স্বপ্নের ভাইরাস

ফরিদা ইয়াসমিন সুমি

ঘুমের ভেতর দাপাদাপি করতে থাকলে মুবিন মিয়ার স্ত্রী অজিফার ঘুম ভেঙে যায়। অজিফা উঠে বসে মুবিনকে ডাকে, আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে।

লিচ্চিত বুবায় ধরসে।

কয়েকবার ধাক্কানোর পর সফল হয় অজিফা। মুবিন মিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসে।

কী’তা অইসে তুমার? সপ্পন নি দেখছ?

সহসা জবাব দিতে পারে না মুবিন। চুপ করে থেকে ধাতস্থ হয় কিছুটা। তারপর হঠাৎ উত্তেজনায় অজিফার হাত চেপে ধরে।

আধা ঘুম আধা জাগরণে লম্বা হাই তোলে অজিফা। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় এমনিতেই বিরক্ত। তার উপর মুবিনের নিশ্চুপতা ওকে অধৈর্য করে তোলে।

আরে, অইছে টা কী কইবা তো! বুবায় ধরছিল?

মুবিনের চোখ থেকে ঘুম উধাও! তার বদলে ধকধক করে জ্বলে ওঠে চোখ দুটো! ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অজিফা।

রাতবিরাতে কী মুসিবতে পড়ল। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ে দু’জনে। আজ আবার কী হলো!

বেড়ার বুননের ফাঁক দিয়ে সরু একটা আলোর রেখা পড়েছে মুবিনের মুখে। কেমন যেন স্বপ্নালু দেখাচ্ছে চোখমুখ!

মাঝরাতে এসব আর ভালো লাগে না অজিফার। মাথার তাপে গরম হয়ে যাওয়া বালিশটা উলটে দেয়।

শোওয়ার প্রস্তুতি নিতেই স্বপ্নের ভেতর থেকেই যেন কথা বলে ওঠে মুবিন।

অজিফার হাতদুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, আমরার আর কুনু দুঃখুকষ্ট থাকপ না রে অজিফা। আইর মাত্র কয়ডা দিন খালি। আমরা বড়লোক হইয়া যামু। খোদার কিরা কইলাম! কসম আল্লা! এই দ্যাখ, তর গা ছুইয়া কইতাসি। তুই আমারে বিশ্বাস যাস না?

ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও, মুবিনের মুখটা দেখে ভারি মায়া হয় অজিফার। বিরক্তি চেপে সান্ত¡না দেবার চেষ্টা করে। আইচ্ছা, বিশ্বাস গ্যাছি তুমার কতা। অহন ঘুমাও তো। বিয়ানবেলা না মাডি কাটতে যাওন লাগপো। আমি বাতাস করতাসি, তুমি ঘুম পারো।

মাথার কাছে রাখা নকশা করা হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করে অজিফা। হাতপাখার কাপড়ে কাঁচাহাতে সুঁইসুতায় তোলা, ‘‘গাছটি হল সবুজ, ফুলটি হল লাল। তোমার আমার ভালবাসা থাকবে চিরকাল’’।

মুবিনের পরনে শুধু ঢিলা করে পরা খাটো লুঙ্গী। খালি গায়েও দরদর করে ঘামছে। অজিফার কথা কিছু শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। কেমন যেন ঘোরের জগতে আছে। খানিকটা চিন্তাও হয় অজিফার। মানুষটাকে বড় ভালোবাসে সে।

আজ ছয়টা মাস খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে ওরা। স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও এর আগে অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পেত। রাজমিস্ত্রীর জোগালি করে সংসার চালানোর মতোই আয় হতো মুবিনের। জোগালি হিসেবে সুনাম থাকাতে মুবিনের কাজের অভাব হতো না।

অজিফার ছুটা কাজ ছিল এক বিদেশীদের বাসায়। প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়া চারজন শ্রীলংকান মেয়ে একসাথে থাকত। প্রথম প্রথম যোগাযোগে অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়। আকারে ইঙ্গিতেই বুঝে যেত অজিফা ওরা কী বলতে চায়। মেয়েগুলো আবার ভাঙাভাঙা বাংলাও বলতে পারত। তাই শুনে অজিফার সে কী হাসি! সে নিজেও ইয়েস, নো, ভেরি গুডের মতো টুকটাক ইংলিশ শিখে নিয়েছিল।

রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা সব করত। বেতনও পেত বেশ ভালো। তার চেয়েও বড় কথা অজিফাকে খুব পছন্দ করত ওরা।

এখন সবই স্বপ্ন! কী থেকে কী হয়ে গেল! বিশ্বাস করতে পারে না অজিফা। নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেছে অনেকবার। এই পরিস্থিতি কী সত্যি সত্যিই ঘটেছে! বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টির মুখেও তো এমন কিছু শুনেনি। এ কেমন দিন এল!

তবে হ্যাঁ! নানি-দাদির মুখে ওলাওঠায় গ্রামকে গ্রাম বিরান হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছে।

করোনা, করোনা, করোনা! মাথামু- কিছুই বুঝে না অজিফা। চোখে দেখা যায় না এমন একটা জিনিস নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে!

