ভূমধ্যসাগরের রত্নময়ী আলেকজান্দ্রিয়ায়

ফজল হাসান

ভ্রমণ : ছয়

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩২৬ সালে আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণের সময় পম্পাইয়ের স্তম্ভে এসেছিলেন। পম্পাইয়ের স্তম্ভ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। নেট ঘেঁটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ১৮০৩ সালে বৃটিশ রণতরীর কমান্ডার জন শর্টল্যান্ড পম্পাইয়ের স্তম্ভের উপর দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছেন, যার জন্য তিনি চূড়ায় দড়ি ফেলে মই বাঁধতে পেরেছিলেন। পরে সেই দড়ির মই বেয়ে তিনি এবং রণতরীর সারেং জন হোয়াইট স্তম্ভের চূড়ায় আরোহণ করেন। সেখানে তারা ইউনিয়ন জ্যাক [বৃটিশ পতাকা] উত্তোলন করেন এবং রাজা তৃতীয় জর্জের দীর্ঘায়ু কামনা করেন। চারদিন পরে তারা পুনরায় চূড়ায় উঠেন এবং সেখানে আবহাওয়ার যন্ত্র স্থাপন করেন। সেদিন তারা চূড়ায় উঠে গরুর ভাঁজা মাংস খান এবং আবারো রাজার দীর্ঘ জীবন কামনা করেন।

পম্পাইয়ের স্তম্ভের চতুর্দিকে সেরাপিয়াম চত্বরে ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ছিল স্তম্ভের দক্ষিণে অবস্থিত রোমান বাথ (স্নানঘর) এবং স্তম্ভের উত্তর দিকে অবস্থিত প্রিসীন্যা। আয়তক্ষেত্রাকার স্নানঘরের মধ্যে স্নানের জন্য একাধিক জায়গা ছিল। অন্যদিকে প্রিসীন্যা হলো গির্জার বেদীর কাছে রাখা অগভীর পাত্র, যা ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। তবে একথা সত্যি যে, বিগত দু’হাজার বছর ধরে পম্পাইয়ের স্তম্ভ এবং স্তম্ভের দু’পাশে স্ফিংক্স এখনো অক্ষত আছে।

যাহোক, একসময় আমরা পম্পাইয়ের স্তম্ভ থেকে নেমে আসি। নামার পথের বাম দিকে ফুটপাতের পাশেই আছে একাধিক মুণ্ডহীন স্ফিংক্স। এগুলোর মধ্যে কালো গ্রানাইটের স্ফিংক্স ১৮তম রাজবংশের [খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১২৯২ পর্যন্ত বিস্তৃত] শেষ ফ্যারাও হোরেনহেভের আমলের। অন্যদিকে হলুদ ডাইয়োরাইটের স্ফিংক্স ২৬তম রাজবংশের [খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ পর্যন্ত] রাজা Psamtik (Psammetichus)। আমলে [রাজত্বকাল: খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬১০] তৈরি করা হয়।

তারপর আমরা যাই ‘নিলোমিটার’-এর কাছে। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। কথিত আছে, নীল নদের সঙ্গে লেক মারিউতের সংযোগকরী খালে, যা সিডিয়া খাল নামে পরিচিত ছিল, বন্যার সময় নীল নদের পানির উচ্চতা মাপার জন্য সেই নিলোমিটার ব্যবহার করা হতো। নিলোমিটারের স্থাপনা সিঁড়ির মতো। তাই পানির উপরের সিঁড়ির সংখ্যা গুণে নীল নদের পানির উচ্চতা মাপা হতো। যদি পানির উচ্চতা কম হয়, তাহলে ধরা হতো দুর্ভিক্ষ আসন্ন এবং যদি বেশি হয়, তাহলে বুঝে নিতো ভালো ফসলের সম্ভাবনা। তখন পরিস্থিতি বুঝে সেভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া হতো। কথিত আছে, রানী ক্লিওপেট্রার রাজত্বের শেষ দিকে নীল নদের পানির উচ্চতা কমে গিয়েছিল। যার ফলে দেখা দিয়েছিল খরা এবং দুর্ভিক্ষ।

অবশেষে বিদায় নেবার সময় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। চত্বর থেকে বেরিয়ে ডানপাশের ফুটপাত ধরে খাবারের দোকানের দিকে হাঁটতে থাকি। আমরা ধন্যবাদ জানানোর আগেই সিস্টার মাই আমাদের উল্টো ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, ‘তোমাদের উছিলায় প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পরে এসব জায়গায় এলাম। সেই স্কুল জীবনে এসেছিলাম। পরে আর কখনো আসিনি।’

আমি কৃতজ্ঞতার সুরে বললাম, ‘ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্য। কেননা তুমি আমাদের নিয়ে এলে। আমরা দেখলাম। স্মৃতির সিন্দুকে আরো কিছু জমা করে রাখলাম। পরে একসময় সেই বন্ধ সিন্দুক খুলে স্মৃতির অ্যালবাম নিয়ে বসবো এবং তখন তোমার সহযোগিতার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে।’

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আলেকজান্দ্রিয়ার মনতাজা প্রাসাদ এবং রাজকীয় বাগিচায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কেননা সেই জায়গা ছাড়া দেখার মতো আর কোন দর্শনীয় স্থান আলেকজান্দ্রিয়া বাকি ছিল না। তাই শেষ দিনের ভ্রমণসূচিতে কাছাকাছি এ জায়গায় যাওয়া ছাড়া কোন জায়গা বাকি রাখিনি। তার প্রধান কারণ ছিল যে, দুপুরের পরে গোছগাছ করে এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাত দশটায় আমাদের সড়ক পথে কায়রো বিমানবন্দরের পথে রওনা দিতে হবে। সেখানে সিস্টার মাই যোগদান করবে এবং আমরা তিনজন মিলে এক সঙ্গে বিমানে করে লুক্সর যাবো। উল্লেখ্য, সকালেই সিস্টার মাই ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজনে কায়রো গিয়েছে। তা নাহলে তিনি আমাদের সঙ্গে যেতেন। যাহোক আন্টি শুশু (সিস্টার মাইয়ের মামী, যিনি প্রয়াত মিশরীয় সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী) আমাদের জন্য একটা বড় গাড়ি যোগাড় করে দিয়েছেন, যাতে স্যুটকেস এবং ট্রলিব্যাগ অনায়াসে ঢোকানো যায়।

আলেকজান্দ্রিয়ায় আমরা যে হোটেলে থেকেছি, তার সামনের রাস্তা পেরোলেই ঠিক উল্টো দিকে সামান্য বাম পাশে রয়েছে মনতাজা প্রাসাদ ও রাজকীয় বাগিচায় ঢোকার প্রধান ফটক। ফটক পেরিয়ে ঢোকার আগে মনতাজা প্রাসাদ ও বাগান সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করি।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পূর্বাঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেষে নির্মাণ করা হয়েছে মনতাজা প্রাসাদ (যার অপর নাম আল-সালামলিক প্রাসাদ) ও বাগান। পুরো এলাকাটি বিশাল। আনুমানিক তিন শ’ ষাট একর জমির উপর তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মিশর ও সুদানের শেষ খেদিব (ভাইসরয় বা শাসকের খেতাব, যা ১৮০৫ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্য্যন্ত চালু ছিল) দ্বিতীয় আব্বাস হেলমী ভূমধ্যসাগর পাড়ে ঘোড়া এবং গাধায় চড়ে বেড়াতেন। চতুর্দিকের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলীর জন্য তিনি জায়গাটি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। অবশেষে সেখানে গ্রীষ্মকালীন সময়ে অবকাশ যাপনের জন্য তিনি রাজপ্রাসাদ ও বিশাল বাগান নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে পুরো এলাকার পরিসীমা বৃদ্ধি করেন এবং তৈরি করেন দ্বিতীয় প্রাসাদ, যা আল-হারামলিক প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত। আব্বাস হেলমীর মৃত্যুর পরে, বিশেষ করে রাজা প্রথম ফারুকের রাজত্বকাল পর্যন্ত, মনতাজা প্রাসাদের দেখভাল করতেন রাজপরিবার। কিন্তু ১৯৫২ সালের বিদ্রোহীরা রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয় এবং বাগানটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে।

যাহোক, আমরা খেয়াল করিনি যে, মনতাজা প্রাসাদ এবং বাগিচায় ঢুকতে গেলে টিকেট কিনতে হয়। অন্যমনষ্ক হয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। আমাদের কাছে টিকেট চাইলে তথ্য না জানার জন্য দুঃখ প্রকাশ করি। তারপর বাইরে এসে কাউন্টার থেকে প্রত্যেকের জন্য মিশরীয় পঁচিশ পাউন্ড করে দুটি টিকেট কিনে পুনরায় ভেতরে প্রবেশ করি। এবার টিকেট দেখে লোকটি খুশি হয় এবং বলে, শুকরিয়া। আমরাও শুকরিয়া বলে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি।

গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পরই টের পাই রাজকীয় বাগিচার বিশালতা। প্রশস্ত রাস্তার দু’ধারে রয়েছে পথচরীদের জন্য হাঁটার সরু পথ। আমরা ডান পাশের পথ ধরে এগোতে থাকি। খানিকটা দূরে বেশ কয়েকজন মালি বাগানে কাজ করছিল। কেউ আগাছা পরিষ্কার করছিল, আবার কেউ ফুল গাছের গোড়ায় পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছিল। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ ছাড়াও বাগানে রয়েছে অসংখ্য পাম-ট্রী এবং বিরল প্রজাতীর বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ। বেশ খানিকটা দূরে এক জোড়া নর-নারী সামনের দিকে পা মেলে বসেছিল। নিমগ্ন হয়ে তারা হয়তো আগামী দিনের পরিকল্পনা করছিল।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাগিচার অভ্যন্তরে আল-সালামলিক প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ইতোমধ্যে রাস্তার পাশে কয়েকজন পর্যটক দাঁড়িয়ে দেখছিল। উল্লেখ্য, মনতাজা বাগিচার ভেতর যতগুলো প্রাসাদ আছে, সেগুলোর মধ্যে আল-সালামলিকই মূল প্রাসাদ। আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে আমরা যে সময়ে গিয়েছি, তখন প্রাসাদের সংস্কার কাজ চলছিল। তাই আমরা মিউজিয়ামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারিনি। তবে বাইরে থেকে দালানের অপূর্ব কারুকাজ দেখেছি। কেননা প্রাসাদের নকশা অন্যরকম এবং সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের স্থাপত্য। বাইজেন্টাইন স্থাপত্য শৈলীর আধিক্য থাকলেও সেখানে রয়েছে অন্য ধরনের স্থাপত্য, যেমন গথিক, ক্লাসিক এবং ইসলামি শৈলীর স্থাপত্য।

যাহোক, নিবিড় মনে হাঁটার মাঝে একসময় আমরা থেমে গাছের ফাঁকে রঙিন পাখি দেখছিলাম। সেই সময় আচমকা একটা খালি ট্যাক্সি এসে আমাদের পাশে থামে। আমরা থমকে দাঁড়াই। জানালার কাঁচ নামিয়ে ট্যাক্সিচালক নরম গলায় অর্ধেক ইংরেজি এবং বাকিটা আরবি মিশিয়ে যা বললো, তা বাংলায় তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায়: বাগানের পরিসীমা অনেক বড়। সবকিছু দূরে অবস্থিত। হেঁটে সব দেখা যাবে না। তাই সে খুব কম পয়সার বিনিময়ে আমাদের ট্যাক্সিতে নিয়ে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে পারে। ট্যাক্সিচালকের প্রস্তাবে আমরা রাজি হইনি। কেননা আমাদের কোন তাড়া ছিল না। এছাড়া আমাদের হাতে প্রচুর সময় ছিল। অবশেষে ট্যাক্সিচালক হতাশ হয়ে চলে যায়। অবশেষে আমরা হারামলিক প্রাসাদ চত্বরে পৌঁছি। প্রাসাদের সামনেই ভূমধ্যসাগর। দূর থেকে ফেনায়িত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল পাড়ে। আমরা সমুদ্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুনেছি একটানা গর্জন।

তথ্য সূত্রে জেনেছি যে, মিশরের রাজা আহমেদ ফুয়াদের শাসনামলে ১৯২৫ সালে মনতাজা বাগিচার অভ্যন্তরে হারামলিক প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদের ভেতর মাঝখানে খোলা ছাদের বিশাল হলঘর এবং তার চারপাশে রয়েছে বিলাসবহুল বিভিন্ন কামরা। নিচের তলায় ছিল রাজার গ্রীষ্মকালীন সময়ের অফিসঘর এবং ডাইনিং লাউঞ্জ। দ্বিতীয় তলায় রাজা-রানীর কর্মচারীদের আপ্যায়ন করা হতো এবং তৃতীয় তলায় ছিল রাজা-রানীর শয়নকক্ষ, বাচ্চার ঘর এবং বিশাল ব্যালকনি। যাহোক, ১৯৫২ সালের বিদ্রোহের পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসেরের নির্দেশে হারামলিক প্রাসাদকে বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়।

