রোহিঙ্গাদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল

দুই সৈনিক ১৮০ জন হত্যায় জড়িত

২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের সময়ে সৈনিকদের প্রতি নির্দেশ ছিল, ‘যাকে দেখবে তাকে গুলি করবে’। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয়ার সময় মায়ানমারের দু’জন সৈনিক একথা বলে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়া দুই সেনা হলেন- মিও উইন তুন (৩৩) এবং জ নায়েং তুন (৩০)। আদালতে তারা ২০১৭ সালে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের সময়ে নারী, শিশুসহ নিরীহ মানুষদের হত্যা, গণকবরে মাটিচাপা দেয়া, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের কথা স্বীকার করে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই স্বীকারোক্তির ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ওই দুই সেনাকে কোর্টের কাছে নিজেদের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে ভবিষ্যতে মামলায় কাজ করবে। আইসিসির বিভিন্ন ধরনের সাক্ষী সুরক্ষার (উইটনেস প্রটেকশন) নিয়ম আছে এবং তার অধীনে এ ধরনের সাক্ষীদের সব ধরনের সুরক্ষা দেয়া হয়। ওই দুই সেনা ১৯ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছে, যারা সরাসরি এ ধরনের নৃশংসতা করেছে। এছাড়া ছয়জন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এসবের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।

ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র এই দু’জন কমপক্ষে ১৮০ জন রোহিঙ্গা হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। মিও উইন তুন স্বীকারোক্তিতে বলে ‘কর্নেল থান থাকি রোহিঙ্গাদের সমূলে হত্যার নির্দেশ দেন। এরপর সেনারা মুসলিমদের কপালে গুলি করে এবং লাথি মেরে কবরে ফেলে দেয়।’ বুথিডং অঞ্চলে কয়েকটি গ্রাম ধ্বংস করা, ৩০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা, এছাড়া আরও ৬০ থেকে ৭০ জন রোহিঙ্গা হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়েও মিও স্বীকারোক্তি দেয়।

জ নায়েং তুন বলে, ‘মংদু টাউনশিপে ২০টি গ্রাম ধ্বংস এবং অন্তত ৮০ জনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এছাড়া, সার্জেন্ট পায়ে ফোয়ে অং এবং কিয়েত ইয়ু পিন তিন জন রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করেছে, যার সাক্ষী আমি।’

মায়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের ভয়াল চিত্র নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশনের রিপোর্টে উঠে আসে, মায়ানমার সেনাদের দ্বারা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নারীদের ব্যাপকহারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেন। এসব অত্যাচার নির্যাতনের জের ধরে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে। সে ঢলের গতি যখন কমে আসে ততদিনে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা ঠাঁই করে নেয় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে।

মায়ানমার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র যেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হয় সেজন্য ওই সময়ে মায়ানমার সরকারের কড়াকড়িতে রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দেখা গেছে, শুধু আগুন আর কালো ধোঁয়া। সেই সঙ্গে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষের ভিড়। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিদারুণ মানবিক সংকটের অন্যতম দৃষ্টান্ত। মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল-হুসেইন এই নিপীড়নকে ‘জাতিগত নির্মূলের এক আদর্শ উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স বিভাগের পরিচালক তিরানা হাসান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মায়ানমার থেকে বিতাড়নের জন্য মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে সুনির্দিষ্টভাবে প্রচারাভিযান চালিয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে জাতিগত নির্মূল বলাটা কোন ভুল নয়। সেখানে ছকে বাধা নিয়মে ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। মায়ানমার সেনাবাহিনী একেকটি গ্রাম প্রথমে ঘিরে ফেলে, পরে মানুষকে গুলি করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। যা আইনি ভাষায় বলে, এটি হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ।’ আইসিসি’তে রোহিঙ্গা গণহত্যাবিষয়ক অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে।

আরও খবর
গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ
প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশনা
পাওয়ার গ্রিডে আগুন, ময়মনসিংহ বিভাগ বিদ্যুৎহীন
মৃত্যু আরও ৩৬ শনাক্ত ১৮২৯ জন
১২ সেপ্টেম্বর থেকে ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে বিক্রি
একাদশ শ্রেণীতে সর্বোচ্চ ভর্তি ফি ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ
‘চুরি করতে গিয়ে ইউএনও’র ওপর হামলা বিশ্বাসযোগ্য নয়’
তদন্ত প্রতিবেদন ৭৪ বারের মতো পেছালো
বরিশালে দুই পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত
মিলল আরও একটি লিকেজ
দেড়মাস পর রহস্য উদ্ঘাটন, খুনি বাবা-দাদা ও সৎমাসহ ৪ জন গ্রেফতার
ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতন মামলা
মৃতের সংখ্যা ২৮, চিকিৎসাধীন ৮ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক

বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৯ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

আইসিসিতে মায়ানমারের দুই সৈনিকের স্বীকারোক্তি

রোহিঙ্গাদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল

দুই সৈনিক ১৮০ জন হত্যায় জড়িত

সংবাদ ডেস্ক |

২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের সময়ে সৈনিকদের প্রতি নির্দেশ ছিল, ‘যাকে দেখবে তাকে গুলি করবে’। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয়ার সময় মায়ানমারের দু’জন সৈনিক একথা বলে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়া দুই সেনা হলেন- মিও উইন তুন (৩৩) এবং জ নায়েং তুন (৩০)। আদালতে তারা ২০১৭ সালে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের সময়ে নারী, শিশুসহ নিরীহ মানুষদের হত্যা, গণকবরে মাটিচাপা দেয়া, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের কথা স্বীকার করে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই স্বীকারোক্তির ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ওই দুই সেনাকে কোর্টের কাছে নিজেদের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে ভবিষ্যতে মামলায় কাজ করবে। আইসিসির বিভিন্ন ধরনের সাক্ষী সুরক্ষার (উইটনেস প্রটেকশন) নিয়ম আছে এবং তার অধীনে এ ধরনের সাক্ষীদের সব ধরনের সুরক্ষা দেয়া হয়। ওই দুই সেনা ১৯ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছে, যারা সরাসরি এ ধরনের নৃশংসতা করেছে। এছাড়া ছয়জন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এসবের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।

ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র এই দু’জন কমপক্ষে ১৮০ জন রোহিঙ্গা হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। মিও উইন তুন স্বীকারোক্তিতে বলে ‘কর্নেল থান থাকি রোহিঙ্গাদের সমূলে হত্যার নির্দেশ দেন। এরপর সেনারা মুসলিমদের কপালে গুলি করে এবং লাথি মেরে কবরে ফেলে দেয়।’ বুথিডং অঞ্চলে কয়েকটি গ্রাম ধ্বংস করা, ৩০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা, এছাড়া আরও ৬০ থেকে ৭০ জন রোহিঙ্গা হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়েও মিও স্বীকারোক্তি দেয়।

জ নায়েং তুন বলে, ‘মংদু টাউনশিপে ২০টি গ্রাম ধ্বংস এবং অন্তত ৮০ জনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এছাড়া, সার্জেন্ট পায়ে ফোয়ে অং এবং কিয়েত ইয়ু পিন তিন জন রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করেছে, যার সাক্ষী আমি।’

মায়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের ভয়াল চিত্র নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশনের রিপোর্টে উঠে আসে, মায়ানমার সেনাদের দ্বারা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নারীদের ব্যাপকহারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেন। এসব অত্যাচার নির্যাতনের জের ধরে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে। সে ঢলের গতি যখন কমে আসে ততদিনে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা ঠাঁই করে নেয় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে।

মায়ানমার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র যেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হয় সেজন্য ওই সময়ে মায়ানমার সরকারের কড়াকড়িতে রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দেখা গেছে, শুধু আগুন আর কালো ধোঁয়া। সেই সঙ্গে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষের ভিড়। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিদারুণ মানবিক সংকটের অন্যতম দৃষ্টান্ত। মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল-হুসেইন এই নিপীড়নকে ‘জাতিগত নির্মূলের এক আদর্শ উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স বিভাগের পরিচালক তিরানা হাসান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মায়ানমার থেকে বিতাড়নের জন্য মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে সুনির্দিষ্টভাবে প্রচারাভিযান চালিয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে জাতিগত নির্মূল বলাটা কোন ভুল নয়। সেখানে ছকে বাধা নিয়মে ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। মায়ানমার সেনাবাহিনী একেকটি গ্রাম প্রথমে ঘিরে ফেলে, পরে মানুষকে গুলি করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। যা আইনি ভাষায় বলে, এটি হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ।’ আইসিসি’তে রোহিঙ্গা গণহত্যাবিষয়ক অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে।