একজন সাহসী সম্পাদকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

হারুন হাবীব

ত্রিপুরা আমার মূল কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি মুক্তিযুদ্ধে, যদিও রণাঙ্গন সাংবাদিকতার কাজে বারকয়েক আগরতলা যেতে হয়েছিল। সেই সুবাদে দৈনিক সংবাদ ও তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শ্রী ভূপেন দত্ত ভৌমিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ওই পরিচয় তেমন গভীর হয়নি। তবে তাকে বেশি করে জানবার সুযোগ হয় কয়েক বছর পর, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার গণমানুষের ভূমিকার ওপর যখন একটি গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করি।

ভূপেন দত্ত ভৌমিক সম্পর্কে এ লেখাটি একজন সাহসী সম্পাদকের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি; যার প্রায় সবটুকুই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকাকে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালে তার পত্রিকার অফিস ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন আগরতলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। দেশত্যাগী সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ছাত্রনেতা- এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সমর কর্মকাণ্ডে যুক্ত অন্যতম বেসামরিক ও সামরিক ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ দৈনিক সংবাদের জগন্নাথ বাড়ি রোডের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে।

১৯৭১ সালের আগরতলা সব অর্থেই বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিশ্ব খবরের ডেটলাইন হয়ে ওঠে। ভারতীয় সংবাদকর্মীদের ভিড়ের বাইরেও অসংখ্য ভিনদেশি সাংবাদিক এসে জড়ো হন এই ছোট্ট শহরে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে তারা যুদ্ধ ও শরণার্থী পরিস্থিতির খবর পরিবেশন করেন আগরতলায় বসে।

সেদিনকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের অন্যতম মূল পত্রিকা দৈনিক সংবাদ; যা পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে পত্রিকাটির পুরনো সংখ্যাগুলো দেখবার সুযোগ হয় আমার। অতএব বলতেই পারি যে, শ্রী ভৌমিক সম্পাদিত কাগজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে পূর্ব পাকিস্তানের টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহ পরম মমতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তুলে ধরার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। ভূপেন বাবুকে আমি স্মরণ করি আরও একটি কারণে; তার অফিসে বসিয়ে, অনেক সময় নিজে সময় দিয়ে, পুরনো ফাইল ঘেটে পরম আতিথেয়তায় আমার কাজটি সম্পন্ন করাতে সহায়তা করেছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল ত্রিপুরায় শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের কংগ্রেস সরকার। অতএব সরকারি সামর্থ্য ছিল শাসক দলের হাতে। প্রবীন জননেতা শ্রী নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিএম। যার যার অবস্থান রক্ষা করা সত্ত্বেও সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিটি দল বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাজ্যের দলগোষ্ঠীগুলো প্রায় প্রতিদিন সভা-সমাবেশ করেছে, গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে জনমত গড়ে তুলেছে।

শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার বুকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় রাজ্যের শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীগণ মাঠে নামেন অভূতপূর্বভাবে। পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ১ এপ্রিল ১৯৭১ রাজ্যের লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা আগরতলার পোস্টঅফিস চৌমুহনী থেকে বিশাল এক মিছিল বের করেন। ৩ এপ্রিল পালিত হয় ১২ ঘণ্টার ‘ত্রিপুরা বন্ধ’, ছাত্র যুবক শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের মাটিতে নিষ্ঠুর সামরিক আগ্রাসনের খবর ব্যাপকভাবে ত্রিপুরাবাসীকে আলোড়িত করে। রাজ্যের মোট জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে ওঠে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু। রাজ্যের সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ২৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বিধানসভায় বাংলাদেশ নিয়ে সর্বপ্রথম একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ৩১ মার্চ ১৯৭১ রাজ্য আইন সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাস হয়। সে প্রস্তাবে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি দাবি করা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহমর্মিতা জানানো হয়। একই সঙ্গে ত্রিপুরা বিধান সভা সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের কাছে দাবি উত্থাপন করে।

এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রধান সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদ ও তার সম্পাদক প্রভূত ভূমিকা রেখে চলেন। ‘বাংলাদেশ-মাটি ও মানুষ’ শিরোনামে একাধিকবার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে দৈনিক সংবাদ। এসব সংখ্যায় পাকিস্তানিদের গণহত্যা, নির্যাতন ও স্বাধীন বাংলার নব-উত্থানকে স্বাগত জানিয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা লেখেন বিপুল মজুমদার, অনির্বাণ দত্ত, অগ্নিমিত্র, ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য প্রমুখ। এ বিশেষ ধারাবাহিক প্রকাশনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সম্পাদক শ্রী ভৌমিক লেখেন : ‘বাংলাদেশ-মাটি ও মানুষ’ এ বিষয়ের ওপর আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য পদ্মা-মেঘনা পারের যে জীবন এতদিন নাচতো ধানের ক্ষেতে, বাতাসের দোলায়িত ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, গহীন নদীর স্রোতের মতো যার ছিল একটানা গতি, কাঁচা ধান আর পাটের সোঁদা গন্ধ বুক ভরে নিয়ে যে জীবন ছিল শত দুঃখের ও দারিদ্র্যের মধ্যেও পথের পাশে ফুটে ওঠা ঘেঁটু ফুলের মতো তাজা- সেই জীবনের ছন্দ, রূপ আর গতি কী করে পাল্টে গেল, কী করে ওদের কোমল বুকের মৃদু ধুকধুকানিতে শব্দ জেগে উঠল, সারি, জারি আর মুর্শিদী গানে যে ক্রবন উৎকর্ণ হতো; সে কান আজ গুলির শব্দে আর পাখি পড়ার শব্দে কেন এত সতর্ক। মসজিদে আজান আর মন্দিরের সন্ধ্যারতির কাঁসর ঘণ্টায় যে জীবন বন্দনা করত, মানুষের কল্যাণকে সে আজ কেনো খেলছে রক্তের হোলি উৎসব! ...বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার সংগ্রাম জীবনের সংগ্রাম, সংস্কৃতি সংগ্রাম এক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ-মাটি ও মানুষ তারই একটা ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা।’

পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোলাটে এবং উত্তেজক তখন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তিনি বন্দী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতা ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বেশির ভাগ নেতাকর্মী পৌঁছেছেন আগরতলায়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। এ সময়ে আগরতলায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেন। তারা ২ এপ্রিল ১৯৭১ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন।

সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য্যরে মেলার মঠের বাড়িতে সেদিনের বৈঠকটি ছিল একটি মাইলফলক। চট্টগ্রামের প্রবীণ জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভা থেকে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এমএনএ, এমপিএ বিশ্ববাসীর কাছে সর্বপ্রথম এক যৌথ বিবৃতি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। সে বিবৃতি পাঠানো হয় জাতিসংঘের মহাসচিব ইউ থান্ট কে। Stop this Genocide, ‘বন্ধ কর এই গণহত্যা’ শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হয় বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম বিবৃতি। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী এবং পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’ সাময়িকীর প্রতিনিধি অমর রাহা বিবৃতির খসড়া তৈরিতে সহায়তা করেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীর হস্তক্ষেপ কামনা করে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে এটিই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক আবেদন, যা আগরতলার দৈনিক সংবাদ স্ববিস্তারে প্রকাশ করে।

ত্রিপুরার মাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আরও একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। আগরতলা সার্কিট হাউসে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির প্রথম বৈঠক বসে। ১১ ও ১২ এপ্রিলের ওই বৈঠকেই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। উপরাষ্ট্রপতি হন দলের জেষ্ঠ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোসতাক আহমদ হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্য হলেন- ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান।

স্বাধীন বাংলার সরকার গঠনের খবরটি শুধু ভারতের সংবাদপত্রে নয়, সারা বিশ্বেই প্রচারিত হয়। ‘দৈনিক সংবাদ’-এ ১৩ এপ্রিলের ব্যানার হেডলাইনটি ছিল এ রকম : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে রক্ত ও অগ্নিশুদ্ধ স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষিত।’

খবরের সারাংশ যেমন আবেগময় তেমনি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলা বেতারের ঘোষণা ধরে দৈনিক সংবাদ লেখে : ‘জয় বাংলা। স্বাধীন বাংলায় স্বাধীন সরকার গঠিত হয়েছে। একটি আকাক্সিক্ষত প্রত্যাশিত বাঞ্ছিত ঘোষণা। শোণিত তর্পণে শুদ্ধ অগ্নিপুঞ্জ সরকার। জয় বাংলার জয়। জয় স্বাধীনতার জয়। মর্ত্যরে জয় মানুষের জয়। বৃষ্টিস্নাত বাংলার আকাশ থেকে শোনা গেল আজ সেই দীর্ঘ প্রত্যাশিত ঘোষণা। আবার শোনা যাবে ১৩ এপ্রিলের সকাল ৯টায়। স্বাধীন বাংলা সরকার গঠিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে তার মন্ত্রিসভা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রনায়ক। তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গায় হবে স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দফতর (যদিও শেষ পর্যন্ত জায়গা পরিবর্তন করে তা মেহেরপুরে হয়েছিল)। ’

সরকার গঠনের সিদ্ধান্তসহ মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের ঘটনাবলিকে স্ববিস্তারে তোলে ধরে দৈনিক সংবাদ, দেশের কথা, জাগরণ ও সাপ্তাহিক সমাচার। তাদের সংবাদ পরিবেশনে যে ভাষা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তা সামরিক নির্যাতনে পিষ্ট ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত লাখ লাখ শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার মনোবল ফিরিয়ে আনতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল। ত্রিপুরা থেকে সে সময় আরও তিনজন সাংবাদিক নিরলসভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্টিং করেন- কলকাতা স্টেটসম্যানের আগরতলা প্রতিনিধি সত্যব্রত চক্রবর্তী, যুগান্তরের অনিল ভট্টাচার্য্য ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি জে. পি. সাইকিয়া। এদের সঙ্গে ছিলেন পিটিআইয়ের আগরতলা প্রধান মধুসুধন গূহ রায়। দৈনিক সংবাদের প্রতিনিধি হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদন লেখেন বিকচ চৌধুরী। অগণিত ছবি তোলেন মুক্তিযুদ্ধের রবীন সেনগুপ্ত, চিত্ত সেন এবং দীলিপ দেবরায়- ত্রিপুরার এই তিন ফটোগ্রাফার।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ১৭ এপ্রিলের ভাষণের খবর প্রচার করে দৈনিক সংবাদ এভাবে : ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দকে যে বাংলাদেশ তাদের জাতীয় জীবনের মুক্তির দিশারিরূপে মেনে নিয়েছে, এমন কোনো দুর্দৈব বা এমন কোনো শক্তি নেই যা এই বাংলার স্বাধীনতার স্পৃহাকে পরাভূত করতে পারে। যতদিন চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা আকাশে থাকবে ততদিন বাংলার স্বাধীনতা সূর্যও অম্লান থাকবে। ...এক বিশেষ উৎসবে এই নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়। নতুন মন্ত্রিসভা হাজার হাজর উদ্বেলিত মানুষের অভিনন্দন গ্রহণ করেন। দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে উৎসবের বিবরণ সংগ্রহ করেন।’

আমার জানামতে, অসংখ্য সম্পাদকীয়, শীর্ষ খবর এবং নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদন লেখেন ভূপেন দত্ত ভৌমিক নিজে। সেগুলোতে ব্যবহার করেন তিনি জ্বালাময়ী ভাষা ও অফুরন্ত আবেগ। ত্রিপুরার মতো জায়গায় বসে যে সাহসী ভূমিকা এই সম্পাদক রাখেন তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফের ওপর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি ধারাবাহিক রচনা লেখেন তিনি। কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা যায় : ‘মেজর খালেদ মোশাররফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার। মেজর শাফায়াত জামিল তারই সহকর্মী। খালেদ মোশাররফ আজ একটি নাম। কুমিল্লা থেকে আসাম-সিলেট সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ মাইলের মতো আজ মেজর মোশাররফ, তার সহকর্মীদের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিফৌজের আওতাধীন। ...আজ মেজর খালেদ মোশাররফ আর মেজর শাফায়াতের সঙ্গে তাদের সদর দপ্তরে কথা হচ্ছিল। সঙ্গে নয়াদিল্লি থেকে আগত ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়ার (এউএনআই) প্রতিনিধি ক্রি কে. কে. চাড্ডা। ...মেজর মোশাররফকে আমি প্রথম দেখেছিলাম গত ২৯ মার্চ। সেদিন মেজর অনেকাংশেই বিব্রত, উদ্বিগ্ন, উৎকন্ঠিত। খবরৌদ্রদগ্ধ মধ্যাহ্নের মুক্ত আকশের নিচে দাঁড়িয়ে সেদিন আবেগমথিত কন্ঠে সৌখিন খালেদ প্রশ্ন করেছিলেন- ‘পৃথিবীতে সভ্যতা কি ধ্বংস হয়ে গেছে? মানবাধিকারের ঘোষণা কি শুধু কথার মালা? বাংলার কোটি কোটি মানুষ কি অন্যায় করেছিল? দাসত্ব থেকে মুক্তি চাওয়া কি অন্যায়? হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে মানুষ ধিক্কার দেয়। কিন্তু বাংলার লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে খুন, সম্পদ নাশ, বাংলার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার ঘটনাকে কেন বিশ্বের মানুষ আজ ধিক্কার দেয় না? ...৩ এপ্রিলের সন্ধ্যায় সীমান্ত প্রান্তে দাঁড়িয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম মেজরকে। ...সিলেটের চা বাগানের পথ ধরে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল। বাংলাদেশের গাঢ় সবুজ রংয়ের জাতীয় পতাকার মধ্যে রোদের রক্ত আভা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ যেন ঠিক সবুজ বাংলার হৃৎপি-। ...মেজর খালেদ-বয়স কত? সাকুল্যে ৩৩। মেজর শাফায়েত ৩১-এ পা দিয়েছে। উভয়েই দুটি সন্তানের জনক। ঢাকায় পরিবার। স্ত্রী, পুত্রকন্যার খবর কেউ জানেন না। বেঁচে নেই- এটাই ধরে নিয়েছেন। ...হালকা বাদামি রঙের শার্ট গায়ে মেজর মোশাররফ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন- আরে? কেমন আছেন? কন্ঠে যেন কতদিনের আত্মীয়তার সুর। মোশাররফ এক অদ্ভুত চরিত্রের লোক। ওর মধ্যে এমন আশ্চর্য গুণ আছে যা অন্যকে সহজে অভিভূত করে। চোখেমুখে স্পষ্টই ক্লান্তির ছাপ। নিদ্রাহীনতায়, পরিক্রমে, উৎকন্ঠায়- সবকিছুর মধ্যে তার চোখ দুটিতে অদ্ভুত এক মায়াময় স্বপ্ন। স্বাধীনতার মগ্ন চেতনায় ওর আয়ত চোখ দুটি গভীর।’

মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ও একনিষ্ঠ ভূমিকার কারণে ভূপেন দত্ত ভৌমিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা লাভ করেন। এ সম্মান তার প্রাপ্য। তার প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মক্তিযুদ্ধ গবেষক]

শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২১ মহররম ১৪৪২, ২৩ ভাদ্র ১৪২৭

একজন সাহসী সম্পাদকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

হারুন হাবীব

ত্রিপুরা আমার মূল কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি মুক্তিযুদ্ধে, যদিও রণাঙ্গন সাংবাদিকতার কাজে বারকয়েক আগরতলা যেতে হয়েছিল। সেই সুবাদে দৈনিক সংবাদ ও তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শ্রী ভূপেন দত্ত ভৌমিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ওই পরিচয় তেমন গভীর হয়নি। তবে তাকে বেশি করে জানবার সুযোগ হয় কয়েক বছর পর, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার গণমানুষের ভূমিকার ওপর যখন একটি গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করি।

ভূপেন দত্ত ভৌমিক সম্পর্কে এ লেখাটি একজন সাহসী সম্পাদকের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি; যার প্রায় সবটুকুই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকাকে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালে তার পত্রিকার অফিস ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন আগরতলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। দেশত্যাগী সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ছাত্রনেতা- এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সমর কর্মকাণ্ডে যুক্ত অন্যতম বেসামরিক ও সামরিক ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ দৈনিক সংবাদের জগন্নাথ বাড়ি রোডের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে।

১৯৭১ সালের আগরতলা সব অর্থেই বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিশ্ব খবরের ডেটলাইন হয়ে ওঠে। ভারতীয় সংবাদকর্মীদের ভিড়ের বাইরেও অসংখ্য ভিনদেশি সাংবাদিক এসে জড়ো হন এই ছোট্ট শহরে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে তারা যুদ্ধ ও শরণার্থী পরিস্থিতির খবর পরিবেশন করেন আগরতলায় বসে।

সেদিনকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের অন্যতম মূল পত্রিকা দৈনিক সংবাদ; যা পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে পত্রিকাটির পুরনো সংখ্যাগুলো দেখবার সুযোগ হয় আমার। অতএব বলতেই পারি যে, শ্রী ভৌমিক সম্পাদিত কাগজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে পূর্ব পাকিস্তানের টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহ পরম মমতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তুলে ধরার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। ভূপেন বাবুকে আমি স্মরণ করি আরও একটি কারণে; তার অফিসে বসিয়ে, অনেক সময় নিজে সময় দিয়ে, পুরনো ফাইল ঘেটে পরম আতিথেয়তায় আমার কাজটি সম্পন্ন করাতে সহায়তা করেছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল ত্রিপুরায় শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের কংগ্রেস সরকার। অতএব সরকারি সামর্থ্য ছিল শাসক দলের হাতে। প্রবীন জননেতা শ্রী নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিএম। যার যার অবস্থান রক্ষা করা সত্ত্বেও সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিটি দল বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাজ্যের দলগোষ্ঠীগুলো প্রায় প্রতিদিন সভা-সমাবেশ করেছে, গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে জনমত গড়ে তুলেছে।

শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার বুকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় রাজ্যের শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীগণ মাঠে নামেন অভূতপূর্বভাবে। পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ১ এপ্রিল ১৯৭১ রাজ্যের লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা আগরতলার পোস্টঅফিস চৌমুহনী থেকে বিশাল এক মিছিল বের করেন। ৩ এপ্রিল পালিত হয় ১২ ঘণ্টার ‘ত্রিপুরা বন্ধ’, ছাত্র যুবক শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের মাটিতে নিষ্ঠুর সামরিক আগ্রাসনের খবর ব্যাপকভাবে ত্রিপুরাবাসীকে আলোড়িত করে। রাজ্যের মোট জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে ওঠে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু। রাজ্যের সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ২৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বিধানসভায় বাংলাদেশ নিয়ে সর্বপ্রথম একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ৩১ মার্চ ১৯৭১ রাজ্য আইন সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাস হয়। সে প্রস্তাবে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি দাবি করা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহমর্মিতা জানানো হয়। একই সঙ্গে ত্রিপুরা বিধান সভা সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের কাছে দাবি উত্থাপন করে।

এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রধান সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদ ও তার সম্পাদক প্রভূত ভূমিকা রেখে চলেন। ‘বাংলাদেশ-মাটি ও মানুষ’ শিরোনামে একাধিকবার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে দৈনিক সংবাদ। এসব সংখ্যায় পাকিস্তানিদের গণহত্যা, নির্যাতন ও স্বাধীন বাংলার নব-উত্থানকে স্বাগত জানিয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা লেখেন বিপুল মজুমদার, অনির্বাণ দত্ত, অগ্নিমিত্র, ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য প্রমুখ। এ বিশেষ ধারাবাহিক প্রকাশনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সম্পাদক শ্রী ভৌমিক লেখেন : ‘বাংলাদেশ-মাটি ও মানুষ’ এ বিষয়ের ওপর আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য পদ্মা-মেঘনা পারের যে জীবন এতদিন নাচতো ধানের ক্ষেতে, বাতাসের দোলায়িত ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, গহীন নদীর স্রোতের মতো যার ছিল একটানা গতি, কাঁচা ধান আর পাটের সোঁদা গন্ধ বুক ভরে নিয়ে যে জীবন ছিল শত দুঃখের ও দারিদ্র্যের মধ্যেও পথের পাশে ফুটে ওঠা ঘেঁটু ফুলের মতো তাজা- সেই জীবনের ছন্দ, রূপ আর গতি কী করে পাল্টে গেল, কী করে ওদের কোমল বুকের মৃদু ধুকধুকানিতে শব্দ জেগে উঠল, সারি, জারি আর মুর্শিদী গানে যে ক্রবন উৎকর্ণ হতো; সে কান আজ গুলির শব্দে আর পাখি পড়ার শব্দে কেন এত সতর্ক। মসজিদে আজান আর মন্দিরের সন্ধ্যারতির কাঁসর ঘণ্টায় যে জীবন বন্দনা করত, মানুষের কল্যাণকে সে আজ কেনো খেলছে রক্তের হোলি উৎসব! ...বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার সংগ্রাম জীবনের সংগ্রাম, সংস্কৃতি সংগ্রাম এক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ-মাটি ও মানুষ তারই একটা ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা।’

পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোলাটে এবং উত্তেজক তখন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তিনি বন্দী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতা ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বেশির ভাগ নেতাকর্মী পৌঁছেছেন আগরতলায়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। এ সময়ে আগরতলায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেন। তারা ২ এপ্রিল ১৯৭১ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন।

সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য্যরে মেলার মঠের বাড়িতে সেদিনের বৈঠকটি ছিল একটি মাইলফলক। চট্টগ্রামের প্রবীণ জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভা থেকে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এমএনএ, এমপিএ বিশ্ববাসীর কাছে সর্বপ্রথম এক যৌথ বিবৃতি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। সে বিবৃতি পাঠানো হয় জাতিসংঘের মহাসচিব ইউ থান্ট কে। Stop this Genocide, ‘বন্ধ কর এই গণহত্যা’ শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হয় বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম বিবৃতি। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী এবং পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’ সাময়িকীর প্রতিনিধি অমর রাহা বিবৃতির খসড়া তৈরিতে সহায়তা করেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীর হস্তক্ষেপ কামনা করে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে এটিই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক আবেদন, যা আগরতলার দৈনিক সংবাদ স্ববিস্তারে প্রকাশ করে।

ত্রিপুরার মাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আরও একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। আগরতলা সার্কিট হাউসে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির প্রথম বৈঠক বসে। ১১ ও ১২ এপ্রিলের ওই বৈঠকেই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। উপরাষ্ট্রপতি হন দলের জেষ্ঠ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোসতাক আহমদ হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্য হলেন- ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান।

স্বাধীন বাংলার সরকার গঠনের খবরটি শুধু ভারতের সংবাদপত্রে নয়, সারা বিশ্বেই প্রচারিত হয়। ‘দৈনিক সংবাদ’-এ ১৩ এপ্রিলের ব্যানার হেডলাইনটি ছিল এ রকম : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে রক্ত ও অগ্নিশুদ্ধ স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষিত।’

খবরের সারাংশ যেমন আবেগময় তেমনি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলা বেতারের ঘোষণা ধরে দৈনিক সংবাদ লেখে : ‘জয় বাংলা। স্বাধীন বাংলায় স্বাধীন সরকার গঠিত হয়েছে। একটি আকাক্সিক্ষত প্রত্যাশিত বাঞ্ছিত ঘোষণা। শোণিত তর্পণে শুদ্ধ অগ্নিপুঞ্জ সরকার। জয় বাংলার জয়। জয় স্বাধীনতার জয়। মর্ত্যরে জয় মানুষের জয়। বৃষ্টিস্নাত বাংলার আকাশ থেকে শোনা গেল আজ সেই দীর্ঘ প্রত্যাশিত ঘোষণা। আবার শোনা যাবে ১৩ এপ্রিলের সকাল ৯টায়। স্বাধীন বাংলা সরকার গঠিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে তার মন্ত্রিসভা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রনায়ক। তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গায় হবে স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দফতর (যদিও শেষ পর্যন্ত জায়গা পরিবর্তন করে তা মেহেরপুরে হয়েছিল)। ’

সরকার গঠনের সিদ্ধান্তসহ মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের ঘটনাবলিকে স্ববিস্তারে তোলে ধরে দৈনিক সংবাদ, দেশের কথা, জাগরণ ও সাপ্তাহিক সমাচার। তাদের সংবাদ পরিবেশনে যে ভাষা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তা সামরিক নির্যাতনে পিষ্ট ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত লাখ লাখ শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার মনোবল ফিরিয়ে আনতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল। ত্রিপুরা থেকে সে সময় আরও তিনজন সাংবাদিক নিরলসভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্টিং করেন- কলকাতা স্টেটসম্যানের আগরতলা প্রতিনিধি সত্যব্রত চক্রবর্তী, যুগান্তরের অনিল ভট্টাচার্য্য ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি জে. পি. সাইকিয়া। এদের সঙ্গে ছিলেন পিটিআইয়ের আগরতলা প্রধান মধুসুধন গূহ রায়। দৈনিক সংবাদের প্রতিনিধি হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদন লেখেন বিকচ চৌধুরী। অগণিত ছবি তোলেন মুক্তিযুদ্ধের রবীন সেনগুপ্ত, চিত্ত সেন এবং দীলিপ দেবরায়- ত্রিপুরার এই তিন ফটোগ্রাফার।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ১৭ এপ্রিলের ভাষণের খবর প্রচার করে দৈনিক সংবাদ এভাবে : ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দকে যে বাংলাদেশ তাদের জাতীয় জীবনের মুক্তির দিশারিরূপে মেনে নিয়েছে, এমন কোনো দুর্দৈব বা এমন কোনো শক্তি নেই যা এই বাংলার স্বাধীনতার স্পৃহাকে পরাভূত করতে পারে। যতদিন চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা আকাশে থাকবে ততদিন বাংলার স্বাধীনতা সূর্যও অম্লান থাকবে। ...এক বিশেষ উৎসবে এই নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়। নতুন মন্ত্রিসভা হাজার হাজর উদ্বেলিত মানুষের অভিনন্দন গ্রহণ করেন। দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে উৎসবের বিবরণ সংগ্রহ করেন।’

আমার জানামতে, অসংখ্য সম্পাদকীয়, শীর্ষ খবর এবং নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদন লেখেন ভূপেন দত্ত ভৌমিক নিজে। সেগুলোতে ব্যবহার করেন তিনি জ্বালাময়ী ভাষা ও অফুরন্ত আবেগ। ত্রিপুরার মতো জায়গায় বসে যে সাহসী ভূমিকা এই সম্পাদক রাখেন তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফের ওপর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি ধারাবাহিক রচনা লেখেন তিনি। কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা যায় : ‘মেজর খালেদ মোশাররফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার। মেজর শাফায়াত জামিল তারই সহকর্মী। খালেদ মোশাররফ আজ একটি নাম। কুমিল্লা থেকে আসাম-সিলেট সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ মাইলের মতো আজ মেজর মোশাররফ, তার সহকর্মীদের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিফৌজের আওতাধীন। ...আজ মেজর খালেদ মোশাররফ আর মেজর শাফায়াতের সঙ্গে তাদের সদর দপ্তরে কথা হচ্ছিল। সঙ্গে নয়াদিল্লি থেকে আগত ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়ার (এউএনআই) প্রতিনিধি ক্রি কে. কে. চাড্ডা। ...মেজর মোশাররফকে আমি প্রথম দেখেছিলাম গত ২৯ মার্চ। সেদিন মেজর অনেকাংশেই বিব্রত, উদ্বিগ্ন, উৎকন্ঠিত। খবরৌদ্রদগ্ধ মধ্যাহ্নের মুক্ত আকশের নিচে দাঁড়িয়ে সেদিন আবেগমথিত কন্ঠে সৌখিন খালেদ প্রশ্ন করেছিলেন- ‘পৃথিবীতে সভ্যতা কি ধ্বংস হয়ে গেছে? মানবাধিকারের ঘোষণা কি শুধু কথার মালা? বাংলার কোটি কোটি মানুষ কি অন্যায় করেছিল? দাসত্ব থেকে মুক্তি চাওয়া কি অন্যায়? হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে মানুষ ধিক্কার দেয়। কিন্তু বাংলার লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে খুন, সম্পদ নাশ, বাংলার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার ঘটনাকে কেন বিশ্বের মানুষ আজ ধিক্কার দেয় না? ...৩ এপ্রিলের সন্ধ্যায় সীমান্ত প্রান্তে দাঁড়িয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম মেজরকে। ...সিলেটের চা বাগানের পথ ধরে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল। বাংলাদেশের গাঢ় সবুজ রংয়ের জাতীয় পতাকার মধ্যে রোদের রক্ত আভা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ যেন ঠিক সবুজ বাংলার হৃৎপি-। ...মেজর খালেদ-বয়স কত? সাকুল্যে ৩৩। মেজর শাফায়েত ৩১-এ পা দিয়েছে। উভয়েই দুটি সন্তানের জনক। ঢাকায় পরিবার। স্ত্রী, পুত্রকন্যার খবর কেউ জানেন না। বেঁচে নেই- এটাই ধরে নিয়েছেন। ...হালকা বাদামি রঙের শার্ট গায়ে মেজর মোশাররফ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন- আরে? কেমন আছেন? কন্ঠে যেন কতদিনের আত্মীয়তার সুর। মোশাররফ এক অদ্ভুত চরিত্রের লোক। ওর মধ্যে এমন আশ্চর্য গুণ আছে যা অন্যকে সহজে অভিভূত করে। চোখেমুখে স্পষ্টই ক্লান্তির ছাপ। নিদ্রাহীনতায়, পরিক্রমে, উৎকন্ঠায়- সবকিছুর মধ্যে তার চোখ দুটিতে অদ্ভুত এক মায়াময় স্বপ্ন। স্বাধীনতার মগ্ন চেতনায় ওর আয়ত চোখ দুটি গভীর।’

মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ও একনিষ্ঠ ভূমিকার কারণে ভূপেন দত্ত ভৌমিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা লাভ করেন। এ সম্মান তার প্রাপ্য। তার প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মক্তিযুদ্ধ গবেষক]