এ নির্ঘাৎ কেয়ামতের লক্ষণ! আল্লাহতায়ালা বড়ই অসন্তুষ্ট মানবজাতির উপর। আর হবেই বা না কেন? চারদিকে অন্যায়-অবিচার, খুন-রাহাজানি চলছে অবাধে। আর কত সহ্য করবে মাবুদ! তারও তো সহ্যের একটা সীমা আছে।

সবই বোঝে। মানেও। কিন্তু তাদের মতো গরিবদের কী দোষ! মাবুদের অনুগ্রহ থেকে তারা কেন বঞ্চিত! এমনটা ভেবে পরক্ষণেই আবার খাস দিলে তওবা করে অজিফা। তার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের কী আল্লাহর ইরাদা বোঝার জ্ঞান আছে! পরম ভক্তিভরে আল্লাহকে স্মরণ করে অজিফা। তার চোখ ছলছল করে উঠে, আকুল মনে মাফ চায় খোদার কাছে।

আজ প্রায় ছয়টা মাস মুবিন আর অজিফা দু’জনই বেকার। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শ্রীলংকান মেয়েগুলো নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। বিল্ডিং তৈরির কাজও বন্ধ। মুবিনের কিছু টাকা পাওনা ছিল। সেগুলোও পায় নি। মিল-কারখানা থেকে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। গার্মেন্টসগুলোতে লোক নিচ্ছে না।

বস্তির অনেকে দলেদলে গ্রামের ভিটায় ফিরে গেছে, যাচ্ছে। দিব্যি সুস্থ-সবল কিশোর, যুবকসহ নানাবয়সী মানুষের মৃত্যু দেখেছে সে নিজের চোখে। বস্তির দুই রুমের বাসা ছেড়ে বেড়ার এক ভাঙাচোড়া ছাপড়া ঘরে আশ্রয় নিয়েছে আমিনার মায়ের সাথে।

প্রথম দেড়, দুইমাস রিলিফের কিছু চাল-ডাল পেয়েছিল। এখন সামান্য দানাপানিও পেটে দেবার উপায় নেই। আশেপাশের সব শাক, লতাপাতাও

খাওয়া সারা। টেলিভিশন, রেডিও, মাইকে শুধু বলে মাস্ক পরার কথা। একজন থেকে আরেকজন দূরে থাকার কথা। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তারই কেরামতি! আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহই সরিয়ে দিচ্ছে পরস্পর থেকে।

যখন সুযোগ ছিল, মিলেমিশে থাকার, থাকে নি মানুষ। তখন করেছে মারামারি আর হানাহানি। এইবার প্রকৃতির প্রতিশোধ নেবার পালা। অল্প জ্ঞানবুদ্ধিতে এইটুকু বুঝই শুধু কুলায় অজিফার মাথায়। এর বেশি বুঝে উঠতে পারে না।

এই কয় মাস দ্বারে দ্বারে ঘুরে একটা কাজও জোগাড় করতে পারে নি। গেইট থেকেই তাড়িয়ে দেয় বাড়ির দারোয়ানেরা। মন্দের ভালো যে, দুই দিন হলো, মানুষটা মাটিকাটার একটা কাজ পেয়েছে। এই কাজ শরীরে সয় না মুবিনের। বোঝে অজিফা। কিন্তু কী’ই বা করার আছে।

আজকে হঠাৎ কী হলো মানুষটার!

পরম মমতায় মুবিনের গায়ে হাত রাখে। চমকে উঠে অজিফা! ও আল্লা গো! আম্নের তো দেহি গা পুইরা যাইতাসে গা! চিৎকারের শব্দে মাটিতে শুয়ে থাকা আমেনার মা’ও জেগে ওঠে। চিন্তিত হয়। তাড়াতাড়ি পানি আর গামছা এগিয়ে দেয়।

মুবিন শুতে চায় না কিছুতে। জোর করেও শোয়ানো যায় না ওকে। বসেই থাকে। হঠাৎ কেমন ক্ষেপে গেল লোকটা! গামছাটা ভিজিয়ে বসা অবস্থাতেই গা মোছায় অজিফা। আমিনার মাকে খুব সমীহ করে মুবিন। বুবু বলে ডাকে। আমিনার বাবা করোনায় মারা যাওয়ার পর থেকে একে অপরের সুখদুখের সাথী হয়ে আছে ওরা।

আমিনার মা কিছুটা জোর করেই শুইয়ে দেয় মুবিনকে। পানি-পট্টি দেয় কপালে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না অজিফা। জোরে জোরে শ্বাস নেয় মুবিন। কথা বলতে চায়। আমিনার মা মুবিনের হাতটা ধরে বলে, ভাইডি আমার, জ্বরডা একটুক কমুক, হের বাদে কইয়ো নে, যা কইতে মনে লয়।

মুবিনের মাথায় পানি ঢালে অজিফা। আমিনার মা ঘরে থাকা একমুঠ চাল বেশি করে পানি দিয়ে চুলায় চাপিয়ে দেয়। ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম মাড়ভর্তি বাটিটা মুবিনের মুখের সামনে ধরে। বহুকষ্টে দুই চুমুক খায় মুবিন। মুখটা বিকৃত করে। শাকপাতা, ফেন মুখে রুচে না আর!

জ্বরটা একটু কমে এসেছে। মুবিনের চোখেমুখে এখনও সেই কথা বলতে চাওয়ার আকুলতা। কী বলতে চাইছিল মানুষটা? ভাবে অজিফা। কী কথা বলতে সে মাঝরাতে ধরফর করে জেগে উঠেছিল? নাকি সবই জ্বরের ঘোরে করেছে!

ভেজা গামছাটা গায়ে জড়িয়ে আয়েশ করে বসে মুবিন। নিচে বিছানো মাদুরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সাত বছরের আমিনা। পেটটা যেন পিঠের সাথে লাগানো। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুবিন। নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। বাবার হাত ধরে যেদিন গঞ্জে যেত সেদিন তার কাছে ইদ ইদ লাগত। কলতলায় নিয়ে ডলে ডলে গোসল করিয়ে দিত মা। মাথায় তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে দিত। গামছায় করে বেঁধে দিত গুড়, মুড়ি। তাই খেতে খেতে ক্ষেতের আইল ধরে বাবা আর ছেলে পথ চলত। সোঁদা-মাটি আর ফসলের ঘ্রাণ নাকমুখ বিবশ করে দিত। ঘরের দাওয়ায় খুঁটি ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত মা। যতক্ষণ ওদের চিহ্ন দেখা যায়। আহা! কিসব দিন!

কথা বলার জন্য আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার চোখমুখ! বুবু আর অজিফা, হুনো, আইজ তোমগোরে খুব গোপন একখান দামী কতা কমু। কাউরে কিন্তুক কইবা না খবরদার! অজিফার মুখটা চিন্তাগ্রস্ত, শুকনো দেখায়। আমিনার মা অজিফার কষ্টটা বোঝে। পরিবেশটা স্বাভাবিক করে তুলতে সচেষ্ট হয় সে। হাসিমুখে বলে, কী তোমার দামী কতা কও দেহি মিয়া!

মুবিনের কোটরাগত চোখদুটো চকচক করে ওঠে! যেন বা আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে হাতে! উত্তেজনায় জোরালো হয় শ্বাস। কণ্ঠার আর পাঁজরের হাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাঁপরের মতো উঠানামা করে।

হুনো তোমরা, সপ্পনে আমি করোনা সারাইবার ঔষধিগাছ পাইছি। অজিফা হাঁটুতে কনুই রেখে হাতের পাতা দিয়ে গালে ঠেস দিয়ে বসে। অনেকটা গা-ছাড়া ভাব।

তাতে দমে যায় না মুবিন। সে ওর স্বপ্নালু চোখে বলে যেতে থাকে। হেই ভেষজ পাইতে আমগোরে যাওন লাগব বারআউলিয়া মাজারের উত্তর-পূবমুখি হইয়া জঙ্গলের একদম ভিত্রে। মাইল আষ্টেক যাওনের পর পাইবা পুরানা এক বটগাছ। বউত পুরানা। হেই বটগাছ হইতে গইনা গইনা চাইরশ কদম হাইট্টা গ্যালে পাইবা ঘন এক্কান ঝোপ। ঝোপের মইধ্যিখানে আছে বিরাট আইশ্চর্য এক গাছ। ফুল ফুটে বেগনি, বেগনি। হেই গাছের শিকড় বাইট্যা খাইলে কীয়ের করোনা আর কিয়ের কী! সর্বরোগের মুক্তি। মুশকিল আসান।

অজিফা আর আমিনার মা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। আশঙ্কা হয়, মাথা খারাপ হইয়া গ্যালো নি মানুষডার! আমিনার মা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে অজিফার পিঠে মৃদু চাপ দেয়, যাতে মুবিন টের না পায়।

আবার বলতে শুরু করে মুবিন, কী! মনে করছ খুব সুজা! না, না, অত্ত সুজা না। দুইন্নার কামিয়াবি কোনোডাই সুজা না। দুইন্যাদারি বহুত কডিন। যতলা ততলা যাইতারবা না। যাওন লাগব অমাবস্যার রাইতে। রাত্তিরি দ্বিপহরে। পাকসাফ না অইয়া গ্যালে বড়ো বিফদ আছে কইলাম! খুব সাবধানে তোলন লাগব হেই গাছ। যেই কয়খান পাওন যায় হেইগুলা আইনা জমিতে চাষ করন লাগব। তারফর দিয়া দলে দলে সবতে তহন আমগো কাছে আইবো। সারা পিথিবির মাইনষে আইব। এই মুবিন মিয়ারে খোজব।

তুমরা দুইজনে টাকা গইন্যা কূল পাইতা না। আমিনারেও দিও কিছু গনতে। তোমগো কার কী শখের জিনিস আছে, লিস্টি কইরা লাও। আমিনার বাতাসা আর লেবেনচুষ যেন বাদ না যায়। হা হা হা।

অজিফার ভয় পাওয়া চোখের দিকে চেয়ে মুবিন হাসলো। কী! বিশ্বাস করলা না তো? জানতাম, করবা না। হুনো, আইজগা ঘুমডা যহন গভীরের থন এট্টু পাতল অইতে লাগছিল, হেই সময় দেহি, এক বিরাট লম্বা-চওড়া হুজুর। মাথা গিয়া ঠ্যাকছে আসমানের লগে। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। কী সুন্দর নূরানি চেহারা। ঘি-রঙা পাঞ্জাবীর উফরে কালা আংরাখা পরা। ধবধবা সাদা লম্বা দাড়ি।

আচমকা ভরকায় গিয়া সেলাম দিতেও ভুইল্যা গেছি গা। অইবোই তো! ওইরম কামেল হুজুরের সামনে হগগলেরই ভুল হইয়া যাইব। আর আমি তো এক মামুলি মুবিন মিয়া! আমি ভুইল্যা গেলে কী অইছে! হেই হুজুরই সেলাম দিল আমারে। আমি লজ্জা পাইয়া কইলাম, ওয়ালাইকুম সালাম।

ধারে আইয়া দাড়াইলো সে, মাথায় হাত দিয়া কইলো, মুবিন রে, তরার কি খুউব কষ্ট নাহি রে বেটা? আমার কান্দন আইয়া গ্যালো, কী কইতে কী কমু বুঝতারি নাইকা। আমার চউক্ষের ফানি দেইহা কইলো, হুন, পিরথিবিডা এক্কেরে নষ্ট অইয়া গ্যাছেগা। মাইনষের মনের মইদ্যে হারামিপানা ছাড়া কিসসু নাই। মিল-মহব্বত নাই। দিলে দয়া-মায়া নাই।

দ্যাখতাছস, লক্ষ লক্ষ মাইনষে মরতাছে ছুডু একটা ভাইরাস দিয়া।

কিসসু করতারবো না মাইনষে। কিসসু না। এই ভাইরাসও যাইত না কুনুদিন। তগো কষ্ট দেইখ্যা আমি আইছি। তরে এই করোনা সারাইবার অষুধ দিমু নে। কিন্তুক সাবধান! আফনার লোগ ছাড়া কাউরে কবি না কইলাম। আমি যহন কানতে কানতে হের দুই পা জড়ায় ধইরা চুমা খাইতে গেলাম। তারপর চাইয়া দেহিÑ হে নাই। কুনুখানে নাইকা। কত বিছড়ান বিছড়াইছি। নাই। নাই। নাই। ওষুধের কতা কওয়নের পরই গায়েব অইয়া গ্যাছে গা!

সব বুজবার পারছি। এখন ফেনডা আরেকডু মুহে দ্যাও তো দিহি। আমিনার মা বাটিটা এগিয়ে দিল।

তার মানে, তোমরা বিশ্বাস যাও নাইক্যা? স্বপ্নের ঘোর থেকে যেন ফিরে আসে মুবিন। অ্যাই অজিফা, তুই ক, বিশ্বাস যাস নায়?

বুবু, তুমিও বিশ্বাস যাও নায়?

আমিনার মা কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমরা দুইজনেই বিশ্বাস গেছি। বিশ্বাস যামু না ক্যারে! কত লোকেই ত সপ্পনে দাওয়াই ফায়। অহন ফেনটুক খাইয়া এট্টু ঘুমা বাই। তর শরীরডা বালা না। গা-ডা গরম ঠেকতাছে।

আগে কও, অমাবইস্যার রাইতে আমার লগে যাইবা হেই গাছ আনতে? যেইডাতে বেগনি, বেগনি ফুল ধইরা থাহে। মুবিনের চোখে আবারও সেই ঘোর! কও না বুবু। অই অজিফা, কসনা ক্যারে! প্রলাপ বকতে বকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল মুবিন।

সকালে মাটি কাটতে যাবার সঙ্গীরা ডাকতে এসে ফেরত গেল। চোখ খোলার মতো অবস্থা ছিল না মুবিনের। প্রচণ্ড জ্বরের সাথে গলাব্যথা, বমি আর পাতলা পায়খানা শুরু হলো। এলাকার মহাজনদের ধরে চাঁদা তুলে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল নিয়ে গেল।

জ্বরের ঘোরে শুধু একটি কথাই বারবার বলছিল মুবিন, বড় কামেল হুজুর আছিল অজিফা, অবিশ্বাস করিস না। দোহাই লাগে। অবিশ্বাস করলে অমঙ্গল অইবো।

মুবিন মারা যাওয়ার তিন দিন পর রিপোর্ট এলো, করোনা পজিটিভ। কান্না করবার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিল না অজিফার। মাথায় হাত দিয়ে পাথুরে দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফনের জন্য নিয়ে গেল মুবিনের শরীরটা। কে জানে সাথে ওর চোখভরা স্বপ্নটাও নিয়ে গেল কি’না!

অমাবস্যার রাতে করোনাভাইরাস সারানোর গাছ আনতে যাবার আকুলতা থাকলেও মুবিনের মৃত্যু হলো ভরাপূর্ণিমায়।

পেটে যাদের জন্ম থেকেই পাথর বাঁধা তাদের কাছে অমাবস্যাই কী আর পূর্ণিমাই বা কী! চাঁদের হিসেবেই বা কী এসে যায়! কিন্তু কী আশ্চর্য! মুবিনের মৃত্যুর দিন থেকে চাঁদের হিসেব রাখতে শুরু করেছে অজিফা।

এক ঘুটঘুটে অমাবস্যার রাতে আমিনার মাকে ডেকে তোলে অজিফা। ফিসফিস করে বলে, আইজকা অমাবইস্যা বুবু। চলো না গো, মানুষডার সপ্পনে পাওয়া ভেষজের খোঁজে যাই। যেই গাছে ফুডে বেগনি, বেগনি ফুল। না-কইরো না বুবু। দোহাই লাগে তুমার।

অজিফার চোখেমুখে মুবিনের সেই রাতের ঘোরলাগা স্বপ্নীলতার ছাপ দেখে আঁতকে ওঠে আমিনার মা! বোঝে, ভাইরাসের মতো এই স্বপ্নও সহসা যাবার নয়!

বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২০ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

স্বপ্নের ভাইরাস

ফরিদা ইয়াসমিন সুমি

image

ঘুমের ভেতর দাপাদাপি করতে থাকলে মুবিন মিয়ার স্ত্রী অজিফার ঘুম ভেঙে যায়। অজিফা উঠে বসে মুবিনকে ডাকে, আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে।

লিচ্চিত বুবায় ধরসে।

কয়েকবার ধাক্কানোর পর সফল হয় অজিফা। মুবিন মিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসে।

কী’তা অইসে তুমার? সপ্পন নি দেখছ?

সহসা জবাব দিতে পারে না মুবিন। চুপ করে থেকে ধাতস্থ হয় কিছুটা। তারপর হঠাৎ উত্তেজনায় অজিফার হাত চেপে ধরে।

আধা ঘুম আধা জাগরণে লম্বা হাই তোলে অজিফা। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় এমনিতেই বিরক্ত। তার উপর মুবিনের নিশ্চুপতা ওকে অধৈর্য করে তোলে।

আরে, অইছে টা কী কইবা তো! বুবায় ধরছিল?

মুবিনের চোখ থেকে ঘুম উধাও! তার বদলে ধকধক করে জ্বলে ওঠে চোখ দুটো! ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অজিফা।

রাতবিরাতে কী মুসিবতে পড়ল। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ে দু’জনে। আজ আবার কী হলো!

বেড়ার বুননের ফাঁক দিয়ে সরু একটা আলোর রেখা পড়েছে মুবিনের মুখে। কেমন যেন স্বপ্নালু দেখাচ্ছে চোখমুখ!

মাঝরাতে এসব আর ভালো লাগে না অজিফার। মাথার তাপে গরম হয়ে যাওয়া বালিশটা উলটে দেয়।

শোওয়ার প্রস্তুতি নিতেই স্বপ্নের ভেতর থেকেই যেন কথা বলে ওঠে মুবিন।

অজিফার হাতদুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, আমরার আর কুনু দুঃখুকষ্ট থাকপ না রে অজিফা। আইর মাত্র কয়ডা দিন খালি। আমরা বড়লোক হইয়া যামু। খোদার কিরা কইলাম! কসম আল্লা! এই দ্যাখ, তর গা ছুইয়া কইতাসি। তুই আমারে বিশ্বাস যাস না?

ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও, মুবিনের মুখটা দেখে ভারি মায়া হয় অজিফার। বিরক্তি চেপে সান্ত¡না দেবার চেষ্টা করে। আইচ্ছা, বিশ্বাস গ্যাছি তুমার কতা। অহন ঘুমাও তো। বিয়ানবেলা না মাডি কাটতে যাওন লাগপো। আমি বাতাস করতাসি, তুমি ঘুম পারো।

মাথার কাছে রাখা নকশা করা হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করে অজিফা। হাতপাখার কাপড়ে কাঁচাহাতে সুঁইসুতায় তোলা, ‘‘গাছটি হল সবুজ, ফুলটি হল লাল। তোমার আমার ভালবাসা থাকবে চিরকাল’’।

মুবিনের পরনে শুধু ঢিলা করে পরা খাটো লুঙ্গী। খালি গায়েও দরদর করে ঘামছে। অজিফার কথা কিছু শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। কেমন যেন ঘোরের জগতে আছে। খানিকটা চিন্তাও হয় অজিফার। মানুষটাকে বড় ভালোবাসে সে।

আজ ছয়টা মাস খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে ওরা। স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও এর আগে অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পেত। রাজমিস্ত্রীর জোগালি করে সংসার চালানোর মতোই আয় হতো মুবিনের। জোগালি হিসেবে সুনাম থাকাতে মুবিনের কাজের অভাব হতো না।

অজিফার ছুটা কাজ ছিল এক বিদেশীদের বাসায়। প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়া চারজন শ্রীলংকান মেয়ে একসাথে থাকত। প্রথম প্রথম যোগাযোগে অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়। আকারে ইঙ্গিতেই বুঝে যেত অজিফা ওরা কী বলতে চায়। মেয়েগুলো আবার ভাঙাভাঙা বাংলাও বলতে পারত। তাই শুনে অজিফার সে কী হাসি! সে নিজেও ইয়েস, নো, ভেরি গুডের মতো টুকটাক ইংলিশ শিখে নিয়েছিল।

রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা সব করত। বেতনও পেত বেশ ভালো। তার চেয়েও বড় কথা অজিফাকে খুব পছন্দ করত ওরা।

এখন সবই স্বপ্ন! কী থেকে কী হয়ে গেল! বিশ্বাস করতে পারে না অজিফা। নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেছে অনেকবার। এই পরিস্থিতি কী সত্যি সত্যিই ঘটেছে! বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টির মুখেও তো এমন কিছু শুনেনি। এ কেমন দিন এল!

তবে হ্যাঁ! নানি-দাদির মুখে ওলাওঠায় গ্রামকে গ্রাম বিরান হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছে।

করোনা, করোনা, করোনা! মাথামু- কিছুই বুঝে না অজিফা। চোখে দেখা যায় না এমন একটা জিনিস নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে!

