কোভিড ১৯ : শিক্ষা সংকট ও অটোপ্রমোশন

শঙ্কর প্রসাদ দে

করোনা সংকট মোকাবেলায় গোটা বিশ্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কারাগার ব্যবস্থাপনায় কঠোর রক্ষণশীল পথে হেঁটেছে। বাংলাদেশও প্রশংসনীয়ভাবে এ দুটো জায়গায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তার পথে হেঁটেছে। সুফলও আমরা পেয়েছি। আমাদের কারাগারগুলো আজও সংক্রমণমুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাচ্চাদের, কিশোরদের, যুবকদের মোটামুটি বাড়ি বা আশপাশে আটকে রাখতে পেরেছি। হাতেগোনা কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ত্রিশের নিচেকার ছেলেমেয়েদের সংক্রমণমুক্ত রাখা গেছে- এটা স্পষ্ট। কোভিড-১৯ সংকটে আমাদের বহু ব্যর্থতা ছিল। সীমাবদ্ধতাও ছিল। তবে জাতির পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারা আমাদের সকল ব্যর্থতাকে পুষিয়ে দিয়েছে। কারাগারে গ্রেফতার কার্যক্রম বন্ধ থাকা অর্থাৎ কারাগারে নতুন হাজতি ঢুকতে না দেয়া, কারাগার সাফল্যের মুল কারণ। তেমনি একেবারে শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, ছোটদের মাঝে সংক্রমণ না ঘটার প্রধান কারণ। সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে দুটো প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।

প্রথমত, ৪ অক্টোবর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ঠিক হবে কিনা ? দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করা ঠিক হবে কিনা?

ঈদুল আজহা পরবর্তী সময়ে জনজীবন স্বাভাবিকতায় ফিরছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুটোই বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, টিকা পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯, আমাদের জীবনসঙ্গী হয়ে থাকবে। বলা হচ্ছে, সংক্রমিত রোগীদের পারিবারিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা বাবা আক্রান্ত হবার পরও বাচ্চারা আক্রান্ত হচ্ছে না। অথবা বাচ্চাদের সংক্রমণের হার খুবই নি¤œ। তাহলে এই বাচ্চাগুলো স্কুল কলেজে গেলেওতো ব্যাপকহারে সংক্রমিত না হবারই কথা। এই বিষয়টি নিয়ে এখনো অবধি বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা বা আমাদের বিশেষজ্ঞদের নিকট থেকে সুষ্পষ্ট মতামত পাওয়া যায়নি। যদি বিশেষজ্ঞরা বলতেন অল্পবয়সীদের শক্ত ইমউনিটির কারণে স্কুলে গেলেও তাদের ঝুঁকি নেই, তবে ওইভাবে চিন্তা করা যেত। যেহেতু ওই ধরনের কোন নিশ্চয়তা চিকিৎসা জগৎ থেকে আসেনি, সেহেতু ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ নেই। ছুটির মেয়াদ ডিসেম্বর অবধি বাড়ানোই যুক্তিযুক্ত।

সরকারের একটি বিকল্প চিন্তা শেষ পর্যন্ত টিকবে বলে মনে হয় না। বলা হচ্ছে সামনের কয়েক মাসে কাটছাঁট সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে তুলে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান এক্ষুনি খোলা না গেলে কাটছাঁটের সুযোগ থাকে না; দ্বিতীয়ত, স্বল্প সিলেবাস স্বল্প লেখাপড়া স্বল্প প্রস্তুতি কোনটাই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তাছাড়া এটি হবে নিয়মিত পড়ার উপর একটি অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি। এটি একাধারে মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক থেকে ঘটবে। শিক্ষকদেরও চাপের মধ্যে সবদিক সামাল দিতে হবে। অসম্পূর্ণ এই সিলেবাস, অসম্পূর্ণ লেখাপড়া ছাত্র/ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মানস গঠনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফাউন্ডেশন দুর্বল হলে দালান নড়বড়ে হয়। এক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ দৃঢ়তা, নড়বড়ে হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

পঞ্চম শ্রেণীর পিএসসি এবং অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। কী পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের প্রমোশন দেয়া যায়, তা জানতে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞাদের মতামত চাওয়া হয়েছে। অনেক অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করলাম, শর্টকার্টপন্থায় প্রমোশনের পক্ষে নগরাঞ্চলের কেউ রাজি হচ্ছেন না। অনেকে সরাসরি বলছেন শর্টকার্ট পন্থায় সরকার প্রমোশনের ব্যবস্থা করলেও তারা একই ক্লাসে আবার রেখে দেবেন। এ মনোভাব নীতি নির্ধারকদের নিকট অজানা নয়। বহু- অভিভাবকদের চিন্তাটা হলো যদি ৪ঠা অক্টোবর স্কুল কলেজ খুলেও দেয়া হয় তারা কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলে পাঠাবেন না। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের অভিভাবক এ প্রশ্নে পুরোপুরি রক্ষণশীল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যদি মাস খানেক চলে যায় তবে বাকি থাকে এক থেকে দু’মাস।

