চিঠিপত্র : অসুর শক্তির বিনাশের প্রার্থনা হোক মহালয়ায়

অসুর শক্তির বিনাশের প্রার্থনা হোক মহালয়ায়

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার

সনাতন ধর্মের মানুষ মূর্তি পূজা করে না , তারা মূর্র্তিতে ভগবানের পূজা করেন। মূর্তিভাব দূর করে ভগ্বদ্ভাবে পূজা করেন। গীতায় ভগবান বলেছেন, ‘ভক্তরা ভক্তিপূর্বক আমাকে নমষ্কার করে আমার পূজা করেন (৯/১৪),’ ‘যে ভক্ত শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ পূর্বক পত্র-পুষ্প, ফল-জল ইত্যাদি আমাকে অর্পণ করেন , তাদের দেয়া উপহার আমি ভক্ষণ করে থাকি’ (৯/২৬)। সাকার উপাসনায় মূর্তি স্থাপন করে ভগবানের আরাধনা করা হয়ে থাকে। আর এক্ষেত্রে অনেকেই বিভ্রান্ত হন যে, মাটির মূর্তিতে ভগবান থাকে কিভাবে? ভগবান শব্দটিই অদৃশ্য শক্তি যে শক্তি ভক্ত লাভ করে থাকে ভক্তির মাধ্যমে। আর এই ভক্তি স্থাপনের লক্ষেই মাটির মূর্তি স্থাপন করে ভগবানের কল্পিপ রূপ অন্তরে স্থাপন করা হয়ে থাকে। মূলত অর্থে ধর্মীয় বিধিবিধানের ক্ষেত্রে বিশ্বাস স্থাপনই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আর এই মূর্তি পূজায় সবচেয়ে বড় আয়োজন হয়ে থাকে সনাতন ধর্মালম্বীদের দুর্গা পূজায়। যা এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। একসময় জমিদার শ্রেণীর লোকজন এ পূজার আয়োজন করলেও বর্তমানে বারোয়ারি আকারেই সম্পন্ন হচ্ছে বেশির ভাগ মন্দির স্থাপন। বর্ষা ঋতুর শেষে শরতের আগমনে প্রকৃতি যখন নতুর রূপে শোভিত হয় তখনই ধরাধামে মা দুর্গার আগমন ঘটে। তাই সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে অতীতের ন্যায় এবারও শুরু হয়েছে মা দুর্গার আগমনের প্রহর গণনা। কখন আসবে মা দুর্গা। দুর্গার আগমনে তাই ঘরে ঘরে বইছে আনন্দের ঢেউ। মহাশক্তি মহামায়াকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা। তিনি বারবার প্রলয়কালে হাজির হয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেছেন। রক্ষা করেছেন সৃষ্টি কূলকে। বিনাশ করেছেন অসুরদের। তিনি কখনও মহাশক্তি কখনও মহামায়া আবার কখনও মহালক্ষী হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন ধরাধামে। তিনি যেমন মায়ারূপ ধারণ করেছেন তেমনি শক্তির আধারও হয়েছেন। তিনি আবার দান করেছেন বরাভয়। তিনি যুদ্ধ আর মৃত্যুর উপত্যকায় আশ্রয় হয়েছেন দেবলোকের। তিনি ভক্তদের দ্বারা পূজিত হন শরৎকালে। কিন্তু তার এ বোধন অকালের। শ্রী রামচন্দ্র রাক্ষস রাজা রাবণ বধের জন্য আকূল হয়ে এই অসময়েই আহ্বান করেছিলেন মা দুর্গার। মূলত দেবতারা ছয় মাস জাগেন আর ছয়মাস ঘুমান। তাদের এই ছয় মাসের নিদ্রা আর ছয়মাস জাগরণের হিসাব রাখেন চন্দ্র আর সূর্য। মাঘ থেকে আষাঢ় তখন উত্তরায়ণ দেবতাদের জাগরণের কাল। শ্রাবণ থেকে পৌষ দক্ষিণায়ন দেবতারা মগ্ন থাকেন নিদ্রায়। এ সময়ই শ্রীরামচন্দ্র দেবতাদের নিদ্রায় যাওয়ার সময় দেবীর নিদ্রা ভঙ্গ করেছিলেন। আকূল হয়ে ডেকেছিলেন মা দুর্গাকে রাবণ বধের জন্য। এইযে দেবীকে স্মরণ করেছিলেন, এই স্মরণ করেই হয় মহালয়া। দেবীর আর্বিভাব ঘোষিত হয় মহালয়ায় এবং দেবী জাগ্রত হন বোধনের দিন। পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবী পক্ষের শুরু এই মাহেন্দ্রক্ষণেই মহালয়া। তিথিগত কারণেই এবার মহালয়া অনেক আগেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মূলত আশ্বিন মাসের আমবস্যাতে মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু এবছর আশ্বিন মাস মল (এক মাসে দু’বার আমবস্যা) মাস হওয়ায় ভাদ্র মাসের শেষ তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহালয়া। তাই মা দুর্গার আগমনী বার্তাও বেজে উঠেছে ধরাধামে। তিনি যেমন ধ্বংস করেছেন তেমনি আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি রূপের মায়ায় অসুরকে মোহিত করেছেন আবার মহাশক্তি দিয়ে তিনি অসুর বিনাশ করেছেন। সেই মোহিনী রূপ ধরা মহালয়াকে কেন্দ্র করেই মাহেন্দ্রক্ষণটি মহালয়া। যদি এক কথায় বলা যায় তাহলে বলা যেতে পারে মূলত মহালয়া হলো মহিষাসুর বধের আহ্বান। সমাজ থেকে অসুর প্রকৃতি ধ্বংস করার জন্যই মহালয়ার দিন দেবীর শক্তির আহ্বান। যারই প্রতিচ্ছবি দশমীতে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ এবং অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবীর বর লাভ করে শ্রী রামচন্দ্রের দশমীতে রাবণ বধ। এবধের মাধ্যমে আমরা যে শিক্ষা পেয়ে থাকি তা থেকে যে শিক্ষা লাভ আমরা করি তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করলে অবশ্যই পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করবে। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস জাগত হতে হবে হৃদয়ে। শিক্ষা নিতে হবে জীবন চলার পথের। মহালয়ার মাধ্যমে যে আসুরিক শক্তির বিনাসের আহ্বান জানানো হয়েছে সেই শক্তির প্রয়োগ হতে হবে সমাজ জীবনে। মানবসভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই এই আসুরিক শক্তির বিনাশের জন্য সনাতন ধর্মের ভক্তবৃন্দরা মা দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছে। তাই আজকের এ মহালয়ার লগ্নে সবারই প্রার্থনা হোক আসুরিক শক্তির বিনাশের। কারণ আসুরিক শক্তির বিনাশ ছাড়া এই ধরাধাম শান্তিযোগ্য হবে না।

