সোনার কলম

হাসান অরিন্দম

আজ ঢাকায় না গেলেই নয়। গতকাল দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে এসেও মন না-টানায় সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। আজ মন না চাইলেও যেতে হবে। ব্যবসাটা তো তার নিজেরই, এমনিতে গত তিন মাসে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। বাইরে কাজ করার জন্য একজন কর্মচারী ছিল, লস কমিয়ে আনতে ছয় মাসের জন্য ওকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে।

সোহানের জন্মের আগে থেকেই ওর মা হার্টের সমস্যাসহ নানান রোগেশোকে ভুগছিলেন। তাই বছর-খানেক বয়স না-হতেই দাদি ওর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। মা-র স্মৃতি অস্পষ্ট, কারণ সোহানের বয়স পাঁচ হওয়ার দুমাস আগে মা প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগে ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত দাদিই ছিলো তার প্রধান অবলম্বন, দাদিকে ছাড়া সে কিছুই বুঝতো না। স্নান-আহার-নিদ্রা সবকিছুতেই দাদিকে লাগতো। সেই দাদির অসুস্থতার খবর শুনে মহামারী-দুর্যোগের মধ্যেও সে ছুটে এসেছিল বাড়িতে। সোহান আসার দুদিন পরই দাদি মারা গেলেন একাশি বছর বয়সে।

সে তিনশ টাকার টিকেট সাড়ে পাঁচশ টাকায় কিনে হাইচয়েস নামক নীল রঙের বাসে জানালার ধারে একটা সিট নেয়। বিয়াল্লিশ সিটের গাড়িতে অবশ্য মাত্র চব্বিশ জন যাত্রী তোলা হয়েছে দেখে সে খানিকটা স্বস্তি পায়। দুবার হর্ন দিয়ে এগারোটা আটত্রিশ মিনিটে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভার বাসটা ছাড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস শহর ছেড়ে যখন সবুজ মাঠের ভেতরকার সর্পিল কালো রাস্তা দিয়ে চলা শুরু করল তখন সদ্য মৃত দুজন মানুষের মুখ মনে পড়ায় সোহানের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। দাদি অবশ্য পরিণত বয়সেই গিয়েছেন, তিনি সহজ-সাদা মানুষ ছিলেন- তার পরলোক নিশ্চয়ই কল্যাণময়ই হবে। কিন্তু অন্য মৃত্যুটা মেনে নেয়া যায় না।

সোহান বাড়িতে এসেছিল ৩ তারিখ, দাদি ৫ তারিখ মাগরিবের আজানের খানিক পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মারা গেলেন। আর এই ঘটনাটা ৯ তারিখ অর্থাৎ সোমবার দিবাগত রাতের। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির সোহানের মাছ ধরার নেশা। পুকুর ছাড়াও ওদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের দোয়ায় গিয়ে অনেক মাছ ধরেছে। সোহান রাতে টিনের চালের নিচে বাইরের ঘরে শুয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো কে যেন বাইরে থেকে শেকল নাড়াচ্ছে। একবার মনে হলো বোধ হয় ঝড়ো বাতাসে নড়েছে। পরে আবারো শব্দ হলে সে ‘কে?’ বললে জবাব আসে, ‘আমি তাহসিন, চল মাছ ধরতে যাই।’

তাহসিন তার ছেলেবেলার বন্ধু, গ্রামের বেশ ধনী পরিবারের ছেলে। স্কুল থেকে আইএ ক্লাস পর্যন্ত একসাথে পড়েছে। পরে সোহান যখন বিশ^বিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তাহসিন তখন অস্ট্রিয়া চলে যায়। তাহসিনকে নিয়ে সোহান বহুবার পুকুরে-খালে-দোয়ায় মাছ ধরেছে। সে বালিশের পাশা রাখা মোবাইল টিপে দেখে রাত দুটো বায়ান্ন। দূরে কোথাও তক্ষক ডাকছে, এতো রাতে ও কোত্থেকে? ও যে দেশে এসেছে তা-ই তো জানে না সোহান। ওর নামটাও এ কদিনে কারো কাছে শুনেছে বলে মনে পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে বলে, ‘তুই এতো রাতে- কোত্থেকে এলি?’

বাইরে থেকে উত্তর আসে, ‘আজই সন্ধ্যায়। তুই আমার প্রাণের দোস্ত তাই খুব দেখতে ইচ্ছে হলো।’

অন্য কেউ হলে সোহান নিশ্চিত রেগে গিয়ে বলত, এত রাতে কেউ কারো বাড়িতে আসে। যা এখন! কিন্তু এতোদিন পর প্রবাসী বন্ধু তার দরজায় কড়া নাড়ছে। রাতদিন যা-ই হোক সে নাখোশ হয় কী করে? সোহান দরজা খুলে দেখে সত্যিই জলজ্যান্ত তাহসিন সামনে দাঁড়িয়ে। ওর পরনে দামী পোশাক, গা দিয়ে ফুরফুর করে দামী পারফিউম সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, দেখতে-শুনতে আরও স্মার্ট হয়েছে। হবেই তো- ইউরোপের উন্নত একটি দেশের বাসিন্দা সে।

‘আয়, ভেতরে এসে বস।’

‘না, ভেতরে যাব না, চল দোয়ায় যাই। বাইরে চমৎকার পরিবেশ। আজ আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ, তবে মহাশূন্য জুড়ে কোটি তারার মেলা।’

সোহান বাইরে তাকিয়ে দেখে আবছা অন্ধকারে মৃদুমন্দ বাতাসে নারকেল, মেহগনি, দেবদারু গাছগুলো দুলছে। সে-সবের উপরে অজস্র তারায় আকাশটা ঝিকমিক করছে। সে স্যান্ডো গেঞ্জির উপর লিনেনের একটা শার্ট চড়াতে চড়াতে বলে, ‘আমার কাছে ছিপ-জাল কিছুই তো নেই। কত দিন মাছটাছ ধরি না। মনে হয় আব্বার কাছে একটা জাল থাকতে পারে।’

‘লাগবে না, ওসব আমার আছে, চল তুই।’ সুবোধ বালকের মতো সোহান তাহসিনের পেছন-পেছন হাঁটতে শুরু করে।

‘তোর সাথে আজ বোধ হয় পাঁচ বছর পরে দেখা। তা ওখানে কেমন আছিস?’

‘হ্যাঁ, চার বছর নয় মাস পরে বাড়ি এলাম। আসলে ওসব দেশ তো এখানকার মতো নয়, ওরা সিস্টেমেটিক ওয়েতে চলে, যেখানেই যাবি সবকিছু পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি, আমার ভালো লাগে।’

‘তুই ওখানে কী কাজ করিস?’

‘গত চার বছর পড়াশোনার পাশাপাশি হোটেলে কাজ করতাম। টেলিফোনে বা অনলাইনে খাবারের যে অর্ডার আসত তা পৌঁছে দেয়ার কাজ ছিল আমার। ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। আমার মাস্টার্স শেষ, এবার গিয়ে একটা স্কুলে সোশাল সায়েন্সের এসিস্ট্যান্ট

টিচার পদে জয়েন করব। তা তোর ব্যবসার কী অবস্থা?’

‘দু মাস চায়না থেকে মাল আসা পুরোপুরি বন্ধ ছিলো। আগামী সপ্তাহে আবার চালু হবে। আমি অবাক হচ্ছি তুই এই করোনার মধ্যে এলি কী করে?’

‘আমার যে-উপায় জানা আছে- আমার আসা কেউ আটকাতে পারে না।’

‘মানে?’

‘মানে কিছু নয়, পরে বুঝবি।’

ওরা যখন বসতি এলাকা ছেড়ে গাছঘেরা নির্জন রাস্তায় এসে উঠেছে তখন সোহান খেয়াল করে তাহসিন খুব দ্রুত আর মসৃণ গতিতে হাঁটছে। আর সে বার বার পেছনে পড়ে যাচ্ছে। সে না বলে পারে না ‘অত জোরে হাঁটছিস কী করে? তোর পায়ে কী চাকা লাগানো?’

‘ও তাই? ঠিক আছে এইতো আস্তে হাঁটছি। আচ্ছা তুই এই কলম আর এই প্যাকেটটা রাখ।’

‘প্যাকেটে কী?’

‘চকোলেট। অস্ট্রিয়া থেকে এনেছি কিছু। রেখে দে, পরে ভুলে যাব।’

কলমটা পকেটে রাখবার সময় আলো-আঁধারিতে ওর চকচকে সোনালি ভাবটা টের পাওয়া যায়। ওরা দুজন কথা বলতে বলতে মিনিট-বিশেকের মধ্যে দোয়ার কাছে চলে এলে কাদাপানি আর নানান জলজ উদ্ভিদের পরিচিত গন্ধটা পাওয়া যায়। ওদেরকে দেখে একজোড়া শেয়াল দৌড়ে পালাল। দোয়ার চারদিকে অনেক খেজুরগাছ, আশপাশে কতক আকাশছোঁয়া তালগাছও আছে।

সোহান বলে, ‘কই তোর এখানে তো মাছ ধরার যন্ত্রপাতি কিছুই দেখছি না।’

‘তুই দাঁড়া। দেখ আমি কীভাবে মাছ ধরি।’ বলে তাহসিন জলাশয়ের কূলে বসে ডান হাত জলের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়ার কয়েক সেকে- পরে পানির মধ্যে মাছের ছটফটানি টের পাওয়া যায়। সোহান অবাক না হয়ে পারে না। এভাবে এত সহজে মাছটা ধরে ফেলল? সম্ভবত কূলে এসে মাছটা ঘুমাচ্ছিল। তাহসিন ওটা সোহানের দিকে ছুঁড়ে দিলে সে খেয়াল করে প্রায় এক পোয়া ওজনের একটা পাকা মাগুর মাছ। তাহসিন আবার জলের মধ্যে হাত ডুবালে সোহান না বলে পারে না, ‘তুই ভাবছিস বসে থেকে আবারও মাছ পাবি- মাছ ধরা এতো সোজা নয় বন্ধু।’