একসময় আমরা হারামলিক প্রাসাদ পেরিয়ে সাগরের পাড়ে যাই। সেখানে দু’জন লোক উচ্ছল তরঙ্গের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাঁতার কাটছে। কয়েকজন স্থানীয় অধিবাসী বালুর উপর শুয়ে সারা শরীরে রোদের তাপ নিচ্ছে। আমরা পানির দিকে না যেয়ে ডানদিকে ঘুরে খানিকটা উঁচু জায়গায় যাই। সেখানে একজন চায়নীজ মহিলা পর্যটক লাল রঙের ড্রাগন আঁকা পোশাক পড়ে এদিক-ওদিক হেলে, কখনো বা মাথা কাত করে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। পাশেই একটা বেঞ্চে আমরা বসি। আমি সাগর পাড়ে তাকিয়ে বালুর উপর আছড়ে পড়া ঢেউ গনি- এক, দুই, তিন... চল্লিশ... নিরানব্বই...। আচমকা আমার পেটের মধ্যে ক্ষুধা নামক জন্তুটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তখনই আমার সংবিৎ ফিরে আসে। মেহেরুনকে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে সে উঠে দাঁড়ায়। হোটেলের পাশে শপিং সেন্টারে খাবারের দোকান। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা পা বাড়াই।

শেষ কথা

অবশেষে একটা সময় এসে সামনে আমাদের দাঁড়ায়, যখন আলেকজান্দ্রিয়ার ভ্রমণ পর্বের ইতি টানতে হয়েছে। জানি, সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে একধরনের দুঃখবোধ থেকে যায়। তবে দু’চোখ ভরে আমরা যেটুকু দেখেছি বা যেসব পুরাকৃতির জায়গায় পা রেখেছি, কিংবা স্পর্শ করেছি স্থাপনা, তার স্মৃতি এবং ভালো লাগার অনুভূতির আবেশে পরিপূর্ণ হয়ে থাক আমাদের বাকি জীবনের অমৃত সুধার পাত্র। আগেই উল্লেখ করেছি যে, মিশর ভ্রমণের পরের পর্বের জন্য সেদিন রাতেই আমরা সড়ক পথে কায়রো রওনা হয়েছি এবং সেখান থেকে প্লেনে চড়ে গিয়েছি লুক্সর।

গ্রিক লেখক, দার্শনিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসবিদ দিয়ো ক্রিসস্টেমের [জন্ম ৪০ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ৪০ খ্রিস্টাব্দ] একটা চরণ উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি লেখা: ‘সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে মিলেমিশে আলেকজান্দ্রিয়া আগে যেমন ছিল, আগামীতেও তেমন থাকবে।’

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ড. মাই শৌম্যানের প্রতি সবিনয় এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কেননা মিশর ভ্রমণে তিনি আমাদের উৎসাহিত করেছেন এবং সারাদিন আমাদের সঙ্গী হয়ে ঘুরেছেন ও দেখিয়েছেন আলেকজান্দ্রিয়ার দর্শনীয় জায়গাগুলো। এছাড়া এই ভ্রমণ গদ্যে ব্যবহৃত কিছু ছবি অন্তর্জালের বিভিন্ন সূত্র থেকে নেয়া হয়েছে এবং বাকি ছবি তুলেছেন মেহেরুন নিসা, সিস্টার মাই, সাদাত মিউজিয়ামের জনৈক নারী নিরাপত্তা কর্মী, কয়েকজন অপরিচিত পথচারী ও পর্যটক এবং লেখক। অন্তর্জাল থেকে যাদের ছবি ব্যবহার করেছি এবং অন্যান্য যারা ছবি তুলেছেন, সবার কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী।]

image

হোটেলের উল্টোদিকে মনতাজা প্রাসাদ ও রাজকীয় বাগিচায় ঢোকার প্রধান ফটক

আরও খবর
জেনারেল করোনা : দ্য কমান্ডার ইন চিফ
সোনার কলম
স্বপ্নের ভাইরাস
সাময়িকী কবিতা

বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২০ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

ভূমধ্যসাগরের রত্নময়ী আলেকজান্দ্রিয়ায়

ফজল হাসান

image

হোটেলের উল্টোদিকে মনতাজা প্রাসাদ ও রাজকীয় বাগিচায় ঢোকার প্রধান ফটক

ভ্রমণ : ছয়

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩২৬ সালে আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণের সময় পম্পাইয়ের স্তম্ভে এসেছিলেন। পম্পাইয়ের স্তম্ভ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। নেট ঘেঁটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ১৮০৩ সালে বৃটিশ রণতরীর কমান্ডার জন শর্টল্যান্ড পম্পাইয়ের স্তম্ভের উপর দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছেন, যার জন্য তিনি চূড়ায় দড়ি ফেলে মই বাঁধতে পেরেছিলেন। পরে সেই দড়ির মই বেয়ে তিনি এবং রণতরীর সারেং জন হোয়াইট স্তম্ভের চূড়ায় আরোহণ করেন। সেখানে তারা ইউনিয়ন জ্যাক [বৃটিশ পতাকা] উত্তোলন করেন এবং রাজা তৃতীয় জর্জের দীর্ঘায়ু কামনা করেন। চারদিন পরে তারা পুনরায় চূড়ায় উঠেন এবং সেখানে আবহাওয়ার যন্ত্র স্থাপন করেন। সেদিন তারা চূড়ায় উঠে গরুর ভাঁজা মাংস খান এবং আবারো রাজার দীর্ঘ জীবন কামনা করেন।

পম্পাইয়ের স্তম্ভের চতুর্দিকে সেরাপিয়াম চত্বরে ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ছিল স্তম্ভের দক্ষিণে অবস্থিত রোমান বাথ (স্নানঘর) এবং স্তম্ভের উত্তর দিকে অবস্থিত প্রিসীন্যা। আয়তক্ষেত্রাকার স্নানঘরের মধ্যে স্নানের জন্য একাধিক জায়গা ছিল। অন্যদিকে প্রিসীন্যা হলো গির্জার বেদীর কাছে রাখা অগভীর পাত্র, যা ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। তবে একথা সত্যি যে, বিগত দু’হাজার বছর ধরে পম্পাইয়ের স্তম্ভ এবং স্তম্ভের দু’পাশে স্ফিংক্স এখনো অক্ষত আছে।

যাহোক, একসময় আমরা পম্পাইয়ের স্তম্ভ থেকে নেমে আসি। নামার পথের বাম দিকে ফুটপাতের পাশেই আছে একাধিক মুণ্ডহীন স্ফিংক্স। এগুলোর মধ্যে কালো গ্রানাইটের স্ফিংক্স ১৮তম রাজবংশের [খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১২৯২ পর্যন্ত বিস্তৃত] শেষ ফ্যারাও হোরেনহেভের আমলের। অন্যদিকে হলুদ ডাইয়োরাইটের স্ফিংক্স ২৬তম রাজবংশের [খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ পর্যন্ত] রাজা Psamtik (Psammetichus)। আমলে [রাজত্বকাল: খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬১০] তৈরি করা হয়।

তারপর আমরা যাই ‘নিলোমিটার’-এর কাছে। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। কথিত আছে, নীল নদের সঙ্গে লেক মারিউতের সংযোগকরী খালে, যা সিডিয়া খাল নামে পরিচিত ছিল, বন্যার সময় নীল নদের পানির উচ্চতা মাপার জন্য সেই নিলোমিটার ব্যবহার করা হতো। নিলোমিটারের স্থাপনা সিঁড়ির মতো। তাই পানির উপরের সিঁড়ির সংখ্যা গুণে নীল নদের পানির উচ্চতা মাপা হতো। যদি পানির উচ্চতা কম হয়, তাহলে ধরা হতো দুর্ভিক্ষ আসন্ন এবং যদি বেশি হয়, তাহলে বুঝে নিতো ভালো ফসলের সম্ভাবনা। তখন পরিস্থিতি বুঝে সেভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া হতো। কথিত আছে, রানী ক্লিওপেট্রার রাজত্বের শেষ দিকে নীল নদের পানির উচ্চতা কমে গিয়েছিল। যার ফলে দেখা দিয়েছিল খরা এবং দুর্ভিক্ষ।