লেখক পরিচিতি : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ।

যুগ্ম-সম্পাদক, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব।

আরও খবর

বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৭ মহররম ১৪৪২, ২৯ ভাদ্র ১৪২৭

চিঠিপত্র : অসুর শক্তির বিনাশের প্রার্থনা হোক মহালয়ায়

অসুর শক্তির বিনাশের প্রার্থনা হোক মহালয়ায়

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার

সনাতন ধর্মের মানুষ মূর্তি পূজা করে না , তারা মূর্র্তিতে ভগবানের পূজা করেন। মূর্তিভাব দূর করে ভগ্বদ্ভাবে পূজা করেন। গীতায় ভগবান বলেছেন, ‘ভক্তরা ভক্তিপূর্বক আমাকে নমষ্কার করে আমার পূজা করেন (৯/১৪),’ ‘যে ভক্ত শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ পূর্বক পত্র-পুষ্প, ফল-জল ইত্যাদি আমাকে অর্পণ করেন , তাদের দেয়া উপহার আমি ভক্ষণ করে থাকি’ (৯/২৬)। সাকার উপাসনায় মূর্তি স্থাপন করে ভগবানের আরাধনা করা হয়ে থাকে। আর এক্ষেত্রে অনেকেই বিভ্রান্ত হন যে, মাটির মূর্তিতে ভগবান থাকে কিভাবে? ভগবান শব্দটিই অদৃশ্য শক্তি যে শক্তি ভক্ত লাভ করে থাকে ভক্তির মাধ্যমে। আর এই ভক্তি স্থাপনের লক্ষেই মাটির মূর্তি স্থাপন করে ভগবানের কল্পিপ রূপ অন্তরে স্থাপন করা হয়ে থাকে। মূলত অর্থে ধর্মীয় বিধিবিধানের ক্ষেত্রে বিশ্বাস স্থাপনই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আর এই মূর্তি পূজায় সবচেয়ে বড় আয়োজন হয়ে থাকে সনাতন ধর্মালম্বীদের দুর্গা পূজায়। যা এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। একসময় জমিদার শ্রেণীর লোকজন এ পূজার আয়োজন করলেও বর্তমানে বারোয়ারি আকারেই সম্পন্ন হচ্ছে বেশির ভাগ মন্দির স্থাপন। বর্ষা ঋতুর শেষে শরতের আগমনে প্রকৃতি যখন নতুর রূপে শোভিত হয় তখনই ধরাধামে মা দুর্গার আগমন ঘটে। তাই সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে অতীতের ন্যায় এবারও শুরু হয়েছে মা দুর্গার আগমনের প্রহর গণনা। কখন আসবে মা দুর্গা। দুর্গার আগমনে তাই ঘরে ঘরে বইছে আনন্দের ঢেউ। মহাশক্তি মহামায়াকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা। তিনি বারবার প্রলয়কালে হাজির হয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেছেন। রক্ষা করেছেন সৃষ্টি কূলকে। বিনাশ করেছেন অসুরদের। তিনি কখনও মহাশক্তি কখনও মহামায়া আবার কখনও মহালক্ষী হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন ধরাধামে। তিনি যেমন মায়ারূপ ধারণ করেছেন তেমনি শক্তির আধারও হয়েছেন। তিনি আবার দান করেছেন বরাভয়। তিনি যুদ্ধ আর মৃত্যুর উপত্যকায় আশ্রয় হয়েছেন দেবলোকের। তিনি ভক্তদের দ্বারা পূজিত হন শরৎকালে। কিন্তু তার এ বোধন অকালের। শ্রী রামচন্দ্র রাক্ষস রাজা রাবণ বধের জন্য আকূল হয়ে এই অসময়েই আহ্বান করেছিলেন মা দুর্গার। মূলত