ওর মুখে কোনো কথা নেই। জলের মধ্যে আবারও মাছ আর মানুষের হাতের ধস্তাধস্তি টের পাওয়া যায়। ও মাছটা তুলে বলে, ‘এই দেখ। আমি এখন এভাবেই মাছ ধরি।’ সোহান হঠাৎ খেয়াল করে তাহসিনের দু চোখ দিয়ে যেন লালচে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। ‘আমি এখন’- এই শব্দজোড়া রহস্যের গন্ধমাখা সোহানের তা বুঝতে বাকি থাকে না। তার মনে হয় সে যেন ঘুমের ঘোরে ভুল বা অলৌকিক কিছু দেখছে। কিন্তু নিজের গায়ে চিমটি কেটে ব্যথা পেলে নিশ্চিত হয় সে অন্তত স্বপ্ন দেখছে না। সোহান তখন দেখে তালগাছের মাথায় আলোর মতো কী যেন জ¦লছে, আলোটা এগাছ থেকে ওগাছে যাচ্ছে উল্কার মতো। হঠাৎ অদ্ভুত একটা আওয়াজে সে নিচে দৃষ্টি ফিরিয়ে আলো-আঁধারিতে দেখতে পায় তাহসিন কাঁচা মাছটা গপগপ করে খাচ্ছে। ওর ঠোঁটে রক্তের নিশানা, চোখে লালচে আলোর জ্যোতি বেড়েছে। একি তার সেই বাল্যবন্ধু তাহসিনই? হঠাৎ ভয়ে সোহানের শরীর হিম হয়ে আসে। তার মুখ দিয়ে কথা সরে না, জিভ শুকিয়ে কাঠ। পকেটে মোবাইল ফোন থাকলেও তার সতর্ক মন বলে দেয়, তুমি এভাবে কাউকে না-বলে এত রাতে বেরিয়ে ভুল করেছ, একবার বাবাকে বলে আসা উচিৎ ছিল। এখন এর গায়ে মোবাইলের আলো ফেললে মহাবিপদ ঘনিয়ে আসতে সময় লাগবে না, মুহূর্তে রূপ বদলে ঘাড় মটকে তোমার রক্ত খেতে কতক্ষণ? সোহান জানে এ-রকম সময় আগুন খুব কাজে লাগে। আদিম কাল থেকে মানুষ আগুনের সাহায্যেই হিংস্র পশু আর ছদ্মবেশী অপশক্তির ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। সে পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেট বের করে কাঁপা-কাঁপা হাতে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে। তারপর পেছনে না-তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরে। প্রথম কিছুক্ষণ স্বাভাবিকভাবে হাঁটে, তারপর প্রায় দৌড়ের ভঙ্গিতে হেঁটে ঘরে গিয়ে ভীষণ হাঁপাতে থাকে।

সোহান আর রফিক দু’রুমের একটা বাসা নিয়ে ঢাকার রাজাবাজার এলাকায় থাকে। লালমনিরহাটের রফিক বাড়ি থেকে ফিরবে আরও এক সপ্তাহ পর, ততদিন রান্নার খালারও ছুটি। এ কদিন হয় বাইরে খেতে হবে নইলে নিজে রান্না করতে হবে। ফেরিঘাটে জ্যাম থাকায় আসতে বেশ বিলম্ব হয়। গাবতলি থেকে বাসায় ফেরার সময় আসাদ গেটের কাছে একটা হোটেল থেকে রাত নয়টার দিকে রুটি আর কাবাব খেয়ে নেয়। ঘরে ফিরে খানিক জিরিয়ে নিয়ে ¯œানঘরে ঢোকে। আধভেজা শরীরে ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় বের করার সময় মনে পড়ে সেই কলম আর চকোলেটগুলোর কথা। কাপড় বদলে ব্যাগ থেকে ওগুলো বের করে নাড়াচাড়া করবার সময় ভয় ভয় লাগে।

সোমবার ওই মাছধরা কাণ্ডের পর সে যখন ঘরে ফেরে। তার মিনিট-কুড়ি পরেই মসজিদের আজান শোনা গিয়েছিল। তারপর সোহান আর ঘুমাতে পারেনি। সেই সময় থেকেই রহস্যের জট খুলবার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে থাকে। সে ভাবে তাহসিনদের বাড়িতে গেলেই হয়তো অনেককিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেখানে যেতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। সে নাস্তা সেরে রওনা হয়েছিল ওদের বাড়ি যাবে বলে। পথে আনিসের সঙ্গে দেখা। আনিস বলে, ‘কোথায় চললি এই সকাল বেলা?’

‘তাহসিনের কোনো খবর জানিস? ওদের বাড়ির দিকে একটু যাচ্ছিলাম।’

‘কেন তুই জানিস না কিছু?’

‘কী বল তো?’

‘খবর এসেছে পরশু, ও তিন সপ্তাহ আগেই ভিয়েনাতে করোনা হয়ে মারা যায়। সেখান থেকে ডেডবডি পাঠাবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওখানেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় মুসলিম কায়দায় দাফন হয়েছে। আমি পরশুই গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। ওর মা খবর শুনে বার বার কেবল মূর্ছা যাচ্ছিল। তুই যাবি এখন?’

‘না, থাক। খবরটা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এখন গিয়েইবা কী করব?’

তাহসিনের মৃত্যু-সংবাদ সোহানকে তাৎক্ষণিকভাবে ভীষণ বিমর্ষ করে তোলে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার চেয়ে যে-বড় একটি ঘটনা তার মগজের ভেতরকার রক্তপ্রবাহকে আন্দোলিত করে তোলে তা হলো গতকাল শেষরাতের ঘটনা। ওর মুখে এসে গিয়েছিল, ‘কিন্তু গত রাতে যে আমাকে ও ডাকল?’ তবে তখনই সোহান বুঝতে পারে এ-প্রসঙ্গ ওর কাছে তোলা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। এগুলো খুব স্পর্শকাতর বিষয়, গোপনে সূক্ষ্মবুদ্ধি দিয়ে এর সমাধান খুঁজতে হবে।

সোহান ব্যাগের পকেট থেকে কলম আর চকোলেটগুলো বের করে। ওগুলো থেকে কেমন অদ্ভুত সুবাস বেরুচ্ছে। কিন্তু চকোলেট খুলে মুখে দেয়ার সাহস হয় না, কে জানে ওর মধ্যে কী আছে? ও কলমটা খুলবার সময় এর ওজন আর চাকচিক্য দেখে বুঝতে পারে এটা হয়তো দামি কোনো মেটালে তৈরি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা কুড়ি। তার কেমন ভয় ভয় করতে থাকে। একা বাড়িতে ঘুম আসবে কিনা এই আশঙ্কায় সে একটা রিভোট্রিল ট্যাবলেট খেয়ে নেয়। ভাগ্য ভালো, কোনো গভীর আশঙ্কায় রাতটা নির্ঘুম কাটে না। ফজরের আজানের সময় ঘুম ভাঙলে পৌনে পাঁচ ঘণ্টার ঘুমেই সে বিশেষ সন্তুষ্ট থাকে। সাতটা থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে ব্যবসার হিসেবপত্রগুলো মিলায়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাইরে বেরোনোর সময় কলমটা নিয়ে বের হয়। চায়না থেকে এক্সপোর্ট কোম্পানির প্রতিনিধি কিম জিয়ং জানিয়েছে ওরা যে মাল পাঠিয়েছে তা সোহান কাল যেন গুলশান থেকে রিসিভ করে। আজ মতিঝিল আর জনসন রোডে দুটো মেশিন দেখে আসতে হবে। ঠিক না হলে নতুন মেশিন দিতে হবে। কলমটা নিয়ে গ্রিনরোডে একটা দোকানে দেখালে ওরা বেশ খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে। বলে, ‘মেটালটা দামি হতে পারে। আপনি বরং একবার জুয়েলারি দোকানে দেখান।’

মিনিট-দশেক হাঁটার পর একটা জুয়েলারি দোকানের সন্ধান পেয়ে গ্লাস ঠেলে ভেতরে ঢুকে সোহান বলে, ‘এই কলমের মেটালটা একটু দেখবেন প্লিজ?’

‘আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?’

‘অস্ট্রিয়া থেকে আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছে। লেখা আছে মেইড ইন জার্মান।’

ক্যাশে বসে থাকা তাগড়া লোকটা তার কারিগরের কাছে কলমটা এগিয়ে দিলে সে প্রথমে একটা রেত দিয়ে ওটা ঘঁষে। তারপর সোহানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এটা যাচাই করতে গেলে স্পট পড়তে পারে।’

‘তা পড়ুক। আপনি দেখুন।’

মিনিট-তিনেক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর কাঁচাপাকা চুলের লোকটি জানায়, ‘ক্যাপ আর বডির বাইরের অংশ গোল্ড, টুয়েন্টি ওয়ান ক্যারেট বোধহয়।’

‘সবমিলিয়ে কতখানি গোল্ড আছে?’

‘এভাবে তো বলা মুশকিল, এসিডে না দিলে বোঝা যাবে না।’

‘তবু এর একটা আনুমানিক মূল্য যদি বলতেন।’

‘এক লাখ বিশ হাজার হতে পারে।’

টাকার অংক শুনে সোহান উৎফুল্ল হতে পারে না। বরং তার মাথার ভেতরকার জট আরও জটিল হতে থাকে। কলমটা নিয়ে তার কী করা উচিৎ, এ নিয়ে আবার উটকো কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়বে না-তো সে? সোহান লোকের ভিড়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে এ কোন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়া গেল? এখানে তার তো কোনো দোষ নেই। একটা ভুল আছে, যাচাই না করে গভীর রাতে বেরিয়ে পড়া। ঢাকা শহরে এমন কেউ নেই যার সাথে তাহসিন-সংক্রান্ত সেই রাতের, লাখ টাকা মূল্যের এই কলমের কথাটা শেয়ার করা যায়। তাহলে কি সে আবার বাড়ি চলে যাবে? বাবাকে আর বড় ভাইকে বলবে সব খুলে? মনে হয় তাহসিনদের বাড়িতেও একবার যাওয়া দরকার। ও বাড়িতে কী কী কথা বলত, এ পর্যন্ত কী পাঠিয়েছে সে-সব জানলে ব্যাপারগুলো খানিকটা খোলসা হতো। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে এই সমস্যার একটা বিহিত করে আসা উচিৎ ছিল।

দ্বিতীয় রাতেও ঘুমানোর আগে সোহান একটা রিভোট্রিল খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ ভেতরটা আরও বেশি অস্থির। ডিম লাইটের আলোতে চোখ বুঁজতেও কেমন ভয় লাগে। সে উঠে পাশের ঘরের আলো জে্বলে আসে। মনেক কেন্দ্রীভূত করবার জন্য মেডিটেশন করছিল। এভাবে হয়তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আচমকা গভীর রাতে মনে হলো দরজায় কে যেন নক করছে। সোহান মশারির ভেতর ধড়াস করে উঠে বসে। খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালে। গ্লাস থেকে খানিক পানি খেতে খেতে টের পায় বুকের ভেতর ভীষণ ঢিপঢিপ করছে। সে কিছুক্ষণ ঘরের ভিতরটা পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ধীর পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে বলে, ‘কে?’

‘আরে খোল, এতো দেরি কেন- আমি তাহসিন।’

হ্যাঁ, এ-তো তাহসিনেরই কণ্ঠ। তার মুহূর্তে মনে পড়ে সোমবার রাতের সেই কাঁচামাছ খাওয়ার দৃশ্য, সেই রক্তাক্ত ঠোঁট, সেই আগুনঝরা চোখ! তার শরীর বেয়ে একঝাঁক শীতল সাপ যেন কিলবিল করে নেমে যেতে থাকে।

সে ভাবে দরজা খুলে প্রথমে আগন্তুকের কলমটা ফিরিয়ে দেবে। বলবে, এ কলম আমি চাইনে, তোমার জিনিস তুমি নিয়ে যাও। তারপর? আর কিছু ভাবতে পারে না সোহান।

সকালবেলা যখন চেতনা ফেরে সোহান নিজেকে আবিষ্কার করে মেঝের ক্রিম কালার শীতল টাইলসের উপর। তার হাতের ভেতর তখনো সোনালি রঙের কলমটা আলতো করে ধরা ছিল। ওর মুখের একদিকে ভাদ্র-সকালের রোদ এসে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২০ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