বাস্তব অবস্থা সবাই উপলদ্ধি করছেন। এটিই ভালো লক্ষণ। শিক্ষামন্ত্রী সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, এক বছর ছেলে মেয়েরা না পড়লে মুর্খ হবে না। কিন্তু সংক্রমিত হলে বহু মায়ের বুক খালি হবে। তার এ উক্তি থেকে মনে হচ্ছে সরকারও অন্তত এ বছর স্কুল কলেজ খোলার পক্ষে নন। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিকে স্কুল কলেজ খোলা রেখেছিল। পরিস্থিতির অবনতি শুরু হলে অবস্থান পরিবর্তন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়। জার্মানীর একটি রাজ্যে আগস্টের প্রথম দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছিল। জনগণের তীব্র আপত্তির মুখে সরকার শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পূর্বের অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ভারত কোন অবস্থাতেই এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নয়। আমেরিকার কয়েকটি রাজ্য আগস্টে খোলার উদ্যেগ নিয়েছিল। প্রেসিডেন্টের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. স্কট এটলাসের তীব্র আপত্তির মুখে রাজ্যগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে- করোনাভাইরাস একবার সংক্রমিত হলে পরপর একই ব্যক্তিকে অসুস্থ করার ঝুঁকি থাকে। বাচ্চারা প্রথমবার হয়তো শক্তিশালী ইমিউনিটির কারণে অসুস্থ হলো না। এ অবস্থায় জীবাণু শরীরে থেকে যেতে পারে সুপ্ত অবস্থায়। পরবর্তীতে ভাইরাসটি বাচ্চাদের আক্রমণ করবে না এমন নিশ্চয়তা চিকিৎসা বিজ্ঞান দিচ্ছে না। এটি একটি টেকনিক্যাল সমস্যা। এ সমস্যা ভবিষ্যতে প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি সেটি কমিউনিটি বা লোকাল ট্রান্সমিশনে যদি রূপান্তরিত হয় তবে মহাবিপদের কথা। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর চরিত্র পরিবর্তন এখনো সুষ্পষ্ট নয়। দেখা যাচ্ছে ইউরোপে এর চরিত্র বদলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তনের মিল নেই। এই উপমহাদেশে ভাইরাসটির জীনগত বৈশিষ্ট্য বা জিনোম আবিষ্কারের তোড়জোড় চলছে। বিজ্ঞানীরা এখনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি যে, ভবিষ্যতে এসিম্পটমিক অল্প বয়সীরা ভবিষ্যতে আক্রান্ত হবে না। এরূপ অবস্থায় গোটা একটি প্রজন্ম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার বা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই।

একাত্তরে এক বছর লেখাপড়া হয়নি। বায়াত্তরে এসে সবাইকে অটোপ্রমোশন দেয়া হল। বাবা আমাকে সিক্সেই রেখে দিয়েছিলেন। আজকের সব বাবা-মা’দের একই অবস্থা। এখন অভিভাবকরা অনেক বেশি সচেতন। হৈ হৈ করে উপরের ক্লাসে উঠে গেলেই বিদ্যার্জন হয় না। পড়ালেখা করেই বিদ্যার্জন করতে হয়। ভীত শক্ত করতে হয়। কিছু মানুষের মধ্যে অটোপ্রমোশনের ঝোঁক রয়েছে। সর্বনাশা এই ঝোঁক পরিহার করা উচিত, স্বাধীনতা-উত্তর ব্যাপক নকল প্রবণতার ভিত্তি ছিল বাহাত্তরের অটোপ্রমোশন। নকলের মহোৎসব থেকে মুক্তি পেতে দু’দশক সময় লেগেছে। এখন একই ভুলের পুনরাবৃত্তির সুযোগ নেই। আরেকটি বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত না হয়ে অটোপ্রমোশনের চিন্তা মাথা থেকে এক্ষুণি ঝেড়ে ফেলা উচিত। অবশিষ্ট বিশে^র গৃহীত পদক্ষেপের বাইরে যাওয়াও উচিত হবে না। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ সমাজ বিন্যাস মাথায় রাখা উচিত। কিচ্ছু হবে না এক বছর হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিলে বরং এক শতাব্দীর অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করাই হবে অধিকতর শ্রেয়।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

spdey2011@gmail.com

সোমবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৭ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

কোভিড ১৯ : শিক্ষা সংকট ও অটোপ্রমোশন

শঙ্কর প্রসাদ দে

করোনা সংকট মোকাবেলায় গোটা বিশ্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কারাগার ব্যবস্থাপনায় কঠোর রক্ষণশীল পথে হেঁটেছে। বাংলাদেশও প্রশংসনীয়ভাবে এ দুটো জায়গায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তার পথে হেঁটেছে। সুফলও আমরা পেয়েছি। আমাদের কারাগারগুলো আজও সংক্রমণমুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাচ্চাদের, কিশোরদের, যুবকদের মোটামুটি বাড়ি বা আশপাশে আটকে রাখতে পেরেছি। হাতেগোনা কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ত্রিশের নিচেকার ছেলেমেয়েদের সংক্রমণমুক্ত রাখা গেছে- এটা স্পষ্ট। কোভিড-১৯ সংকটে আমাদের বহু ব্যর্থতা ছিল। সীমাবদ্ধতাও ছিল। তবে জাতির পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারা আমাদের সকল ব্যর্থতাকে পুষিয়ে দিয়েছে। কারাগারে গ্রেফতার কার্যক্রম বন্ধ থাকা অর্থাৎ কারাগারে নতুন হাজতি ঢুকতে না দেয়া, কারাগার সাফল্যের মুল কারণ। তেমনি একেবারে শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, ছোটদের মাঝে সংক্রমণ না ঘটার প্রধান কারণ। সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে দুটো প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।

প্রথমত, ৪ অক্টোবর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ঠিক হবে কিনা ? দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করা ঠিক হবে কিনা?

ঈদুল আজহা পরবর্তী সময়ে জনজীবন স্বাভাবিকতায় ফিরছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুটোই বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, টিকা পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯, আমাদের জীবনসঙ্গী হয়ে থাকবে। বলা হচ্ছে, সংক্রমিত রোগীদের পারিবারিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা বাবা আক্রান্ত হবার পরও বাচ্চারা আক্রান্ত হচ্ছে না। অথবা বাচ্চাদের সংক্রমণের হার খুবই নি¤œ। তাহলে এই বাচ্চাগুলো স্কুল কলেজে গেলেওতো ব্যাপকহারে সংক্রমিত না হবারই কথা। এই বিষয়টি নিয়ে এখনো অবধি বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা বা আমাদের বিশেষজ্ঞদের নিকট থেকে সুষ্পষ্ট মতামত পাওয়া যায়নি। যদি বিশেষজ্ঞরা বলতেন অল্পবয়সীদের শক্ত ইমউনিটির কারণে স্কুলে গেলেও তাদের ঝুঁকি নেই, তবে ওইভাবে চিন্তা করা যেত। যেহেতু ওই ধরনের কোন নিশ্চয়তা চিকিৎসা জগৎ থেকে আসেনি, সেহেতু ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ নেই। ছুটির মেয়াদ ডিসেম্বর অবধি বাড়ানোই যুক্তিযুক্ত।

সরকারের একটি বিকল্প চিন্তা শেষ পর্যন্ত টিকবে বলে মনে হয় না। বলা হচ্ছে সামনের কয়েক মাসে কাটছাঁট সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে তুলে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান এক্ষুনি খোলা না গেলে কাটছাঁটের সুযোগ থাকে না; দ্বিতীয়ত, স্বল্প সিলেবাস স্বল্প লেখাপড়া স্বল্প প্রস্তুতি কোনটাই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তাছাড়া এটি হবে নিয়মিত পড়ার উপর একটি অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি। এটি একাধারে মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক থেকে ঘটবে। শিক্ষকদেরও চাপের মধ্যে সবদিক সামাল দিতে হবে। অসম্পূর্ণ এই সিলেবাস, অসম্পূর্ণ লেখাপড়া ছাত্র/ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মানস গঠনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফাউন্ডেশন দুর্বল হলে দালান নড়বড়ে হয়। এক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ দৃঢ়তা, নড়বড়ে হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

পঞ্চম শ্রেণীর পিএসসি এবং অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। কী পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের প্রমোশন দেয়া যায়, তা জানতে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞাদের মতামত চাওয়া হয়েছে। অনেক অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করলাম, শর্টকার্টপন্থায় প্রমোশনের পক্ষে নগরাঞ্চলের কেউ রাজি হচ্ছেন না। অনেকে সরাসরি বলছেন শর্টকার্ট পন্থায় সরকার প্রমোশনের ব্যবস্থা করলেও তারা একই ক্লাসে আবার রেখে দেবেন। এ মনোভাব নীতি নির্ধারকদের নিকট অজানা নয়। বহু- অভিভাবকদের চিন্তাটা হলো যদি ৪ঠা অক্টোবর স্কুল কলেজ খুলেও দেয়া হয় তারা কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলে পাঠাবেন না। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের অভিভাবক এ প্রশ্নে পুরোপুরি রক্ষণশীল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যদি মাস খানেক চলে যায় তবে বাকি থাকে এক থেকে দু’মাস।

বাস্তব অবস্থা সবাই উপলদ্ধি করছেন। এটিই ভালো লক্ষণ। শিক্ষামন্ত্রী সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে, এক বছর ছেলে মেয়েরা না পড়লে মুর্খ হবে না। কিন্তু সংক্রমিত হলে বহু মায়ের বুক খালি হবে। তার এ উক্তি থেকে মনে হচ্ছে সরকারও অন্তত এ বছর স্কুল কলেজ খোলার পক্ষে নন। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিকে স্কুল কলেজ খোলা রেখেছিল। পরিস্থিতির অবনতি শুরু হলে অবস্থান পরিবর্তন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়। জার্মানীর একটি রাজ্যে আগস্টের প্রথম দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছিল। জনগণের তীব্র আপত্তির মুখে সরকার শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পূর্বের অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ভারত কোন অবস্থাতেই এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নয়। আমেরিকার কয়েকটি রাজ্য আগস্টে খোলার উদ্যেগ নিয়েছিল। প্রেসিডেন্টের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. স্কট এটলাসের তীব্র আপত্তির মুখে রাজ্যগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে- করোনাভাইরাস একবার সংক্রমিত হলে পরপর একই ব্যক্তিকে অসুস্থ করার ঝুঁকি থাকে। বাচ্চারা প্রথমবার হয়তো শক্তিশালী ইমিউনিটির কারণে অসুস্থ হলো না। এ অবস্থায় জীবাণু শরীরে থেকে যেতে পারে সুপ্ত অবস্থায়। পরবর্তীতে ভাইরাসটি বাচ্চাদের আক্রমণ করবে না এমন নিশ্চয়তা চিকিৎসা বিজ্ঞান দিচ্ছে না। এটি একটি টেকনিক্যাল সমস্যা। এ সমস্যা ভবিষ্যতে প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি সেটি কমিউনিটি বা লোকাল ট্রান্সমিশনে যদি রূপান্তরিত হয় তবে মহাবিপদের কথা। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর চরিত্র পরিবর্তন এখনো সুষ্পষ্ট নয়। দেখা যাচ্ছে ইউরোপে এর চরিত্র বদলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবর্তনের মিল নেই। এই উপমহাদেশে ভাইরাসটির জীনগত বৈশিষ্ট্য বা জিনোম আবিষ্কারের তোড়জোড় চলছে। বিজ্ঞানীরা এখনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি যে, ভবিষ্যতে এসিম্পটমিক অল্প বয়সীরা ভবিষ্যতে আক্রান্ত হবে না। এরূপ অবস্থায় গোটা একটি প্রজন্ম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার বা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই।

একাত্তরে এক বছর লেখাপড়া হয়নি। বায়াত্তরে এসে সবাইকে অটোপ্রমোশন দেয়া হল। বাবা আমাকে সিক্সেই রেখে দিয়েছিলেন। আজকের সব বাবা-মা’দের একই অবস্থা। এখন অভিভাবকরা অনেক বেশি সচেতন। হৈ হৈ করে উপরের ক্লাসে উঠে গেলেই বিদ্যার্জন হয় না। পড়ালেখা করেই বিদ্যার্জন করতে হয়। ভীত শক্ত করতে হয়। কিছু মানুষের মধ্যে অটোপ্রমোশনের ঝোঁক রয়েছে। সর্বনাশা এই ঝোঁক পরিহার করা উচিত, স্বাধীনতা-উত্তর ব্যাপক নকল প্রবণতার ভিত্তি ছিল বাহাত্তরের অটোপ্রমোশন। নকলের মহোৎসব থেকে মুক্তি পেতে দু’দশক সময় লেগেছে। এখন একই ভুলের পুনরাবৃত্তির সুযোগ নেই। আরেকটি বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত না হয়ে অটোপ্রমোশনের চিন্তা মাথা থেকে এক্ষুণি ঝেড়ে ফেলা উচিত। অবশিষ্ট বিশে^র গৃহীত পদক্ষেপের বাইরে যাওয়াও উচিত হবে না। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ সমাজ বিন্যাস মাথায় রাখা উচিত। কিচ্ছু হবে না এক বছর হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিলে বরং এক শতাব্দীর অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করাই হবে অধিকতর শ্রেয়।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

spdey2011@gmail.com