দেবতারা ছয় মাস জাগেন আর ছয়মাস ঘুমান। তাদের এই ছয় মাসের নিদ্রা আর ছয়মাস জাগরণের হিসাব রাখেন চন্দ্র আর সূর্য। মাঘ থেকে আষাঢ় তখন উত্তরায়ণ দেবতাদের জাগরণের কাল। শ্রাবণ থেকে পৌষ দক্ষিণায়ন দেবতারা মগ্ন থাকেন নিদ্রায়। এ সময়ই শ্রীরামচন্দ্র দেবতাদের নিদ্রায় যাওয়ার সময় দেবীর নিদ্রা ভঙ্গ করেছিলেন। আকূল হয়ে ডেকেছিলেন মা দুর্গাকে রাবণ বধের জন্য। এইযে দেবীকে স্মরণ করেছিলেন, এই স্মরণ করেই হয় মহালয়া। দেবীর আর্বিভাব ঘোষিত হয় মহালয়ায় এবং দেবী জাগ্রত হন বোধনের দিন। পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবী পক্ষের শুরু এই মাহেন্দ্রক্ষণেই মহালয়া। তিথিগত কারণেই এবার মহালয়া অনেক আগেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মূলত আশ্বিন মাসের আমবস্যাতে মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু এবছর আশ্বিন মাস মল (এক মাসে দু’বার আমবস্যা) মাস হওয়ায় ভাদ্র মাসের শেষ তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহালয়া। তাই মা দুর্গার আগমনী বার্তাও বেজে উঠেছে ধরাধামে। তিনি যেমন ধ্বংস করেছেন তেমনি আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি রূপের মায়ায় অসুরকে মোহিত করেছেন আবার মহাশক্তি দিয়ে তিনি অসুর বিনাশ করেছেন। সেই মোহিনী রূপ ধরা মহালয়াকে কেন্দ্র করেই মাহেন্দ্রক্ষণটি মহালয়া। যদি এক কথায় বলা যায় তাহলে বলা যেতে পারে মূলত মহালয়া হলো মহিষাসুর বধের আহ্বান। সমাজ থেকে অসুর প্রকৃতি ধ্বংস করার জন্যই মহালয়ার দিন দেবীর শক্তির আহ্বান। যারই প্রতিচ্ছবি দশমীতে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ এবং অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবীর বর লাভ করে শ্রী রামচন্দ্রের দশমীতে রাবণ বধ। এবধের মাধ্যমে আমরা যে শিক্ষা পেয়ে থাকি তা থেকে যে শিক্ষা লাভ আমরা করি তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করলে অবশ্যই পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করবে। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস জাগত হতে হবে হৃদয়ে। শিক্ষা নিতে হবে জীবন চলার পথের। মহালয়ার মাধ্যমে যে আসুরিক শক্তির বিনাসের আহ্বান জানানো হয়েছে সেই শক্তির প্রয়োগ হতে হবে সমাজ জীবনে। মানবসভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই এই আসুরিক শক্তির বিনাশের জন্য সনাতন ধর্মের ভক্তবৃন্দরা মা দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছে। তাই আজকের এ মহালয়ার লগ্নে সবারই প্রার্থনা হোক আসুরিক শক্তির বিনাশের। কারণ আসুরিক শক্তির বিনাশ ছাড়া এই ধরাধাম শান্তিযোগ্য হবে না।

লেখক পরিচিতি : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ।

যুগ্ম-সম্পাদক, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব।