প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার আগে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে

কোভিড-১৯ সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নির্দেশিকায় বলা হয়েছেÑ যখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হোক তখন যেন নির্দেশনা মেনে বিদ্যালয় খোলা যায়, তেমন প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার এ নির্দেশিকা প্রকাশ করে। সেখানে অর্ধশতাধিক নির্দেশনা রয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের ওপর পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির খসড়াসহ একটি উপস্থাপনা প্রদানের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

দেশে করোনা সংক্রমণ যখন নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায়, বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে যখন প্রায় প্রতিদিনই প্রায় অর্ধ-শতাধিক মৃত্যুর কথা জানাচ্ছে সরকারি সূত্র, সেই প্রেক্ষাপটে স্কুল খোলার ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন অতি উৎসাহ আমাদের শঙ্কিত করে। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকেই সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি চিন্তিত। করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অনিচ্ছুক। অথচ অভিভাবকদের সঙ্গে কোনরকম আলোচনা না করে, তাদের মতামত না নিয়েই তাদের শিশুদের বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূর্ব ধারণার চাইতেও দীর্ঘ সময়জুড়ে স্থায়ী হতে পারে করোনাভাইরাসের চলমান মহামারী। উন্নত দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, উন্নয়নশীল দেশে যেমন- দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনও লাগামহীন গতিতে বাড়ছে। এ অবস্থার মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার উদ্যোগ নিলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস এখন বাতাসে ভর করে বিস্তার লাভ করছে। ভাইরাসের ‘বায়ুবাহী’ বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে; ঘরের ভেতরে বেশি মানুষের ভিড়ে এবং যেখানে মুক্তভাবে বায়ুপ্রবাহের সুযোগ কম এমন আবদ্ধ স্থানে। শ্রেণীকক্ষে এমন পরিবেশ থাকায় সংক্রমণ ঝুঁকিও অনেক বেশি।

একটি বিষয়ে গবেষকরা প্রায় একমত যে, সংক্রমণ হার বেশি থাকা অবস্থায় কোনো দেশের জন্যই বিদ্যালয় চালু করা ঝুঁকিমুক্ত নয়। সংক্রমণ মোকাবিলায় সফল ইউরোপের কয়েকটি দেশে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরিধানের মাধ্যমে অনেকটাই ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়। তবে যে দেশটি এমন সতর্কতা বিধি মেনে পাঠদান শুরু করবে, ওই দেশের মহামারী পরিস্থিতি কেমন- তার ওপরই আলোচিত পদক্ষেপের সফলতা নির্ভর করে। অর্থাৎ ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার চলছে এমন অঞ্চলে এসব পদক্ষেপ খুব একটা সুরক্ষা দেবে না, বরং উল্টো শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করবে।

অনেক দেশই বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর কথা ভাবছে না, ভাবা উচিতও নয়। বাংলাদেশে স্কুল চালু করার মতো পরিস্থিতি কবে হবে, তা নির্ভর করবে পুরো করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার ওপর। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফলতার পর যখন নতুন সংক্রমণ হার স্থিরভাবে পড়তির দিকে অবস্থান করবে, কেবলমাত্র তখনই বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। যদি এরপরও জরুরি কোন কারণ দেখিয়ে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তবে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং সামাজিক দূরত্বের বিধি মেনেই সীমিত আকারে ক্লাস শুরুর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংক্রমণ শনাক্তে নিয়মিত করোনা পরীক্ষা চালাতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২০ মহররম ১৪৪২, ২২ ভাদ্র ১৪২৭

প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার আগে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে

কোভিড-১৯ সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নির্দেশিকায় বলা হয়েছেÑ যখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হোক তখন যেন নির্দেশনা মেনে বিদ্যালয় খোলা যায়, তেমন প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার এ নির্দেশিকা প্রকাশ করে। সেখানে অর্ধশতাধিক নির্দেশনা রয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের ওপর পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির খসড়াসহ একটি উপস্থাপনা প্রদানের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

দেশে করোনা সংক্রমণ যখন নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায়, বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে যখন প্রায় প্রতিদিনই প্রায় অর্ধ-শতাধিক মৃত্যুর কথা জানাচ্ছে সরকারি সূত্র, সেই প্রেক্ষাপটে স্কুল খোলার ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন অতি উৎসাহ আমাদের শঙ্কিত করে। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকেই সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি চিন্তিত। করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অনিচ্ছুক। অথচ অভিভাবকদের সঙ্গে কোনরকম আলোচনা না করে, তাদের মতামত না নিয়েই তাদের শিশুদের বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূর্ব ধারণার চাইতেও দীর্ঘ সময়জুড়ে স্থায়ী হতে পারে করোনাভাইরাসের চলমান মহামারী। উন্নত দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, উন্নয়নশীল দেশে যেমন- দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনও লাগামহীন গতিতে বাড়ছে। এ অবস্থার মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার উদ্যোগ নিলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস এখন বাতাসে ভর করে বিস্তার লাভ করছে। ভাইরাসের ‘বায়ুবাহী’ বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে; ঘরের ভেতরে বেশি মানুষের ভিড়ে এবং যেখানে মুক্তভাবে বায়ুপ্রবাহের সুযোগ কম এমন আবদ্ধ স্থানে। শ্রেণীকক্ষে এমন পরিবেশ থাকায় সংক্রমণ ঝুঁকিও অনেক বেশি।

একটি বিষয়ে গবেষকরা প্রায় একমত যে, সংক্রমণ হার বেশি থাকা অবস্থায় কোনো দেশের জন্যই বিদ্যালয় চালু করা ঝুঁকিমুক্ত নয়। সংক্রমণ মোকাবিলায় সফল ইউরোপের কয়েকটি দেশে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরিধানের মাধ্যমে অনেকটাই ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়। তবে যে দেশটি এমন সতর্কতা বিধি মেনে পাঠদান শুরু করবে, ওই দেশের মহামারী পরিস্থিতি কেমন- তার ওপরই আলোচিত পদক্ষেপের সফলতা নির্ভর করে। অর্থাৎ ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার চলছে এমন অঞ্চলে এসব পদক্ষেপ খুব একটা সুরক্ষা দেবে না, বরং উল্টো শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করবে।

অনেক দেশই বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর কথা ভাবছে না, ভাবা উচিতও নয়। বাংলাদেশে স্কুল চালু করার মতো পরিস্থিতি কবে হবে, তা নির্ভর করবে পুরো করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার ওপর। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফলতার পর যখন নতুন সংক্রমণ হার স্থিরভাবে পড়তির দিকে অবস্থান করবে, কেবলমাত্র তখনই বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। যদি এরপরও জরুরি কোন কারণ দেখিয়ে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তবে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং সামাজিক দূরত্বের বিধি মেনেই সীমিত আকারে ক্লাস শুরুর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংক্রমণ শনাক্তে নিয়মিত করোনা পরীক্ষা চালাতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।