সোনার কলম

হাসান অরিন্দম

image

আজ ঢাকায় না গেলেই নয়। গতকাল দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে এসেও মন না-টানায় সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। আজ মন না চাইলেও যেতে হবে। ব্যবসাটা তো তার নিজেরই, এমনিতে গত তিন মাসে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। বাইরে কাজ করার জন্য একজন কর্মচারী ছিল, লস কমিয়ে আনতে ছয় মাসের জন্য ওকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে।

সোহানের জন্মের আগে থেকেই ওর মা হার্টের সমস্যাসহ নানান রোগেশোকে ভুগছিলেন। তাই বছর-খানেক বয়স না-হতেই দাদি ওর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। মা-র স্মৃতি অস্পষ্ট, কারণ সোহানের বয়স পাঁচ হওয়ার দুমাস আগে মা প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগে ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত দাদিই ছিলো তার প্রধান অবলম্বন, দাদিকে ছাড়া সে কিছুই বুঝতো না। স্নান-আহার-নিদ্রা সবকিছুতেই দাদিকে লাগতো। সেই দাদির অসুস্থতার খবর শুনে মহামারী-দুর্যোগের মধ্যেও সে ছুটে এসেছিল বাড়িতে। সোহান আসার দুদিন পরই দাদি মারা গেলেন একাশি বছর বয়সে।

সে তিনশ টাকার টিকেট সাড়ে পাঁচশ টাকায় কিনে হাইচয়েস নামক নীল রঙের বাসে জানালার ধারে একটা সিট নেয়। বিয়াল্লিশ সিটের গাড়িতে অবশ্য মাত্র চব্বিশ জন যাত্রী তোলা হয়েছে দেখে সে খানিকটা স্বস্তি পায়। দুবার হর্ন দিয়ে এগারোটা আটত্রিশ মিনিটে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভার বাসটা ছাড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস শহর ছেড়ে যখন সবুজ মাঠের ভেতরকার সর্পিল কালো রাস্তা দিয়ে চলা শুরু করল তখন সদ্য মৃত দুজন মানুষের মুখ মনে পড়ায় সোহানের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। দাদি অবশ্য পরিণত বয়সেই গিয়েছেন, তিনি সহজ-সাদা মানুষ ছিলেন- তার পরলোক নিশ্চয়ই কল্যাণময়ই হবে। কিন্তু অন্য মৃত্যুটা মেনে নেয়া যায় না।

সোহান বাড়িতে এসেছিল ৩ তারিখ, দাদি ৫ তারিখ মাগরিবের আজানের খানিক পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মারা গেলেন। আর এই ঘটনাটা ৯ তারিখ অর্থাৎ সোমবার দিবাগত রাতের। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির সোহানের মাছ ধরার নেশা। পুকুর ছাড়াও ওদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের দোয়ায় গিয়ে অনেক মাছ ধরেছে। সোহান রাতে টিনের চালের নিচে বাইরের ঘরে শুয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো কে যেন বাইরে থেকে শেকল নাড়াচ্ছে। একবার মনে হলো বোধ হয় ঝড়ো বাতাসে নড়েছে। পরে আবারো শব্দ হলে সে ‘কে?’ বললে জবাব আসে, ‘আমি তাহসিন, চল মাছ ধরতে যাই।’

তাহসিন তার ছেলেবেলার বন্ধু, গ্রামের বেশ ধনী পরিবারের ছেলে। স্কুল থেকে আইএ ক্লাস পর্যন্ত একসাথে পড়েছে। পরে সোহান যখন বিশ^বিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তাহসিন তখন অস্ট্রিয়া চলে যায়। তাহসিনকে নিয়ে সোহান বহুবার পুকুরে-খালে-দোয়ায় মাছ ধরেছে। সে বালিশের পাশা রাখা মোবাইল টিপে দেখে রাত দুটো বায়ান্ন। দূরে কোথাও তক্ষক ডাকছে, এতো রাতে ও কোত্থেকে? ও যে দেশে এসেছে তা-ই তো জানে না সোহান। ওর নামটাও এ কদিনে কারো কাছে শুনেছে বলে মনে পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে বলে, ‘তুই এতো রাতে- কোত্থেকে এলি?’

বাইরে থেকে উত্তর আসে, ‘আজই সন্ধ্যায়। তুই আমার প্রাণের দোস্ত তাই খুব দেখতে ইচ্ছে হলো।’

অন্য কেউ হলে সোহান নিশ্চিত রেগে গিয়ে বলত, এত রাতে কেউ কারো বাড়িতে আসে। যা এখন! কিন্তু এতোদিন পর প্রবাসী বন্ধু তার দরজায় কড়া নাড়ছে। রাতদিন যা-ই হোক সে নাখোশ হয় কী করে? সোহান দরজা খুলে দেখে সত্যিই জলজ্যান্ত তাহসিন সামনে দাঁড়িয়ে। ওর পরনে দামী পোশাক, গা দিয়ে ফুরফুর করে দামী পারফিউম সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, দেখতে-শুনতে আরও স্মার্ট হয়েছে। হবেই তো- ইউরোপের উন্নত একটি দেশের বাসিন্দা সে।

‘আয়, ভেতরে এসে বস।’

‘না, ভেতরে যাব না, চল দোয়ায় যাই। বাইরে চমৎকার পরিবেশ। আজ আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ, তবে মহাশূন্য জুড়ে কোটি তারার মেলা।’

সোহান বাইরে তাকিয়ে দেখে আবছা অন্ধকারে মৃদুমন্দ বাতাসে নারকেল, মেহগনি, দেবদারু গাছগুলো দুলছে। সে-সবের উপরে অজস্র তারায় আকাশটা ঝিকমিক করছে। সে স্যান্ডো গেঞ্জির উপর লিনেনের একটা শার্ট চড়াতে চড়াতে বলে, ‘আমার কাছে ছিপ-জাল কিছুই তো নেই। কত দিন মাছটাছ ধরি না। মনে হয় আব্বার কাছে একটা জাল থাকতে পারে।’

‘লাগবে না, ওসব আমার আছে, চল তুই।’ সুবোধ বালকের মতো সোহান তাহসিনের পেছন-পেছন হাঁটতে শুরু করে।

‘তোর সাথে আজ বোধ হয় পাঁচ বছর পরে দেখা। তা ওখানে কেমন আছিস?’