এ নির্ঘাৎ কেয়ামতের লক্ষণ! আল্লাহতায়ালা বড়ই অসন্তুষ্ট মানবজাতির উপর। আর হবেই বা না কেন? চারদিকে অন্যায়-অবিচার, খুন-রাহাজানি চলছে অবাধে। আর কত সহ্য করবে মাবুদ! তারও তো সহ্যের একটা সীমা আছে।

সবই বোঝে। মানেও। কিন্তু তাদের মতো গরিবদের কী দোষ! মাবুদের অনুগ্রহ থেকে তারা কেন বঞ্চিত! এমনটা ভেবে পরক্ষণেই আবার খাস দিলে তওবা করে অজিফা। তার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের কী আল্লাহর ইরাদা বোঝার জ্ঞান আছে! পরম ভক্তিভরে আল্লাহকে স্মরণ করে অজিফা। তার চোখ ছলছল করে উঠে, আকুল মনে মাফ চায় খোদার কাছে।

আজ প্রায় ছয়টা মাস মুবিন আর অজিফা দু’জনই বেকার। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শ্রীলংকান মেয়েগুলো নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। বিল্ডিং তৈরির কাজও বন্ধ। মুবিনের কিছু টাকা পাওনা ছিল। সেগুলোও পায় নি। মিল-কারখানা থেকে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। গার্মেন্টসগুলোতে লোক নিচ্ছে না।

বস্তির অনেকে দলেদলে গ্রামের ভিটায় ফিরে গেছে, যাচ্ছে। দিব্যি সুস্থ-সবল কিশোর, যুবকসহ নানাবয়সী মানুষের মৃত্যু দেখেছে সে নিজের চোখে। বস্তির দুই রুমের বাসা ছেড়ে বেড়ার এক ভাঙাচোড়া ছাপড়া ঘরে আশ্রয় নিয়েছে আমিনার মায়ের সাথে।

প্রথম দেড়, দুইমাস রিলিফের কিছু চাল-ডাল পেয়েছিল। এখন সামান্য দানাপানিও পেটে দেবার উপায় নেই। আশেপাশের সব শাক, লতাপাতাও

খাওয়া সারা। টেলিভিশন, রেডিও, মাইকে শুধু বলে মাস্ক পরার কথা। একজন থেকে আরেকজন দূরে থাকার কথা। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তারই কেরামতি! আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহই সরিয়ে দিচ্ছে পরস্পর থেকে।

যখন সুযোগ ছিল, মিলেমিশে থাকার, থাকে নি মানুষ। তখন করেছে মারামারি আর হানাহানি। এইবার প্রকৃতির প্রতিশোধ নেবার পালা। অল্প জ্ঞানবুদ্ধিতে এইটুকু বুঝই শুধু কুলায় অজিফার মাথায়। এর বেশি বুঝে উঠতে পারে না।

এই কয় মাস দ্বারে দ্বারে ঘুরে একটা কাজও জোগাড় করতে পারে নি। গেইট থেকেই তাড়িয়ে দেয় বাড়ির দারোয়ানেরা। মন্দের ভালো যে, দুই দিন হলো, মানুষটা মাটিকাটার একটা কাজ পেয়েছে। এই কাজ শরীরে সয় না মুবিনের। বোঝে অজিফা। কিন্তু কী’ই বা করার আছে।

আজকে হঠাৎ কী হলো মানুষটার!

পরম মমতায় মুবিনের গায়ে হাত রাখে। চমকে উঠে অজিফা! ও আল্লা গো! আম্নের তো দেহি গা পুইরা যাইতাসে গা! চিৎকারের শব্দে মাটিতে শুয়ে থাকা আমেনার মা’ও জেগে ওঠে। চিন্তিত হয়। তাড়াতাড়ি পানি আর গামছা এগিয়ে দেয়।

মুবিন শুতে চায় না কিছুতে। জোর করেও শোয়ানো যায় না ওকে। বসেই থাকে। হঠাৎ কেমন ক্ষেপে গেল লোকটা! গামছাটা ভিজিয়ে বসা অবস্থাতেই গা মোছায় অজিফা। আমিনার মাকে খুব সমীহ করে মুবিন। বুবু বলে ডাকে। আমিনার বাবা করোনায় মারা যাওয়ার পর থেকে একে অপরের সুখদুখের সাথী হয়ে আছে ওরা।

আমিনার মা কিছুটা জোর করেই শুইয়ে দেয় মুবিনকে। পানি-পট্টি দেয় কপালে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না অজিফা। জোরে জোরে শ্বাস নেয় মুবিন। কথা বলতে চায়। আমিনার মা মুবিনের হাতটা ধরে বলে, ভাইডি আমার, জ্বরডা একটুক কমুক, হের বাদে কইয়ো নে, যা কইতে মনে লয়।

মুবিনের মাথায় পানি ঢালে অজিফা। আমিনার মা ঘরে থাকা একমুঠ চাল বেশি করে পানি দিয়ে চুলায় চাপিয়ে দেয়। ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম মাড়ভর্তি বাটিটা মুবিনের মুখের সামনে ধরে। বহুকষ্টে দুই চুমুক খায় মুবিন। মুখটা বিকৃত করে। শাকপাতা, ফেন মুখে রুচে না আর!

জ্বরটা একটু কমে এসেছে। মুবিনের চোখেমুখে এখনও সেই কথা বলতে চাওয়ার আকুলতা। কী বলতে চাইছিল মানুষটা? ভাবে অজিফা। কী কথা বলতে সে মাঝরাতে ধরফর করে জেগে উঠেছিল? নাকি সবই জ্বরের ঘোরে করেছে!

