এক দশকে তিস্তা নদী গিলে খেল দেড়শ’ গ্রাম

তীর রক্ষা হচ্ছে না : ডাম্পিং করা বালির বস্তা ভেসে যাচ্ছে স্রোতের ঘূর্ণিপাকে

‘বাহে হামারগুলার মাঠ ভরা ফসল, গোয়ালভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ আছিল। সগে তিস্তা নদী গিলি খাইছে। এ্যালা আরেকজনের ভিটাবাড়িত আশ্রয় নিছি। সেটেও ভাঙবের ধরছে। এ্যালা হামরা যামো কোটে।’ এমন আর্তনাদের স্বরে নিজেদের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরলেন তিস্তা পাড়ের ভাঙনকবলিত তৈয়ব আলী (৭০), চাঁন মিয়া (৬৬) ও আবুল হোসেন (৬৭)। সবার বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের গাবুর হেলান এলাকায়।

ভাঙনকবলিত এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন গত কয়েক দশক ধরে তীররক্ষা প্রকল্পের কাজ করলেও সেটা রক্ষা করতে পারছে না তারা। এবার তীররক্ষায় ডাম্পিং করা হয়েছে শত শত জিও ব্যাগের বালির বস্তা। কিন্তু তিস্তার প্রলয়ঙ্কর তীব্র ¯্রােতের ঘূর্ণিপাকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেসব সাময়িক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা। প্রতিবছর এভাবে লাখ লাখ টাকা নদীগর্ভে গেলেও টনক নড়ে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। ভাঙন রক্ষায় কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের কথা গত কয়েক দশক ধরে শোনা গেলেও নানা কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে রাজারহাটে বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় দেড়শ’ গ্রাম। বর্তমানে এই এলাকায় হুমকির মুখে রয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, ৬টি ক্রসবাঁধ, ২টি বেরিবাঁধ, বেশ কয়েকটি হাট-বাজারসহ কয়েক একর ফসলি জমি। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গাবুর হেলান, ডাংরারহাট, চতুরা, কালিরহাট ও বুড়িরহাট এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি সরিয়ে পার্শ্ববর্তী বাঁধের রাস্তায় কিংবা উঁচুস্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।

চলতি বর্ষা মৌসুমে তিনদফা বন্যা ও তিস্তার প্রবল ভাঙনে অর্ধশত ঘর-বাড়িসহ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ভাঙনকবলিত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে করেছেন নদী পাড়ের মানুষ। ভাঙনকবলিত এলাকার গাবুর হেলান গ্রামের আইজার আলী (৫৬), আবদুল হানিফ (৬৫) ও আবদুল মান্নান (৬০) জানান, সরকারিভাবে যে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি তাতে আমাদের কিছুই হয় না। আমরা সাহায্য চাই না, নদী শাসনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা চাই।

ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন রাজারহাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দ্দী বাপ্পি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম, তিস্তা নদীরক্ষা জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাংবাদিক আলতাফ হোসেন সরকার, বিদ্যানন্দ ইউপি চেয়ারম্যান মো. তাইজুল ইসলামসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানান।

বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. তাইজুল ইসলাম জানান, মানচিত্র থেকে আমার ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডের দুইভাগ নদীগর্ভে চলে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে নদী খনন করা হলে ভাঙন কমে যাবে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, সরকার তিস্তা নদী তীরবর্তী ৪টি জেলা যথাক্রমে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার কিছু অংশ নিয়ে চায়না সরকারের পাওয়ার চায়না কোম্পানির সঙ্গে ২০১৯ সালে একটি চুক্তি করেছে। এতে পারমানেন্টভাবে নদী শাসন ব্যবস্থাপনা থাকবে। বিষয়টি স্টাডি হয়েছে। লোন স্যাংশন হয়েছে। বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ৮ হাজার ২শ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন হলে তিস্তা পাড়ের মানুষের আর কষ্ট থাকবে না। এটি অর্থনৈতিক জোন হিসেবে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে।

image

কুড়িগ্রাম : ভিটেমাটি হারানোর বুক ফাটা কান্না কারও নজরে আসে না। ছবিটি রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের গাবুর হেলান থেকে সংগৃহীত - সংবাদ

আরও খবর
দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গৃহস্থালির সেবামূলক শ্রমকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
ব্যথা সারানোর কার্যকর যন্ত্র উদ্ভাবন করল ঢাবি গবেষকরা
ঢাবি অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি
রাঙ্গামাটিতে দুর্বৃত্তের গুলিতে একজন নিহত
বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় গ্রাহকদের দুর্ভোগ
শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা পলাশ ভাগিনাসহ গ্রেফতার
রংপুর ছাত্রলীগ নেতা রনির বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করে জীবন বিপন্ন স্কুলশিক্ষিকার
বালিশ কাণ্ডের ঠিকাদার শাহাদাতের জামিন বাতিলের আবেদন
টিপু সুলতানের ঋণ জালিয়াতি মামলার চার্জশিট শীঘ্রই
নবজাতকের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে প্রাণ গেল বাবা-মাসহ ৬ জনের

বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২০ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

এক দশকে তিস্তা নদী গিলে খেল দেড়শ’ গ্রাম

তীর রক্ষা হচ্ছে না : ডাম্পিং করা বালির বস্তা ভেসে যাচ্ছে স্রোতের ঘূর্ণিপাকে

হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম

image

কুড়িগ্রাম : ভিটেমাটি হারানোর বুক ফাটা কান্না কারও নজরে আসে না। ছবিটি রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের গাবুর হেলান থেকে সংগৃহীত - সংবাদ

‘বাহে হামারগুলার মাঠ ভরা ফসল, গোয়ালভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ আছিল। সগে তিস্তা নদী গিলি খাইছে। এ্যালা আরেকজনের ভিটাবাড়িত আশ্রয় নিছি। সেটেও ভাঙবের ধরছে। এ্যালা হামরা যামো কোটে।’ এমন আর্তনাদের স্বরে নিজেদের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরলেন তিস্তা পাড়ের ভাঙনকবলিত তৈয়ব আলী (৭০), চাঁন মিয়া (৬৬) ও আবুল হোসেন (৬৭)। সবার বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের গাবুর হেলান এলাকায়।

ভাঙনকবলিত এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন গত কয়েক দশক ধরে তীররক্ষা প্রকল্পের কাজ করলেও সেটা রক্ষা করতে পারছে না তারা। এবার তীররক্ষায় ডাম্পিং করা হয়েছে শত শত জিও ব্যাগের বালির বস্তা। কিন্তু তিস্তার প্রলয়ঙ্কর তীব্র ¯্রােতের ঘূর্ণিপাকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেসব সাময়িক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা। প্রতিবছর এভাবে লাখ লাখ টাকা নদীগর্ভে গেলেও টনক নড়ে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। ভাঙন রক্ষায় কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের কথা গত কয়েক দশক ধরে শোনা গেলেও নানা কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে রাজারহাটে বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় দেড়শ’ গ্রাম। বর্তমানে এই এলাকায় হুমকির মুখে রয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, ৬টি ক্রসবাঁধ, ২টি বেরিবাঁধ, বেশ কয়েকটি হাট-বাজারসহ কয়েক একর ফসলি জমি। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গাবুর হেলান, ডাংরারহাট, চতুরা, কালিরহাট ও বুড়িরহাট এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি সরিয়ে পার্শ্ববর্তী বাঁধের রাস্তায় কিংবা উঁচুস্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।

চলতি বর্ষা মৌসুমে তিনদফা বন্যা ও তিস্তার প্রবল ভাঙনে অর্ধশত ঘর-বাড়িসহ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ভাঙনকবলিত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে করেছেন নদী পাড়ের মানুষ। ভাঙনকবলিত এলাকার গাবুর হেলান গ্রামের আইজার আলী (৫৬), আবদুল হানিফ (৬৫) ও আবদুল মান্নান (৬০) জানান, সরকারিভাবে যে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি তাতে আমাদের কিছুই হয় না। আমরা সাহায্য চাই না, নদী শাসনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা চাই।

ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন রাজারহাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহিদ ইকবাল সোহরাওয়ার্দ্দী বাপ্পি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম, তিস্তা নদীরক্ষা জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাংবাদিক আলতাফ হোসেন সরকার, বিদ্যানন্দ ইউপি চেয়ারম্যান মো. তাইজুল ইসলামসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানান।

বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. তাইজুল ইসলাম জানান, মানচিত্র থেকে আমার ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডের দুইভাগ নদীগর্ভে চলে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে নদী খনন করা হলে ভাঙন কমে যাবে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, সরকার তিস্তা নদী তীরবর্তী ৪টি জেলা যথাক্রমে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার কিছু অংশ নিয়ে চায়না সরকারের পাওয়ার চায়না কোম্পানির সঙ্গে ২০১৯ সালে একটি চুক্তি করেছে। এতে পারমানেন্টভাবে নদী শাসন ব্যবস্থাপনা থাকবে। বিষয়টি স্টাডি হয়েছে। লোন স্যাংশন হয়েছে। বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ৮ হাজার ২শ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন হলে তিস্তা পাড়ের মানুষের আর কষ্ট থাকবে না। এটি অর্থনৈতিক জোন হিসেবে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে।