নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে প্রথম রায় : অনুকরণীয়, অনুসরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

সিরাজ প্রামাণিক

থানায় নিয়ে জনি নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় পল্লবী থানার তৎকালীন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান জাহিদসহ তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার অন্য দুই আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের এটি প্রথম রায়। বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- পল্লবী থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু। সাত বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- সোর্স সুমন ও রাশেদ।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টরে স্থানীয় সাদেকের ছেলের গায়েহলুদ অনুষ্ঠান চলাকালে পুলিশের সোর্স সুমন মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এ সময় জনি ও তার ভাই সুমনকে চলে যেতে বলেন। সুমন চলে গেলেও পরদিন এসে আবার আগের মতো আচরণ করতে থাকেন। তখন জনি ও তার ভাই তাকে চলে যেতে বললে সুমন পুলিশকে ফোন করে এনে তাদের ধরে নিয়ে যান। তাদের নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার লোকজন ধাওয়া দিলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। পরে থানায় নিয়ে জনিকে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে জনির অবস্থা খারাপ হলে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আমাদের সাংবিধানিক অধিকার হলো কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে কোনোরুপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনানুযায়ী ছাড়া জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না কিংবা কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কাজ করা যাবে না। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। সেই সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ কি অন্যায় কিছু করতে পারে?

অথচ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জনসাধারণকে নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। এর বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে উক্ত বাহিনীর হাতে আটককৃত থাকার সময় বা নিরাপত্তা হেফাজতে বা রিমান্ডে থাকার সময়। অথচ এ ধরনের নির্যাতন প্রতিকারের তেমন কোন কার্যকর আইন না থাকা ও আইন প্রয়োগ না করা এবং অনেক ক্ষেত্রে শাস্তি না হওয়ার কারণে এরূপ অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচার হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু কখনই সমর্থনযোগ্য নয় এবং এরকম ঘটনা ঘটলে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনাগুলোর প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হয় না এবং কয়জন সদস্যের বিচার হয়েছে সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এটাও দায়মুক্তির একটা অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। নির্যাতনমূলক আচরণ ও শাস্তি নিষিদ্ধ করার আন্তর্জাতিক ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর সংসদে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন পাস হয়।

এই আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনটিতে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর তার নির্দোষিতা প্রমাণের দায়ভার দেয়া। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনের পথ অনুসরণ থেকে নিবৃত্ত করার কাজে লাগতে পারে। নির্যাতনে প্ররোচনা এবং সহায়তা করাকেও শাস্তিযোগ্য করা এবং আদালতে কেউ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করলে, তার ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করার বিধান সুফল দিতে পারে। হেফাজতে মৃত্যু বলতে সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, এছাড়াও অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতারকালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এমনকি কোনো মামলায় সাক্ষী হোক বা না হোক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হবে। গ্রেফতারের সময় মৃত্যু এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় মৃত্যুকেও হেফাজতে মৃত্যুর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণে এ আইন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের উপায়সমূহের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় কিল-ঘুসি, ভয়ভীতি বা হুমকি প্রদান, মারাত্মকভাবে পিটুনি, সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা, ঘুমাতে না দেয়া, প্রজননতন্ত্রে বৈদ্যুতিক শক দেয়া, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আটককৃতদের পায়ে গুলি করা। নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যা, ধর্ষণ অনেক সময় নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়েছেন। হেফাজতে এ ধরনের আত্মহত্যা পরোক্ষভাবে হত্যার শামিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন ও নিষ্ঠুর অমানবিক লাঞ্ছনাকর, অবমাননাকর দণ্ড ও ব্যবহার নাগরিকের মৌলিক অধিকাররূপে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেসবের কিছুই প্রকৃতার্থে বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা পুলিশ হেফাজতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা। তখন প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে সাতজন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হন। ইয়াসমিন ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে। বাসটি রাত ৩টার পরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান। তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহস পাননি। এরপর বীরগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের চালক অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান। পিকআপভ্যানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আবদুস সাত্তার বসে ছিলেন। পরে ওই এলাকার লোকজন রাস্তায় রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টাতিনেক পর ব্র্যাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে থানার উপপরিদর্শক প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।

‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩’ অনুসারে ঘটনা সংশ্লিষ্ট যে কেউ অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। এ আইনের অধীনে ‘অভিযোগকারী’ হতে পারেন অভিযোগ উত্থাপনকারী বা ভুক্তভোগী উভয়ে। ‘ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ অর্থ হচ্ছে ওই ব্যক্তি যাকে এ আইনের অধীনে তার ওপর অথবা তার সংশ্লিষ্ট বা উদ্বিগ্ন এমন কারও ওপর নির্যাতন করা হয়েছে।

এছাড়াও কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্যাতন করেছে বা করছে এরকম কোনো তথ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে উক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন।

আইনত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে- আইন অনুসারে ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ অর্থাৎ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ভিডিপি ও কোস্টগার্ডসহ দেশে আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী সরকারি কোনো সংস্থা অর্থাৎ ‘সশস্ত্র বাহিনী’ (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী অথবা অপর কোনো রাষ্ট্রীয় ইউনিট) যা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার জন্য গঠিত।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে পদস্থ নয় এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। অভিযোগ দাখিলের পর পুলিশ সুপার অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন। অভিযোগ দাখিলের পর থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যথায় উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে অতিরিক্ত আরও ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই মামলা শেষ করার বিধান রয়েছে।

[লেখক : আইনজীবী]

seraj.pramanik@gmail.com

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২২ মহররম ১৪৪২, ২৪ ভাদ্র ১৪২৭

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে প্রথম রায় : অনুকরণীয়, অনুসরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

সিরাজ প্রামাণিক

থানায় নিয়ে জনি নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় পল্লবী থানার তৎকালীন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান জাহিদসহ তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার অন্য দুই আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের এটি প্রথম রায়। বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- পল্লবী থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু। সাত বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- সোর্স সুমন ও রাশেদ।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টরে স্থানীয় সাদেকের ছেলের গায়েহলুদ অনুষ্ঠান চলাকালে পুলিশের সোর্স সুমন মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এ সময় জনি ও তার ভাই সুমনকে চলে যেতে বলেন। সুমন চলে গেলেও পরদিন এসে আবার আগের মতো আচরণ করতে থাকেন। তখন জনি ও তার ভাই তাকে চলে যেতে বললে সুমন পুলিশকে ফোন করে এনে তাদের ধরে নিয়ে যান। তাদের নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার লোকজন ধাওয়া দিলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। পরে থানায় নিয়ে জনিকে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে জনির অবস্থা খারাপ হলে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আমাদের সাংবিধানিক অধিকার হলো কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে কোনোরুপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনানুযায়ী ছাড়া জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না কিংবা কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কাজ করা যাবে না। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। সেই সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ কি অন্যায় কিছু করতে পারে?

অথচ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জনসাধারণকে নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। এর বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে উক্ত বাহিনীর হাতে আটককৃত থাকার সময় বা নিরাপত্তা হেফাজতে বা রিমান্ডে থাকার সময়। অথচ এ ধরনের নির্যাতন প্রতিকারের তেমন কোন কার্যকর আইন না থাকা ও আইন প্রয়োগ না করা এবং অনেক ক্ষেত্রে শাস্তি না হওয়ার কারণে এরূপ অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচার হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু কখনই সমর্থনযোগ্য নয় এবং এরকম ঘটনা ঘটলে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনাগুলোর প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হয় না এবং কয়জন সদস্যের বিচার হয়েছে সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এটাও দায়মুক্তির একটা অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। নির্যাতনমূলক আচরণ ও শাস্তি নিষিদ্ধ করার আন্তর্জাতিক ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর সংসদে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন পাস হয়।

এই আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনটিতে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর তার নির্দোষিতা প্রমাণের দায়ভার দেয়া। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনের পথ অনুসরণ থেকে নিবৃত্ত করার কাজে লাগতে পারে। নির্যাতনে প্ররোচনা এবং সহায়তা করাকেও শাস্তিযোগ্য করা এবং আদালতে কেউ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করলে, তার ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করার বিধান সুফল দিতে পারে। হেফাজতে মৃত্যু বলতে সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, এছাড়াও অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতারকালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এমনকি কোনো মামলায় সাক্ষী হোক বা না হোক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হবে। গ্রেফতারের সময় মৃত্যু এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় মৃত্যুকেও হেফাজতে মৃত্যুর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণে এ আইন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের উপায়সমূহের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় কিল-ঘুসি, ভয়ভীতি বা হুমকি প্রদান, মারাত্মকভাবে পিটুনি, সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা, ঘুমাতে না দেয়া, প্রজননতন্ত্রে বৈদ্যুতিক শক দেয়া, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আটককৃতদের পায়ে গুলি করা। নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যা, ধর্ষণ অনেক সময় নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়েছেন। হেফাজতে এ ধরনের আত্মহত্যা পরোক্ষভাবে হত্যার শামিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন ও নিষ্ঠুর অমানবিক লাঞ্ছনাকর, অবমাননাকর দণ্ড ও ব্যবহার নাগরিকের মৌলিক অধিকাররূপে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেসবের কিছুই প্রকৃতার্থে বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা পুলিশ হেফাজতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা। তখন প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে সাতজন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হন। ইয়াসমিন ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে। বাসটি রাত ৩টার পরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান। তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহস পাননি। এরপর বীরগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের চালক অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান। পিকআপভ্যানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আবদুস সাত্তার বসে ছিলেন। পরে ওই এলাকার লোকজন রাস্তায় রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টাতিনেক পর ব্র্যাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে থানার উপপরিদর্শক প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।

‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩’ অনুসারে ঘটনা সংশ্লিষ্ট যে কেউ অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। এ আইনের অধীনে ‘অভিযোগকারী’ হতে পারেন অভিযোগ উত্থাপনকারী বা ভুক্তভোগী উভয়ে। ‘ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ অর্থ হচ্ছে ওই ব্যক্তি যাকে এ আইনের অধীনে তার ওপর অথবা তার সংশ্লিষ্ট বা উদ্বিগ্ন এমন কারও ওপর নির্যাতন করা হয়েছে।

এছাড়াও কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্যাতন করেছে বা করছে এরকম কোনো তথ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে উক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন।

আইনত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে- আইন অনুসারে ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ অর্থাৎ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ভিডিপি ও কোস্টগার্ডসহ দেশে আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী সরকারি কোনো সংস্থা অর্থাৎ ‘সশস্ত্র বাহিনী’ (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী অথবা অপর কোনো রাষ্ট্রীয় ইউনিট) যা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার জন্য গঠিত।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে পদস্থ নয় এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। অভিযোগ দাখিলের পর পুলিশ সুপার অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন। অভিযোগ দাখিলের পর থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যথায় উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে অতিরিক্ত আরও ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই মামলা শেষ করার বিধান রয়েছে।

[লেখক : আইনজীবী]

seraj.pramanik@gmail.com