‘হ্যাঁ, চার বছর নয় মাস পরে বাড়ি এলাম। আসলে ওসব দেশ তো এখানকার মতো নয়, ওরা সিস্টেমেটিক ওয়েতে চলে, যেখানেই যাবি সবকিছু পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি, আমার ভালো লাগে।’

‘তুই ওখানে কী কাজ করিস?’

‘গত চার বছর পড়াশোনার পাশাপাশি হোটেলে কাজ করতাম। টেলিফোনে বা অনলাইনে খাবারের যে অর্ডার আসত তা পৌঁছে দেয়ার কাজ ছিল আমার। ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। আমার মাস্টার্স শেষ, এবার গিয়ে একটা স্কুলে সোশাল সায়েন্সের এসিস্ট্যান্ট

টিচার পদে জয়েন করব। তা তোর ব্যবসার কী অবস্থা?’

‘দু মাস চায়না থেকে মাল আসা পুরোপুরি বন্ধ ছিলো। আগামী সপ্তাহে আবার চালু হবে। আমি অবাক হচ্ছি তুই এই করোনার মধ্যে এলি কী করে?’

‘আমার যে-উপায় জানা আছে- আমার আসা কেউ আটকাতে পারে না।’

‘মানে?’

‘মানে কিছু নয়, পরে বুঝবি।’

ওরা যখন বসতি এলাকা ছেড়ে গাছঘেরা নির্জন রাস্তায় এসে উঠেছে তখন সোহান খেয়াল করে তাহসিন খুব দ্রুত আর মসৃণ গতিতে হাঁটছে। আর সে বার বার পেছনে পড়ে যাচ্ছে। সে না বলে পারে না ‘অত জোরে হাঁটছিস কী করে? তোর পায়ে কী চাকা লাগানো?’

‘ও তাই? ঠিক আছে এইতো আস্তে হাঁটছি। আচ্ছা তুই এই কলম আর এই প্যাকেটটা রাখ।’

‘প্যাকেটে কী?’

‘চকোলেট। অস্ট্রিয়া থেকে এনেছি কিছু। রেখে দে, পরে ভুলে যাব।’

কলমটা পকেটে রাখবার সময় আলো-আঁধারিতে ওর চকচকে সোনালি ভাবটা টের পাওয়া যায়। ওরা দুজন কথা বলতে বলতে মিনিট-বিশেকের মধ্যে দোয়ার কাছে চলে এলে কাদাপানি আর নানান জলজ উদ্ভিদের পরিচিত গন্ধটা পাওয়া যায়। ওদেরকে দেখে একজোড়া শেয়াল দৌড়ে পালাল। দোয়ার চারদিকে অনেক খেজুরগাছ, আশপাশে কতক আকাশছোঁয়া তালগাছও আছে।

সোহান বলে, ‘কই তোর এখানে তো মাছ ধরার যন্ত্রপাতি কিছুই দেখছি না।’

‘তুই দাঁড়া। দেখ আমি কীভাবে মাছ ধরি।’ বলে তাহসিন জলাশয়ের কূলে বসে ডান হাত জলের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়ার কয়েক সেকে- পরে পানির মধ্যে মাছের ছটফটানি টের পাওয়া যায়। সোহান অবাক না হয়ে পারে না। এভাবে এত সহজে মাছটা ধরে ফেলল? সম্ভবত কূলে এসে মাছটা ঘুমাচ্ছিল। তাহসিন ওটা সোহানের দিকে ছুঁড়ে দিলে সে খেয়াল করে প্রায় এক পোয়া ওজনের একটা পাকা মাগুর মাছ। তাহসিন আবার জলের মধ্যে হাত ডুবালে সোহান না বলে পারে না, ‘তুই ভাবছিস বসে থেকে আবারও মাছ পাবি- মাছ ধরা এতো সোজা নয় বন্ধু।’

