মুক্তিযুদ্ধের কলম সৈনিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষের জন্মশতবার্ষিকী

গত ৯ সেপ্টেম্বর জন্মদিনের শতবর্ষ পার করেন সন্তোষ কুমার ঘোষ। ১৯২০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে তার জন্ম। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘোষ পৈতৃক ভিটা বরিশাল ছেড়ে কবে কেন রাজবাড়ী স্থায়ী হন জানা নেই। মা সরযূবালা দেবী। বাল্যশিক্ষা আর ম্যাট্রিকুলেশন রাজবাড়ীতেই। বাংলা ও গণিতে লেটার মার্ক নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন রাজা সূর্যকুমার ইনস্টিটিউট থেকে। আমার বাবা কুমারেশ চন্দ্র চক্রবর্তী এবং কাজী হালিম ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী। স্কুলজীবনেই তার লেখার হাত, মেধা, প্রতিভা সবার দৃষ্টিতে ছিল বলেই বাবা গল্প করতেন। কলেজ জীবন শুরু করেন কলকাতায়। ডিস্টিংশন নাম্বার নিয়ে গ্র?্যাজুয়েশন করেন। প্রথাগত লেখাপড়া আর করেননি। কলেজ জীবন থেকেই নিজেকে অবারিত করেন শুধু পাঠ আর পাঠে। ইংরেজি, সংস্কৃত আর বাংলা সাহিত্যের সর্বভুক পাঠক হিসেবে গোগ্রাসী ক্ষিধা কখনই যেন মিটত না। রবীন্দ্রসাহিত্য আর রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠে তার জীবনের সর্বপর্যায়ের সাথী। গ্রামীণ জীবনের জড়তা কাটিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত অঙ্গনের প্রথিতযশা সবার সঙ্গে তার ওঠাবসা মেলবন্ধন শুরু হয়ে যায়।

১৯৩৭ সালে ভারতবর্ষ পত্রিকায় তার প্রথম ছোটগল্প- নবশক্তি পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। এরপর বাকি জীবনে কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটদের বই, উপন্যাস একের পর এক বেরোতেই থাকে। প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘কিনু গোয়ালার গলি’ (১৯৫০) কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠা দেয়। আরও ডজনখানেক উপন্যাসের মধ্যে ‘শেষ নমস্কার-শ্রী চরণেষু মা’ (১৯৭১) সর্বভারতীয় সাহিত্য জগতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ বছরই তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। পরের বছর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। তাইওয়ান কবিসংঘ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর কলকাতার নাগরিক জীবন, যে জীবনের সঙ্গে মিশে যান ওতপ্রোতভাবে, মূলত তার লেখায়- সাহিত্যে সেই প্রতিফলনই বেশি দেখা যায়। যে গ্রামীণ জীবন তিনি ছেড়ে যান তা আত্মজৈবনিক ছায়া হিসেবে বিভিন্ন ছোটগল্পে, নানা রঙের দিন উপন্যাসে কিছু কিছু ছাপ ফেলে। আলাদা করে জীবনী তিনি লেখেননি। ...জীবনী মানে যদি হয় কতকগুলো প্রামাণিক ঘটনা, তা হলে এক কথায় উত্তর ...‘না’। কিছু কিছু বেদনা, কিছু অনুভূতি, কিছু সন্ধান, কিছু প্রতীতী, তা-ও তো জীবন-ই! ...এই ভাষা সন্তোষ কুমার ঘোষের লেখা থেকেই নেয়া। কথাসাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত এই লেখকের জীবনের এক অসম প্রতিযোগিতা ছিল সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে।

কলেজ জীবন শেষ করেই ১৯৪১ সালে দৈনিক প্রত্যহ পত্রিকা দিয়ে শুরু। দৈনিক যুগান্তর, মর্নিং নিউজ, দি স্টেসম্যান, দি নেশন, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডস একের পর এক বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। স্থিতু হন ১৯৫৮ সালে কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম বার্তা সম্পাদক পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে এই পত্রিকার মূল দায়িত্বে এসে। ১৯৬৪ সালে একই সঙ্গে আনন্দবাজার আর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডস পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিক হিসেবে একনিষ্ঠতার কারণে সাহিত্য রচনায় যথাযথ সময় দিতে পারেননি অনেকটাই। একদিকে একজন প্রতিভাবান সংবেদনশীল সাহিত্যিক, অন্যদিকে বাঘা সাংবাদিক এর মাঝে কিছু বৈপরীত্য থেকেই যায়।

