পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে হবে

অগ্নিকাণ্ড এড়াতে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম স্থাপনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখা হলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাসায়নিক ব্যবসা করে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। টিআইবির ‘নিমতলী, চুড়িহাট্টা এবং অতঃপর পুরান ঢাকার অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি সুশাসনের ঘাটতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান যে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে সেটা স্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে এবং হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো- অতিমাত্রায় দাহ্য পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত বিভিন্ন রাসায়নিকের গুদামগুলো পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কিছুতেই সরানো সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বহু লেখালেখি হয়েছে, বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু রাসায়নিক গুদাম সরানোর ব্যাপারে কোনরকম অগ্রগতি হয়নি। বড় ধরনের কোন অগ্নিকাণ্ডের পর পরই কিছুটা সরব হলেও পরবর্তীতে সব কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর কিছুদিন কেমিক্যাল গুদামগুলো সরাতে অভিযান চালিয়েছিল বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়া এবং অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল।

জানা গেছে, কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা। নানা যুক্তি দেখিয়ে তারা সেখান থেকে কারখানা সরাতে চাচ্ছেন না। টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা স্থাপনে লাইসেন্স প্রদান বা নবায়ন বন্ধ থাকলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে লাইসেন্স বের করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের পরামর্শে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে রাসায়নিক শব্দটি বাদ দিয়ে এন্টারপ্রাইজ হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স বের করে নিচ্ছে। লাইসেন্স বের করা কঠিন হয়ে পড়লে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব ব্যবহার করা হচ্ছে।

যেভাবেই হোক, এ অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্ঘটনার পর যেসব সুপারিশ ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল এতদিনেও তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি- সে রহস্য উন্মোচন করতে হবে। যারা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তারা যত প্রভাবশালীই হোক, আইনের আওতায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে।

আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউনগুলো স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। অনেক সময় গড়িয়েছে, অনেক প্রাণ অকালে ঝরে গেছে, কাজেই আর সময়ক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো পুরান ঢাকা থেকে স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হোক। এ উদ্যোগে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই, আর যেন নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো কোনো অগ্নিকাণ্ড, কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে। এ ব্যাপারে আমরা কোনো অজুহাত শুনতে চাই না- দুটি ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালমুক্ত করতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে- এটাই প্রত্যাশা।

মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৮ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে হবে

অগ্নিকাণ্ড এড়াতে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম স্থাপনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখা হলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাসায়নিক ব্যবসা করে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। টিআইবির ‘নিমতলী, চুড়িহাট্টা এবং অতঃপর পুরান ঢাকার অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি সুশাসনের ঘাটতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান যে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে সেটা স্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে এবং হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো- অতিমাত্রায় দাহ্য পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত বিভিন্ন রাসায়নিকের গুদামগুলো পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কিছুতেই সরানো সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বহু লেখালেখি হয়েছে, বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু রাসায়নিক গুদাম সরানোর ব্যাপারে কোনরকম অগ্রগতি হয়নি। বড় ধরনের কোন অগ্নিকাণ্ডের পর পরই কিছুটা সরব হলেও পরবর্তীতে সব কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর কিছুদিন কেমিক্যাল গুদামগুলো সরাতে অভিযান চালিয়েছিল বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়া এবং অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল।

জানা গেছে, কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা। নানা যুক্তি দেখিয়ে তারা সেখান থেকে কারখানা সরাতে চাচ্ছেন না। টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা স্থাপনে লাইসেন্স প্রদান বা নবায়ন বন্ধ থাকলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে লাইসেন্স বের করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের পরামর্শে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে রাসায়নিক শব্দটি বাদ দিয়ে এন্টারপ্রাইজ হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স বের করে নিচ্ছে। লাইসেন্স বের করা কঠিন হয়ে পড়লে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব ব্যবহার করা হচ্ছে।

যেভাবেই হোক, এ অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্ঘটনার পর যেসব সুপারিশ ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল এতদিনেও তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি- সে রহস্য উন্মোচন করতে হবে। যারা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তারা যত প্রভাবশালীই হোক, আইনের আওতায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে।

আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউনগুলো স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। অনেক সময় গড়িয়েছে, অনেক প্রাণ অকালে ঝরে গেছে, কাজেই আর সময়ক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো পুরান ঢাকা থেকে স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হোক। এ উদ্যোগে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই, আর যেন নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো কোনো অগ্নিকাণ্ড, কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে। এ ব্যাপারে আমরা কোনো অজুহাত শুনতে চাই না- দুটি ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালমুক্ত করতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে- এটাই প্রত্যাশা।