ওর মুখে কোনো কথা নেই। জলের মধ্যে আবারও মাছ আর মানুষের হাতের ধস্তাধস্তি টের পাওয়া যায়। ও মাছটা তুলে বলে, ‘এই দেখ। আমি এখন এভাবেই মাছ ধরি।’ সোহান হঠাৎ খেয়াল করে তাহসিনের দু চোখ দিয়ে যেন লালচে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। ‘আমি এখন’- এই শব্দজোড়া রহস্যের গন্ধমাখা সোহানের তা বুঝতে বাকি থাকে না। তার মনে হয় সে যেন ঘুমের ঘোরে ভুল বা অলৌকিক কিছু দেখছে। কিন্তু নিজের গায়ে চিমটি কেটে ব্যথা পেলে নিশ্চিত হয় সে অন্তত স্বপ্ন দেখছে না। সোহান তখন দেখে তালগাছের মাথায় আলোর মতো কী যেন জ¦লছে, আলোটা এগাছ থেকে ওগাছে যাচ্ছে উল্কার মতো। হঠাৎ অদ্ভুত একটা আওয়াজে সে নিচে দৃষ্টি ফিরিয়ে আলো-আঁধারিতে দেখতে পায় তাহসিন কাঁচা মাছটা গপগপ করে খাচ্ছে। ওর ঠোঁটে রক্তের নিশানা, চোখে লালচে আলোর জ্যোতি বেড়েছে। একি তার সেই বাল্যবন্ধু তাহসিনই? হঠাৎ ভয়ে সোহানের শরীর হিম হয়ে আসে। তার মুখ দিয়ে কথা সরে না, জিভ শুকিয়ে কাঠ। পকেটে মোবাইল ফোন থাকলেও তার সতর্ক মন বলে দেয়, তুমি এভাবে কাউকে না-বলে এত রাতে বেরিয়ে ভুল করেছ, একবার বাবাকে বলে আসা উচিৎ ছিল। এখন এর গায়ে মোবাইলের আলো ফেললে মহাবিপদ ঘনিয়ে আসতে সময় লাগবে না, মুহূর্তে রূপ বদলে ঘাড় মটকে তোমার রক্ত খেতে কতক্ষণ? সোহান জানে এ-রকম সময় আগুন খুব কাজে লাগে। আদিম কাল থেকে মানুষ আগুনের সাহায্যেই হিংস্র পশু আর ছদ্মবেশী অপশক্তির ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। সে পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেট বের করে কাঁপা-কাঁপা হাতে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে। তারপর পেছনে না-তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরে। প্রথম কিছুক্ষণ স্বাভাবিকভাবে হাঁটে, তারপর প্রায় দৌড়ের ভঙ্গিতে হেঁটে ঘরে গিয়ে ভীষণ হাঁপাতে থাকে।

সোহান আর রফিক দু’রুমের একটা বাসা নিয়ে ঢাকার রাজাবাজার এলাকায় থাকে। লালমনিরহাটের রফিক বাড়ি থেকে ফিরবে আরও এক সপ্তাহ পর, ততদিন রান্নার খালারও ছুটি। এ কদিন হয় বাইরে খেতে হবে নইলে নিজে রান্না করতে হবে। ফেরিঘাটে জ্যাম থাকায় আসতে বেশ বিলম্ব হয়। গাবতলি থেকে বাসায় ফেরার সময় আসাদ গেটের কাছে একটা হোটেল থেকে রাত নয়টার দিকে রুটি আর কাবাব খেয়ে নেয়। ঘরে ফিরে খানিক জিরিয়ে নিয়ে ¯œানঘরে ঢোকে। আধভেজা শরীরে ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় বের করার সময় মনে পড়ে সেই কলম আর চকোলেটগুলোর কথা। কাপড় বদলে ব্যাগ থেকে ওগুলো বের করে নাড়াচাড়া করবার সময় ভয় ভয় লাগে।

সোমবার ওই মাছধরা কাণ্ডের পর সে যখন ঘরে ফেরে। তার মিনিট-কুড়ি পরেই মসজিদের আজান শোনা গিয়েছিল। তারপর সোহান আর ঘুমাতে পারেনি। সেই সময় থেকেই রহস্যের জট খুলবার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে থাকে। সে ভাবে তাহসিনদের বাড়িতে গেলেই হয়তো অনেককিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেখানে যেতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। সে নাস্তা সেরে রওনা হয়েছিল ওদের বাড়ি যাবে বলে। পথে আনিসের সঙ্গে দেখা। আনিস বলে, ‘কোথায় চললি এই সকাল বেলা?’

‘তাহসিনের কোনো খবর জানিস? ওদের বাড়ির দিকে একটু যাচ্ছিলাম।’

‘কেন তুই জানিস না কিছু?’

‘কী বল তো?’

‘খবর এসেছে পরশু, ও তিন সপ্তাহ আগেই ভিয়েনাতে করোনা হয়ে মারা যায়। সেখান থেকে ডেডবডি পাঠাবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওখানেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় মুসলিম কায়দায় দাফন হয়েছে। আমি পরশুই গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। ওর মা খবর শুনে বার বার কেবল মূর্ছা যাচ্ছিল। তুই যাবি এখন?’

‘না, থাক। খবরটা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এখন গিয়েইবা কী করব?’

তাহসিনের মৃত্যু-সংবাদ সোহানকে তাৎক্ষণিকভাবে ভীষণ বিমর্ষ করে তোলে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার চেয়ে যে-বড় একটি ঘটনা তার মগজের ভেতরকার রক্তপ্রবাহকে আন্দোলিত করে তোলে তা হলো গতকাল শেষরাতের ঘটনা। ওর মুখে এসে গিয়েছিল, ‘কিন্তু গত রাতে যে আমাকে ও ডাকল?’ তবে তখনই সোহান বুঝতে পারে এ-প্রসঙ্গ ওর কাছে তোলা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। এগুলো খুব স্পর্শকাতর বিষয়, গোপনে সূক্ষ্মবুদ্ধি দিয়ে এর সমাধান খুঁজতে হবে।

সোহান ব্যাগের পকেট থেকে কলম আর চকোলেটগুলো বের করে। ওগুলো থেকে কেমন অদ্ভুত সুবাস বেরুচ্ছে। কিন্তু চকোলেট খুলে মুখে দেয়ার সাহস হয় না, কে জানে ওর মধ্যে কী আছে? ও কলমটা খুলবার সময় এর ওজন আর চাকচিক্য দেখে বুঝতে পারে এটা হয়তো দামি কোনো মেটালে তৈরি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা কুড়ি। তার কেমন ভয় ভয় করতে থাকে। একা বাড়িতে ঘুম আসবে কিনা এই আশঙ্কায় সে একটা রিভোট্রিল ট্যাবলেট খেয়ে নেয়। ভাগ্য ভালো, কোনো গভীর আশঙ্কায় রাতটা নির্ঘুম কাটে না। ফজরের আজানের সময় ঘুম ভাঙলে পৌনে পাঁচ ঘণ্টার ঘুমেই সে বিশেষ সন্তুষ্ট থাকে। সাতটা থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে ব্যবসার হিসেবপত্রগুলো মিলায়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাইরে বেরোনোর সময় কলমটা নিয়ে বের হয়। চায়না থেকে এক্সপোর্ট কোম্পানির প্রতিনিধি কিম জিয়ং জানিয়েছে ওরা যে মাল পাঠিয়েছে তা সোহান কাল যেন গুলশান থেকে রিসিভ করে। আজ মতিঝিল আর জনসন রোডে দুটো মেশিন দেখে আসতে হবে। ঠিক না হলে নতুন মেশিন দিতে হবে। কলমটা নিয়ে গ্রিনরোডে একটা দোকানে দেখালে ওরা বেশ খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে। বলে, ‘মেটালটা দামি হতে পারে। আপনি বরং একবার জুয়েলারি দোকানে দেখান।’

মিনিট-দশেক হাঁটার পর একটা জুয়েলারি দোকানের সন্ধান পেয়ে গ্লাস ঠেলে ভেতরে ঢুকে সোহান বলে, ‘এই কলমের মেটালটা একটু দেখবেন প্লিজ?’

‘আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?’

‘অস্ট্রিয়া থেকে আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছে। লেখা আছে মেইড ইন জার্মান।’

ক্যাশে বসে থাকা তাগড়া লোকটা তার কারিগরের কাছে কলমটা এগিয়ে দিলে সে প্রথমে একটা রেত দিয়ে ওটা ঘঁষে। তারপর সোহানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এটা যাচাই করতে গেলে স্পট পড়তে পারে।’

‘তা পড়ুক। আপনি দেখুন।’

মিনিট-তিনেক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর কাঁচাপাকা চুলের লোকটি জানায়, ‘ক্যাপ আর বডির বাইরের অংশ গোল্ড, টুয়েন্টি ওয়ান ক্যারেট বোধহয়।’

‘সবমিলিয়ে কতখানি গোল্ড আছে?’

‘এভাবে তো বলা মুশকিল, এসিডে না দিলে বোঝা যাবে না।’

‘তবু এর একটা আনুমানিক মূল্য যদি বলতেন।’

‘এক লাখ বিশ হাজার হতে পারে।’

টাকার অংক শুনে সোহান উৎফুল্ল হতে পারে না। বরং তার মাথার ভেতরকার জট আরও জটিল হতে থাকে। কলমটা নিয়ে তার কী করা উচিৎ, এ নিয়ে আবার উটকো কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়বে না-তো সে? সোহান লোকের ভিড়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে এ কোন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়া গেল? এখানে তার তো কোনো দোষ নেই। একটা ভুল আছে, যাচাই না করে গভীর রাতে বেরিয়ে পড়া। ঢাকা শহরে এমন কেউ নেই যার সাথে তাহসিন-সংক্রান্ত সেই রাতের, লাখ টাকা মূল্যের এই কলমের কথাটা শেয়ার করা যায়। তাহলে কি সে আবার বাড়ি চলে যাবে? বাবাকে আর বড় ভাইকে বলবে সব খুলে? মনে হয় তাহসিনদের বাড়িতেও একবার যাওয়া দরকার। ও বাড়িতে কী কী কথা বলত, এ পর্যন্ত কী পাঠিয়েছে সে-সব জানলে ব্যাপারগুলো খানিকটা খোলসা হতো। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে এই সমস্যার একটা বিহিত করে আসা উচিৎ ছিল।

দ্বিতীয় রাতেও ঘুমানোর আগে সোহান একটা রিভোট্রিল খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ ভেতরটা আরও বেশি অস্থির। ডিম লাইটের আলোতে চোখ বুঁজতেও কেমন ভয় লাগে। সে উঠে পাশের ঘরের আলো জে্বলে আসে। মনেক কেন্দ্রীভূত করবার জন্য মেডিটেশন করছিল। এভাবে হয়তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আচমকা গভীর রাতে মনে হলো দরজায় কে যেন নক করছে। সোহান মশারির ভেতর ধড়াস করে উঠে বসে। খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালে। গ্লাস থেকে খানিক পানি খেতে খেতে টের পায় বুকের ভেতর ভীষণ ঢিপঢিপ করছে। সে কিছুক্ষণ ঘরের ভিতরটা পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ধীর পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে বলে, ‘কে?’

‘আরে খোল, এতো দেরি কেন- আমি তাহসিন।’

হ্যাঁ, এ-তো তাহসিনেরই কণ্ঠ। তার মুহূর্তে মনে পড়ে সোমবার রাতের সেই কাঁচামাছ খাওয়ার দৃশ্য, সেই রক্তাক্ত ঠোঁট, সেই আগুনঝরা চোখ! তার শরীর বেয়ে একঝাঁক শীতল সাপ যেন কিলবিল করে নেমে যেতে থাকে।

সে ভাবে দরজা খুলে প্রথমে আগন্তুকের কলমটা ফিরিয়ে দেবে। বলবে, এ কলম আমি চাইনে, তোমার জিনিস তুমি নিয়ে যাও। তারপর? আর কিছু ভাবতে পারে না সোহান।

সকালবেলা যখন চেতনা ফেরে সোহান নিজেকে আবিষ্কার করে মেঝের ক্রিম কালার শীতল টাইলসের উপর। তার হাতের ভেতর তখনো সোনালি রঙের কলমটা আলতো করে ধরা ছিল। ওর মুখের একদিকে ভাদ্র-সকালের রোদ এসে পড়েছে।