ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ওয়েবিনার

‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রমে আরও গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান

করোনা আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে শিক্ষা কার্যক্রমে এ ব্যবস্থা আরও কার্যকরভাবে চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর যুগোযোগীকরণ, স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদানসহ সর্বোপরি আমাদের শিক্ষানীতিতে ‘ই-লার্নিং’ কে আরও প্রধান্য দিতে হবে। গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ই-লার্নিং’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী ড. দীপু মনি।

জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ-এর উপাচার্য প্রফেসর ড. কারম্যান জেড লামাংনা, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি’র ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইশতিয়াক আজিম প্রমুখ ওই ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে যোগদান করেন।

প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেন, কোভিড মহমারী একটি বৈশি^ক সংকট। এতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এ মহামারী শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বর্তমান সময়ে ‘ই-লার্নিং’ অত্যন্ত কার্যকর এবং সামনের দিনগুলোতে এটি আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশের মানুষ নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এ পার্যায়ে এসে পৌঁছেছে এবং কোভিড মহামারী মোকাবিলায় এদেশের মানুষ সাহসিকতার পরিচয় দিবে। এদেশের মানুষ অত্যন্ত প্রযুক্তি বান্ধব। এর কারণে বিশেষ করে শিক্ষাকার্যক্রমে ই-লার্নিংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধিতে আমাদের জন্য খুব বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতি-২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে, সেটাকে যুগোপোযোগীকরণ এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সামনের দিনগুলোতে কি ধরনের দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হবে, তার একটি প্রাক নির্বাচনের মাধ্যমে সে অনুযায়ী আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম, অবকাঠামো এবং শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা আরও সম্প্রসারণে মানসিকতা একটি বড় বাধা। মেধাবীদের শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসার জন্য এ পেশাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলতে হবে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে তোলতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে আরও বেশি হারে গবেষণা পরিচালনার ওপর জোরারোপ করেন। তিনি জানান, বর্তমানে দেশের ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে। তিনি পরীক্ষা এবং সনদ সর্বস্ব শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে, মত প্রকাশ করেন এবং শিল্পখাত ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ইউনেস্কো’র হিসাব অনুযায়ী কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারাবিশ্বে ১.৩৭ বিলিয়ন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য প্রথাগত শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ায় নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে ই-লার্নিং নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং ই-লার্নিং কে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতীয় শিক্ষা নীতিতে ‘ই-লার্নিং পলিসি’ অন্তর্ভুক্তকরণ, সারাদেশে নির্ভরযোগ্য হাই স্পিড ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স হ্রাসকরণ, ই-লার্নিংয়ের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত স্টার্টআপগুলোকে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া এবং ব্যাংক অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। অবকাঠামো ও ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ হাউসহোল্ডের ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এবং ৫.৬ শতাংশ হাউজহোল্ডের কম্পিউটার রয়েছে, এছাড়াও মোবাইল ডেটা প্যাকেজের উচ্চ মূল্য প্রান্তিক জনগণের ইন্টারনেট সংযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। শিল্পখাতের চাহিদা অনুযায়ী তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করতে কারিগরি শিক্ষায় আরও বেশি হারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ভুক্ত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় গড় অংশগ্রহণের হার ৪৫ শতাংশের উপরে, সেখানে বাংলাদেশে ১৫ শতাংশেরও কম। এমতাবস্থায় কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং আগ্রহ বৃদ্ধি করতে একে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ই-লার্নিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাজ্যের ‘ইউনির্ভাসিটি অব সারে’-এর উপ-উপাচার্য প্রফেসর ওসামা খান। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ই-লার্নিং এর ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের জন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ও পোস্টাল সার্ভিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যেখানে এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচির গুণগতমান নিশ্চিত করা এবং এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কার্যকর মিথস্ক্রিয়া অতীব জরুরি। এজন্য ভার্চুয়াল লার্নিং ইনভায়রনমেন্ট খুবই জরুরি। কি শিখানো হবে এবং কিভাবে শিখানো হবে সেটা যথাযথভবে নির্ধারণ করা গেলে তা যথার্থ হবে।

নির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ বলেন, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে ই-লার্নিং পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এবং কোভিড মাহামারী আমাদের জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে দেশব্যাপী ২৬০টি কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান অবস্থা মোকাবিলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০০০০ শিক্ষকের মধ্যে নির্বাচিত ১৫০০ জন শিক্ষকের মাধ্যমে অনলাইনে ১৭ হাজার ৫০০টি লেকচার প্রদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। শিল্পখাতের চাহিদা মোতাবেক খুব শীঘ্রই ৯টি কলেজে ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ কোর্স পরিচালনা করা হবে।

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশের উপাচার্য প্রফেসর ড. কারম্যান জেড লামাংনা বলেন, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ই-লার্নিং প্রদানের জন্য অবকাঠামো দিক দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। তিনি এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোরারোপ করেন।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা জানান, শিল্পখাতের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষা কারিক্যুলাম প্রণয়ন করতে হবে এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে কিভাবে ই-লানির্ং কার্যক্রম পরিচালিত হবে সে বিষয়ে এখনই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি’র ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ বলেন, ই-লার্নিং কার্যক্রমের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মিথস্ক্রিয়া খুবই জরুরি এবং এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও বেশি হারে দক্ষতা উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে ‘ই-লার্নিং’ আরও বেশি হারে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইশতিয়াক আজিম বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচেছ এবং আমাদের এ পরিবর্তনকে উপেক্ষা না করে বরং তার সাথে মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও তিনি আগামী ২০-৩০ বছর পর শিক্ষা ব্যবস্থায় কি ধরনের পরিবর্তন আসবে তা মানিয়ে নেয়ার জন্য এখনই যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তার দ্রুত বাস্তাবায়নের আহ্বান জানান। মুক্ত আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের সাবেক সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ্, রিয়াদ হোসেন এবং ডিবিআই-এর প্রশিক্ষক শংকর রায় অংশগ্রহণ করেন।

রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৩ মহররম ১৪৪২, ২৫ ভাদ্র ১৪২৭

ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ওয়েবিনার

‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রমে আরও গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান

image

করোনা আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে শিক্ষা কার্যক্রমে এ ব্যবস্থা আরও কার্যকরভাবে চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর যুগোযোগীকরণ, স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদানসহ সর্বোপরি আমাদের শিক্ষানীতিতে ‘ই-লার্নিং’ কে আরও প্রধান্য দিতে হবে। গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ই-লার্নিং’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী ড. দীপু মনি।

জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ-এর উপাচার্য প্রফেসর ড. কারম্যান জেড লামাংনা, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি’র ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইশতিয়াক আজিম প্রমুখ ওই ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে যোগদান করেন।

প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেন, কোভিড মহমারী একটি বৈশি^ক সংকট। এতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এ মহামারী শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বর্তমান সময়ে ‘ই-লার্নিং’ অত্যন্ত কার্যকর এবং সামনের দিনগুলোতে এটি আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশের মানুষ নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এ পার্যায়ে এসে পৌঁছেছে এবং কোভিড মহামারী মোকাবিলায় এদেশের মানুষ সাহসিকতার পরিচয় দিবে। এদেশের মানুষ অত্যন্ত প্রযুক্তি বান্ধব। এর কারণে বিশেষ করে শিক্ষাকার্যক্রমে ই-লার্নিংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধিতে আমাদের জন্য খুব বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতি-২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে, সেটাকে যুগোপোযোগীকরণ এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সামনের দিনগুলোতে কি ধরনের দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হবে, তার একটি প্রাক নির্বাচনের মাধ্যমে সে অনুযায়ী আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম, অবকাঠামো এবং শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা আরও সম্প্রসারণে মানসিকতা একটি বড় বাধা। মেধাবীদের শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসার জন্য এ পেশাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলতে হবে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে তোলতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে আরও বেশি হারে গবেষণা পরিচালনার ওপর জোরারোপ করেন। তিনি জানান, বর্তমানে দেশের ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে। তিনি পরীক্ষা এবং সনদ সর্বস্ব শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে, মত প্রকাশ করেন এবং শিল্পখাত ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ইউনেস্কো’র হিসাব অনুযায়ী কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারাবিশ্বে ১.৩৭ বিলিয়ন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য প্রথাগত শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ায় নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে ই-লার্নিং নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং ই-লার্নিং কে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতীয় শিক্ষা নীতিতে ‘ই-লার্নিং পলিসি’ অন্তর্ভুক্তকরণ, সারাদেশে নির্ভরযোগ্য হাই স্পিড ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স হ্রাসকরণ, ই-লার্নিংয়ের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত স্টার্টআপগুলোকে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া এবং ব্যাংক অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। অবকাঠামো ও ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ হাউসহোল্ডের ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এবং ৫.৬ শতাংশ হাউজহোল্ডের কম্পিউটার রয়েছে, এছাড়াও মোবাইল ডেটা প্যাকেজের উচ্চ মূল্য প্রান্তিক জনগণের ইন্টারনেট সংযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। শিল্পখাতের চাহিদা অনুযায়ী তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করতে কারিগরি শিক্ষায় আরও বেশি হারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ভুক্ত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় গড় অংশগ্রহণের হার ৪৫ শতাংশের উপরে, সেখানে বাংলাদেশে ১৫ শতাংশেরও কম। এমতাবস্থায় কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং আগ্রহ বৃদ্ধি করতে একে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ই-লার্নিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাজ্যের ‘ইউনির্ভাসিটি অব সারে’-এর উপ-উপাচার্য প্রফেসর ওসামা খান। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ই-লার্নিং এর ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের জন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ও পোস্টাল সার্ভিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যেখানে এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচির গুণগতমান নিশ্চিত করা এবং এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কার্যকর মিথস্ক্রিয়া অতীব জরুরি। এজন্য ভার্চুয়াল লার্নিং ইনভায়রনমেন্ট খুবই জরুরি। কি শিখানো হবে এবং কিভাবে শিখানো হবে সেটা যথাযথভবে নির্ধারণ করা গেলে তা যথার্থ হবে।

নির্ধারিত আলোচনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ বলেন, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে ই-লার্নিং পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এবং কোভিড মাহামারী আমাদের জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে দেশব্যাপী ২৬০টি কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান অবস্থা মোকাবিলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০০০০ শিক্ষকের মধ্যে নির্বাচিত ১৫০০ জন শিক্ষকের মাধ্যমে অনলাইনে ১৭ হাজার ৫০০টি লেকচার প্রদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। শিল্পখাতের চাহিদা মোতাবেক খুব শীঘ্রই ৯টি কলেজে ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ কোর্স পরিচালনা করা হবে।

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশের উপাচার্য প্রফেসর ড. কারম্যান জেড লামাংনা বলেন, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ই-লার্নিং প্রদানের জন্য অবকাঠামো দিক দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। তিনি এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোরারোপ করেন।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা জানান, শিল্পখাতের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষা কারিক্যুলাম প্রণয়ন করতে হবে এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে কিভাবে ই-লানির্ং কার্যক্রম পরিচালিত হবে সে বিষয়ে এখনই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি’র ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ বলেন, ই-লার্নিং কার্যক্রমের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মিথস্ক্রিয়া খুবই জরুরি এবং এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও বেশি হারে দক্ষতা উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে ‘ই-লার্নিং’ আরও বেশি হারে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইশতিয়াক আজিম বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচেছ এবং আমাদের এ পরিবর্তনকে উপেক্ষা না করে বরং তার সাথে মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও তিনি আগামী ২০-৩০ বছর পর শিক্ষা ব্যবস্থায় কি ধরনের পরিবর্তন আসবে তা মানিয়ে নেয়ার জন্য এখনই যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তার দ্রুত বাস্তাবায়নের আহ্বান জানান। মুক্ত আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের সাবেক সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ্, রিয়াদ হোসেন এবং ডিবিআই-এর প্রশিক্ষক শংকর রায় অংশগ্রহণ করেন।