অবশেষে বিদায় নেবার সময় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। চত্বর থেকে বেরিয়ে ডানপাশের ফুটপাত ধরে খাবারের দোকানের দিকে হাঁটতে থাকি। আমরা ধন্যবাদ জানানোর আগেই সিস্টার মাই আমাদের উল্টো ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, ‘তোমাদের উছিলায় প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পরে এসব জায়গায় এলাম। সেই স্কুল জীবনে এসেছিলাম। পরে আর কখনো আসিনি।’

আমি কৃতজ্ঞতার সুরে বললাম, ‘ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্য। কেননা তুমি আমাদের নিয়ে এলে। আমরা দেখলাম। স্মৃতির সিন্দুকে আরো কিছু জমা করে রাখলাম। পরে একসময় সেই বন্ধ সিন্দুক খুলে স্মৃতির অ্যালবাম নিয়ে বসবো এবং তখন তোমার সহযোগিতার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে।’

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আলেকজান্দ্রিয়ার মনতাজা প্রাসাদ এবং রাজকীয় বাগিচায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কেননা সেই জায়গা ছাড়া দেখার মতো আর কোন দর্শনীয় স্থান আলেকজান্দ্রিয়া বাকি ছিল না। তাই শেষ দিনের ভ্রমণসূচিতে কাছাকাছি এ জায়গায় যাওয়া ছাড়া কোন জায়গা বাকি রাখিনি। তার প্রধান কারণ ছিল যে, দুপুরের পরে গোছগাছ করে এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাত দশটায় আমাদের সড়ক পথে কায়রো বিমানবন্দরের পথে রওনা দিতে হবে। সেখানে সিস্টার মাই যোগদান করবে এবং আমরা তিনজন মিলে এক সঙ্গে বিমানে করে লুক্সর যাবো। উল্লেখ্য, সকালেই সিস্টার মাই ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজনে কায়রো গিয়েছে। তা নাহলে তিনি আমাদের সঙ্গে যেতেন। যাহোক আন্টি শুশু (সিস্টার মাইয়ের মামী, যিনি প্রয়াত মিশরীয় সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী) আমাদের জন্য একটা বড় গাড়ি যোগাড় করে দিয়েছেন, যাতে স্যুটকেস এবং ট্রলিব্যাগ অনায়াসে ঢোকানো যায়।

আলেকজান্দ্রিয়ায় আমরা যে হোটেলে থেকেছি, তার সামনের রাস্তা পেরোলেই ঠিক উল্টো দিকে সামান্য বাম পাশে রয়েছে মনতাজা প্রাসাদ ও রাজকীয় বাগিচায় ঢোকার প্রধান ফটক। ফটক পেরিয়ে ঢোকার আগে মনতাজা প্রাসাদ ও বাগান সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করি।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পূর্বাঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেষে নির্মাণ করা হয়েছে মনতাজা প্রাসাদ (যার অপর নাম আল-সালামলিক প্রাসাদ) ও বাগান। পুরো এলাকাটি বিশাল। আনুমানিক তিন শ’ ষাট একর জমির উপর তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মিশর ও সুদানের শেষ খেদিব (ভাইসরয় বা শাসকের খেতাব, যা ১৮০৫ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্য্যন্ত চালু ছিল) দ্বিতীয় আব্বাস হেলমী ভূমধ্যসাগর পাড়ে ঘোড়া এবং গাধায় চড়ে বেড়াতেন। চতুর্দিকের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলীর জন্য তিনি জায়গাটি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। অবশেষে সেখানে গ্রীষ্মকালীন সময়ে অবকাশ যাপনের জন্য তিনি রাজপ্রাসাদ ও বিশাল বাগান নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে পুরো এলাকার পরিসীমা বৃদ্ধি করেন এবং তৈরি করেন দ্বিতীয় প্রাসাদ, যা আল-হারামলিক প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত। আব্বাস হেলমীর মৃত্যুর পরে, বিশেষ করে রাজা প্রথম ফারুকের রাজত্বকাল পর্যন্ত, মনতাজা প্রাসাদের দেখভাল করতেন রাজপরিবার। কিন্তু ১৯৫২ সালের বিদ্রোহীরা রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয় এবং বাগানটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে।

যাহোক, আমরা খেয়াল করিনি যে, মনতাজা প্রাসাদ এবং বাগিচায় ঢুকতে গেলে টিকেট কিনতে হয়। অন্যমনষ্ক হয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। আমাদের কাছে টিকেট চাইলে তথ্য না জানার জন্য দুঃখ প্রকাশ করি। তারপর বাইরে এসে কাউন্টার থেকে প্রত্যেকের জন্য মিশরীয় পঁচিশ পাউন্ড করে দুটি টিকেট কিনে পুনরায় ভেতরে প্রবেশ করি। এবার টিকেট দেখে লোকটি খুশি হয় এবং বলে, শুকরিয়া। আমরাও শুকরিয়া বলে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি।

গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পরই টের পাই রাজকীয় বাগিচার বিশালতা। প্রশস্ত রাস্তার দু’ধারে রয়েছে পথচরীদের জন্য হাঁটার সরু পথ। আমরা ডান পাশের পথ ধরে এগোতে থাকি। খানিকটা দূরে বেশ কয়েকজন মালি বাগানে কাজ করছিল। কেউ আগাছা পরিষ্কার করছিল, আবার কেউ ফুল গাছের গোড়ায় পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছিল। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ ছাড়াও বাগানে রয়েছে অসংখ্য পাম-ট্রী এবং বিরল প্রজাতীর বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ। বেশ খানিকটা দূরে এক জোড়া নর-নারী সামনের দিকে পা মেলে বসেছিল। নিমগ্ন হয়ে তারা হয়তো আগামী দিনের পরিকল্পনা করছিল।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাগিচার অভ্যন্তরে আল-সালামলিক প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ইতোমধ্যে রাস্তার পাশে কয়েকজন পর্যটক দাঁড়িয়ে দেখছিল। উল্লেখ্য, মনতাজা বাগিচার ভেতর যতগুলো প্রাসাদ আছে, সেগুলোর মধ্যে আল-সালামলিকই মূল প্রাসাদ। আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে আমরা যে সময়ে গিয়েছি, তখন প্রাসাদের সংস্কার কাজ চলছিল। তাই আমরা মিউজিয়ামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারিনি। তবে বাইরে থেকে দালানের অপূর্ব কারুকাজ দেখেছি। কেননা প্রাসাদের নকশা অন্যরকম এবং সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের স্থাপত্য। বাইজেন্টাইন স্থাপত্য শৈলীর আধিক্য থাকলেও সেখানে রয়েছে অন্য ধরনের স্থাপত্য, যেমন গথিক, ক্লাসিক এবং ইসলামি শৈলীর স্থাপত্য।

যাহোক, নিবিড় মনে হাঁটার মাঝে একসময় আমরা থেমে গাছের ফাঁকে রঙিন পাখি দেখছিলাম। সেই সময় আচমকা একটা খালি ট্যাক্সি এসে আমাদের পাশে থামে। আমরা থমকে দাঁড়াই। জানালার কাঁচ নামিয়ে ট্যাক্সিচালক নরম গলায় অর্ধেক ইংরেজি এবং বাকিটা আরবি মিশিয়ে যা বললো, তা বাংলায় তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায়: বাগানের পরিসীমা অনেক বড়। সবকিছু দূরে অবস্থিত। হেঁটে সব দেখা যাবে না। তাই সে খুব কম পয়সার বিনিময়ে আমাদের ট্যাক্সিতে নিয়ে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে পারে। ট্যাক্সিচালকের প্রস্তাবে আমরা রাজি হইনি। কেননা আমাদের কোন তাড়া ছিল না। এছাড়া আমাদের হাতে প্রচুর সময় ছিল। অবশেষে ট্যাক্সিচালক হতাশ হয়ে চলে যায়। অবশেষে আমরা হারামলিক প্রাসাদ চত্বরে পৌঁছি। প্রাসাদের সামনেই ভূমধ্যসাগর। দূর থেকে ফেনায়িত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল পাড়ে। আমরা সমুদ্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুনেছি একটানা গর্জন।