ভেজা গামছাটা গায়ে জড়িয়ে আয়েশ করে বসে মুবিন। নিচে বিছানো মাদুরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সাত বছরের আমিনা। পেটটা যেন পিঠের সাথে লাগানো। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুবিন। নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। বাবার হাত ধরে যেদিন গঞ্জে যেত সেদিন তার কাছে ইদ ইদ লাগত। কলতলায় নিয়ে ডলে ডলে গোসল করিয়ে দিত মা। মাথায় তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে দিত। গামছায় করে বেঁধে দিত গুড়, মুড়ি। তাই খেতে খেতে ক্ষেতের আইল ধরে বাবা আর ছেলে পথ চলত। সোঁদা-মাটি আর ফসলের ঘ্রাণ নাকমুখ বিবশ করে দিত। ঘরের দাওয়ায় খুঁটি ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত মা। যতক্ষণ ওদের চিহ্ন দেখা যায়। আহা! কিসব দিন!

কথা বলার জন্য আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার চোখমুখ! বুবু আর অজিফা, হুনো, আইজ তোমগোরে খুব গোপন একখান দামী কতা কমু। কাউরে কিন্তুক কইবা না খবরদার! অজিফার মুখটা চিন্তাগ্রস্ত, শুকনো দেখায়। আমিনার মা অজিফার কষ্টটা বোঝে। পরিবেশটা স্বাভাবিক করে তুলতে সচেষ্ট হয় সে। হাসিমুখে বলে, কী তোমার দামী কতা কও দেহি মিয়া!

মুবিনের কোটরাগত চোখদুটো চকচক করে ওঠে! যেন বা আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে হাতে! উত্তেজনায় জোরালো হয় শ্বাস। কণ্ঠার আর পাঁজরের হাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাঁপরের মতো উঠানামা করে।

হুনো তোমরা, সপ্পনে আমি করোনা সারাইবার ঔষধিগাছ পাইছি। অজিফা হাঁটুতে কনুই রেখে হাতের পাতা দিয়ে গালে ঠেস দিয়ে বসে। অনেকটা গা-ছাড়া ভাব।

তাতে দমে যায় না মুবিন। সে ওর স্বপ্নালু চোখে বলে যেতে থাকে। হেই ভেষজ পাইতে আমগোরে যাওন লাগব বারআউলিয়া মাজারের উত্তর-পূবমুখি হইয়া জঙ্গলের একদম ভিত্রে। মাইল আষ্টেক যাওনের পর পাইবা পুরানা এক বটগাছ। বউত পুরানা। হেই বটগাছ হইতে গইনা গইনা চাইরশ কদম হাইট্টা গ্যালে পাইবা ঘন এক্কান ঝোপ। ঝোপের মইধ্যিখানে আছে বিরাট আইশ্চর্য এক গাছ। ফুল ফুটে বেগনি, বেগনি। হেই গাছের শিকড় বাইট্যা খাইলে কীয়ের করোনা আর কিয়ের কী! সর্বরোগের মুক্তি। মুশকিল আসান।

অজিফা আর আমিনার মা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। আশঙ্কা হয়, মাথা খারাপ হইয়া গ্যালো নি মানুষডার! আমিনার মা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে অজিফার পিঠে মৃদু চাপ দেয়, যাতে মুবিন টের না পায়।

আবার বলতে শুরু করে মুবিন, কী! মনে করছ খুব সুজা! না, না, অত্ত সুজা না। দুইন্নার কামিয়াবি কোনোডাই সুজা না। দুইন্যাদারি বহুত কডিন। যতলা ততলা যাইতারবা না। যাওন লাগব অমাবস্যার রাইতে। রাত্তিরি দ্বিপহরে। পাকসাফ না অইয়া গ্যালে বড়ো বিফদ আছে কইলাম! খুব সাবধানে তোলন লাগব হেই গাছ। যেই কয়খান পাওন যায় হেইগুলা আইনা জমিতে চাষ করন লাগব। তারফর দিয়া দলে দলে সবতে তহন আমগো কাছে আইবো। সারা পিথিবির মাইনষে আইব। এই মুবিন মিয়ারে খোজব।

তুমরা দুইজনে টাকা গইন্যা কূল পাইতা না। আমিনারেও দিও কিছু গনতে। তোমগো কার কী শখের জিনিস আছে, লিস্টি কইরা লাও। আমিনার বাতাসা আর লেবেনচুষ যেন বাদ না যায়। হা হা হা।

অজিফার ভয় পাওয়া চোখের দিকে চেয়ে মুবিন হাসলো। কী! বিশ্বাস করলা না তো? জানতাম, করবা না। হুনো, আইজগা ঘুমডা যহন গভীরের থন এট্টু পাতল অইতে লাগছিল, হেই সময় দেহি, এক বিরাট লম্বা-চওড়া হুজুর। মাথা গিয়া ঠ্যাকছে আসমানের লগে। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। কী সুন্দর নূরানি চেহারা। ঘি-রঙা পাঞ্জাবীর উফরে কালা আংরাখা পরা। ধবধবা সাদা লম্বা দাড়ি।

