সিলেটের ইমজা’র দৃষ্টান্ত স্থাপন

সাত শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার গল্প

কখনো ক্বীনব্রিজ, কখনোবা রিকাবীবাজারের পানির ট্যাংকি এলাকা। ঘুপচির অন্ধকারে কিংবা প্রকাশ্যেই মাদক গ্রহণ। টিউব জোড়া লাগানোর সলিউশন পলিথিনে ঢেলে ছোট্ট বুকের পুরোটাই ভরে নিত ‘ড্যান্ডিতে’। এদের কারও মা আছে, কারও বাবা, কারও বা কেউই নেই, আবার অনেকের থেকেও নেই। তাদের কাউকে কাউকে অলিখিতভাবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে ভিক্ষুকচক্রের কাছে। ছিনতাই বা ভিক্ষা করে তারা কেউ কেউ মা বাবাকে ভাগ দিত, বাকিদের কাছে নেশাতে ডুবে থাকাই ছিল জীবন। অথচ তাদের কারওই বয়স চৌদ্দ পেরোয়নি। সবচেয়ে ছোটোটির বয়স মাত্র পাঁচ। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে এরকম সাতটি শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সিলেটের টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ইলেকট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েসন (ইমজা)।

করোনাকালে ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এবং একবেলা খাবার নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয় ইমজা। সংগঠনের সদস্যদের পেশাগত নিরাপত্তা, উৎকর্ষতা ও সদস্যদের দুঃসময়ে ঐক্যের মাধ্যমে পাশের দাঁড়ানো ইমজার মূল লক্ষ্য হলেও করোনার সংকটে সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে সংগঠনটি মানবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়।

খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির মাঝামাঝি এসে ইমজার স্বেচ্ছাসেবকদের নজরে আসে পথশিশুদের বিপথগামীতার বিষয়টি। বৃহৎ পরিসরে না হলেও দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য গ্রহণ করা হয় ছোটো একটি প্রকল্প। খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি চলাকালেই অন্তত ২০টি পথশিশুকে রাখা হয় পর্যবেক্ষণে। নানানভাবে তাদের মানবিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা হয়। রূঢ়তার বদলে নাগরিক মানুষের আন্তরিক ব্যবহার তাদের মধ্যে অল্প হলেও প্রভাব ফেলে। তবে সময় সুযোগের অভাবে তাদের সবাইকে ধরে রাখা যায়নি। একশ’ দিনের কর্মসূচি শেষে ১৫টি শিশুকে পাওয়া যায় যাদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাড়া আছে। ১৫টি শিশুকে টানা ১৫ দিন একত্রে রেখে তাদের খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু যোগান দেয়ার উদ্যোগ নেয় ইমজা। উদ্দেশ্য, মাদকে আসক্তি কমিয়ে নানান প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে দায়িত্বশীল সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তুলে দেয়া।

জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এবং ক্রীড়া সংস্থার সহায়তায় নগরীর মোহাম্মদ আলী জিমনেসিয়ামে তাদের রাখা হয়। দিনরাত এক করে তাদের বিনোদন, খেলাধূলা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। নেয়া হয় চিকিৎসকের পরামর্শ। ইমজার উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষা ও অভিপ্রায়ের কর্মীরা। ঊষার শিশুরা পুরোপুরি মিশে যায় এসব পথশিশুদের সাথে। এর মধ্যেও ছিল কিছু হতাশা। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েও শেষ ১৫ দিনে ধরে রাখা সম্ভব হয় ৭টি শিশুকে। কৌশলে পালিয়ে যাওয়া শিশুদের করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুনরায় অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলানো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৫ দিনের প্রকল্পটি শেষ হয় ২১ দিনে এসে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিমনেশিয়ামে এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম, মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিনের উপস্থিতিতে উপস্থাপন করা হয় জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ পরিচালক নিবাস দাসের কাছে। স্বেচ্ছাসেবক নিঘাদ সাদিয়া একে একে পরিচয় করিয়ে দেন ফাহিম মিয়া (৫), আলমগীর হোসেন (১২), সোহেল মিয়া (১০), মোশারফ হোসেন (১৪), হৃদয় (৮), শাহীনুর (১০) ও আবু বক্কর আকবর (৯) নামের সাত শিশুকে। সংগঠনের মূল লক্ষ্যের বাইরে এসে ইমজার এমন ব্যতিক্রমী মানবিক উদ্যোগে মুগ্ধ জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তাদের এই সাতটি শিশুর তত্ত্বাবধানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশ দেন। টানা ২১ দিনের কর্মসূচিতে ইমজার স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মানবিক বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া শিশুদের গুছিয়ে নিতে আরও একদিন সময় নেয়া হয়। অবশেষে ১০ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় খাদিমপাড়ায় অবস্থিত শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। উপ প্রকল্প পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মীদের নিয়ে সাতটি শিশুকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিন সপ্তাহের ভালোবাসার প্রতিদান চোখের জলে দিয়ে সাতটি শিশু মিশে যায় সেখানে থাকা অন্যান্য শিশুদের ভিড়ে।

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২২ মহররম ১৪৪২, ২৪ ভাদ্র ১৪২৭

সিলেটের ইমজা’র দৃষ্টান্ত স্থাপন

সাত শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার গল্প

প্রতিনিধি, সিলেট

image

কখনো ক্বীনব্রিজ, কখনোবা রিকাবীবাজারের পানির ট্যাংকি এলাকা। ঘুপচির অন্ধকারে কিংবা প্রকাশ্যেই মাদক গ্রহণ। টিউব জোড়া লাগানোর সলিউশন পলিথিনে ঢেলে ছোট্ট বুকের পুরোটাই ভরে নিত ‘ড্যান্ডিতে’। এদের কারও মা আছে, কারও বাবা, কারও বা কেউই নেই, আবার অনেকের থেকেও নেই। তাদের কাউকে কাউকে অলিখিতভাবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে ভিক্ষুকচক্রের কাছে। ছিনতাই বা ভিক্ষা করে তারা কেউ কেউ মা বাবাকে ভাগ দিত, বাকিদের কাছে নেশাতে ডুবে থাকাই ছিল জীবন। অথচ তাদের কারওই বয়স চৌদ্দ পেরোয়নি। সবচেয়ে ছোটোটির বয়স মাত্র পাঁচ। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে এরকম সাতটি শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সিলেটের টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ইলেকট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েসন (ইমজা)।

করোনাকালে ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এবং একবেলা খাবার নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয় ইমজা। সংগঠনের সদস্যদের পেশাগত নিরাপত্তা, উৎকর্ষতা ও সদস্যদের দুঃসময়ে ঐক্যের মাধ্যমে পাশের দাঁড়ানো ইমজার মূল লক্ষ্য হলেও করোনার সংকটে সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে সংগঠনটি মানবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়।

খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির মাঝামাঝি এসে ইমজার স্বেচ্ছাসেবকদের নজরে আসে পথশিশুদের বিপথগামীতার বিষয়টি। বৃহৎ পরিসরে না হলেও দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য গ্রহণ করা হয় ছোটো একটি প্রকল্প। খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি চলাকালেই অন্তত ২০টি পথশিশুকে রাখা হয় পর্যবেক্ষণে। নানানভাবে তাদের মানবিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা হয়। রূঢ়তার বদলে নাগরিক মানুষের আন্তরিক ব্যবহার তাদের মধ্যে অল্প হলেও প্রভাব ফেলে। তবে সময় সুযোগের অভাবে তাদের সবাইকে ধরে রাখা যায়নি। একশ’ দিনের কর্মসূচি শেষে ১৫টি শিশুকে পাওয়া যায় যাদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাড়া আছে। ১৫টি শিশুকে টানা ১৫ দিন একত্রে রেখে তাদের খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু যোগান দেয়ার উদ্যোগ নেয় ইমজা। উদ্দেশ্য, মাদকে আসক্তি কমিয়ে নানান প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে দায়িত্বশীল সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তুলে দেয়া।

জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এবং ক্রীড়া সংস্থার সহায়তায় নগরীর মোহাম্মদ আলী জিমনেসিয়ামে তাদের রাখা হয়। দিনরাত এক করে তাদের বিনোদন, খেলাধূলা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। নেয়া হয় চিকিৎসকের পরামর্শ। ইমজার উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষা ও অভিপ্রায়ের কর্মীরা। ঊষার শিশুরা পুরোপুরি মিশে যায় এসব পথশিশুদের সাথে। এর মধ্যেও ছিল কিছু হতাশা। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েও শেষ ১৫ দিনে ধরে রাখা সম্ভব হয় ৭টি শিশুকে। কৌশলে পালিয়ে যাওয়া শিশুদের করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুনরায় অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলানো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৫ দিনের প্রকল্পটি শেষ হয় ২১ দিনে এসে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিমনেশিয়ামে এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম, মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিনের উপস্থিতিতে উপস্থাপন করা হয় জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ পরিচালক নিবাস দাসের কাছে। স্বেচ্ছাসেবক নিঘাদ সাদিয়া একে একে পরিচয় করিয়ে দেন ফাহিম মিয়া (৫), আলমগীর হোসেন (১২), সোহেল মিয়া (১০), মোশারফ হোসেন (১৪), হৃদয় (৮), শাহীনুর (১০) ও আবু বক্কর আকবর (৯) নামের সাত শিশুকে। সংগঠনের মূল লক্ষ্যের বাইরে এসে ইমজার এমন ব্যতিক্রমী মানবিক উদ্যোগে মুগ্ধ জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তাদের এই সাতটি শিশুর তত্ত্বাবধানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশ দেন। টানা ২১ দিনের কর্মসূচিতে ইমজার স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মানবিক বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া শিশুদের গুছিয়ে নিতে আরও একদিন সময় নেয়া হয়। অবশেষে ১০ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় খাদিমপাড়ায় অবস্থিত শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। উপ প্রকল্প পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মীদের নিয়ে সাতটি শিশুকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিন সপ্তাহের ভালোবাসার প্রতিদান চোখের জলে দিয়ে সাতটি শিশু মিশে যায় সেখানে থাকা অন্যান্য শিশুদের ভিড়ে।