জাতিসংঘের কাছে প্রত্যাশা

জাতিসংঘের আসন্ন ৭৫তম অধিবেশন ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশ্বনেতাদের মিলনমেলা বসে। তবে এবার সে সুযোগ নেই। অধিবেশনের প্রথাগত ঐতিহ্য ভেঙে এবারই প্রথম অনলাইনে সাধারণ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। মাধ্যম যা-ই হোক না কেন, সাম্প্রতিক সময় বিবেচনায় বিভিন্ন কারণে এবারের অধিবেশনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে পৃথিবীর বেশ কিছু চলমান সমস্যা নিয়ে সদস্য দেশসমূহের মধ্যে আলোচনা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে সময়োপযোগী ও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। এসব বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে কোভিড-১৯ সংকট। মহামারী শুরুর পর এটিই বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রথম সম্মেলন। তাই মহামারী মোকাবিলায় সকল দেশ একযোগে কাজ করার ব্যাপারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মহামারীর প্রকোপ কীভাবে কমানো যায়, ভ্যাকসিন তৈরি ও তা পৃথিবীর সকল মানুষের হাতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া কীরূপ হবে সেটিও এবারের মূল আলোচ্য বিষয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম পৃথিবী এ ধরনের সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছে। তাই পরবর্তী সময়ে সংকট মোকাবেলায় পৃথিবীর প্রস্তুতি কেমন হবে তার একটি রূপরেখা এখন থেকেই তৈরি করা দরকার। এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ের দায়িত্ব নিতে হবে জাতিসংঘকেই।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে আলোচনারও যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। সংকটের ধরণ সবসময়ই এক থাকে না। পৃথিবীর তাপমাত্রা এবং কার্বন নিঃসরণ যেভাবে বাড়ছে, তা কমানো না গেলে পরবর্তীতে বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হবে, যা মোকাবেলার জন্য হিমশিম খেতে হবে পৃথিবীর মানুষকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মূলত উন্নত দেশগুলোই দায়ী। কিন্তু এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে অনুন্নত দেশগুলোকে? জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান সংকট নিরসনে জাতিসংঘকেই এগিয়ে আসতে হবে। এই দুই শক্তিধর দেশের সাম্প্রতিক কর্মকাৗÍ নতুন একটি স্নায়ুযুদ্ধের আভাস দিচ্ছে, সময়ের ব্যবধানে যার সামরিকরূপ লাভেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ কিংবা সামরিক যুদ্ধ- উভয়ই পৃথিবীর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সৌহাদ্যের পথে আনতে এবারের অধিবেশনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

চতুর্থত, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমশ বেড়ে চলা আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনের সম্ভাব্য উপায়সমূহ খুঁজে বের করতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক গত কয়েক দশকের মধ্যে সবথেকে উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণাম সংঘাত। উল্লেখ্য যে, চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের অবস্থান এই অঞ্চলে। বিশ্বশান্তি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্প্রীতি অপরিহার্য। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই এর একটি সমাধান হওয়া দরকার।

পঞ্চমত, কোভিড-১৯ এর তাৗবে বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোর যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণে পৃথিবীর সকল দেশকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতিকে কীভাবে সচল করা যায়, তার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক তহবিল গঠনের মাধ্যমে পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় এগিয়ে আসার ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়াও পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশুহত্যা, শরণার্থী সংকটসহ বিশ্বের আরো নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে শুধু আলোচনা পর্যন্ত ইতি টানলেই হবে না, বরং বৈশ্বিক এই সংকট থেকে উত্তরণের পথে কার্যকরী কর্মপন্থা হাতে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বনেতৃবৃন্দের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এক্ষেত্রে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর ঐক্য-ই সবচেয়ে বেশি জরুরি। আর জরুরি এবং একইসঙ্গে কঠিন এই কাজটি জাতিসংঘকেই করতে হবে। জাতিসংঘের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, শক্তিশালী দেশগুলোর হস্তক্ষেপে অনেক সময়ই জাতিসংঘ নিজস্ব কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারে না। তবে বৈশ্বিক সংকটের জন্য যে ঐক্যের দরকার, একমাত্র জাতিসংঘ-ই পারে সেটি তৈরি করতে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আবার, মানবজাতিকে সংকটের হাত থেকে বাঁচানোরও মোক্ষম সময় এটি। তাই এই পর্যায়ে জাতিসংঘের সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ এসে পড়েছে। জাতিসংঘ কি পারবে বিদ্যমান সংকটগুলো নিরসনে বিশ্বনেতাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি নিরাপদ পৃথিবী বিনির্মাণের ঘোষণা দিতে? উত্তরের অপেক্ষায় পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষ।

ফারহান ইশরাক

শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও খবর

শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২১ মহররম ১৪৪২, ২৩ ভাদ্র ১৪২৭

জাতিসংঘের কাছে প্রত্যাশা

জাতিসংঘের আসন্ন ৭৫তম অধিবেশন ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশ্বনেতাদের মিলনমেলা বসে। তবে এবার সে সুযোগ নেই। অধিবেশনের প্রথাগত ঐতিহ্য ভেঙে এবারই প্রথম অনলাইনে সাধারণ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। মাধ্যম যা-ই হোক না কেন, সাম্প্রতিক সময় বিবেচনায় বিভিন্ন কারণে এবারের অধিবেশনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনে পৃথিবীর বেশ কিছু চলমান সমস্যা নিয়ে সদস্য দেশসমূহের মধ্যে আলোচনা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে সময়োপযোগী ও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। এসব বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে কোভিড-১৯ সংকট। মহামারী শুরুর পর এটিই বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রথম সম্মেলন। তাই মহামারী মোকাবিলায় সকল দেশ একযোগে কাজ করার ব্যাপারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মহামারীর প্রকোপ কীভাবে কমানো যায়, ভ্যাকসিন তৈরি ও তা পৃথিবীর সকল মানুষের হাতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া কীরূপ হবে সেটিও এবারের মূল আলোচ্য বিষয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম পৃথিবী এ ধরনের সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছে। তাই পরবর্তী সময়ে সংকট মোকাবেলায় পৃথিবীর প্রস্তুতি কেমন হবে তার একটি রূপরেখা এখন থেকেই তৈরি করা দরকার। এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ের দায়িত্ব নিতে হবে জাতিসংঘকেই।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে আলোচনারও যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। সংকটের ধরণ সবসময়ই এক থাকে না। পৃথিবীর তাপমাত্রা এবং কার্বন নিঃসরণ যেভাবে বাড়ছে, তা কমানো না গেলে পরবর্তীতে বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হবে, যা মোকাবেলার জন্য হিমশিম খেতে হবে পৃথিবীর মানুষকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মূলত উন্নত দেশগুলোই দায়ী। কিন্তু এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে অনুন্নত দেশগুলোকে? জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান সংকট নিরসনে জাতিসংঘকেই এগিয়ে আসতে হবে। এই দুই শক্তিধর দেশের সাম্প্রতিক কর্মকাৗÍ নতুন একটি স্নায়ুযুদ্ধের আভাস দিচ্ছে, সময়ের ব্যবধানে যার সামরিকরূপ লাভেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ কিংবা সামরিক যুদ্ধ- উভয়ই পৃথিবীর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সৌহাদ্যের পথে আনতে এবারের অধিবেশনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

চতুর্থত, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমশ বেড়ে চলা আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনের সম্ভাব্য উপায়সমূহ খুঁজে বের করতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক গত কয়েক দশকের মধ্যে সবথেকে উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণাম সংঘাত। উল্লেখ্য যে, চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের অবস্থান এই অঞ্চলে। বিশ্বশান্তি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্প্রীতি অপরিহার্য। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই এর একটি সমাধান হওয়া দরকার।

পঞ্চমত, কোভিড-১৯ এর তাৗবে বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোর যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণে পৃথিবীর সকল দেশকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতিকে কীভাবে সচল করা যায়, তার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক তহবিল গঠনের মাধ্যমে পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় এগিয়ে আসার ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়াও পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশুহত্যা, শরণার্থী সংকটসহ বিশ্বের আরো নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে শুধু আলোচনা পর্যন্ত ইতি টানলেই হবে না, বরং বৈশ্বিক এই সংকট থেকে উত্তরণের পথে কার্যকরী কর্মপন্থা হাতে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বনেতৃবৃন্দের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এক্ষেত্রে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর ঐক্য-ই সবচেয়ে বেশি জরুরি। আর জরুরি এবং একইসঙ্গে কঠিন এই কাজটি জাতিসংঘকেই করতে হবে। জাতিসংঘের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, শক্তিশালী দেশগুলোর হস্তক্ষেপে অনেক সময়ই জাতিসংঘ নিজস্ব কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারে না। তবে বৈশ্বিক সংকটের জন্য যে ঐক্যের দরকার, একমাত্র জাতিসংঘ-ই পারে সেটি তৈরি করতে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আবার, মানবজাতিকে সংকটের হাত থেকে বাঁচানোরও মোক্ষম সময় এটি। তাই এই পর্যায়ে জাতিসংঘের সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ এসে পড়েছে। জাতিসংঘ কি পারবে বিদ্যমান সংকটগুলো নিরসনে বিশ্বনেতাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি নিরাপদ পৃথিবী বিনির্মাণের ঘোষণা দিতে? উত্তরের অপেক্ষায় পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষ।

ফারহান ইশরাক

শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়