আব্রাহাম লিংকন, বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস এবং চার্চিল

মো. কায়ছার আলী

‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসনই গণতন্ত্র। ‘.. that these dead shall not have died in vain—that this nation, under God, shall have a new birth of freedom-and that Government of the people, by the people and for the people shall not perish from the earth.’ পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের সার্বজনীন এই সংজ্ঞা প্রদান করেন। যে মানুষটি গণতন্ত্রের উত্তম সংজ্ঞা প্রদান করলেন দুঃখজনক হলেও সত্য তাকেই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো আততায়ীর গুলিতে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ পুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে প্রধান শিক্ষককে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে যে চিঠিখানা লিখেন তা এক ঐতিহাসিক চিঠি। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অর্থাৎ প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধে পরিশ্রমী ও সাহসী। ছাত্রজীবনে কোন কাগজ পড়ে থাকলেই তা পড়তেন, তখন অন্যরা তাকে ব্যঙ্গ করে বলত ইস! ব্যাটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। তিনি বলতেন, ‘হ্যাঁ হব।’ ২১ বছর বয়সে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত, ২২ বছর বয়সে আইনসভায় পরাজিত, ২৪ বছর বয়সে আবার ব্যবসায় অসফল, ২৬ বছর বয়সে প্রিয়তমার মৃত্যু, ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত, ৪৫ বছর বয়সে সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়, ৪৭ বছর বয়সে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেষ্টায় ব্যর্থ। ৪৯ বছর বয়সে সিনেট নির্বাচনে আবার পরাজয়। ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক গ্রামের স্টেশনে ১১ বছর বয়সী সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী গ্রেস বেডেল বলেছিলেন তুমি দাড়ি রাখলে সুন্দর দেখাবে এবং নির্বাচনে জয়ী হবে। সত্যিই তাই হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ওই স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই আমেরিকার পতাকাতলে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা কি আমার সঙ্গে থাকবে?’ পরে মেয়েটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ইতিহাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে লিংকন তিনজন পরাজিত প্রার্থীকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বানালেন। তার মন্ত্রিপরিষদকে বলা হয় ‘The team of Rivals’ অর্থাৎ বিরোধীদের নিয়ে সংঘ। ১৮৩৭ সালে পেশায় আইনজীবী এক প্রতিপক্ষ কোর্টের মধ্যেই লিংকনকে হেয় করে কটূক্তি ও বাজে মন্তব্য করেছিলেন। সেই স্ট্যানস্টনকেই তিনি যুদ্ধমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। এ রকম leadership বিশ্ববাসী আগে কখনও দেখেনি। অসাধারণ বিস্ময়কর leadership ক্ষমতা ছিল তার। কুখ্যাত দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় আমেরিকায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও তিনি দেশকে বিভক্ত না করে ভৌগলিক অখণ্ডতা বজায় রেখে ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটে।

১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম তিন দিন গেটিসবার্গ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শত্রু সেনাপতি লি ৪ জুলাই রাতে পালাতে শুরু করলে সারা দেশ মেঘে ঢাকা পড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। পটোম্যাক নদী অতিক্রম করা শত্রু পক্ষের জন্য সম্ভব ছিল না। লি ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের আদেশ অমান্য করে যুদ্ধের সেনাপতি সরাসরি আক্রমণের অস্বীকৃতি জানিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। নদীর পানি কমে গেল এবং লি তার সেনাবাহিনী নিয়ে পটোম্যাক নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হলো। মীরজাফরের মতো বেঈমান যুগে যুগে সবখানে থাকে। ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে থিয়েটার হলে পৌঁছলে সমগ্র দর্শকরা তাকে অভিনন্দন জানালেন। সেখানে একজন অভিনেতা আততায়ী ভেতরে ঢুকেই লিংকনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালান। তিনি চেয়ারের উপরেই লুটিয়ে পড়লেন, তখন ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সামনের একটা বাড়িতে। ৯ ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর সকালে তিনি শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যু পথযাত্রী লিংকনের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি অব ওয়ার স্ট্যানস্টন বলেছিলেন, ‘ওই যে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সবার চেয়ে যোগ্য একজন শাসক।’ দৈহিকভাবে মৃত্যু হলেও তার নীতি ও আদর্শ গণতন্ত্র সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে আজ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় সরকার ব্যবস্থা হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Democracy শব্দটি এসেছে Demos এবং Kratos দুটি গ্রিক শব্দ হতে। এ শব্দ দুটি অর্থ যথাক্রমে ‘একটি শহর, অঞ্চল বা রাষ্ট্রের সব মানুষ বা জনগণ’ এবং ‘শাসন বা কর্তৃত্ব’। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। রাষ্ট্রসমূহের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করে মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের উদ্দেশ্য। আধুনিক রাষ্ট্রে অধিক সংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণের শ্রেষ্ঠ উপায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে সহনশীল হতে শেখায় অন্যদিকে পরমত সহিষ্ণুতা ও বহুমতকে ধারণ করতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অনুপ্রেরণা দেয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। জনগণের জন্য, জনগণের মাধ্যমে গঠিত গণতন্ত্র বাকস্বাধীনতাসহ মানুষের সার্বিক বিকাশে সর্বদা কার্যকর। ফলে এটি সর্বত্র, সবসময়, সর্বজন কর্তৃক আনন্দময় ও অর্থবহ বলে বিবেচিত। স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। সত্যিকার মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। মানুষের সার্বজনীন অধিকার মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (IPU) গণতন্ত্রের বিশ্ব ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় গণতন্ত্রের নীতি, গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনার উপাদান ও সরকার পরিচালনায় গণতন্ত্রের প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রসার সুনিশ্চিত করার প্রত্যয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা ব্যক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন সি একুইনো গণতন্ত্র নবায়ন ও পুনরুদ্ধারের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের সূচনা ঘটান। প্রাথমিকভাবে সরকার, সংসদ সদস্য ও সিভিল সোসাইটি সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তঃসরকারি ফোরাম গঠন করা হয়। ২০০৬ সালে ICNRD-6 এর সম্মেলন দোহায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে গণতন্ত্রের নীতি ও মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের আলোকে কাতার আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস প্রতিষ্ঠিত জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। IPU-এর সঙ্গে আলোচনাক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ৮ নভেম্বর গৃহীত এ/৬২/৭ নং রেজুলেশনের অনুবলে প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সাধারণ অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত সরকার। এর অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর মতামত ও স্বার্থকে উপেক্ষা করবে বরং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কতখানি গণতান্ত্রিক সেটা জানার মানদণ্ড নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু দল বা ব্যক্তির মতামত ও স্বার্থ কতখানি রক্ষিত হচ্ছে তার ওপর। গণতন্ত্র সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে প্রচলিত হয়। মধ্য যুগে ধর্ম ও রাজার দ্বৈত শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘকাল পরে ইউরোপে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৯ ও ২০ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারা উৎস হিসেবে ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা হয়, যা হোকÑবর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ এতই সাফল্য লাভ করেছে যে, আধুনিক সভ্যতা গণতান্ত্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের নির্বাচনে উইন্সটন চার্চিল পরাজিত হলেন। অথচ তার নেতৃত্ব, মেধা আর অসীম সাহসের জন্যই সেদিন মিত্রশক্তির বিজয় ঘটেছিল। নির্বাচনে পরাজয়ের পর মি. চার্চিল অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কিন্তু জনগণের রায় মেনে নিয়েছিলেন। এমনি অবস্থায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার তাকে আমেরিকা সফরের জন্য চিঠি লিখলেন। চিঠি পেয়ে চার্চিল খুশি হয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমেরিকায় যান। চার্চিল বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার মানুষ এবং সাংবাদিক এসেছিলেন তাকে দেখতে এবং তার সাক্ষাৎকার নিতে। তারা তাকে কাছে পেয়ে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করা শুরু করলেন, আপনি ব্রিটেনের জন্য এতকিছু করলেন আর ব্রিটেনের মানুষ নির্বাচনে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করল কেন? কেউবা বললেন, নির্বাচনে পরাজয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? ইত্যাদি, ইত্যাদি চার্চিল অনেকক্ষণ সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো শুনলেন। কিন্তু কারও প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। পরিশেষে বললেন, সাংবাদিক বন্ধুরা আমি আমার পুরোনো বন্ধুর কাছে ব্যক্তিগত সফরে বেড়াতে এসেছি। এ অবস্থায় আমার দেশ বা দেশের মানুষের সম্পর্কে আমি কোন কথা বলব না। তাতে আমার দেশের অসম্মান হবে। আমার দেশের মানুষ আমার প্রতি অবিচার করেছে বলে মনে হলেও দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনকে গড়ার জন্য যা করার দরকার তাই করব। জনগণের সিদ্ধান্ত আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েছি, এটাই গণতন্ত্রের রায়। আবার যদি কোন দিন ডাক আসে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু দেশ সম্পর্কে, দেশের মানুষের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে পারব না। প্লিজ, ক্ষমা করবেন। সবাই স্তম্ভিত হলেন। চার্চিলের দেশপ্রেম গণতন্ত্রের জন্য শ্রদ্ধা ও জাতির প্রতি তার আনুগত্যের কথা ভেবে সেদিন সব সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী মুগ্ধ হয়েছিলেন।

পরিশেষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে মনে করি গণতন্ত্রই হলো সর্বজননন্দিত প্রকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা এর শ্রেষ্ঠত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধে এবং কাম্য শাসন ব্যবস্থা। যদিও একজন মহানুভব প্রেসিডেন্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং আরেকজন মহান ও উদার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু তার পরে ও তারা গণতন্ত্রের পতাকাই ধরে রেখেছেন। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।

[লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]

০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪ kaisardinajpur@yahoo.com

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৬ মহররম ১৪৪২, ২৮ ভাদ্র ১৪২৭

আব্রাহাম লিংকন, বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস এবং চার্চিল

মো. কায়ছার আলী

‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসনই গণতন্ত্র। ‘.. that these dead shall not have died in vain—that this nation, under God, shall have a new birth of freedom-and that Government of the people, by the people and for the people shall not perish from the earth.’ পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের সার্বজনীন এই সংজ্ঞা প্রদান করেন। যে মানুষটি গণতন্ত্রের উত্তম সংজ্ঞা প্রদান করলেন দুঃখজনক হলেও সত্য তাকেই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো আততায়ীর গুলিতে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ পুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে প্রধান শিক্ষককে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে যে চিঠিখানা লিখেন তা এক ঐতিহাসিক চিঠি। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অর্থাৎ প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধে পরিশ্রমী ও সাহসী। ছাত্রজীবনে কোন কাগজ পড়ে থাকলেই তা পড়তেন, তখন অন্যরা তাকে ব্যঙ্গ করে বলত ইস! ব্যাটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। তিনি বলতেন, ‘হ্যাঁ হব।’ ২১ বছর বয়সে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত, ২২ বছর বয়সে আইনসভায় পরাজিত, ২৪ বছর বয়সে আবার ব্যবসায় অসফল, ২৬ বছর বয়সে প্রিয়তমার মৃত্যু, ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত, ৪৫ বছর বয়সে সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়, ৪৭ বছর বয়সে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেষ্টায় ব্যর্থ। ৪৯ বছর বয়সে সিনেট নির্বাচনে আবার পরাজয়। ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক গ্রামের স্টেশনে ১১ বছর বয়সী সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী গ্রেস বেডেল বলেছিলেন তুমি দাড়ি রাখলে সুন্দর দেখাবে এবং নির্বাচনে জয়ী হবে। সত্যিই তাই হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ওই স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই আমেরিকার পতাকাতলে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা কি আমার সঙ্গে থাকবে?’ পরে মেয়েটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ইতিহাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে লিংকন তিনজন পরাজিত প্রার্থীকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বানালেন। তার মন্ত্রিপরিষদকে বলা হয় ‘The team of Rivals’ অর্থাৎ বিরোধীদের নিয়ে সংঘ। ১৮৩৭ সালে পেশায় আইনজীবী এক প্রতিপক্ষ কোর্টের মধ্যেই লিংকনকে হেয় করে কটূক্তি ও বাজে মন্তব্য করেছিলেন। সেই স্ট্যানস্টনকেই তিনি যুদ্ধমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। এ রকম leadership বিশ্ববাসী আগে কখনও দেখেনি। অসাধারণ বিস্ময়কর leadership ক্ষমতা ছিল তার। কুখ্যাত দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় আমেরিকায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও তিনি দেশকে বিভক্ত না করে ভৌগলিক অখণ্ডতা বজায় রেখে ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটে।

১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম তিন দিন গেটিসবার্গ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শত্রু সেনাপতি লি ৪ জুলাই রাতে পালাতে শুরু করলে সারা দেশ মেঘে ঢাকা পড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। পটোম্যাক নদী অতিক্রম করা শত্রু পক্ষের জন্য সম্ভব ছিল না। লি ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের আদেশ অমান্য করে যুদ্ধের সেনাপতি সরাসরি আক্রমণের অস্বীকৃতি জানিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। নদীর পানি কমে গেল এবং লি তার সেনাবাহিনী নিয়ে পটোম্যাক নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হলো। মীরজাফরের মতো বেঈমান যুগে যুগে সবখানে থাকে। ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে থিয়েটার হলে পৌঁছলে সমগ্র দর্শকরা তাকে অভিনন্দন জানালেন। সেখানে একজন অভিনেতা আততায়ী ভেতরে ঢুকেই লিংকনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালান। তিনি চেয়ারের উপরেই লুটিয়ে পড়লেন, তখন ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সামনের একটা বাড়িতে। ৯ ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর সকালে তিনি শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যু পথযাত্রী লিংকনের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি অব ওয়ার স্ট্যানস্টন বলেছিলেন, ‘ওই যে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সবার চেয়ে যোগ্য একজন শাসক।’ দৈহিকভাবে মৃত্যু হলেও তার নীতি ও আদর্শ গণতন্ত্র সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে আজ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় সরকার ব্যবস্থা হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Democracy শব্দটি এসেছে Demos এবং Kratos দুটি গ্রিক শব্দ হতে। এ শব্দ দুটি অর্থ যথাক্রমে ‘একটি শহর, অঞ্চল বা রাষ্ট্রের সব মানুষ বা জনগণ’ এবং ‘শাসন বা কর্তৃত্ব’। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। রাষ্ট্রসমূহের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করে মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের উদ্দেশ্য। আধুনিক রাষ্ট্রে অধিক সংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণের শ্রেষ্ঠ উপায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে সহনশীল হতে শেখায় অন্যদিকে পরমত সহিষ্ণুতা ও বহুমতকে ধারণ করতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অনুপ্রেরণা দেয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। জনগণের জন্য, জনগণের মাধ্যমে গঠিত গণতন্ত্র বাকস্বাধীনতাসহ মানুষের সার্বিক বিকাশে সর্বদা কার্যকর। ফলে এটি সর্বত্র, সবসময়, সর্বজন কর্তৃক আনন্দময় ও অর্থবহ বলে বিবেচিত। স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। সত্যিকার মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। মানুষের সার্বজনীন অধিকার মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (IPU) গণতন্ত্রের বিশ্ব ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় গণতন্ত্রের নীতি, গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনার উপাদান ও সরকার পরিচালনায় গণতন্ত্রের প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রসার সুনিশ্চিত করার প্রত্যয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা ব্যক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন সি একুইনো গণতন্ত্র নবায়ন ও পুনরুদ্ধারের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের সূচনা ঘটান। প্রাথমিকভাবে সরকার, সংসদ সদস্য ও সিভিল সোসাইটি সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তঃসরকারি ফোরাম গঠন করা হয়। ২০০৬ সালে ICNRD-6 এর সম্মেলন দোহায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে গণতন্ত্রের নীতি ও মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের আলোকে কাতার আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস প্রতিষ্ঠিত জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। IPU-এর সঙ্গে আলোচনাক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ৮ নভেম্বর গৃহীত এ/৬২/৭ নং রেজুলেশনের অনুবলে প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সাধারণ অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত সরকার। এর অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর মতামত ও স্বার্থকে উপেক্ষা করবে বরং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কতখানি গণতান্ত্রিক সেটা জানার মানদণ্ড নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু দল বা ব্যক্তির মতামত ও স্বার্থ কতখানি রক্ষিত হচ্ছে তার ওপর। গণতন্ত্র সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে প্রচলিত হয়। মধ্য যুগে ধর্ম ও রাজার দ্বৈত শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘকাল পরে ইউরোপে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৯ ও ২০ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারা উৎস হিসেবে ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা হয়, যা হোকÑবর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ এতই সাফল্য লাভ করেছে যে, আধুনিক সভ্যতা গণতান্ত্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের নির্বাচনে উইন্সটন চার্চিল পরাজিত হলেন। অথচ তার নেতৃত্ব, মেধা আর অসীম সাহসের জন্যই সেদিন মিত্রশক্তির বিজয় ঘটেছিল। নির্বাচনে পরাজয়ের পর মি. চার্চিল অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কিন্তু জনগণের রায় মেনে নিয়েছিলেন। এমনি অবস্থায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার তাকে আমেরিকা সফরের জন্য চিঠি লিখলেন। চিঠি পেয়ে চার্চিল খুশি হয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমেরিকায় যান। চার্চিল বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার মানুষ এবং সাংবাদিক এসেছিলেন তাকে দেখতে এবং তার সাক্ষাৎকার নিতে। তারা তাকে কাছে পেয়ে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করা শুরু করলেন, আপনি ব্রিটেনের জন্য এতকিছু করলেন আর ব্রিটেনের মানুষ নির্বাচনে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করল কেন? কেউবা বললেন, নির্বাচনে পরাজয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? ইত্যাদি, ইত্যাদি চার্চিল অনেকক্ষণ সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো শুনলেন। কিন্তু কারও প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। পরিশেষে বললেন, সাংবাদিক বন্ধুরা আমি আমার পুরোনো বন্ধুর কাছে ব্যক্তিগত সফরে বেড়াতে এসেছি। এ অবস্থায় আমার দেশ বা দেশের মানুষের সম্পর্কে আমি কোন কথা বলব না। তাতে আমার দেশের অসম্মান হবে। আমার দেশের মানুষ আমার প্রতি অবিচার করেছে বলে মনে হলেও দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনকে গড়ার জন্য যা করার দরকার তাই করব। জনগণের সিদ্ধান্ত আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েছি, এটাই গণতন্ত্রের রায়। আবার যদি কোন দিন ডাক আসে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু দেশ সম্পর্কে, দেশের মানুষের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে পারব না। প্লিজ, ক্ষমা করবেন। সবাই স্তম্ভিত হলেন। চার্চিলের দেশপ্রেম গণতন্ত্রের জন্য শ্রদ্ধা ও জাতির প্রতি তার আনুগত্যের কথা ভেবে সেদিন সব সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী মুগ্ধ হয়েছিলেন।

পরিশেষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে মনে করি গণতন্ত্রই হলো সর্বজননন্দিত প্রকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা এর শ্রেষ্ঠত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধে এবং কাম্য শাসন ব্যবস্থা। যদিও একজন মহানুভব প্রেসিডেন্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং আরেকজন মহান ও উদার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু তার পরে ও তারা গণতন্ত্রের পতাকাই ধরে রেখেছেন। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।

[লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]

০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪ kaisardinajpur@yahoo.com