আচমকা ভরকায় গিয়া সেলাম দিতেও ভুইল্যা গেছি গা। অইবোই তো! ওইরম কামেল হুজুরের সামনে হগগলেরই ভুল হইয়া যাইব। আর আমি তো এক মামুলি মুবিন মিয়া! আমি ভুইল্যা গেলে কী অইছে! হেই হুজুরই সেলাম দিল আমারে। আমি লজ্জা পাইয়া কইলাম, ওয়ালাইকুম সালাম।

ধারে আইয়া দাড়াইলো সে, মাথায় হাত দিয়া কইলো, মুবিন রে, তরার কি খুউব কষ্ট নাহি রে বেটা? আমার কান্দন আইয়া গ্যালো, কী কইতে কী কমু বুঝতারি নাইকা। আমার চউক্ষের ফানি দেইহা কইলো, হুন, পিরথিবিডা এক্কেরে নষ্ট অইয়া গ্যাছেগা। মাইনষের মনের মইদ্যে হারামিপানা ছাড়া কিসসু নাই। মিল-মহব্বত নাই। দিলে দয়া-মায়া নাই।

দ্যাখতাছস, লক্ষ লক্ষ মাইনষে মরতাছে ছুডু একটা ভাইরাস দিয়া।

কিসসু করতারবো না মাইনষে। কিসসু না। এই ভাইরাসও যাইত না কুনুদিন। তগো কষ্ট দেইখ্যা আমি আইছি। তরে এই করোনা সারাইবার অষুধ দিমু নে। কিন্তুক সাবধান! আফনার লোগ ছাড়া কাউরে কবি না কইলাম। আমি যহন কানতে কানতে হের দুই পা জড়ায় ধইরা চুমা খাইতে গেলাম। তারপর চাইয়া দেহিÑ হে নাই। কুনুখানে নাইকা। কত বিছড়ান বিছড়াইছি। নাই। নাই। নাই। ওষুধের কতা কওয়নের পরই গায়েব অইয়া গ্যাছে গা!

সব বুজবার পারছি। এখন ফেনডা আরেকডু মুহে দ্যাও তো দিহি। আমিনার মা বাটিটা এগিয়ে দিল।

তার মানে, তোমরা বিশ্বাস যাও নাইক্যা? স্বপ্নের ঘোর থেকে যেন ফিরে আসে মুবিন। অ্যাই অজিফা, তুই ক, বিশ্বাস যাস নায়?

বুবু, তুমিও বিশ্বাস যাও নায়?

আমিনার মা কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমরা দুইজনেই বিশ্বাস গেছি। বিশ্বাস যামু না ক্যারে! কত লোকেই ত সপ্পনে দাওয়াই ফায়। অহন ফেনটুক খাইয়া এট্টু ঘুমা বাই। তর শরীরডা বালা না। গা-ডা গরম ঠেকতাছে।

আগে কও, অমাবইস্যার রাইতে আমার লগে যাইবা হেই গাছ আনতে? যেইডাতে বেগনি, বেগনি ফুল ধইরা থাহে। মুবিনের চোখে আবারও সেই ঘোর! কও না বুবু। অই অজিফা, কসনা ক্যারে! প্রলাপ বকতে বকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল মুবিন।

সকালে মাটি কাটতে যাবার সঙ্গীরা ডাকতে এসে ফেরত গেল। চোখ খোলার মতো অবস্থা ছিল না মুবিনের। প্রচণ্ড জ্বরের সাথে গলাব্যথা, বমি আর পাতলা পায়খানা শুরু হলো। এলাকার মহাজনদের ধরে চাঁদা তুলে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল নিয়ে গেল।

জ্বরের ঘোরে শুধু একটি কথাই বারবার বলছিল মুবিন, বড় কামেল হুজুর আছিল অজিফা, অবিশ্বাস করিস না। দোহাই লাগে। অবিশ্বাস করলে অমঙ্গল অইবো।

মুবিন মারা যাওয়ার তিন দিন পর রিপোর্ট এলো, করোনা পজিটিভ। কান্না করবার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিল না অজিফার। মাথায় হাত দিয়ে পাথুরে দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফনের জন্য নিয়ে গেল মুবিনের শরীরটা। কে জানে সাথে ওর চোখভরা স্বপ্নটাও নিয়ে গেল কি’না!

অমাবস্যার রাতে করোনাভাইরাস সারানোর গাছ আনতে যাবার আকুলতা থাকলেও মুবিনের মৃত্যু হলো ভরাপূর্ণিমায়।

পেটে যাদের জন্ম থেকেই পাথর বাঁধা তাদের কাছে অমাবস্যাই কী আর পূর্ণিমাই বা কী! চাঁদের হিসেবেই বা কী এসে যায়! কিন্তু কী আশ্চর্য! মুবিনের মৃত্যুর দিন থেকে চাঁদের হিসেব রাখতে শুরু করেছে অজিফা।

এক ঘুটঘুটে অমাবস্যার রাতে আমিনার মাকে ডেকে তোলে অজিফা। ফিসফিস করে বলে, আইজকা অমাবইস্যা বুবু। চলো না গো, মানুষডার সপ্পনে পাওয়া ভেষজের খোঁজে যাই। যেই গাছে ফুডে বেগনি, বেগনি ফুল। না-কইরো না বুবু। দোহাই লাগে তুমার।

অজিফার চোখেমুখে মুবিনের সেই রাতের ঘোরলাগা স্বপ্নীলতার ছাপ দেখে আঁতকে ওঠে আমিনার মা! বোঝে, ভাইরাসের মতো এই স্বপ্নও সহসা যাবার নয়!