ত হয়েও এত কিছুর পরও কারাগারে থাকা শ্রেয় মনে করছেন। তারা আমাকে বলেছেন জামিন নিয়েও লাভ নেই, আবারো জেলগেট থেকে ৫৪ ধারা বা নতুন কোন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হবে এবং কারাগারে ফিরে আসতে হবে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বিভীষিকা প্রতিনিয়ত তাড়া করে ভুক্তভোগীদের, যার সামান্য অংশই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিরোধী মতাবলম্বীদের প্রতি সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ এর যদি কোন পরিবর্তন না ঘটে, কারাগারে আটক বন্দীদের প্রতি পশুর মত আচরণের অবসান যদি না ঘটে কিংবা প্রতিপক্ষকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে হত্যা যদি নিয়মে পরিণত হয় আমাদের আশঙ্কা বাংলাদেশের অবস্থা তালেবানি আফগানিস্তান কিংবা মায়ানমারের মতো কিংবা তার চেয়ে আরো খারাপ হতে বাধ্য।
যে কোন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিচারের প্রধান মানদন্ড হচ্ছে সে দেশের সংবিধান। প্রথমে দেখা হয় জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সে দেশের সংবিধানে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কতটুকু গ্যারান্টি আছে। দ্বিতীয়ত সে দেশের সরকার সংবিধানপ্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক। তৃতীয়ত সরকার যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তার প্রতিকার বিধানের উপযুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ সে দেশে আছে কিনা। চতুর্থত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিবেশনের স্বাধীনতা সে দেশের সংবাদপত্রের আছে কি-না। পঞ্চমত দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং মানবাধিকার কর্মীরা সরকারি ও দলীয় চাপ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি-না। এই পাঁচটি বিষয় পর্যালোচনা করলেই সে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় অসঙ্গতি বাদ দিলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের অধিকাংশ ধারা এতে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ধারায় মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ২৩টি অনুচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭(ক) পর্যন্ত) আছে যাতে মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সরকার প্রতিনিয়ত এই সকল ধারা লঙ্ঘন করছে এবং এর জন্য সরকারকে কদাচিৎ অভিযুক্ত করে মামলা করা হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সরকার ও প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নয় সেহেতু নিম্ন আদালত তো বটেই উচ্চতর আদালতের রায়েও বহু ক্ষেত্রে সরকারের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়। এ ধরনের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছিল বিগত বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বিচার বিভাগের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিম্ন আদালতের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও যে সব রায় সরকারের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় না, বা যা সরকারের বিরুদ্ধে যায় তা অগ্রাহ্য করা বর্তমানে প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যৌথ অভিযান চলাকালীন তৎকালীন সরকার চাতুর্যের সঙ্গে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। বিএনপির জাতীয় পর্যায়ের কোন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এমনকি জেলা পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও ছিলেন এই অভিযান থেকে মুক্ত। অথচ আওয়ালী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস, সাবেক হুইপ মোস্তফা রশিদী সুজা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আব্দুল খালেক এমপির মতো সিনিয়র নেতাদের সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে। সেনা সদস্যরা দলের প্রেসিডিয়ামের প্রভাবশালী তিন সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদকে গ্রেফতার করার জন্য একাধিকবার তাদের বাসায় অভিযান চালায়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও যৌথ বাহিনীর অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। দলের আরো বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এ সময় আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথবাহিনীর ওই অভিযান চলে। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন- ২০০৩’ করা হয়। এই দায়মুক্তি আইনের বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই যারা চান তারা মামলা করবেন এবং মামলা হবে স্টেটের বিরুদ্ধে। আর ক্ষতিপূরণের মামলাও তারা সবাই করতে পারবেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের মামলার মাধ্যমে তারা তাদের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।’ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩’র মাধ্যমে যেসব হত্যাকান্ড- ঘটেছিল তৎকালীন সরকার সংসদে আইন পাস করে তার বৈধতা দেয়। ২০১২ সালে তা বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বা ব্যক্তিগতভাবে যদি কাউকে দোষী মনে হয়, সাক্ষী-প্রমাণ থাকে থানায় অথবা কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারবে। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজ হাতে আইন তুলে নিতে পারেন না। সংবিধান অনুযায়ী একজন শীর্ষ অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে কারও মৃত্যুকে জঘন্য অপরাধ বলেও পর্যবেক্ষণে বলেন আদালত।
