দারকিতে পাল্টে গেল গ্রামের চেহারা

একসময় যে গ্রামের মানুষ অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত ছিল, বেঁচে থাকার তাগিদে একটা কাজের আশায় গ্রাম থেকে শহরের পানে ছুটছিল, আজ তারা অভাব-অনটনকে জয় করে সুখের সন্ধানে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। আজ তারা কাজের আশায় অন্যের দ্বারে কড়া নাড়ে নাহ, উপরন্তু কাজের আশায় হাজারও জনতা তাদের দুয়ারে হুমড়ি খায়। বলছি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার খেরুয়াজানী ইউনিয়নের বানিয়াকাজী গ্রামের কথা। এই গ্রাম আজ এদেশের অন্যতম একটি আর্দশ গ্রাম। নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলার মন্ত্র আজ এই গ্রামের প্রত্যেকের জানা। আজ এই গ্রামের প্রায় সকলেই এক একজন সফল উদ্যক্তো। যার ফলে বানিয়াকাজী গ্রামের এক একটি পরিবারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে আশপাশের প্রায় দুই থেকে তিন গ্রামের মানুষ। আর এরই মাধ্যমে এই অঞ্জলে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।

করোনাকালের এই বিশ্ব মন্দার মধ্যেই এই গ্রামের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতে পারছে। করোনার ফলে অর্থনৈতিক কোন বিপর্যয় এই গ্রামে দেখা দেয়নি। আর এসবের জন্য একমাত্র কারণ হলো মাছ ধরার দেশীয় পণ্য দারকি তৈরির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করা। স্থানীয়ভাবে যাকে বুচনা বলে অভিহিত করা হয়। এই দারকির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দরুণ এই গ্রামের পরিবেশ দিনকে দিন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আগে চারটি পাঁচটি পরিবার এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে বানিয়াকাজী গ্রাম সহ আশে পাশের কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই দারকি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। পূর্বে বানিয়াকাজী গ্রামের অনেক পরিবার কাজের সন্ধানে শহরের দিকে পাড়ি জমাতো।

কিন্তু বর্তমানে দারকির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ত করার পর অনেক পরিবারই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসছে। ফিরে এসে নিজের বসত বাড়িতে বসেই তৈরি করছে দেশীয় এই পণ্য। পুঁজির পরিমাণ ৫০০ টাকা হলেও এই ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। আর এই দারকি তৈরিতে প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র বাঁশ এবং কালো মোটা লাইলন সূতা। স্বাভাবিকভাবে দারকি তৈরিতে তেমন খরচ হয় না। একটি ভালোজাতের বাঁশ দিয়ে চার থেকে পাঁচটি দারকি তৈরি করা সম্ভব। আর সূতাও বেশি প্রয়োজন হয় না। মজুরিসহ ৫০-৬০ টাকার মধ্যেই একটি দারকি তৈরি হয়ে যায়। আর বুননকৌশল যথাযথ রক্ষা করলে প্রতিটি দারকি ১৫০ পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভবপর হয়? দারকি তৈরি করাও খুবই সহজ একটি কাজ। ছেলে বুড়ো সবাই অতি সহজেই কাজটি সমাধান করতে পারে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট বাচ্চারাও বাবা মাকে দারকি তৈরিতে সহসায় সাহায্য করতে পারে। প্রথমত দারকি তৈরি করতে চাঁটার প্রয়োজন হয়। কাঠের তৈরি বিশেষ ধরনের একটি বস্তুর সাহায্য বাঁশের চিকন শলা আর সুতার মারপ্যাচে আস্তে আস্তে সুন্দর এক চাঁটা তৈরি হয়। তারপর বাঁশের শক্ত কাঠি দ্বারা হাতের সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি হয়ে যায় মাছ ধরার দেশীয় পণ্য - নাম যার দারকি। সাধারণত নিযুক্ত শ্রমিকেরা বাঁশের শলা আর সুতা নিয়ে চাঁটা তৈরি করে। চাঁটার সাইজ ও এইসব শ্রমিকের মজুরি হিসাব করা হয় আনি দ্বারা। (স্থানীয়ভাবে দারকির সাইজ নির্ধারণ করতে ‘আনি’ হিসাব করা হয়) তারপর শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁটা সংগ্রহ করে মালিক দারকির রূপ দিয়ে বাজারজাত করে। বিশেষকরে প্রতি মঙ্গলবার গ্রামের ভিতর বিরাট কর্মজজ্ঞ চলে কারণ মুক্তাগাছা পৌরসভার স্বাভাবিক হাট বসে প্রতি বুধবার। হাটে উপস্থিত বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি এবং খুচরা ক্রেতার মাধ্যমে দারকির বিপননের ব্যাবস্থা হয়। এক সপ্তাহ অতিবাহিত হবার পর আবারও পরবর্তী হাটবারের অপেক্ষা। আর এইভাবেই সফলতার মুখ দেখছে বানিয়াকাজী গ্রামের গোটা শতেক পরিবার। এই দারকি তৈরি করে তারা যেমন তাদের পরিবারের চেহারা পরিবর্তন করছে তেমনি লালন করছে আমাদের দেশের ঐতিহ্য। যা আমাদের নিজস্ব সম্পদ।

কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে দেশীয় ঐতিহ্যের লালন করা দেশীয় পণ্য আজ ধ্বংসের মুখে। আধুনিকতার দোহায় দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এদেশের গ্রামীণ পণ্য। এলাকাবাসীর দাবি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মাছ ধরার দেশীয় পণ্য দারকির ঐতিহ্য আরও সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তুলা সম্ভবপর হতো। কালের পরিক্রমায় স্থান পেত এদেশের হাজারো ঐতিহ্যের মধ্যে একটি।

আফসারুল আলম মামুন

বানিয়াকাজী, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

আরও খবর

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৪ মহররম ১৪৪২, ২৬ ভাদ্র ১৪২৭

দারকিতে পাল্টে গেল গ্রামের চেহারা

একসময় যে গ্রামের মানুষ অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত ছিল, বেঁচে থাকার তাগিদে একটা কাজের আশায় গ্রাম থেকে শহরের পানে ছুটছিল, আজ তারা অভাব-অনটনকে জয় করে সুখের সন্ধানে সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। আজ তারা কাজের আশায় অন্যের দ্বারে কড়া নাড়ে নাহ, উপরন্তু কাজের আশায় হাজারও জনতা তাদের দুয়ারে হুমড়ি খায়। বলছি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার খেরুয়াজানী ইউনিয়নের বানিয়াকাজী গ্রামের কথা। এই গ্রাম আজ এদেশের অন্যতম একটি আর্দশ গ্রাম। নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলার মন্ত্র আজ এই গ্রামের প্রত্যেকের জানা। আজ এই গ্রামের প্রায় সকলেই এক একজন সফল উদ্যক্তো। যার ফলে বানিয়াকাজী গ্রামের এক একটি পরিবারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে আশপাশের প্রায় দুই থেকে তিন গ্রামের মানুষ। আর এরই মাধ্যমে এই অঞ্জলে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।

করোনাকালের এই বিশ্ব মন্দার মধ্যেই এই গ্রামের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতে পারছে। করোনার ফলে অর্থনৈতিক কোন বিপর্যয় এই গ্রামে দেখা দেয়নি। আর এসবের জন্য একমাত্র কারণ হলো মাছ ধরার দেশীয় পণ্য দারকি তৈরির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করা। স্থানীয়ভাবে যাকে বুচনা বলে অভিহিত করা হয়। এই দারকির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দরুণ এই গ্রামের পরিবেশ দিনকে দিন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আগে চারটি পাঁচটি পরিবার এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে বানিয়াকাজী গ্রাম সহ আশে পাশের কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই দারকি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। পূর্বে বানিয়াকাজী গ্রামের অনেক পরিবার কাজের সন্ধানে শহরের দিকে পাড়ি জমাতো।

কিন্তু বর্তমানে দারকির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ত করার পর অনেক পরিবারই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসছে। ফিরে এসে নিজের বসত বাড়িতে বসেই তৈরি করছে দেশীয় এই পণ্য। পুঁজির পরিমাণ ৫০০ টাকা হলেও এই ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। আর এই দারকি তৈরিতে প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র বাঁশ এবং কালো মোটা লাইলন সূতা। স্বাভাবিকভাবে দারকি তৈরিতে তেমন খরচ হয় না। একটি ভালোজাতের বাঁশ দিয়ে চার থেকে পাঁচটি দারকি তৈরি করা সম্ভব। আর সূতাও বেশি প্রয়োজন হয় না। মজুরিসহ ৫০-৬০ টাকার মধ্যেই একটি দারকি তৈরি হয়ে যায়। আর বুননকৌশল যথাযথ রক্ষা করলে প্রতিটি দারকি ১৫০ পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভবপর হয়? দারকি তৈরি করাও খুবই সহজ একটি কাজ। ছেলে বুড়ো সবাই অতি সহজেই কাজটি সমাধান করতে পারে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট বাচ্চারাও বাবা মাকে দারকি তৈরিতে সহসায় সাহায্য করতে পারে। প্রথমত দারকি তৈরি করতে চাঁটার প্রয়োজন হয়। কাঠের তৈরি বিশেষ ধরনের একটি বস্তুর সাহায্য বাঁশের চিকন শলা আর সুতার মারপ্যাচে আস্তে আস্তে সুন্দর এক চাঁটা তৈরি হয়। তারপর বাঁশের শক্ত কাঠি দ্বারা হাতের সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি হয়ে যায় মাছ ধরার দেশীয় পণ্য - নাম যার দারকি। সাধারণত নিযুক্ত শ্রমিকেরা বাঁশের শলা আর সুতা নিয়ে চাঁটা তৈরি করে। চাঁটার সাইজ ও এইসব শ্রমিকের মজুরি হিসাব করা হয় আনি দ্বারা। (স্থানীয়ভাবে দারকির সাইজ নির্ধারণ করতে ‘আনি’ হিসাব করা হয়) তারপর শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁটা সংগ্রহ করে মালিক দারকির রূপ দিয়ে বাজারজাত করে। বিশেষকরে প্রতি মঙ্গলবার গ্রামের ভিতর বিরাট কর্মজজ্ঞ চলে কারণ মুক্তাগাছা পৌরসভার স্বাভাবিক হাট বসে প্রতি বুধবার। হাটে উপস্থিত বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি এবং খুচরা ক্রেতার মাধ্যমে দারকির বিপননের ব্যাবস্থা হয়। এক সপ্তাহ অতিবাহিত হবার পর আবারও পরবর্তী হাটবারের অপেক্ষা। আর এইভাবেই সফলতার মুখ দেখছে বানিয়াকাজী গ্রামের গোটা শতেক পরিবার। এই দারকি তৈরি করে তারা যেমন তাদের পরিবারের চেহারা পরিবর্তন করছে তেমনি লালন করছে আমাদের দেশের ঐতিহ্য। যা আমাদের নিজস্ব সম্পদ।

কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে দেশীয় ঐতিহ্যের লালন করা দেশীয় পণ্য আজ ধ্বংসের মুখে। আধুনিকতার দোহায় দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এদেশের গ্রামীণ পণ্য। এলাকাবাসীর দাবি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মাছ ধরার দেশীয় পণ্য দারকির ঐতিহ্য আরও সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তুলা সম্ভবপর হতো। কালের পরিক্রমায় স্থান পেত এদেশের হাজারো ঐতিহ্যের মধ্যে একটি।

আফসারুল আলম মামুন

বানিয়াকাজী, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।