মহামারী যুগে যুগে

আবদুল লতিফ

এই তো ক’দিন আগের কথা। কখনও কাজের মাঝে, কখনও অবসরের অলস সময়ে দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে এলো করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, হতাশা, লকডাউন সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর জীবনযাপন। অন্ধকার ভবিষ্যৎ, মরণব্যাধির ভয়, নিঃসঙ্গ জীবন সব মিলিয়ে একদম ভালো নেই। ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে বন্দী থাকা অবস্থায় হাতের কাছে খবরের কাগজ পাই না। মনে হয় যে ছেলেটা আমাদের এখানে খবরের কাগজ দিয়ে যেত, সে শহর ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। একমাত্র সম্বল টেলিভিশন। সেখানে সারা পৃথিবীর বিভীষিকাময় রূপ দেখছি, প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সন্ধ্যা হলে শহরের রাস্তাঘাট জনশূন্য মৃত্যুপুরীর মতো।

টেলিভিশনের পাশাপাশি আছে নানারকম সামাজিক মাধ্যম; ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার ইত্যাদি। সেখানে প্রতিনিয়ত যে সব তথ্যের সমাগম ঘটছে তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন তথ্যে ভরা। কেউ উপদেশ দেয় গরম বাষ্পের নিঃশাস নাও, শতকরা শতভাগ ভাইরাস নিশ্চিহ্ন হবে। সেই সঙ্গে ভুরি ভুরি ভেষজ ওষুধের উপদেশ আসছে যেমন, আদা, কালোজিরা, মধু, লবঙ্গ, তেজপাতা, গরম জলে লেবু, নিমপাতার রস, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছেন দেশের কিছু ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি। তাদের মতে করোনা ব্যাধি পৃথিবীতে এসেছে আল্লাহর অভিশাপ হয়ে। চীন দেশে মুসলিম এক অসহায় নারীর প্রতি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে আল্লাহ সরাসরি সেখানে করোনা নামের এই সূক্ষ্ম অথচ অপরিসীম শক্তিধারী ভাইরাস প্রেরণ করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যেখানে ইসলামের অবমাননা ঘটেছে করোনা সেখানেই হানা দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। স্বপ্নে এই ভাইরাস দেখা দিয়ে মুমিন মুসলমানদের তাদের এই অভিযানের বিবৃতি দিয়েছে। ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি সরাসরি করোনাভাইরাসের ইন্টারভিউ গ্রহণ করে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন। সবচেয়ে আশার বাণী, যা তাদের মুখ থেকে শুনতে পাওয়া গেছে তা হলো এই করোনাভাইরাস নিজে থেকেই তাদের প্রাণভোমরার হদিশ দিয়ে ফেলেছে। এই প্রাণভোমরাকে দেখতে এইরকম: 1.Q7+6=13. দেখলে মনে হয় পঞ্চম শ্রেণীর বীজগণিতের একটি সমাধান অঙ্ক যার উত্তর হলো Q=1. কিন্তু না ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এই সূত্রের মধ্যে রয়ে গেছে করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করার ওষুধ বা টিকা। রহস্যজনক এই সূত্রটির রহস্যভেদ করতে জ্ঞানী ব্যক্তিটি নারাজ। তিনি বলছেন, ‘এই সূত্রটির সম্পর্কে আমরা জানি কিন্তু তা এখন বলা যাবে না।’ কারণ এ দিয়ে তিনি নিজেই করোনার প্রতিষেধক ওষুধটি তৈরি করবেন। তার কাছ থেকে এও জানতে পারা গেছে এই সূত্রটি ইউরোপ আমেরিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছে গেছে। তারা এখন এর মর্মোদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এইভাবে এই সব তথাকথিত ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি ধর্মের অপব্যবহার করে এইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছেন। করোনা সম্পর্কে তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য ও প্রচারণা ভাইরাসটি সম্পর্কে মানুষ ভুল ও মিথ্যা তথ্যই দিয়েছে শুধু অন্য কোন উপকার করতে পারেনি।

সর্বপ্রথম যে খবরটা আমাদের আলোড়িত করেছিল তা হলো চীনারা বাদুড়ের স্যুপ খেয়ে সেখান থেকে এই মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। চীনের উহান অঞ্চলে এই ভাইরাসটির প্রথম দেখা মেলে। সেখানকার একটা পচনশীল মাছ মাংসের বাজার ছিল এই ভাইরাসের উৎস। ভাইরাস পরিবহনকারী হিসাবে বাদুড়কে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে বাদুড় থেকে অন্য পশুপক্ষীর মাংসে এর সংক্রমণ হতে থাকে। তারপর সেই ভাইরাস দ্রুতগতিতে সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। চীন থেকে ইটালি স্পেন এবং ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশে মনুষ্যবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে ফেলে। দলে দলে মানুষ মারা পড়তে থাকে।

এবার আসি সংবাদপত্রের খবরে। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বিস্তার লাভের ব্যাপারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে চলেছে। বাদুড় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই এর উৎপত্তি। ডেইলি মেইল পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি, ইউন্নান থেকে এক হাজার মাইল দূরে একটি গুহায় বাদুড় নিয়ে ওই গবেষণা চালাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র নাকি এজন্য ৩.৭ মিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগ করেছে। আর এখন ওই গুহায় নাকি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিযোগ আছে যে, ল্যাবের বিজ্ঞানীরা ইচ্ছাকৃতভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওদিকে আমেরিকার এফবিআই বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে এক চীনা অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করেছে যিনি নাকি উহানের এক পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাস মারণাস্ত্র হিসেবে উৎপন্ন করেছিলেন। সবই সংবাদপত্রের পাতায় পাওয়া, এর সত্য মিথ্যা আমরা কিছুই জানি না।

২০১৮ সালে আরেকটি গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। এই গবেষণায় বাদুড়ের শরীর থেকে করোনাভাইরাস সংগ্রহ করে শুকরের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। সংক্রামিত শুকরের কাছ থেকে অন্য কোন শুকর সংক্রামিত হয় কিনা তা পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে এই ভাইরাস কিছুদিনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার মহামারী তার থাবা বিস্তার করেছে। তারই একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচের তালিকাটিতে পাওয়া যাবে:

http://print.thesangbad.net/images/2020/September/16Sep20/news/sampadakio.jpg

মহামারী আকারে আজ যে করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে নারী নেতৃত্বের বিরাট সাফল্যের কথা উল্লেখ করতেই হবে। জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং তাইওয়ানের নারী নেতৃত্ব এই ভাইরাস সাফল্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশে এই সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কম।

সারা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তৃতির ফলে জনমনে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক প্রথাসমূহ যেমন করমর্দন, কোলাকুলি সৌহার্দ প্রকাশের চিরাচরিত নিয়মগুলো লুপ্ত হয়েছে। কারন এসব প্রথা করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারন হতে পারে ভেবে আমরা সভয়ে তা পরিত্যাগ করেছি। বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। ৩০ কোটি শিশু আজ বিদ্যালয়ের বাইরে গৃহবন্দী হয়ে আছে। সদাসচল বিমানবন্দর, রেলস্টেশন সবখানেই স্থবিরতা। তীর্থস্থানগুলোতে তীর্থযাত্রী নেই।

আজ সবার মনে যে প্রশ্নটি ঘোরাফেরা করছে, তা হলো কেমন করে জীবজন্তুর শরীর থেকে মানবদেহে এই জীবাণু পরিবাহিত হলো? লাখ লাখ বছর ধরে জীবজন্তুর শরীরে এই জীবাণুর অস্তিত্ব ছিল। কেউ টের পায়নি। তবে আজ এই আধুনিক যুগে কেন জীবের শরীর থেকে মনুষ্য শরীরে তা সংক্রামিত হচ্ছে?

এর উত্তর লুকিয়ে আছে বর্তমান মানবসভ্যতার উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে। আমরা উন্নয়নের নামে আমাদের গ্রহের আবহাওয়া ও পরিবেশগত ডিএনএকে আলোড়িত করেছি, যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে শিল্পোন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের গ্রহের প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের ভারসাম্যের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছি, তারই ফলশ্রুতিতে জীবজগতে যে সব ক্ষতিকর ভাইরাস যুগে যুগে ধারণ করে আছে তা আজ মানবদেহে পরিবাহিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন আর প্রগতির নামে আমরা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতিসাধন করেছি। বনজঙ্গল উজাড় করে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট করে তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছি। জীবজন্তুর স্বাভাবিক বাসস্থান বিনষ্ট হবার ফলে হয় তারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নয়তো তারা মনুষ্য অধ্যুষিত এলাকায় সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে তাদের মধ্যে সুপ্ত জীবাণু মানবশরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

২০০৩ সালে প্রথম পরিলক্ষিত হয় যে, সার্স করনোভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে বিড়ালের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল এবং তারপর দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ওদিকে ২০১২ সালে সৌদি আরবে সংক্রামিত মার্স করনোভাইরাসের উৎপত্তির কারণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এই ভাইরাস উটের কাছ থেকে মানুষের শরীরে স্থান করে নিয়েছিল। একদিকে শিল্পবাণিজ্য এবং গৃহস্থালির কাজে আমরা যত বেশি জন্তুজানোয়ারদের কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি তত বেশি ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে দিনে দিনে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের প্রচলিত প্রোটিন উৎসের বাইরেও অন্য উৎস খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে। চীনের উহান মার্কেট তারই এক দৃষ্টান্ত। Pandemic: Tracking Contagion from Cholera to Ebola and Beyond (2016)-এর লেখক বিজ্ঞান সাংবাদিক সোনিয়া শাহের একটি উদ্ধৃতি:

‘Since 1940, hundreds of microbial pathogens have either emerged or reemerged into new territory where they’ve never been seen before. They include HIV, Ebola in West Africa, Zika in the Americas, and a bevy of novel coronaviruses. The majority of them—60% originate in the bodies of animals. Some come from pets and livestock. Most of them, more than two thirds originate in wildlife’

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টায় বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা করোভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, চীনের উদ্ভাবিত একটি টিকা বাংলাদেশের ৪০০ রোগীর ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। এই পরীক্ষা সফল হলে চীন বাংলাদেশে বিনা মূল্যে ১ লাখ ২০ হাজার টিকা সরবরাহ করবে।

বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা সফল হোক। সারা বিশ্ব করোনার করালগ্রাস থেকে মুক্তি পাক, জগতের সব মানুষ সেই সুদিনের আশায় তাকিয়ে আছে।

তথ্যসূত্র : ১। মহামারীর মহাত্রাস কালে কালে দেশে দেশে: শান্তা মারিয়া ২। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ৩। Who is really responsible for the coronavirus pandemic: Adnan Zillur Morshed ৪। ইউটিউবে প্রচারিত ওয়াজ মাহফিল।

বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৭ মহররম ১৪৪২, ২৯ ভাদ্র ১৪২৭

মহামারী যুগে যুগে

আবদুল লতিফ

এই তো ক’দিন আগের কথা। কখনও কাজের মাঝে, কখনও অবসরের অলস সময়ে দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে এলো করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, হতাশা, লকডাউন সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর জীবনযাপন। অন্ধকার ভবিষ্যৎ, মরণব্যাধির ভয়, নিঃসঙ্গ জীবন সব মিলিয়ে একদম ভালো নেই। ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে বন্দী থাকা অবস্থায় হাতের কাছে খবরের কাগজ পাই না। মনে হয় যে ছেলেটা আমাদের এখানে খবরের কাগজ দিয়ে যেত, সে শহর ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। একমাত্র সম্বল টেলিভিশন। সেখানে সারা পৃথিবীর বিভীষিকাময় রূপ দেখছি, প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সন্ধ্যা হলে শহরের রাস্তাঘাট জনশূন্য মৃত্যুপুরীর মতো।

টেলিভিশনের পাশাপাশি আছে নানারকম সামাজিক মাধ্যম; ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার ইত্যাদি। সেখানে প্রতিনিয়ত যে সব তথ্যের সমাগম ঘটছে তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন তথ্যে ভরা। কেউ উপদেশ দেয় গরম বাষ্পের নিঃশাস নাও, শতকরা শতভাগ ভাইরাস নিশ্চিহ্ন হবে। সেই সঙ্গে ভুরি ভুরি ভেষজ ওষুধের উপদেশ আসছে যেমন, আদা, কালোজিরা, মধু, লবঙ্গ, তেজপাতা, গরম জলে লেবু, নিমপাতার রস, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছেন দেশের কিছু ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি। তাদের মতে করোনা ব্যাধি পৃথিবীতে এসেছে আল্লাহর অভিশাপ হয়ে। চীন দেশে মুসলিম এক অসহায় নারীর প্রতি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে আল্লাহ সরাসরি সেখানে করোনা নামের এই সূক্ষ্ম অথচ অপরিসীম শক্তিধারী ভাইরাস প্রেরণ করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যেখানে ইসলামের অবমাননা ঘটেছে করোনা সেখানেই হানা দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। স্বপ্নে এই ভাইরাস দেখা দিয়ে মুমিন মুসলমানদের তাদের এই অভিযানের বিবৃতি দিয়েছে। ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি সরাসরি করোনাভাইরাসের ইন্টারভিউ গ্রহণ করে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন। সবচেয়ে আশার বাণী, যা তাদের মুখ থেকে শুনতে পাওয়া গেছে তা হলো এই করোনাভাইরাস নিজে থেকেই তাদের প্রাণভোমরার হদিশ দিয়ে ফেলেছে। এই প্রাণভোমরাকে দেখতে এইরকম: 1.Q7+6=13. দেখলে মনে হয় পঞ্চম শ্রেণীর বীজগণিতের একটি সমাধান অঙ্ক যার উত্তর হলো Q=1. কিন্তু না ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এই সূত্রের মধ্যে রয়ে গেছে করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করার ওষুধ বা টিকা। রহস্যজনক এই সূত্রটির রহস্যভেদ করতে জ্ঞানী ব্যক্তিটি নারাজ। তিনি বলছেন, ‘এই সূত্রটির সম্পর্কে আমরা জানি কিন্তু তা এখন বলা যাবে না।’ কারণ এ দিয়ে তিনি নিজেই করোনার প্রতিষেধক ওষুধটি তৈরি করবেন। তার কাছ থেকে এও জানতে পারা গেছে এই সূত্রটি ইউরোপ আমেরিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছে গেছে। তারা এখন এর মর্মোদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এইভাবে এই সব তথাকথিত ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি ধর্মের অপব্যবহার করে এইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছেন। করোনা সম্পর্কে তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য ও প্রচারণা ভাইরাসটি সম্পর্কে মানুষ ভুল ও মিথ্যা তথ্যই দিয়েছে শুধু অন্য কোন উপকার করতে পারেনি।

সর্বপ্রথম যে খবরটা আমাদের আলোড়িত করেছিল তা হলো চীনারা বাদুড়ের স্যুপ খেয়ে সেখান থেকে এই মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। চীনের উহান অঞ্চলে এই ভাইরাসটির প্রথম দেখা মেলে। সেখানকার একটা পচনশীল মাছ মাংসের বাজার ছিল এই ভাইরাসের উৎস। ভাইরাস পরিবহনকারী হিসাবে বাদুড়কে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে বাদুড় থেকে অন্য পশুপক্ষীর মাংসে এর সংক্রমণ হতে থাকে। তারপর সেই ভাইরাস দ্রুতগতিতে সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। চীন থেকে ইটালি স্পেন এবং ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশে মনুষ্যবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে ফেলে। দলে দলে মানুষ মারা পড়তে থাকে।

এবার আসি সংবাদপত্রের খবরে। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বিস্তার লাভের ব্যাপারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে চলেছে। বাদুড় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই এর উৎপত্তি। ডেইলি মেইল পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি, ইউন্নান থেকে এক হাজার মাইল দূরে একটি গুহায় বাদুড় নিয়ে ওই গবেষণা চালাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র নাকি এজন্য ৩.৭ মিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগ করেছে। আর এখন ওই গুহায় নাকি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিযোগ আছে যে, ল্যাবের বিজ্ঞানীরা ইচ্ছাকৃতভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওদিকে আমেরিকার এফবিআই বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে এক চীনা অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করেছে যিনি নাকি উহানের এক পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাস মারণাস্ত্র হিসেবে উৎপন্ন করেছিলেন। সবই সংবাদপত্রের পাতায় পাওয়া, এর সত্য মিথ্যা আমরা কিছুই জানি না।

২০১৮ সালে আরেকটি গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। এই গবেষণায় বাদুড়ের শরীর থেকে করোনাভাইরাস সংগ্রহ করে শুকরের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। সংক্রামিত শুকরের কাছ থেকে অন্য কোন শুকর সংক্রামিত হয় কিনা তা পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে এই ভাইরাস কিছুদিনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার মহামারী তার থাবা বিস্তার করেছে। তারই একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচের তালিকাটিতে পাওয়া যাবে:

http://print.thesangbad.net/images/2020/September/16Sep20/news/sampadakio.jpg

মহামারী আকারে আজ যে করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে নারী নেতৃত্বের বিরাট সাফল্যের কথা উল্লেখ করতেই হবে। জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং তাইওয়ানের নারী নেতৃত্ব এই ভাইরাস সাফল্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশে এই সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কম।

সারা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তৃতির ফলে জনমনে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক প্রথাসমূহ যেমন করমর্দন, কোলাকুলি সৌহার্দ প্রকাশের চিরাচরিত নিয়মগুলো লুপ্ত হয়েছে। কারন এসব প্রথা করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারন হতে পারে ভেবে আমরা সভয়ে তা পরিত্যাগ করেছি। বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। ৩০ কোটি শিশু আজ বিদ্যালয়ের বাইরে গৃহবন্দী হয়ে আছে। সদাসচল বিমানবন্দর, রেলস্টেশন সবখানেই স্থবিরতা। তীর্থস্থানগুলোতে তীর্থযাত্রী নেই।

আজ সবার মনে যে প্রশ্নটি ঘোরাফেরা করছে, তা হলো কেমন করে জীবজন্তুর শরীর থেকে মানবদেহে এই জীবাণু পরিবাহিত হলো? লাখ লাখ বছর ধরে জীবজন্তুর শরীরে এই জীবাণুর অস্তিত্ব ছিল। কেউ টের পায়নি। তবে আজ এই আধুনিক যুগে কেন জীবের শরীর থেকে মনুষ্য শরীরে তা সংক্রামিত হচ্ছে?

এর উত্তর লুকিয়ে আছে বর্তমান মানবসভ্যতার উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে। আমরা উন্নয়নের নামে আমাদের গ্রহের আবহাওয়া ও পরিবেশগত ডিএনএকে আলোড়িত করেছি, যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে শিল্পোন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের গ্রহের প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের ভারসাম্যের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছি, তারই ফলশ্রুতিতে জীবজগতে যে সব ক্ষতিকর ভাইরাস যুগে যুগে ধারণ করে আছে তা আজ মানবদেহে পরিবাহিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন আর প্রগতির নামে আমরা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতিসাধন করেছি। বনজঙ্গল উজাড় করে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট করে তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছি। জীবজন্তুর স্বাভাবিক বাসস্থান বিনষ্ট হবার ফলে হয় তারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নয়তো তারা মনুষ্য অধ্যুষিত এলাকায় সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে তাদের মধ্যে সুপ্ত জীবাণু মানবশরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

২০০৩ সালে প্রথম পরিলক্ষিত হয় যে, সার্স করনোভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে বিড়ালের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল এবং তারপর দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ওদিকে ২০১২ সালে সৌদি আরবে সংক্রামিত মার্স করনোভাইরাসের উৎপত্তির কারণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এই ভাইরাস উটের কাছ থেকে মানুষের শরীরে স্থান করে নিয়েছিল। একদিকে শিল্পবাণিজ্য এবং গৃহস্থালির কাজে আমরা যত বেশি জন্তুজানোয়ারদের কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি তত বেশি ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে দিনে দিনে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের প্রচলিত প্রোটিন উৎসের বাইরেও অন্য উৎস খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে। চীনের উহান মার্কেট তারই এক দৃষ্টান্ত। Pandemic: Tracking Contagion from Cholera to Ebola and Beyond (2016)-এর লেখক বিজ্ঞান সাংবাদিক সোনিয়া শাহের একটি উদ্ধৃতি:

‘Since 1940, hundreds of microbial pathogens have either emerged or reemerged into new territory where they’ve never been seen before. They include HIV, Ebola in West Africa, Zika in the Americas, and a bevy of novel coronaviruses. The majority of them—60% originate in the bodies of animals. Some come from pets and livestock. Most of them, more than two thirds originate in wildlife’

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টায় বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা করোভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, চীনের উদ্ভাবিত একটি টিকা বাংলাদেশের ৪০০ রোগীর ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। এই পরীক্ষা সফল হলে চীন বাংলাদেশে বিনা মূল্যে ১ লাখ ২০ হাজার টিকা সরবরাহ করবে।

বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা সফল হোক। সারা বিশ্ব করোনার করালগ্রাস থেকে মুক্তি পাক, জগতের সব মানুষ সেই সুদিনের আশায় তাকিয়ে আছে।

তথ্যসূত্র : ১। মহামারীর মহাত্রাস কালে কালে দেশে দেশে: শান্তা মারিয়া ২। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ৩। Who is really responsible for the coronavirus pandemic: Adnan Zillur Morshed ৪। ইউটিউবে প্রচারিত ওয়াজ মাহফিল।