এই দুইয়ের মাঝে তাকে সামগ্রিকভাবে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রচিন্তা আর রবিকর তার দুটি প্রবন্ধের বই। রবীন্দ্রনাথকে তিনি শুধু আত্মস্থই করেননি, মুখস্থ করেন অনেকটাই। জোর দিয়েই তাই বলতে পারেন, সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্য খোয়া গেলে ক্ষতি নেই। আমার কন্ঠস্থ তিনি। সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গে হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রতর মতো শিল্পীদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল তার বাড়ি। যদিও বিশ্বভারতীর সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের বিরোধে তিনি বিশ্বভারতীর পক্ষেই পরে অবস্থান নেন। প্রচ-ভাবে রবীন্দ্র আনুগত্যই এর প্রধান কারণ।

রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য সাধনা আর সাংবাদিকতা তিন দিকেই ছিল তার অমোঘ অনিবার্য ত্রিবেণী সংগম। কোনটার চেয়ে কোনটা কম বা বেশি বলা কঠিন। এটুকু বলা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অনন্য প্রজ্ঞার অধিকারী এবং আদর্শনিষ্ঠ। পরিচিতির জগতে সাংবাদিক হিসেবেই এগিয়ে আছেন।

এই সাংবাদিক হিসেবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনি অন্যতম কলমযোদ্ধা। কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের খবর পরদিন ছাপা হবে আনন্দবাজার পত্রিকায়। খবরটা প্রকাশের ধরন নিয়ে ওই সময় তিনি অনেকটা চিন্তিত থাকেন; যা লেখক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত পরবর্তীতে প্রকাশ করেন এবং উল্লেখ করেন বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর- পরিচয়ে পরদিন তার সংবাদ প্রকাশ কীভাবে একটা নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই কথা। আর যা মুহূর্তে মান্যতা পেয়ে যায় বিভিন্ন মহলে এবং আজ যা ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আনন্দবাজার পত্রিকার বাংলাদেশের স্বপক্ষীয় ভূমিকা তৈরিতে তার নিরলস ও উৎসাহী ভূমিকা অবশ্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবি রাখে।

একাত্তরেই আমার বাবা অর্থাৎ বাল্যবন্ধুর সঙ্গে আবার তার অনেকটা নৈকট্য ঘটে। আর সেই সুবাদে দুই দিন তার বাড়িতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়। কর্মক্ষেত্রে অনেকেই তাকে হঠাৎ মেজাজী, হঠাৎই গলে যাওয়া জল হিসেবে দেখেছেন, পেয়েছেন। প্রচ- অহংকারী হিসেবেও নাম শুনেছি। অথচ দুইজন বাল্যবন্ধুর আলাপচারিতা ছিল অনেকটাই শিশুর মতো। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর তার লেখায় সেই অর্থে প্রাধান্য কমই পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে পূর্ববঙ্গের মানুষটির লেখক জীবন সর্ববঙ্গের, সর্বভারতীয়ও বটে। কিন্তু উপন্যাসের কোন এক চরিত্র যখন বিড়বিড় করে বলে- ‘এইবার আমি যাব, স্বদেশে ফিরব।’ ...ভিতরে ভিতরে এই যে প্রথম যথার্থই প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল, স্বদেশ! স্বদেশ! একটা আকস্মিক আলেয়ার মতো। যেখানে সে আছে, এই শয্যা, এই ঘর তার নয়। সাময়িক সরাই শুধু। এই যন্ত্রণার আগে এবং পরে আছে যা তার উৎস, বা যা তার পরিণাম। যেখানে সে সহজ, স্বচ্ছন্দ, শান্ত তার স্বদেশ। ...বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চরিত্রের কোথাও কী তিনি নিজে প্রচ্ছন্নভাবে ছিলেন না? ...প্রখর ব্যক্তিত্বের মানুষটিকে যখনই মনে হয়, এই কথাটাই যেন জোর করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে- ছিলেন, ভীষণভাবে ছিলেন।

১৯৮৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি মারা যান। আবাল্যস্বভাবে অন্তশীল এক অনন্ত অস্থিরতায় তৈরি তার শিল্পের জমিন। শেষবেলাতেও যখন কলম ধরতে পারেননি, কন্যা কাকলি চক্রবর্তীকে দিয়ে শ্রুতিলেখনীর মাধ্যমে শেষ করেন ‘যাত্রাভঙ্গ’ লেখাটি। এ সময়ের এই স্থিরতায় বিস্মিত শক্তি চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর ৪ দিন আগে ‘অগ্রিম’ কবিতায় তার উদ্দেশে লেখেন-

‘কীভাবে মুহূর্তে মরছো, বিলাপ করছো না

হেসে হেসে বলছো, দ্যাখ জীবনে একবার

মৃত্যুর নিকটে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি।’

বিলাপহীন মৃত্যু জীবন থেকে তাকে কেড়ে নেয়নি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে যিনি ধারণ করতে পারেন অবলীলায়, বহুকাল অবধি তিনি থেকেই যান।

সন্তোষ কুমার ঘোষ তেমনই রয়ে যাবেন আমাদের ইতিহাস সচেতনতায়, আমাদের সাহিত্য প্রীতিতে। মুক্তিযুদ্ধের অক্লান্ত কলম সৈনিক হিসেবে, এই জন্মমাটির ঈর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, সাংবাদিকতা জগতের এক বলিষ্ঠ স্তম্ভ হিসেবে, বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম যুগস্রষ্টা হিসেবে। জন্মশতকের শ্রদ্ধা জানানোর ঋণভার তাই সার্বিক অর্থে আমাদের রয়েই যায়।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৪ মহররম ১৪৪২, ২৬ ভাদ্র ১৪২৭

শ্রদ্ধাঞ্জলি

মুক্তিযুদ্ধের কলম সৈনিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষের জন্মশতবার্ষিকী

দেবাহুতি চক্রবর্তী

গত ৯ সেপ্টেম্বর জন্মদিনের শতবর্ষ পার করেন সন্তোষ কুমার ঘোষ। ১৯২০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে তার জন্ম। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘোষ পৈতৃক ভিটা বরিশাল ছেড়ে কবে কেন রাজবাড়ী স্থায়ী হন জানা নেই। মা সরযূবালা দেবী। বাল্যশিক্ষা আর ম্যাট্রিকুলেশন রাজবাড়ীতেই। বাংলা ও গণিতে লেটার মার্ক নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন রাজা সূর্যকুমার ইনস্টিটিউট থেকে। আমার বাবা কুমারেশ চন্দ্র চক্রবর্তী এবং কাজী হালিম ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী। স্কুলজীবনেই তার লেখার হাত, মেধা, প্রতিভা সবার দৃষ্টিতে ছিল বলেই বাবা গল্প করতেন। কলেজ জীবন শুরু করেন কলকাতায়। ডিস্টিংশন নাম্বার নিয়ে গ্র?্যাজুয়েশন করেন। প্রথাগত লেখাপড়া আর করেননি। কলেজ জীবন থেকেই নিজেকে অবারিত করেন শুধু পাঠ আর পাঠে। ইংরেজি, সংস্কৃত আর বাংলা সাহিত্যের সর্বভুক পাঠক হিসেবে গোগ্রাসী ক্ষিধা কখনই যেন মিটত না। রবীন্দ্রসাহিত্য আর রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠে তার জীবনের সর্বপর্যায়ের সাথী। গ্রামীণ জীবনের জড়তা কাটিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত অঙ্গনের প্রথিতযশা সবার সঙ্গে তার ওঠাবসা মেলবন্ধন শুরু হয়ে যায়।

১৯৩৭ সালে ভারতবর্ষ পত্রিকায় তার প্রথম ছোটগল্প- নবশক্তি পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। এরপর বাকি জীবনে কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটদের বই, উপন্যাস একের পর এক বেরোতেই থাকে। প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘কিনু গোয়ালার গলি’ (১৯৫০) কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠা দেয়। আরও ডজনখানেক উপন্যাসের মধ্যে ‘শেষ নমস্কার-শ্রী চরণেষু মা’ (১৯৭১) সর্বভারতীয় সাহিত্য জগতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ বছরই তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। পরের বছর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। তাইওয়ান কবিসংঘ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর কলকাতার নাগরিক জীবন, যে জীবনের সঙ্গে মিশে যান ওতপ্রোতভাবে, মূলত তার লেখায়- সাহিত্যে সেই প্রতিফলনই বেশি দেখা যায়। যে গ্রামীণ জীবন তিনি ছেড়ে যান তা আত্মজৈবনিক ছায়া হিসেবে বিভিন্ন ছোটগল্পে, নানা রঙের দিন উপন্যাসে কিছু কিছু ছাপ ফেলে। আলাদা করে জীবনী তিনি লেখেননি। ...জীবনী মানে যদি হয় কতকগুলো প্রামাণিক ঘটনা, তা হলে এক কথায় উত্তর ...‘না’। কিছু কিছু বেদনা, কিছু অনুভূতি, কিছু সন্ধান, কিছু প্রতীতী, তা-ও তো জীবন-ই! ...এই ভাষা সন্তোষ কুমার ঘোষের লেখা থেকেই নেয়া। কথাসাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত এই লেখকের জীবনের এক অসম প্রতিযোগিতা ছিল সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে।

কলেজ জীবন শেষ করেই ১৯৪১ সালে দৈনিক প্রত্যহ পত্রিকা দিয়ে শুরু। দৈনিক যুগান্তর, মর্নিং নিউজ, দি স্টেসম্যান, দি নেশন, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডস একের পর এক বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। স্থিতু হন ১৯৫৮ সালে কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম বার্তা সম্পাদক পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে এই পত্রিকার মূল দায়িত্বে এসে। ১৯৬৪ সালে একই সঙ্গে আনন্দবাজার আর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডস পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিক হিসেবে একনিষ্ঠতার কারণে সাহিত্য রচনায় যথাযথ সময় দিতে পারেননি অনেকটাই। একদিকে একজন প্রতিভাবান সংবেদনশীল সাহিত্যিক, অন্যদিকে বাঘা সাংবাদিক এর মাঝে কিছু বৈপরীত্য থেকেই যায়।

এই দুইয়ের মাঝে তাকে সামগ্রিকভাবে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রচিন্তা আর রবিকর তার দুটি প্রবন্ধের বই। রবীন্দ্রনাথকে তিনি শুধু আত্মস্থই করেননি, মুখস্থ করেন অনেকটাই। জোর দিয়েই তাই বলতে পারেন, সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্য খোয়া গেলে ক্ষতি নেই। আমার কন্ঠস্থ তিনি। সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গে হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রতর মতো শিল্পীদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল তার বাড়ি। যদিও বিশ্বভারতীর সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের বিরোধে তিনি বিশ্বভারতীর পক্ষেই পরে অবস্থান নেন। প্রচ-ভাবে রবীন্দ্র আনুগত্যই এর প্রধান কারণ।

রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য সাধনা আর সাংবাদিকতা তিন দিকেই ছিল তার অমোঘ অনিবার্য ত্রিবেণী সংগম। কোনটার চেয়ে কোনটা কম বা বেশি বলা কঠিন। এটুকু বলা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অনন্য প্রজ্ঞার অধিকারী এবং আদর্শনিষ্ঠ। পরিচিতির জগতে সাংবাদিক হিসেবেই এগিয়ে আছেন।

এই সাংবাদিক হিসেবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনি অন্যতম কলমযোদ্ধা। কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের খবর পরদিন ছাপা হবে আনন্দবাজার পত্রিকায়। খবরটা প্রকাশের ধরন নিয়ে ওই সময় তিনি অনেকটা চিন্তিত থাকেন; যা লেখক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত পরবর্তীতে প্রকাশ করেন এবং উল্লেখ করেন বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর- পরিচয়ে পরদিন তার সংবাদ প্রকাশ কীভাবে একটা নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই কথা। আর যা মুহূর্তে মান্যতা পেয়ে যায় বিভিন্ন মহলে এবং আজ যা ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আনন্দবাজার পত্রিকার বাংলাদেশের স্বপক্ষীয় ভূমিকা তৈরিতে তার নিরলস ও উৎসাহী ভূমিকা অবশ্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবি রাখে।

একাত্তরেই আমার বাবা অর্থাৎ বাল্যবন্ধুর সঙ্গে আবার তার অনেকটা নৈকট্য ঘটে। আর সেই সুবাদে দুই দিন তার বাড়িতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়। কর্মক্ষেত্রে অনেকেই তাকে হঠাৎ মেজাজী, হঠাৎই গলে যাওয়া জল হিসেবে দেখেছেন, পেয়েছেন। প্রচ- অহংকারী হিসেবেও নাম শুনেছি। অথচ দুইজন বাল্যবন্ধুর আলাপচারিতা ছিল অনেকটাই শিশুর মতো। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর তার লেখায় সেই অর্থে প্রাধান্য কমই পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে পূর্ববঙ্গের মানুষটির লেখক জীবন সর্ববঙ্গের, সর্বভারতীয়ও বটে। কিন্তু উপন্যাসের কোন এক চরিত্র যখন বিড়বিড় করে বলে- ‘এইবার আমি যাব, স্বদেশে ফিরব।’ ...ভিতরে ভিতরে এই যে প্রথম যথার্থই প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল, স্বদেশ! স্বদেশ! একটা আকস্মিক আলেয়ার মতো। যেখানে সে আছে, এই শয্যা, এই ঘর তার নয়। সাময়িক সরাই শুধু। এই যন্ত্রণার আগে এবং পরে আছে যা তার উৎস, বা যা তার পরিণাম। যেখানে সে সহজ, স্বচ্ছন্দ, শান্ত তার স্বদেশ। ...বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চরিত্রের কোথাও কী তিনি নিজে প্রচ্ছন্নভাবে ছিলেন না? ...প্রখর ব্যক্তিত্বের মানুষটিকে যখনই মনে হয়, এই কথাটাই যেন জোর করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে- ছিলেন, ভীষণভাবে ছিলেন।

১৯৮৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি মারা যান। আবাল্যস্বভাবে অন্তশীল এক অনন্ত অস্থিরতায় তৈরি তার শিল্পের জমিন। শেষবেলাতেও যখন কলম ধরতে পারেননি, কন্যা কাকলি চক্রবর্তীকে দিয়ে শ্রুতিলেখনীর মাধ্যমে শেষ করেন ‘যাত্রাভঙ্গ’ লেখাটি। এ সময়ের এই স্থিরতায় বিস্মিত শক্তি চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর ৪ দিন আগে ‘অগ্রিম’ কবিতায় তার উদ্দেশে লেখেন-

‘কীভাবে মুহূর্তে মরছো, বিলাপ করছো না

হেসে হেসে বলছো, দ্যাখ জীবনে একবার

মৃত্যুর নিকটে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি।’

বিলাপহীন মৃত্যু জীবন থেকে তাকে কেড়ে নেয়নি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে যিনি ধারণ করতে পারেন অবলীলায়, বহুকাল অবধি তিনি থেকেই যান।

সন্তোষ কুমার ঘোষ তেমনই রয়ে যাবেন আমাদের ইতিহাস সচেতনতায়, আমাদের সাহিত্য প্রীতিতে। মুক্তিযুদ্ধের অক্লান্ত কলম সৈনিক হিসেবে, এই জন্মমাটির ঈর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, সাংবাদিকতা জগতের এক বলিষ্ঠ স্তম্ভ হিসেবে, বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম যুগস্রষ্টা হিসেবে। জন্মশতকের শ্রদ্ধা জানানোর ঋণভার তাই সার্বিক অর্থে আমাদের রয়েই যায়।