আমাদের সমাজে খুব নাটকীয় গতিতে দুর্বৃত্তায়নের উত্থান হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই অপশক্তি ক্ষমতার মসনদে বসে থেকে বড় বড় আওয়াজ দিতে থাকে। অর্থাৎ অবস্থাটা এরকম যেন ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। এ অবস্থাটা কি প্রশাসন, কি রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শত-স্বচ্ছতার অধিকারী কর্মকর্তারা থাকেন পিছিয়ে। এক্ষেত্রে অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পদ-পদবির দিক থেকে শীর্ষ অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলেন। আর এই অবস্থা থেকে শুরু হয় প্রশাসনিক সংকট। এই প্রশাসনিক সংকট ক্রমে রাজনীতির ময়দানকেও কলুষিত করতে থাকে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি- যেমন মাদক বিরোধী অভিযান। আমাদের দেশে মাদক উৎপন্ন হয় না। তারপরেও আমাদের সমাজের উঠতি বয়সের তরুণরা মাদকে আসক্ত, তাহলে এই মাদকের উৎস কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে থেকে আসা এই মাদক আমাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় বা শাসনহীনতায় আমাদের দেশে প্রবেশ করে থাকে। আমরা এই অবস্থা জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমাদের সে আন্তরিকতার বা ইচ্ছাশক্তির অভাব কেন? এবার আসা যাক- অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকা-ে। অতি সম্প্রতি তাকে টেকনাফে পুলিশ বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-টি বাংলাদেশে সমসাময়িক কালে একটি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়। দেশের আনাচে-কানাচে এ ধরনের হত্যাকা- প্রায়শই ঘটছে। কখনো ফল বেপারি, মাছ বেপারি, অন্য কোন ব্যবসায়ী বা সাধারণ কোনো শ্রমিক কৃষক পুলিশ সদস্যের রোষানলের শিকার হচ্ছে। একটি বাহিনীর সদস্য হিসেবে কেমন করে এ ধরনের অনাচার অত্যাচার করে মানুষের জীবনকে নাজেহাল করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই কোন সহায়ক পরিবেশে তা সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে। একটি বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলা বিষয়ে জাতির কাছে প্রশ্ন তা কী করে সম্ভব? পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে কেন পেশাদারিত্বের এমন অবমাননা করা হচ্ছে? এজন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনা সৈনিক পর্যায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে কথা উঠে এসেছে। এমনকি পুলিশের ইন্সপেক্টর মর্যাদার কর্মকর্তাগন একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিকসহ অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন। এ কী করে সম্ভব? যেকোনো সহায়ক পরিবেশে তা সম্ভব হচ্ছে। তবে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসকল অনিয়মকে নজরে আনবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ হত্যাকা-ে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। তবে নিশ্চয়ই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। পুলিশকে অভিবাদন- কেননা পুলিশরা অনেক ভালো কাজ করে থাকেন। করোনাকালে তাদের ভূমিকা ছিল সকলের নজর কাড়ার মতো। আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন এই মানসিকতা নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন। একা শেখ হাসিনা কতটুকু করতে পারেন! তাকে কতটাই বা আন্তরিকভাবে তার কাছের মানুষেরা সহযোগিতা করেন? আমাদের জনগণকে শুদ্ধাচারী হতে হবে। ভিতরে একরকম বাইরে অন্যরকম এই মানসিকতার পরিহার করে এগোতে হবে। যাই হোক, সমাজে মানুষের যে নৈতিক অধঃপতন হয়েছে- তা সুশাসনের অভাবে ঘটে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুঃশাসন, দুর্নীতি ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সজাগ থাকতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল- সকল প্রতিষ্ঠান ও সমাজের মানুষকে তাদের আত্মসমালোচনার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হতে হবে। নচেৎ আত্মসমালোচনা ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে না। এক্ষেত্রে প্রচলিত আইন-কানুনের পরিবর্তন আবশ্যক।
[লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী]
সোমবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৭ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১-২০০২ সালে পনেরো মাসে বিরোধী দল ও মতের যে পরিমাণ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে অতীতে কখনও তা ঘটেনি। প্রতিটি কারাগারে ধারণক্ষমতার পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি বন্দি রাখা হয়েছিল, তাদের সিংহভাগ হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থক। ধারণক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত বন্দি রাখার ফলে সমগ্র কারা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। বন্দিরা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম মানবাধিকার থেকে। চার বা ততোধিক মামলার আসামিদের ২৪ ঘণ্টা ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়, খেতে দেয়া হয় মানুষের পক্ষে গ্রহণের অযোগ্য খাদ্য ও পানীয়, শোবার জন্য অধিকাংশ বন্দিকে দেয়া হয় মাত্র এক হাত প্রশস্ত জায়গা যেখানে চিত হয়ে শোয়া সম্ভব নয়। ফাইলের বহু বন্দী রাতের পর রাত শুতে না পেরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে, যাদের স্নান দূরে থাক প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করারও ন্যূনতম স্থান নেই। এর ফলে বিপুলসংখ্যক বন্দিকে নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতার শিকার হতে হয়, যে অসুস্থতার কোন চিকিৎসা কারাগারে নেই। বাজেট স্বল্পতা ছাড়াও কারাগারে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখা হয়েছে। এই প্রচন্ড শীতে উত্তরবঙ্গের কারাগারে কম্বলের অভাবে বন্দির মৃত্যু সংবাদও পত্রিকায় দেখেছি। ১৯৯৪ সালে সংঘটিত তথাকথিত আনসার বিদ্রোহে যৌথবাহিনীর অপারেশনের পর ২৫০০ জন ব্যাটালিয়ন আনসারসহ ১৫ জন কর্মকর্তাকে কারাগারে অন্তরীণ করে তাদেরকে ডিটেনশন দেওয়া হয়েছিল। সেদিনের ঘটনায় আমিও পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। কারাগারে অবস্থানকালে আমি দেখেছি- রাজনৈতিক কারণে আটক বহু বন্দী তুচ্ছ মামলায় অভিযুক্ত হয়েও এত কিছুর পরও কারাগারে থাকা শ্রেয় মনে করছেন। তারা আমাকে বলেছেন জামিন নিয়েও লাভ নেই, আবারো জেলগেট থেকে ৫৪ ধারা বা নতুন কোন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হবে এবং কারাগারে ফিরে আসতে হবে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বিভীষিকা প্রতিনিয়ত তাড়া করে ভুক্তভোগীদের, যার সামান্য অংশই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিরোধী মতাবলম্বীদের প্রতি সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ এর যদি কোন পরিবর্তন না ঘটে, কারাগারে আটক বন্দীদের প্রতি পশুর মত আচরণের অবসান যদি না ঘটে কিংবা প্রতিপক্ষকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে হত্যা যদি নিয়মে পরিণত হয় আমাদের আশঙ্কা বাংলাদেশের অবস্থা তালেবানি আফগানিস্তান কিংবা মায়ানমারের মতো কিংবা তার চেয়ে আরো খারাপ হতে বাধ্য।
যে কোন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিচারের প্রধান মানদন্ড হচ্ছে সে দেশের সংবিধান। প্রথমে দেখা হয় জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সে দেশের সংবিধানে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কতটুকু গ্যারান্টি আছে। দ্বিতীয়ত সে দেশের সরকার সংবিধানপ্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক। তৃতীয়ত সরকার যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তার প্রতিকার বিধানের উপযুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ সে দেশে আছে কিনা। চতুর্থত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিবেশনের স্বাধীনতা সে দেশের সংবাদপত্রের আছে কি-না। পঞ্চমত দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং মানবাধিকার কর্মীরা সরকারি ও দলীয় চাপ ও প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি-না। এই পাঁচটি বিষয় পর্যালোচনা করলেই সে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় অসঙ্গতি বাদ দিলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের অধিকাংশ ধারা এতে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ধারায় মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ২৩টি অনুচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭(ক) পর্যন্ত) আছে যাতে মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সরকার প্রতিনিয়ত এই সকল ধারা লঙ্ঘন করছে এবং এর জন্য সরকারকে কদাচিৎ অভিযুক্ত করে মামলা করা হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সরকার ও প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নয় সেহেতু নিম্ন আদালত তো বটেই উচ্চতর আদালতের রায়েও বহু ক্ষেত্রে সরকারের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়। এ ধরনের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছিল বিগত বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বিচার বিভাগের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিম্ন আদালতের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও যে সব রায় সরকারের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় না, বা যা সরকারের বিরুদ্ধে যায় তা অগ্রাহ্য করা বর্তমানে প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যৌথ অভিযান চলাকালীন তৎকালীন সরকার চাতুর্যের সঙ্গে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। বিএনপির জাতীয় পর্যায়ের কোন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এমনকি জেলা পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও ছিলেন এই অভিযান থেকে মুক্ত। অথচ আওয়ালী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস, সাবেক হুইপ মোস্তফা রশিদী সুজা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আব্দুল খালেক এমপির মতো সিনিয়র নেতাদের সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে। সেনা সদস্যরা দলের প্রেসিডিয়ামের প্রভাবশালী তিন সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদকে গ্রেফতার করার জন্য একাধিকবার তাদের বাসায় অভিযান চালায়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও যৌথ বাহিনীর অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। দলের আরো বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এ সময় আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথবাহিনীর ওই অভিযান চলে। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন- ২০০৩’ করা হয়। এই দায়মুক্তি আইনের বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই যারা চান তারা মামলা করবেন এবং মামলা হবে স্টেটের বিরুদ্ধে। আর ক্ষতিপূরণের মামলাও তারা সবাই করতে পারবেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের মামলার মাধ্যমে তারা তাদের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।’ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩’র মাধ্যমে যেসব হত্যাকান্ড- ঘটেছিল তৎকালীন সরকার সংসদে আইন পাস করে তার বৈধতা দেয়। ২০১২ সালে তা বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বা ব্যক্তিগতভাবে যদি কাউকে দোষী মনে হয়, সাক্ষী-প্রমাণ থাকে থানায় অথবা কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারবে। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজ হাতে আইন তুলে নিতে পারেন না। সংবিধান অনুযায়ী একজন শীর্ষ অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে কারও মৃত্যুকে জঘন্য অপরাধ বলেও পর্যবেক্ষণে বলেন আদালত।
আমাদের সমাজে খুব নাটকীয় গতিতে দুর্বৃত্তায়নের উত্থান হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই অপশক্তি ক্ষমতার মসনদে বসে থেকে বড় বড় আওয়াজ দিতে থাকে। অর্থাৎ অবস্থাটা এরকম যেন ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। এ অবস্থাটা কি প্রশাসন, কি রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শত-স্বচ্ছতার অধিকারী কর্মকর্তারা থাকেন পিছিয়ে। এক্ষেত্রে অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পদ-পদবির দিক থেকে শীর্ষ অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলেন। আর এই অবস্থা থেকে শুরু হয় প্রশাসনিক সংকট। এই প্রশাসনিক সংকট ক্রমে রাজনীতির ময়দানকেও কলুষিত করতে থাকে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি- যেমন মাদক বিরোধী অভিযান। আমাদের দেশে মাদক উৎপন্ন হয় না। তারপরেও আমাদের সমাজের উঠতি বয়সের তরুণরা মাদকে আসক্ত, তাহলে এই মাদকের উৎস কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে থেকে আসা এই মাদক আমাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় বা শাসনহীনতায় আমাদের দেশে প্রবেশ করে থাকে। আমরা এই অবস্থা জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমাদের সে আন্তরিকতার বা ইচ্ছাশক্তির অভাব কেন? এবার আসা যাক- অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকা-ে। অতি সম্প্রতি তাকে টেকনাফে পুলিশ বাহিনীর সদস্য কর্তৃক নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-টি বাংলাদেশে সমসাময়িক কালে একটি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়। দেশের আনাচে-কানাচে এ ধরনের হত্যাকা- প্রায়শই ঘটছে। কখনো ফল বেপারি, মাছ বেপারি, অন্য কোন ব্যবসায়ী বা সাধারণ কোনো শ্রমিক কৃষক পুলিশ সদস্যের রোষানলের শিকার হচ্ছে। একটি বাহিনীর সদস্য হিসেবে কেমন করে এ ধরনের অনাচার অত্যাচার করে মানুষের জীবনকে নাজেহাল করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই কোন সহায়ক পরিবেশে তা সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে। একটি বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলা বিষয়ে জাতির কাছে প্রশ্ন তা কী করে সম্ভব? পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে কেন পেশাদারিত্বের এমন অবমাননা করা হচ্ছে? এজন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনা সৈনিক পর্যায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে কথা উঠে এসেছে। এমনকি পুলিশের ইন্সপেক্টর মর্যাদার কর্মকর্তাগন একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিকসহ অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন। এ কী করে সম্ভব? যেকোনো সহায়ক পরিবেশে তা সম্ভব হচ্ছে। তবে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসকল অনিয়মকে নজরে আনবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ হত্যাকা-ে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। তবে নিশ্চয়ই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। পুলিশকে অভিবাদন- কেননা পুলিশরা অনেক ভালো কাজ করে থাকেন। করোনাকালে তাদের ভূমিকা ছিল সকলের নজর কাড়ার মতো। আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন এই মানসিকতা নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন। একা শেখ হাসিনা কতটুকু করতে পারেন! তাকে কতটাই বা আন্তরিকভাবে তার কাছের মানুষেরা সহযোগিতা করেন? আমাদের জনগণকে শুদ্ধাচারী হতে হবে। ভিতরে একরকম বাইরে অন্যরকম এই মানসিকতার পরিহার করে এগোতে হবে। যাই হোক, সমাজে মানুষের যে নৈতিক অধঃপতন হয়েছে- তা সুশাসনের অভাবে ঘটে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুঃশাসন, দুর্নীতি ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সজাগ থাকতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল- সকল প্রতিষ্ঠান ও সমাজের মানুষকে তাদের আত্মসমালোচনার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হতে হবে। নচেৎ আত্মসমালোচনা ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে না। এক্ষেত্রে প্রচলিত আইন-কানুনের পরিবর্তন আবশ্যক।
[লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী]