প্রমাণের আগে অপরাধীও ‘অপরাধী’ নয়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়শই দেখা যায় অমুক-তমুকের ফাঁসি চান নেটিজেনরা। ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ হলে তো বিচার দূরে থাক, পারলে তারাই ক্রসফায়ার দিয়ে বসেন। বছরখানেক আগে তাই কথিত হারকিউলিসের উত্থান হাসি ফুটিয়েছিল এমন অনেক মানুষের মুখেই। কিন্তু ‘Every person is innocent before proving him or her guilty’ বা ‘প্রত্যেকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’- আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিষ্ঠিত এই প্রিন্সিপালটিকে থোড়াই কেয়ার করছেন তারা।

এমনকি প্রায়শ দেখা যায়, বিভিন্ন ঘটনায় বিশেষত ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে গণমাধ্যমগুলোও অভিযুক্তকে ঢালাওভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। একটি জাতীয় দৈনিকে ২০১৬ সালে ‘সংস্কারের সুপারিশ করেছেন জেলা জজরা, নারী নির্যাতন মামলার ‘অধিকাংশই মিথা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ‘দেশের ৭২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অথচ এসব ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এগুলোর ‘অধিকাংশই মিথ্যা মামলা’। এর ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ। এসব মামলা তাই আপসে নিষ্পত্তির জন্য আদালত থেকে সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের কাছে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন বিচারকেরা।

ওই সংবাদে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল মন্তব্য করেন, ‘বিচারকদের এই মূল্যায়ন সঠিক।’ তবে কেন এটা ঘটছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে উপযুক্ত সংশোধনী আনার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। নির্যাতিত নারীর সামনে প্রতিকারের অন্য বিকল্প বন্ধ থাকায় তারা সমস্যায় পড়লে পুলিশ, আত্মীয়স্বজন ও আইনজীবীদের পরামর্শে এ ধরনের মামলা করেন বলে মনে করেন তিনি। ওই সংবাদটিতে বিচারকদের বরাত দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার ১০ দফা প্রাথমিক প্রতিবেদনের প্রথম সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয় মিথ্যা মামলাকে।

এছাড়াও ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের (২০১৩ সালে আনীত সংশোধনী) ধারা ৯-এ শুধু ধর্ষণের শাস্তির কথাই উল্লেখ করা হয়নি, বরং মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হলে আদালত অভিযোগকারীকে ৭ বছর কারাদ- এবং অর্থদ- দিতে পারবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। অনেক সময় অভিযোগ যে মিথ্যা হতে পারে সেজন্যই রাখা হয়েছে এই সুযোগ। অথচ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে অনেকেই তাকে অপরাধী ঘোষণা দিয়ে সামাজিক ট্রায়াল শুরু করে দেয়। অভিযোগ যে মিথ্যা হতে পারে, এর পিছনে অন্য কোন ঘটনা থাকতে পারে এমনটি তারা চিন্তাও করতে চান না। একজন ব্যক্তির ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে অস্বীকার করতেও দ্বিধা করেন না তারা।

অপরাধ কমাতে অপরাধীর বিচার সম্পন্ন হওয়া ও সাজা কার্যকর করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কেউই অপরাধী নয়, এটি মেনেই বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে হবে আমাদের। এক ঘটনার আড়ালে অন্য যেকোন ঘটনার সম্ভাব্যতা রয়েছে বলেই বিচার ব্যবস্থার উদ্ভব। নইলে বিচারের প্রয়োজন কী? আমরা দোষীদের যথাযথ শাস্তি চাইতে পারি কিন্তু সবার মানবাধিকার অক্ষুণœ রাখতে হবে।

নবাব আব্দুর রহিম

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৬ মহররম ১৪৪২, ২৮ ভাদ্র ১৪২৭

প্রমাণের আগে অপরাধীও ‘অপরাধী’ নয়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়শই দেখা যায় অমুক-তমুকের ফাঁসি চান নেটিজেনরা। ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ হলে তো বিচার দূরে থাক, পারলে তারাই ক্রসফায়ার দিয়ে বসেন। বছরখানেক আগে তাই কথিত হারকিউলিসের উত্থান হাসি ফুটিয়েছিল এমন অনেক মানুষের মুখেই। কিন্তু ‘Every person is innocent before proving him or her guilty’ বা ‘প্রত্যেকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’- আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিষ্ঠিত এই প্রিন্সিপালটিকে থোড়াই কেয়ার করছেন তারা।

এমনকি প্রায়শ দেখা যায়, বিভিন্ন ঘটনায় বিশেষত ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে গণমাধ্যমগুলোও অভিযুক্তকে ঢালাওভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। একটি জাতীয় দৈনিকে ২০১৬ সালে ‘সংস্কারের সুপারিশ করেছেন জেলা জজরা, নারী নির্যাতন মামলার ‘অধিকাংশই মিথা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ‘দেশের ৭২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অথচ এসব ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এগুলোর ‘অধিকাংশই মিথ্যা মামলা’। এর ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ। এসব মামলা তাই আপসে নিষ্পত্তির জন্য আদালত থেকে সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের কাছে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন বিচারকেরা।

ওই সংবাদে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল মন্তব্য করেন, ‘বিচারকদের এই মূল্যায়ন সঠিক।’ তবে কেন এটা ঘটছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে উপযুক্ত সংশোধনী আনার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। নির্যাতিত নারীর সামনে প্রতিকারের অন্য বিকল্প বন্ধ থাকায় তারা সমস্যায় পড়লে পুলিশ, আত্মীয়স্বজন ও আইনজীবীদের পরামর্শে এ ধরনের মামলা করেন বলে মনে করেন তিনি। ওই সংবাদটিতে বিচারকদের বরাত দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার ১০ দফা প্রাথমিক প্রতিবেদনের প্রথম সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয় মিথ্যা মামলাকে।

এছাড়াও ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের (২০১৩ সালে আনীত সংশোধনী) ধারা ৯-এ শুধু ধর্ষণের শাস্তির কথাই উল্লেখ করা হয়নি, বরং মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হলে আদালত অভিযোগকারীকে ৭ বছর কারাদ- এবং অর্থদ- দিতে পারবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। অনেক সময় অভিযোগ যে মিথ্যা হতে পারে সেজন্যই রাখা হয়েছে এই সুযোগ। অথচ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে অনেকেই তাকে অপরাধী ঘোষণা দিয়ে সামাজিক ট্রায়াল শুরু করে দেয়। অভিযোগ যে মিথ্যা হতে পারে, এর পিছনে অন্য কোন ঘটনা থাকতে পারে এমনটি তারা চিন্তাও করতে চান না। একজন ব্যক্তির ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে অস্বীকার করতেও দ্বিধা করেন না তারা।

অপরাধ কমাতে অপরাধীর বিচার সম্পন্ন হওয়া ও সাজা কার্যকর করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কেউই অপরাধী নয়, এটি মেনেই বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে হবে আমাদের। এক ঘটনার আড়ালে অন্য যেকোন ঘটনার সম্ভাব্যতা রয়েছে বলেই বিচার ব্যবস্থার উদ্ভব। নইলে বিচারের প্রয়োজন কী? আমরা দোষীদের যথাযথ শাস্তি চাইতে পারি কিন্তু সবার মানবাধিকার অক্ষুণœ রাখতে হবে।

নবাব আব্দুর রহিম

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়