অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া হয়
রাষ্ট্রীয় বাপেক্সের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রুশ প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমকে ভোলায় উচ্চমূল্যে ৩টি গ্যাসকূপ খননের কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি)। এখন এই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যাবে। সেখানকার অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে ভোলায় কাজ শুরু করতে পারবে গ্যাজপ্রম। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ভোলায় দুটি অনুসন্ধান ও একটি মূল্যায়নসহ উন্নয়ন (এপ্রেইজাল কাম ডেভেলপমেন্ট), এই তিনটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রমকে দেয়া হচ্ছে ৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি কূপ খননে ব্যয় হচ্ছে ২১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন বা ২ কোটি ১০ লাখ ডলারেরও বেশি। এর আগে বাংলাদেশে কোন গ্যাসকূপ খননে এত ব্যয় হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় গ্যাজপ্রমকে এ কাজ দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীনে তিনটি ব্লকে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত আমেরিকান কোম্পানি শেভরনের প্রতিটি কূপ খননে গড় ব্যয় ১৭ মিলিয়ন ডলারের মত। গ্যাজপ্রমের আগে একাধিক চুক্তির আওতায় মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। এরমধ্যে প্রথম ১০টির চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ১৯৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রতিটি কূপের চুক্তিমূল্য ছিল ১৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এরপর সর্বশেষ যে কূপগুলো গ্যাজপ্রম খনন করেছে তার প্রতিটির চুক্তিমূল্য ছিল ১৬ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম এ বিষয়ে গতকাল বিকেলে সংবাদকে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এই কূপগুলো খননে সম্পূর্ণ সক্ষম। এই অবস্থায় বেশি দামে এই কাজ অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যৌক্তিক নয়। তিনি বলেন, গ্যাজপ্রমের সহযোগিতা আমাদের দরকার সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানে, গভীর কূপ খননে, চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে। বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভোলায় বাপেক্সকে কাজ না দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার উদ্যোগে আমি হতাশ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সংবাদকে বলেন, এখানে গ্যাজপ্রমের প্রস্তাব ছিল ৬৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি। গত বছর মে মাসে গ্যাজপ্রম এ প্রস্তাব দিয়েছিল। গত বছর নভেম্বরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের মেয়াদে গঠিত টেকনিক্যাল সাব কমিটি ডিসেম্বরে ‘গ্যাজপ্রমের টেকনিক্যাল প্রপোজাল অ্যান্ড কমার্শিয়াল প্রপোজাল’ মূল্যায়ন করে পিপিসি বরারব প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই কর্মকর্তা বলেন, পিপিসি’র সভায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানও গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভোলায় কূপগুলোর প্রেসার বেশি হওয়ায় গ্যাস আহরণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে গ্যাজপ্রমের ১৭ কূপ খননের পূর্ব অভিজ্ঞাতা কাজে লাগিয়ে ভোলার ৩টি কূপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস আহরণের আশা করা যায়।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বর্তমান সিনিয়র সচিব এবং পিপিসি’র সভাপতি মো. আনিছুর রহমান এ বছর ৫ জানুয়ারি সচিব হিসেবে এ বিভাগের দায়িত্বে নিয়েই গ্যাজপ্রমের দরপ্রস্তাব কামনোর লক্ষ্যে ‘নেগোসিয়েশনের’ সিদ্ধান্ত নেন। জুনে করোনাকালীন সময় ভাচুয়াল গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সর্বশেষ নেগোসিয়েশনের পর টেকনিক্যাল সাব কমিটি গত ২৯ জুলাই পিপিসি’র আহ্বায়ক এবং জালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কারিগরি কমিটি গ্যাজপ্রমের সঙ্গে দেন-দরবার করে দেড় মিলিয়ন ডলার কমাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির (পিপিসি) সভায় সদস্যদের সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান তাতে সম্মতি দেন। মন্ত্রণায়ের সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তার মতে, ভোলায় তিনটি কূপ খননে যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আগে বিভিন্ন স্থানে কূপ খননের তুলনায় ২০ কোটি টাকার মত বেশি। তবে বেশি ব্যয়ের কারণ হচ্ছে, ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেসার) বেশি। সেখানে ৪৫০০ থেকে ৫০০০ পিএসআই থাকায় কূপ খনন করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, এই কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে ড্রিলিং কন্ট্রাক্টরসহ ৬টি ইঞ্জিনিয়ারিং সেবা (ডিএসটি, সিমেন্টিং, মাড লগিং, ওয়ারলাইন লগিং, টেস্টিং অ্যান্ড কমপ্লিশন) বিভিন্ন স্থান হতে সংগ্রহ করতে হবে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় মালামাল ও জনবল আনা- নেয়ার ব্যয়ও বাড়বে। তাই ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। গ্যাজপ্রমের একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ সরকার গ্যাস খাতের উন্নয়নে নির্ভরযোগ্য ও মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্যাজপ্রমকে পছন্দের তালিকায় রেখেছে। কারণ এ খাতে গ্যাসপ্রম আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য বর্তমান ৩টি কূপ খননের যে প্রস্তাব সারসংক্ষেপ আকারে পাঠায় তার ৫নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় যে, গ্যাজপ্রম ‘হ্রাসকৃত মূল্যে’ এই তিনটি কূপ খনন করবে। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু এখন ৩টি কূপের যে চুক্তিমূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে তা গ্যজপ্রমের আগে খনন করা কূপের দরের চেয়ে বেশি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, গ্যাজপ্রম গত বছরের ২৫ মে ভোলার ওই তিনটি (টবগি-১, ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খননের জন্য ৬৫ দশমিক ০৮৫২১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দর প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কারিগরি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এই উপ-কমিটি কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি শেষে ৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন ডলার দর চূড়ান্ত করে তা পিপিসির কাছে উপস্থাপন করে। গত ২৭ আগস্ট জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পিপিসির সভায় এই দাম সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়।
বাপেক্সের সূত্রে জানা গেছে, ভোলা একটি আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এটি আবিষ্কার করেছে। সেখানে একাধিক কূপও খনন করেছে বাপেক্স। গ্যাজপ্রমকে এখন যে তিনটি কূপ খননের কাজ দেয়া হচ্ছে সেগুলোও বাপেক্সের দেয়া ভূতাত্ত্বিক কারিগরি নির্দেশনা (জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডার বা জিটিও) অনুসরণ করে, বাপেক্সের নির্ধারণ করে দেয়া স্থানেই (লোকেশন) গ্যাজপ্রম খনন করবে।
বাপেক্সের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ভোলায় দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করায় কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যই বাপেক্সের কাছে আছে। কূপ খননের জন্য রিগসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবলও বাপেক্সের আছে। এর একেকটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের ব্যয় হবে (রিগ ভাড়া, জনবলের পিছনে ব্যয়, থার্ড পার্টির সেবাসমূহের ব্যয় প্রভৃতিসহ) ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বসিয়ে রেখে বিদেশিদের কাজ দেয়ায় বাপেক্সের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন অনুযায়ী, প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি) পরিকল্পনাটির প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রস্তাব প্রণয়ন এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের পর্যায় না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কতৃক প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগ পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
তবে অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রস্তাবটি সুপারিশসহ ফেরত পাঠালে, তা প্রক্রিয়াকরণ কমিটিতে উপস্থাপন করতে হবে এবং এবং মন্ত্রিসভা কমিটির নির্দেশনা বিবেচনাক্রমে প্রক্রিয়াকরণ কমিটি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণক্রমে তা মন্ত্রিসভা কমিটির পুনঃবিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করিবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাজপ্রমের কাজ পাওয়ার বিষয়টি এখন উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৬ মহররম ১৪৪২, ২৮ ভাদ্র ১৪২৭
অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া হয়
ফয়েজ আহমেদ তুষার
রাষ্ট্রীয় বাপেক্সের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রুশ প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমকে ভোলায় উচ্চমূল্যে ৩টি গ্যাসকূপ খননের কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি)। এখন এই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যাবে। সেখানকার অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে ভোলায় কাজ শুরু করতে পারবে গ্যাজপ্রম। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ভোলায় দুটি অনুসন্ধান ও একটি মূল্যায়নসহ উন্নয়ন (এপ্রেইজাল কাম ডেভেলপমেন্ট), এই তিনটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রমকে দেয়া হচ্ছে ৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি কূপ খননে ব্যয় হচ্ছে ২১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন বা ২ কোটি ১০ লাখ ডলারেরও বেশি। এর আগে বাংলাদেশে কোন গ্যাসকূপ খননে এত ব্যয় হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় গ্যাজপ্রমকে এ কাজ দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীনে তিনটি ব্লকে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত আমেরিকান কোম্পানি শেভরনের প্রতিটি কূপ খননে গড় ব্যয় ১৭ মিলিয়ন ডলারের মত। গ্যাজপ্রমের আগে একাধিক চুক্তির আওতায় মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। এরমধ্যে প্রথম ১০টির চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ১৯৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রতিটি কূপের চুক্তিমূল্য ছিল ১৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এরপর সর্বশেষ যে কূপগুলো গ্যাজপ্রম খনন করেছে তার প্রতিটির চুক্তিমূল্য ছিল ১৬ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম এ বিষয়ে গতকাল বিকেলে সংবাদকে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এই কূপগুলো খননে সম্পূর্ণ সক্ষম। এই অবস্থায় বেশি দামে এই কাজ অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যৌক্তিক নয়। তিনি বলেন, গ্যাজপ্রমের সহযোগিতা আমাদের দরকার সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানে, গভীর কূপ খননে, চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে। বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভোলায় বাপেক্সকে কাজ না দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার উদ্যোগে আমি হতাশ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সংবাদকে বলেন, এখানে গ্যাজপ্রমের প্রস্তাব ছিল ৬৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি। গত বছর মে মাসে গ্যাজপ্রম এ প্রস্তাব দিয়েছিল। গত বছর নভেম্বরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের মেয়াদে গঠিত টেকনিক্যাল সাব কমিটি ডিসেম্বরে ‘গ্যাজপ্রমের টেকনিক্যাল প্রপোজাল অ্যান্ড কমার্শিয়াল প্রপোজাল’ মূল্যায়ন করে পিপিসি বরারব প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই কর্মকর্তা বলেন, পিপিসি’র সভায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানও গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভোলায় কূপগুলোর প্রেসার বেশি হওয়ায় গ্যাস আহরণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে গ্যাজপ্রমের ১৭ কূপ খননের পূর্ব অভিজ্ঞাতা কাজে লাগিয়ে ভোলার ৩টি কূপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস আহরণের আশা করা যায়।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বর্তমান সিনিয়র সচিব এবং পিপিসি’র সভাপতি মো. আনিছুর রহমান এ বছর ৫ জানুয়ারি সচিব হিসেবে এ বিভাগের দায়িত্বে নিয়েই গ্যাজপ্রমের দরপ্রস্তাব কামনোর লক্ষ্যে ‘নেগোসিয়েশনের’ সিদ্ধান্ত নেন। জুনে করোনাকালীন সময় ভাচুয়াল গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সর্বশেষ নেগোসিয়েশনের পর টেকনিক্যাল সাব কমিটি গত ২৯ জুলাই পিপিসি’র আহ্বায়ক এবং জালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কারিগরি কমিটি গ্যাজপ্রমের সঙ্গে দেন-দরবার করে দেড় মিলিয়ন ডলার কমাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির (পিপিসি) সভায় সদস্যদের সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান তাতে সম্মতি দেন। মন্ত্রণায়ের সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তার মতে, ভোলায় তিনটি কূপ খননে যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আগে বিভিন্ন স্থানে কূপ খননের তুলনায় ২০ কোটি টাকার মত বেশি। তবে বেশি ব্যয়ের কারণ হচ্ছে, ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেসার) বেশি। সেখানে ৪৫০০ থেকে ৫০০০ পিএসআই থাকায় কূপ খনন করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, এই কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে ড্রিলিং কন্ট্রাক্টরসহ ৬টি ইঞ্জিনিয়ারিং সেবা (ডিএসটি, সিমেন্টিং, মাড লগিং, ওয়ারলাইন লগিং, টেস্টিং অ্যান্ড কমপ্লিশন) বিভিন্ন স্থান হতে সংগ্রহ করতে হবে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় মালামাল ও জনবল আনা- নেয়ার ব্যয়ও বাড়বে। তাই ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। গ্যাজপ্রমের একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ সরকার গ্যাস খাতের উন্নয়নে নির্ভরযোগ্য ও মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্যাজপ্রমকে পছন্দের তালিকায় রেখেছে। কারণ এ খাতে গ্যাসপ্রম আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য বর্তমান ৩টি কূপ খননের যে প্রস্তাব সারসংক্ষেপ আকারে পাঠায় তার ৫নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় যে, গ্যাজপ্রম ‘হ্রাসকৃত মূল্যে’ এই তিনটি কূপ খনন করবে। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু এখন ৩টি কূপের যে চুক্তিমূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে তা গ্যজপ্রমের আগে খনন করা কূপের দরের চেয়ে বেশি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, গ্যাজপ্রম গত বছরের ২৫ মে ভোলার ওই তিনটি (টবগি-১, ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খননের জন্য ৬৫ দশমিক ০৮৫২১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দর প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কারিগরি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এই উপ-কমিটি কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি শেষে ৬৩ দশমিক ৫৮৫২১৮ মিলিয়ন ডলার দর চূড়ান্ত করে তা পিপিসির কাছে উপস্থাপন করে। গত ২৭ আগস্ট জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পিপিসির সভায় এই দাম সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়।
বাপেক্সের সূত্রে জানা গেছে, ভোলা একটি আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এটি আবিষ্কার করেছে। সেখানে একাধিক কূপও খনন করেছে বাপেক্স। গ্যাজপ্রমকে এখন যে তিনটি কূপ খননের কাজ দেয়া হচ্ছে সেগুলোও বাপেক্সের দেয়া ভূতাত্ত্বিক কারিগরি নির্দেশনা (জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডার বা জিটিও) অনুসরণ করে, বাপেক্সের নির্ধারণ করে দেয়া স্থানেই (লোকেশন) গ্যাজপ্রম খনন করবে।
বাপেক্সের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ভোলায় দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করায় কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যই বাপেক্সের কাছে আছে। কূপ খননের জন্য রিগসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবলও বাপেক্সের আছে। এর একেকটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের ব্যয় হবে (রিগ ভাড়া, জনবলের পিছনে ব্যয়, থার্ড পার্টির সেবাসমূহের ব্যয় প্রভৃতিসহ) ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বসিয়ে রেখে বিদেশিদের কাজ দেয়ায় বাপেক্সের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন অনুযায়ী, প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি) পরিকল্পনাটির প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রস্তাব প্রণয়ন এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের পর্যায় না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কতৃক প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগ পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
তবে অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রস্তাবটি সুপারিশসহ ফেরত পাঠালে, তা প্রক্রিয়াকরণ কমিটিতে উপস্থাপন করতে হবে এবং এবং মন্ত্রিসভা কমিটির নির্দেশনা বিবেচনাক্রমে প্রক্রিয়াকরণ কমিটি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণক্রমে তা মন্ত্রিসভা কমিটির পুনঃবিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করিবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাজপ্রমের কাজ পাওয়ার বিষয়টি এখন উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।