তথ্য সূত্রে জেনেছি যে, মিশরের রাজা আহমেদ ফুয়াদের শাসনামলে ১৯২৫ সালে মনতাজা বাগিচার অভ্যন্তরে হারামলিক প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদের ভেতর মাঝখানে খোলা ছাদের বিশাল হলঘর এবং তার চারপাশে রয়েছে বিলাসবহুল বিভিন্ন কামরা। নিচের তলায় ছিল রাজার গ্রীষ্মকালীন সময়ের অফিসঘর এবং ডাইনিং লাউঞ্জ। দ্বিতীয় তলায় রাজা-রানীর কর্মচারীদের আপ্যায়ন করা হতো এবং তৃতীয় তলায় ছিল রাজা-রানীর শয়নকক্ষ, বাচ্চার ঘর এবং বিশাল ব্যালকনি। যাহোক, ১৯৫২ সালের বিদ্রোহের পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসেরের নির্দেশে হারামলিক প্রাসাদকে বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়।

একসময় আমরা হারামলিক প্রাসাদ পেরিয়ে সাগরের পাড়ে যাই। সেখানে দু’জন লোক উচ্ছল তরঙ্গের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাঁতার কাটছে। কয়েকজন স্থানীয় অধিবাসী বালুর উপর শুয়ে সারা শরীরে রোদের তাপ নিচ্ছে। আমরা পানির দিকে না যেয়ে ডানদিকে ঘুরে খানিকটা উঁচু জায়গায় যাই। সেখানে একজন চায়নীজ মহিলা পর্যটক লাল রঙের ড্রাগন আঁকা পোশাক পড়ে এদিক-ওদিক হেলে, কখনো বা মাথা কাত করে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। পাশেই একটা বেঞ্চে আমরা বসি। আমি সাগর পাড়ে তাকিয়ে বালুর উপর আছড়ে পড়া ঢেউ গনি- এক, দুই, তিন... চল্লিশ... নিরানব্বই...। আচমকা আমার পেটের মধ্যে ক্ষুধা নামক জন্তুটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তখনই আমার সংবিৎ ফিরে আসে। মেহেরুনকে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে সে উঠে দাঁড়ায়। হোটেলের পাশে শপিং সেন্টারে খাবারের দোকান। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা পা বাড়াই।

শেষ কথা

অবশেষে একটা সময় এসে সামনে আমাদের দাঁড়ায়, যখন আলেকজান্দ্রিয়ার ভ্রমণ পর্বের ইতি টানতে হয়েছে। জানি, সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে একধরনের দুঃখবোধ থেকে যায়। তবে দু’চোখ ভরে আমরা যেটুকু দেখেছি বা যেসব পুরাকৃতির জায়গায় পা রেখেছি, কিংবা স্পর্শ করেছি স্থাপনা, তার স্মৃতি এবং ভালো লাগার অনুভূতির আবেশে পরিপূর্ণ হয়ে থাক আমাদের বাকি জীবনের অমৃত সুধার পাত্র। আগেই উল্লেখ করেছি যে, মিশর ভ্রমণের পরের পর্বের জন্য সেদিন রাতেই আমরা সড়ক পথে কায়রো রওনা হয়েছি এবং সেখান থেকে প্লেনে চড়ে গিয়েছি লুক্সর।

গ্রিক লেখক, দার্শনিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসবিদ দিয়ো ক্রিসস্টেমের [জন্ম ৪০ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ৪০ খ্রিস্টাব্দ] একটা চরণ উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি লেখা: ‘সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে মিলেমিশে আলেকজান্দ্রিয়া আগে যেমন ছিল, আগামীতেও তেমন থাকবে।’

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ড. মাই শৌম্যানের প্রতি সবিনয় এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কেননা মিশর ভ্রমণে তিনি আমাদের উৎসাহিত করেছেন এবং সারাদিন আমাদের সঙ্গী হয়ে ঘুরেছেন ও দেখিয়েছেন আলেকজান্দ্রিয়ার দর্শনীয় জায়গাগুলো। এছাড়া এই ভ্রমণ গদ্যে ব্যবহৃত কিছু ছবি অন্তর্জালের বিভিন্ন সূত্র থেকে নেয়া হয়েছে এবং বাকি ছবি তুলেছেন মেহেরুন নিসা, সিস্টার মাই, সাদাত মিউজিয়ামের জনৈক নারী নিরাপত্তা কর্মী, কয়েকজন অপরিচিত পথচারী ও পর্যটক এবং লেখক। অন্তর্জাল থেকে যাদের ছবি ব্যবহার করেছি এবং অন্যান্য যারা ছবি তুলেছেন, সবার কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী।]