হেফাজতে মৃত্যুর এটাই যেন শেষ বিচার না হয় এটা হতে হবে শুরু

মোহাম্মদ শাহজাহান

থানায় নিয়ে অর্থাৎ পুলিশের হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা মামলায় আদালত তিনজন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। মামলার অপর দুই আসামি পুলিশের সোর্স রাশেদ ও সুমনকে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। সাড়ে ৬ বছর আগে রাজধানীর পল্লবীতে একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে ইশতিয়াক হোসেন জনি ও তার ভাই ইমতিয়াজ হোসেনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। থানায় নিয়ে ইমতিয়াজকে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করলে এক পর্যায়ে বড় ভাই ইশতিয়াক ছোট ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে যায়। এ সময় ইশতিয়াককেও মারধর শুরু করে পুলিশ। এ সময় অনেকটা উন্মাদের মতো ইশতিয়াকের বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরেন এসআই জাহিদুর রহমান। পিপাসার্ত ইশতিয়াক পানির জন্য আকুতি জানালে পানির বদলে ইশতিয়াকের মুখে থুতু ছিটিতে দেয় এসআই জাহিদ।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েস ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ বুধবার দুই আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হচ্ছেন- পল্লবী থানার এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং দুই এএসআই রাশেদুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান মিন্টু। বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের মামলায় এটিই প্রথম রায়। রায়ে সাজার পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানা না দিলে অতিরিক্ত আরও ৬ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। রায়ে বলা হয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নিহতের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দুই সোর্সকে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, থানা হেফাজতে জনিকে যে নির্যাতন করা হয়েছে তা ঘৃণ্য এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। থানা হেফাজতে নির্যাতনকালে জনি পানি পান করতে চাইলে পানির পরিবর্তে থুতু দেয়া হয়। এসআই জাহিদের ওই নির্যাতন বাকি দুই পুলিশ সদস্য দেখলেও তারা ভুক্তভোগীকে সহায়তা না করে অপরাধে সহায়তা করেছে। তাই এই মামলার তিন আসামি পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল হক ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুকে এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো।’ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নিহত জনির ছোট ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেছেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি।’ রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান, সেটি আবারও প্রতিষ্ঠিত হলো।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, ‘এ রায় সন্তোষজনক নয়। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন।’ দৈনিক সংবাদ-এর দৃষ্টিতে ‘এ রায় দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’

মামলার আসামিদের মধ্যে এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ ও পুলিশের সোর্স দুজন কারাগারে রয়েছেন। যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত দুই এএসআই এবং পুলিশের সোর্স রাসেল পলাতক রয়েছেন। ঘটনা সম্পর্কে মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকের ইরানি ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. বিল্লালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে সেখানে উপস্থিত ইশতিয়াক ও তার ছোট ভাই ইমতিয়াজ এর প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে সোর্স সুমনের সঙ্গে তাদের দুই ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়। সোর্স সুমনের ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দুই ভাইকে থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতনে ইশতিয়াকের অবস্থা খারাপ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইমতিয়াজ জানান, ‘তার বড় ভাই জনিকে থানায় নিয়ে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করা হয়। যার কারণে তিনি মারা যান। পুলিশের বিরুদ্ধে করা এই মামলার বিচার পেতে তাদের অনেক বাধা বিপত্তি পেরুতে হয়েছে।’ ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন ইমতিয়াজ। আদালত মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ প্রদান করে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন পেশ করা হয়। প্রতিবেদনে পাঁচজনকে অভিযুক্ত এবং ৫ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছিল। ৪ বছরের বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর ৯ সেপ্টেম্বর এই ঐতিহাসিক রায়টি হলো। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ লিগ্যালএইড অ্যান্ড সার্ভিসেস।

একজন খ্যাতিমান আইনজীবী বলেছেন, আমাদের দেশে বেশিরভাগ আইনের কোন মুখবন্ধ বা প্রারম্ভিক কথা (প্রিয়াম্বল) থাকে না। এদিক দিয়ে ২০১৩ সালে প্রণীত নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটির একটা সুন্দর প্রারম্ভিক রয়েছে। এই মুখবন্ধে বলা হয়েছে আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোন ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি দেয়া যাবে না, এমনকি সে রকম কোন আচরণও করা যাবে না। আইনটির মুখবন্ধে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালে গৃহীত নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বা নির্যাতনবিরোধী সনদের একজন অংশীজন রাষ্ট্র। এই সনদকে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘কনভেনশন এগেইনেস্ট টর্চার। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান এবং জাতিসংঘের এই সনদের বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। অনেক বছর বিলম্বে হলেও অন্তত একটি হত্যার বিচার হয়েছে, অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইনটির একটা খুবই ভালো দিক হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত ব্যক্তিকে বিচার চাওয়ার জন্য অর্থাৎ অভিযোগ দায়েরের জন্য থানায় যেতে হবে না। কারণ, এটা কারও অজানা নয় যে, সাধারণ ডায়েরি বা মামলা করার জন্য থানায় গেলে কোন কোন সময় নানারকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। আর পুলিশের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা যে আমাদের দেশে কত বড় কঠিন কাজ, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে শুরু অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড। দুই বছর ২০০৪ সালে পর বিএনপি-জামায়াত আমলেই শুরু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ার যেটা এখনও চলছে। গত ১২ বছর ধরে মহাজোট সরকারের আমলেও এই বর্বরতা অব্যাহত থাকে। খালেদা জিয়ার আমলে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড শুরু হলে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ এই আদিম বর্বরতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পক্ষই এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে কম বেশি অংশ নিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ও পত্রপত্রিকা বিনা বিচারে হত্যার প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিগত বছরগুলোতে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার, আত্মরক্ষার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক হাজার নাগরিককে হত্যা করেছে এবং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

১০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সমাপনী ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এদেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা যা বলেন, তা বাস্তবায়ন করে ছাড়েন। তিনি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার কারচুপির আশ্রয় নেয়ায় তা তিনিই বাতিল করে দিয়েছেন।’ আমরা বিশ্বাস ও আশা করব, বঙ্গবন্ধু কন্যার আশ্বাসের পর বিচারবহির্ভূত হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িত প্রত্যেকের বিচার এদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে এবং এই আদিম বর্বরতার চির অবসান ঘটবে।

সর্বশেষে দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের এই লেখা শেষ করছি। ৯ সেপ্টেম্বর ৩ পুলিশের বিচারের রায়ের পর ১১ সেপ্টেম্বর ‘পুলিশ কর্মকর্তাদের দণ্ড- আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে দৈনিক সংবাদ সম্পাদকীয়তে ৩ পুলিশের সাজার রায়কে দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছে। সংবাদ লিখেছে : ‘আদালতে পুলিশ কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রমাণ ও আইন অনুযায়ী সাজা হওয়ায় দেশে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। এ রায়ের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হলো যে, অপরাধী যে বা যারাই হোক না কেন তাকে সাজা পেতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা চাইব, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর যত ঘটনা এদেশে ঘটেছে তার প্রতিকার এ আইনের অধীনে করা হোক।’

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৫ মহররম ১৪৪২, ২৭ ভাদ্র ১৪২৭

হেফাজতে মৃত্যুর এটাই যেন শেষ বিচার না হয় এটা হতে হবে শুরু

মোহাম্মদ শাহজাহান

থানায় নিয়ে অর্থাৎ পুলিশের হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা মামলায় আদালত তিনজন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। মামলার অপর দুই আসামি পুলিশের সোর্স রাশেদ ও সুমনকে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। সাড়ে ৬ বছর আগে রাজধানীর পল্লবীতে একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে ইশতিয়াক হোসেন জনি ও তার ভাই ইমতিয়াজ হোসেনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। থানায় নিয়ে ইমতিয়াজকে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করলে এক পর্যায়ে বড় ভাই ইশতিয়াক ছোট ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে যায়। এ সময় ইশতিয়াককেও মারধর শুরু করে পুলিশ। এ সময় অনেকটা উন্মাদের মতো ইশতিয়াকের বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরেন এসআই জাহিদুর রহমান। পিপাসার্ত ইশতিয়াক পানির জন্য আকুতি জানালে পানির বদলে ইশতিয়াকের মুখে থুতু ছিটিতে দেয় এসআই জাহিদ।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েস ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ বুধবার দুই আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হচ্ছেন- পল্লবী থানার এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং দুই এএসআই রাশেদুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান মিন্টু। বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের মামলায় এটিই প্রথম রায়। রায়ে সাজার পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানা না দিলে অতিরিক্ত আরও ৬ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। রায়ে বলা হয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নিহতের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দুই সোর্সকে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, থানা হেফাজতে জনিকে যে নির্যাতন করা হয়েছে তা ঘৃণ্য এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। থানা হেফাজতে নির্যাতনকালে জনি পানি পান করতে চাইলে পানির পরিবর্তে থুতু দেয়া হয়। এসআই জাহিদের ওই নির্যাতন বাকি দুই পুলিশ সদস্য দেখলেও তারা ভুক্তভোগীকে সহায়তা না করে অপরাধে সহায়তা করেছে। তাই এই মামলার তিন আসামি পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল হক ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুকে এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো।’ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নিহত জনির ছোট ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেছেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি।’ রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান, সেটি আবারও প্রতিষ্ঠিত হলো।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, ‘এ রায় সন্তোষজনক নয়। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন।’ দৈনিক সংবাদ-এর দৃষ্টিতে ‘এ রায় দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’

মামলার আসামিদের মধ্যে এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ ও পুলিশের সোর্স দুজন কারাগারে রয়েছেন। যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত দুই এএসআই এবং পুলিশের সোর্স রাসেল পলাতক রয়েছেন। ঘটনা সম্পর্কে মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকের ইরানি ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. বিল্লালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে সেখানে উপস্থিত ইশতিয়াক ও তার ছোট ভাই ইমতিয়াজ এর প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে সোর্স সুমনের সঙ্গে তাদের দুই ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়। সোর্স সুমনের ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দুই ভাইকে থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতনে ইশতিয়াকের অবস্থা খারাপ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইমতিয়াজ জানান, ‘তার বড় ভাই জনিকে থানায় নিয়ে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করা হয়। যার কারণে তিনি মারা যান। পুলিশের বিরুদ্ধে করা এই মামলার বিচার পেতে তাদের অনেক বাধা বিপত্তি পেরুতে হয়েছে।’ ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন ইমতিয়াজ। আদালত মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ প্রদান করে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন পেশ করা হয়। প্রতিবেদনে পাঁচজনকে অভিযুক্ত এবং ৫ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছিল। ৪ বছরের বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর ৯ সেপ্টেম্বর এই ঐতিহাসিক রায়টি হলো। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ লিগ্যালএইড অ্যান্ড সার্ভিসেস।

একজন খ্যাতিমান আইনজীবী বলেছেন, আমাদের দেশে বেশিরভাগ আইনের কোন মুখবন্ধ বা প্রারম্ভিক কথা (প্রিয়াম্বল) থাকে না। এদিক দিয়ে ২০১৩ সালে প্রণীত নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটির একটা সুন্দর প্রারম্ভিক রয়েছে। এই মুখবন্ধে বলা হয়েছে আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোন ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি দেয়া যাবে না, এমনকি সে রকম কোন আচরণও করা যাবে না। আইনটির মুখবন্ধে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালে গৃহীত নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বা নির্যাতনবিরোধী সনদের একজন অংশীজন রাষ্ট্র। এই সনদকে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘কনভেনশন এগেইনেস্ট টর্চার। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান এবং জাতিসংঘের এই সনদের বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। অনেক বছর বিলম্বে হলেও অন্তত একটি হত্যার বিচার হয়েছে, অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইনটির একটা খুবই ভালো দিক হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত ব্যক্তিকে বিচার চাওয়ার জন্য অর্থাৎ অভিযোগ দায়েরের জন্য থানায় যেতে হবে না। কারণ, এটা কারও অজানা নয় যে, সাধারণ ডায়েরি বা মামলা করার জন্য থানায় গেলে কোন কোন সময় নানারকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। আর পুলিশের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা যে আমাদের দেশে কত বড় কঠিন কাজ, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে শুরু অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড। দুই বছর ২০০৪ সালে পর বিএনপি-জামায়াত আমলেই শুরু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ার যেটা এখনও চলছে। গত ১২ বছর ধরে মহাজোট সরকারের আমলেও এই বর্বরতা অব্যাহত থাকে। খালেদা জিয়ার আমলে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড শুরু হলে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ এই আদিম বর্বরতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পক্ষই এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে কম বেশি অংশ নিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ও পত্রপত্রিকা বিনা বিচারে হত্যার প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিগত বছরগুলোতে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার, আত্মরক্ষার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক হাজার নাগরিককে হত্যা করেছে এবং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

১০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সমাপনী ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এদেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা যা বলেন, তা বাস্তবায়ন করে ছাড়েন। তিনি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার কারচুপির আশ্রয় নেয়ায় তা তিনিই বাতিল করে দিয়েছেন।’ আমরা বিশ্বাস ও আশা করব, বঙ্গবন্ধু কন্যার আশ্বাসের পর বিচারবহির্ভূত হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িত প্রত্যেকের বিচার এদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে এবং এই আদিম বর্বরতার চির অবসান ঘটবে।

সর্বশেষে দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের এই লেখা শেষ করছি। ৯ সেপ্টেম্বর ৩ পুলিশের বিচারের রায়ের পর ১১ সেপ্টেম্বর ‘পুলিশ কর্মকর্তাদের দণ্ড- আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে দৈনিক সংবাদ সম্পাদকীয়তে ৩ পুলিশের সাজার রায়কে দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছে। সংবাদ লিখেছে : ‘আদালতে পুলিশ কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রমাণ ও আইন অনুযায়ী সাজা হওয়ায় দেশে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। এ রায়ের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হলো যে, অপরাধী যে বা যারাই হোক না কেন তাকে সাজা পেতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা চাইব, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর যত ঘটনা এদেশে ঘটেছে তার প্রতিকার এ আইনের অধীনে করা হোক।’

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com