ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় অর্থনীতি

রেজাউল করিম খোকন

মানব সভ্যতার সূচনালগ্নে থেকে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে, বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন দেশে নানা বিপর্যয় নেমে এসেছে। এক সঙ্গে গোটা বিশ্বে মহাবিপর্যয় নেমে আসার ঘটনা এবারই প্রথমে প্রত্যক্ষ করছে পৃথিবীর সব মানুষ। কভিড-১৯ নামের মরণঘাতী এক ভাইরাসের প্রকোপে আজ সারা প্রকম্পিত। ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়া আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে প্রায় ৭.৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। গোটা বিশ্বে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি। আমাদের বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যা ৩৫০০ জন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। চরম অনিশ্চয়তা, ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক এখনও সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তেমন পরিস্থিতিতেও অফিস, আদালত খুলে দেয়া হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শপিং মল, মার্কেট, দোকানপাট, কলকারখানা চালু হয়েছে।

করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রকোপে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছে। দীর্ঘ বেশ কয়েক মাস একটানা সরকারি ছুটি, নিয়ন্ত্রিত চলাচল ও নানা বিধি নিষেধের কারণে ব্যবসা -বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হলেও হালে ধীরে ধীরে তা আবার গতিশীল হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী এই মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেন, পর্যটন, বিনোদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাংক-বিমা খাত সংকুচিত হয়ে এবং কলকারখানার উৎপাদন আগের চেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কমে অর্থনীতিতে চরম হুমকি সৃষ্টি করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে, করোনার ভয়াবহ হুমকি উপেক্ষা করে জীবনের তাগিদে মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তার ক্ষতি কাটিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার নতুন লড়াই শুরু করেছে ইতিমধ্যে। যার প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গতি বাড়ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন শহরে, জেলায়, উপজেলায় দোকানপাট খুলেছে। দোকানপাট, মার্কেট, শপিং মল আগের মতো স্বাভাবিক সময়সীমায় খোলা থাকছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য ভাব ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঘুরতে শুরু করেছে শিল্প কারখানার চাকা। বাড়তে শুরু করেছে উৎপাদন ও রপ্তানি আয়। একটানা দীর্ঘ কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের শিল্প কারখানা এখন আবার সচল হওয়ায় শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা কর্মচঞ্চল হয়ে এঠেছেন। তাদের মনে চেপে বসা অনিশ্চয়তার বোঝা ও হতাশা কেটে যাচ্ছে ক্রমেই। আশার বিষয় হলো, মার্চ-এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাপী লকডাউন চলাকালীন সময়ে বাতিল বা স্থগিত হওয়া রপ্তানি আদেশের ৮০ শতাংশ এর মধ্যেই ফিরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসা বাড়াতে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। করোনা প্রকোপের কারণে সৃষ্ট স্থবির অবস্থায় কাঁচামালের অভাবে যে সব কলকারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছিল সেগুলো বর্তমানে আবার চালু হয়েছে কাঁচামাল প্রাপ্যত্যার সুবাদে। অনেক ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ লোকসানের মুখে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে ব্যবসার ধরন পাল্টেছেন। যা তাদের জন্য অনুকুল ফলাফল বয়ে আনতেও শুরু করেছে। এই মহামারীতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে ওঠাটা রাতারাতি সম্ভব নয়। এ জন্য সময় প্রয়োজন। করোনার ভয়াবহ আতঙ্ক কবে পুরোপুরি কাটবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে জীবন ও জীবিকার তাগিদে এবং দেশের সামগ্রিক ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে আগের স্বাভাবিক সমৃদ্ধ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। গত ছয় সাত মাসের অচলাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যারা পুঁজি হারিয়েছেন, তারা নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগের কথা ভাবতে শুরু করেছেন। আজকাল যারা আবার দোকানপাট খুলে আবার ব্যবসা শুরু করেছেন তাদের গত কয়েক মাসের দোকান ভাড়া বিদ্যুৎ বিল বাকি পড়ে আছে। বর্তমানে বেচাকেনা কম থাকলেও বেশি লাভ করার মানসিকতা ত্যাগ করে কাস্টমার পেলে কম লাভে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করছেন তারা। বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে শিল্প উৎপাদন শুরু করেছেন। মহামারীর কারণে স্থগিত হওয়া ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ আবার শুরু হয়েছে। সুদের চাকাও ঘুরতে শুরু করেছে। ফলে অলসভাবে সব কিছু বন্ধ করে বসে থাকায় উপায় নেই, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বকেয়া রাখার সুযোগও নেই। শিল্প খাতেও গতির সঞ্চার হয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে আকাশ পথ খুলে দেয়ায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও চলছে পুর্ণ উদ্যমে। ব্যাংকগুলোতে নতুন করে এলসি খোলা শুরু হয়েছে। তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির খরা কাটেনি। আশা করা যায়, ধীরে ধীরে বন্ধ থাকা বাকি কল-কারখানাগুলো চালু হলে এবং নতুন শিল্প কারখানায় উৎপাদন শুরু করলে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার হারও বাড়বে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও রিসোর্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকার চালুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা পর্যটন শিল্পে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। ধীরে ধীরে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে শুরু করলে আমাদের পর্যটন ব্যবসায় প্রাণ ফিরে আসবে। ইতোমধ্যে পর্যটন খাতে বিরাট ধস নেমেছে করোনার প্রকোপে। এই ধস কাটিয়ে উঠতে সময়োপযোগী নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসতে চাইছেন এ খাতের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। করোনা মহামারি শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। শুধু তাই নয়, প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন গত দুই মাসে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা ইতোমধ্যে ৩৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামলেও জুন মাস থেকে দেশের রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করেছে। গত বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের খাদ্য পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক, তবে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আগামী দিনগুলোতে কিছুটা সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় চাল আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন, যা সবাইকে আশ্বস্ত করেছে। খাদ্য সংকট নিয়ে যে অস্বস্তি দানা বাধছিল তা কেটে গেছে প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞোচিত নির্দেশনায়। করোনা মহামারিতে অনেক দেশ খাদ্য সংকটে পড়লেও বাংলাদেশ তেমন পরিস্থিতিতেও খাদ্য সংকটে পড়েনি, সেটাই হলো বড় প্রাপ্তি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে, তার আর্থিক পরিমাণ ১২ ট্রিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে। বাংলাদেশেও টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে করোনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। এ ক্ষতি খুব তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ওঠা হয়তো সহজ হবে না। তবে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে ধারণা করা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, সাধারণ কর্মজীবী মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রচেষ্টা সব বিপর্যয় কাটিয়ে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : ব্যাংকার]

বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৯ মহররম ১৪৪২, ২১ ভাদ্র ১৪২৭

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় অর্থনীতি

রেজাউল করিম খোকন

মানব সভ্যতার সূচনালগ্নে থেকে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে, বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন দেশে নানা বিপর্যয় নেমে এসেছে। এক সঙ্গে গোটা বিশ্বে মহাবিপর্যয় নেমে আসার ঘটনা এবারই প্রথমে প্রত্যক্ষ করছে পৃথিবীর সব মানুষ। কভিড-১৯ নামের মরণঘাতী এক ভাইরাসের প্রকোপে আজ সারা প্রকম্পিত। ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়া আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে প্রায় ৭.৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। গোটা বিশ্বে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি। আমাদের বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যা ৩৫০০ জন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। চরম অনিশ্চয়তা, ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক এখনও সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তেমন পরিস্থিতিতেও অফিস, আদালত খুলে দেয়া হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শপিং মল, মার্কেট, দোকানপাট, কলকারখানা চালু হয়েছে।

করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রকোপে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছে। দীর্ঘ বেশ কয়েক মাস একটানা সরকারি ছুটি, নিয়ন্ত্রিত চলাচল ও নানা বিধি নিষেধের কারণে ব্যবসা -বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হলেও হালে ধীরে ধীরে তা আবার গতিশীল হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী এই মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেন, পর্যটন, বিনোদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাংক-বিমা খাত সংকুচিত হয়ে এবং কলকারখানার উৎপাদন আগের চেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কমে অর্থনীতিতে চরম হুমকি সৃষ্টি করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে, করোনার ভয়াবহ হুমকি উপেক্ষা করে জীবনের তাগিদে মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তার ক্ষতি কাটিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার নতুন লড়াই শুরু করেছে ইতিমধ্যে। যার প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গতি বাড়ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন শহরে, জেলায়, উপজেলায় দোকানপাট খুলেছে। দোকানপাট, মার্কেট, শপিং মল আগের মতো স্বাভাবিক সময়সীমায় খোলা থাকছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য ভাব ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঘুরতে শুরু করেছে শিল্প কারখানার চাকা। বাড়তে শুরু করেছে উৎপাদন ও রপ্তানি আয়। একটানা দীর্ঘ কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের শিল্প কারখানা এখন আবার সচল হওয়ায় শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা কর্মচঞ্চল হয়ে এঠেছেন। তাদের মনে চেপে বসা অনিশ্চয়তার বোঝা ও হতাশা কেটে যাচ্ছে ক্রমেই। আশার বিষয় হলো, মার্চ-এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাপী লকডাউন চলাকালীন সময়ে বাতিল বা স্থগিত হওয়া রপ্তানি আদেশের ৮০ শতাংশ এর মধ্যেই ফিরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসা বাড়াতে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। করোনা প্রকোপের কারণে সৃষ্ট স্থবির অবস্থায় কাঁচামালের অভাবে যে সব কলকারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছিল সেগুলো বর্তমানে আবার চালু হয়েছে কাঁচামাল প্রাপ্যত্যার সুবাদে। অনেক ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ লোকসানের মুখে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে ব্যবসার ধরন পাল্টেছেন। যা তাদের জন্য অনুকুল ফলাফল বয়ে আনতেও শুরু করেছে। এই মহামারীতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে ওঠাটা রাতারাতি সম্ভব নয়। এ জন্য সময় প্রয়োজন। করোনার ভয়াবহ আতঙ্ক কবে পুরোপুরি কাটবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে জীবন ও জীবিকার তাগিদে এবং দেশের সামগ্রিক ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে আগের স্বাভাবিক সমৃদ্ধ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। গত ছয় সাত মাসের অচলাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যারা পুঁজি হারিয়েছেন, তারা নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগের কথা ভাবতে শুরু করেছেন। আজকাল যারা আবার দোকানপাট খুলে আবার ব্যবসা শুরু করেছেন তাদের গত কয়েক মাসের দোকান ভাড়া বিদ্যুৎ বিল বাকি পড়ে আছে। বর্তমানে বেচাকেনা কম থাকলেও বেশি লাভ করার মানসিকতা ত্যাগ করে কাস্টমার পেলে কম লাভে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করছেন তারা। বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে শিল্প উৎপাদন শুরু করেছেন। মহামারীর কারণে স্থগিত হওয়া ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ আবার শুরু হয়েছে। সুদের চাকাও ঘুরতে শুরু করেছে। ফলে অলসভাবে সব কিছু বন্ধ করে বসে থাকায় উপায় নেই, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বকেয়া রাখার সুযোগও নেই। শিল্প খাতেও গতির সঞ্চার হয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে আকাশ পথ খুলে দেয়ায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও চলছে পুর্ণ উদ্যমে। ব্যাংকগুলোতে নতুন করে এলসি খোলা শুরু হয়েছে। তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির খরা কাটেনি। আশা করা যায়, ধীরে ধীরে বন্ধ থাকা বাকি কল-কারখানাগুলো চালু হলে এবং নতুন শিল্প কারখানায় উৎপাদন শুরু করলে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার হারও বাড়বে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও রিসোর্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকার চালুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা পর্যটন শিল্পে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। ধীরে ধীরে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে শুরু করলে আমাদের পর্যটন ব্যবসায় প্রাণ ফিরে আসবে। ইতোমধ্যে পর্যটন খাতে বিরাট ধস নেমেছে করোনার প্রকোপে। এই ধস কাটিয়ে উঠতে সময়োপযোগী নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসতে চাইছেন এ খাতের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। করোনা মহামারি শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। শুধু তাই নয়, প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন গত দুই মাসে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা ইতোমধ্যে ৩৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামলেও জুন মাস থেকে দেশের রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করেছে। গত বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের খাদ্য পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক, তবে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে আগামী দিনগুলোতে কিছুটা সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় চাল আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন, যা সবাইকে আশ্বস্ত করেছে। খাদ্য সংকট নিয়ে যে অস্বস্তি দানা বাধছিল তা কেটে গেছে প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞোচিত নির্দেশনায়। করোনা মহামারিতে অনেক দেশ খাদ্য সংকটে পড়লেও বাংলাদেশ তেমন পরিস্থিতিতেও খাদ্য সংকটে পড়েনি, সেটাই হলো বড় প্রাপ্তি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে, তার আর্থিক পরিমাণ ১২ ট্রিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে। বাংলাদেশেও টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে করোনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। এ ক্ষতি খুব তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ওঠা হয়তো সহজ হবে না। তবে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে ধারণা করা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, সাধারণ কর্মজীবী মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রচেষ্টা সব বিপর্যয় কাটিয়ে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : ব্যাংকার]