মাহাথির মোহাম্মদ যুগের অবসান

শিতাংশু গুহ

এবার কোভিড-১৯’এ বিশ্বে অনেক মানুষ মারা গেছেন। ক্ষমতাসীন নেতাদের মধ্যে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আর করোনায় আক্রান্ত না হয়েও বেঁচে থেকে জীবন্মৃত হয়ে আছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। একদা তিনি ছিলেন হিরো, এখন জিরো। করোনার ঠিক শুরুতে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তিনি পদত্যাগ করেন এবং রাজনৈতিকভাবে নাজেহাল হয়ে বিদায় নেন। তবে প্রথমে হাল ছাড়েননি। চেষ্টা করেছেন কোয়ালিশন করে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে, কিন্তু ১ মার্চ মহিউদ্দিন ইয়াসিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে তিনি ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে যান। এর সঙ্গে সঙ্গে অবসান ঘটে মাহাথির মোহাম্মদ যুগের।

মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৮ সালে ৯২ বয়সে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে হারিয়ে ক্ষমতাসীন হন। দুই বছরের মাথায় তিনি হারিয়ে গেলেন। মাহাথির বলেছেন, তার দলের প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন ইয়াসিন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘতকতা করেছেন। ২০ মে ২০১৮-তে মাহাথির মোহাম্মদ পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হলে লিখেছিলাম, ক্ষমতার লোভ সামলাতে পারলেন না, একেই বলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি। আরও বলেছিলাম, তার বিদায়টি হবে দুঃখজনক। তখন অনেকে আমাকে গালমন্দ দিয়েছেন। বিষয়টি হলো, একজন বৃদ্ধ মানুষ যখন ভাবেন, তিনিই পারেন দেশকে উদ্ধার করতে, তখন তার ভাবনাটি যে ‘ভুল’ তা বলার অবকাশ রাখে না।

এবার এই পরাজয়ের পেছনে তার পুত্রের স্বেচ্ছাচার অনেকাংশে দায়ী। তা-ই হয়! ২০১৮-তে প্রধানমন্ত্রী হবার পর লিখেছিলাম, এই ক্ষমতা সম্ভবত: ‘বিগিনিং অফ অ্যান্ড অফ মাহাথির’। আগে বেশ সুনাম কামিয়েছেন, এবার সব হারানোর পালা। আগে ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তাকে বলা হয়, ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার’। এরপর রাজনীতি থেকে অবসর। ১৫ বছর পর আবার ফিরে আসেন! এলেন, দুর্নীতি কমাবেন বলে? অনেকটা সামরিক শাসকরা যেমন বলে থাকেন? মাহাথির মোহাম্মদ অবশ্য বলেছিলেন, দুই বছর ক্ষমতায় থাকবেন। থাকতে আর পারলেন কই? চলে তো যেতেই হলো! আর গেলেনও তো ঝগড়াঝাটি করে! রাজনীতির দাবার চালে হেরে।

দুই বছর পূর্তির খুব বেশিদিন বাকি ছিল না। তবু যদি বলতেন, ভাই, ক’টা দিন বাকি, তারপর চলে যাচ্ছি। তা তো নয়, পদত্যাগ করেছিলেন, নতুনভাবে কোয়ালিশন করে আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে? সেই খায়েস আর মিটলো না? কথামত দুই বছরের মাথায় ক্ষমতা ছাড়ার কোন লক্ষণ তার মধ্যে ছিল না। রাজনীতিকরা ওরকম বলে থাকেন। দুবছর পরে হয়তো বলতেন যে, তার কথা তো কোরইন-হাদিসের কথা নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না? তাছাড়া জনগণের ভালোবাসা আছে না? ২০১৮-তে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন জনতার দোহাই দিয়ে? এসব কথা উঠতো না যদি তিনি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতেন। আহা, ক্ষমতা বলে কথা! কেউ ছাড়ে না!

২০১৮-তে মাহাথির জিতেছেন বটে, কিন্তু সবটুকু কৃতিত্ব তার একার ছিল না। বরং জেলবন্দী আনোয়ার ইব্রাহীম ও অন্য শরিকরাও এই কৃতিত্বের দাবিদার। এই আনোয়ার ইব্রাহীম এক সময় তারই ‘সেকেন্ড ম্যান’ ছিলেন, পরে রাজনীতির খেলায় তিনি হয়ে গেলেন মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। মাহাথির মোহাম্মদের ইঙ্গিতেই জেলে গিয়েছিলেন, অপরাধ সমকামিতা। মাহাথির শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জিতেছিলেন। জিতে আনোয়ার ইব্রাহীমকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তার উত্তরসূরি বানিয়েছেন। তার পতœী ওয়ান আজিজা ইসমাইল ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পেশায় আজিজা ডাক্তার, এবং ইব্রাহীম জেলবন্দী থাকাকালে তিনিই দল সামলেছেন। মাহাথির যখন প্রথমবার সসম্মানে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, তখন ক্ষমতা দিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ বাদাওয়ী-কে। বাদাওয়ী হারিয়ে গেছেন।

এরপর ক্ষমতায় আসেন মাহাথিরের শিষ্য নাজিব রাজাক। নাজিবকে হারিয়েই ২০১৮-তে মাহাথির আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ২০১৫-তে নাজীবের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মাহাথির বলেছেন, নাজিব চোর, কয়েকশ’ বা কয়েক হাজার ডলার নয়, নাজিব বিলিয়ন ডলার চোর? চোর ধরতেই শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিত্রকে হারিয়ে তিনি ক্ষমতা নিয়েছেন। এর আগে মাহাথির ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১-২০০৩। পেশায় চিকিৎসক। ‘লুক ইস্ট’ পলিসি নিয়ে তিনি মালয়েশিয়াকে অর্থনীতির ‘খুদে টাইগার’-এ পরিণত করেন। সামাজিক মাধ্যমে কিছু লোক বলছেন, মাহাথির নাকি চট্টগ্রামের লোক, মানে তার পূর্ব-পুরুষেরা চট্টগ্রামে ছিলেন?

মাহাথির বিরোধী ঘড়যন্ত্রে জড়িত হয়ে আনোয়ার ইব্রাহীম জেলে যান, তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আনোয়ার ইব্রাহীম সবসময় বলেছেন তাকে রাজনৈতিক কারণে জেলে যেতে হয়েছে। মাহাথির তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। মালয়েশিয়ায় সাধারণ নির্বাচন হয় ৯ মে ২০১৮। ২২২ সিটের পার্লামেন্টে (দেওয়ান রাকায়েত) মাহাথিরের জোট ‘পাকাতান হারাপান’ ১১৩টি আসন পেয়েছিল। সাবাহ হেরিটেজ পার্টি নামে একটি দল ৮টি আসন পায় এবং ‘পাকাতান হারাপান’কে সমর্থন দিলে মাহাথিরের পক্ষে মোট ১২১টি আসন হয় এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হ’ন। মাহাথির ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সরকার প্রধান, ক্ষমতা হারান মাত্র ৯৪ বছর বয়সে।

# guhasb@gmail.com

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, নিউইয়র্ক

বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৭ মহররম ১৪৪২, ২৯ ভাদ্র ১৪২৭

মাহাথির মোহাম্মদ যুগের অবসান

শিতাংশু গুহ

image

এবার কোভিড-১৯’এ বিশ্বে অনেক মানুষ মারা গেছেন। ক্ষমতাসীন নেতাদের মধ্যে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আর করোনায় আক্রান্ত না হয়েও বেঁচে থেকে জীবন্মৃত হয়ে আছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। একদা তিনি ছিলেন হিরো, এখন জিরো। করোনার ঠিক শুরুতে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তিনি পদত্যাগ করেন এবং রাজনৈতিকভাবে নাজেহাল হয়ে বিদায় নেন। তবে প্রথমে হাল ছাড়েননি। চেষ্টা করেছেন কোয়ালিশন করে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে, কিন্তু ১ মার্চ মহিউদ্দিন ইয়াসিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে তিনি ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে যান। এর সঙ্গে সঙ্গে অবসান ঘটে মাহাথির মোহাম্মদ যুগের।

মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৮ সালে ৯২ বয়সে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে হারিয়ে ক্ষমতাসীন হন। দুই বছরের মাথায় তিনি হারিয়ে গেলেন। মাহাথির বলেছেন, তার দলের প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন ইয়াসিন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘতকতা করেছেন। ২০ মে ২০১৮-তে মাহাথির মোহাম্মদ পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হলে লিখেছিলাম, ক্ষমতার লোভ সামলাতে পারলেন না, একেই বলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি। আরও বলেছিলাম, তার বিদায়টি হবে দুঃখজনক। তখন অনেকে আমাকে গালমন্দ দিয়েছেন। বিষয়টি হলো, একজন বৃদ্ধ মানুষ যখন ভাবেন, তিনিই পারেন দেশকে উদ্ধার করতে, তখন তার ভাবনাটি যে ‘ভুল’ তা বলার অবকাশ রাখে না।

এবার এই পরাজয়ের পেছনে তার পুত্রের স্বেচ্ছাচার অনেকাংশে দায়ী। তা-ই হয়! ২০১৮-তে প্রধানমন্ত্রী হবার পর লিখেছিলাম, এই ক্ষমতা সম্ভবত: ‘বিগিনিং অফ অ্যান্ড অফ মাহাথির’। আগে বেশ সুনাম কামিয়েছেন, এবার সব হারানোর পালা। আগে ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তাকে বলা হয়, ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার’। এরপর রাজনীতি থেকে অবসর। ১৫ বছর পর আবার ফিরে আসেন! এলেন, দুর্নীতি কমাবেন বলে? অনেকটা সামরিক শাসকরা যেমন বলে থাকেন? মাহাথির মোহাম্মদ অবশ্য বলেছিলেন, দুই বছর ক্ষমতায় থাকবেন। থাকতে আর পারলেন কই? চলে তো যেতেই হলো! আর গেলেনও তো ঝগড়াঝাটি করে! রাজনীতির দাবার চালে হেরে।

দুই বছর পূর্তির খুব বেশিদিন বাকি ছিল না। তবু যদি বলতেন, ভাই, ক’টা দিন বাকি, তারপর চলে যাচ্ছি। তা তো নয়, পদত্যাগ করেছিলেন, নতুনভাবে কোয়ালিশন করে আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে? সেই খায়েস আর মিটলো না? কথামত দুই বছরের মাথায় ক্ষমতা ছাড়ার কোন লক্ষণ তার মধ্যে ছিল না। রাজনীতিকরা ওরকম বলে থাকেন। দুবছর পরে হয়তো বলতেন যে, তার কথা তো কোরইন-হাদিসের কথা নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না? তাছাড়া জনগণের ভালোবাসা আছে না? ২০১৮-তে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন জনতার দোহাই দিয়ে? এসব কথা উঠতো না যদি তিনি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতেন। আহা, ক্ষমতা বলে কথা! কেউ ছাড়ে না!

২০১৮-তে মাহাথির জিতেছেন বটে, কিন্তু সবটুকু কৃতিত্ব তার একার ছিল না। বরং জেলবন্দী আনোয়ার ইব্রাহীম ও অন্য শরিকরাও এই কৃতিত্বের দাবিদার। এই আনোয়ার ইব্রাহীম এক সময় তারই ‘সেকেন্ড ম্যান’ ছিলেন, পরে রাজনীতির খেলায় তিনি হয়ে গেলেন মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। মাহাথির মোহাম্মদের ইঙ্গিতেই জেলে গিয়েছিলেন, অপরাধ সমকামিতা। মাহাথির শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জিতেছিলেন। জিতে আনোয়ার ইব্রাহীমকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তার উত্তরসূরি বানিয়েছেন। তার পতœী ওয়ান আজিজা ইসমাইল ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পেশায় আজিজা ডাক্তার, এবং ইব্রাহীম জেলবন্দী থাকাকালে তিনিই দল সামলেছেন। মাহাথির যখন প্রথমবার সসম্মানে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, তখন ক্ষমতা দিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ বাদাওয়ী-কে। বাদাওয়ী হারিয়ে গেছেন।

এরপর ক্ষমতায় আসেন মাহাথিরের শিষ্য নাজিব রাজাক। নাজিবকে হারিয়েই ২০১৮-তে মাহাথির আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ২০১৫-তে নাজীবের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মাহাথির বলেছেন, নাজিব চোর, কয়েকশ’ বা কয়েক হাজার ডলার নয়, নাজিব বিলিয়ন ডলার চোর? চোর ধরতেই শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিত্রকে হারিয়ে তিনি ক্ষমতা নিয়েছেন। এর আগে মাহাথির ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১-২০০৩। পেশায় চিকিৎসক। ‘লুক ইস্ট’ পলিসি নিয়ে তিনি মালয়েশিয়াকে অর্থনীতির ‘খুদে টাইগার’-এ পরিণত করেন। সামাজিক মাধ্যমে কিছু লোক বলছেন, মাহাথির নাকি চট্টগ্রামের লোক, মানে তার পূর্ব-পুরুষেরা চট্টগ্রামে ছিলেন?

মাহাথির বিরোধী ঘড়যন্ত্রে জড়িত হয়ে আনোয়ার ইব্রাহীম জেলে যান, তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আনোয়ার ইব্রাহীম সবসময় বলেছেন তাকে রাজনৈতিক কারণে জেলে যেতে হয়েছে। মাহাথির তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। মালয়েশিয়ায় সাধারণ নির্বাচন হয় ৯ মে ২০১৮। ২২২ সিটের পার্লামেন্টে (দেওয়ান রাকায়েত) মাহাথিরের জোট ‘পাকাতান হারাপান’ ১১৩টি আসন পেয়েছিল। সাবাহ হেরিটেজ পার্টি নামে একটি দল ৮টি আসন পায় এবং ‘পাকাতান হারাপান’কে সমর্থন দিলে মাহাথিরের পক্ষে মোট ১২১টি আসন হয় এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হ’ন। মাহাথির ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সরকার প্রধান, ক্ষমতা হারান মাত্র ৯৪ বছর বয়সে।

# guhasb@gmail.com

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, নিউইয়র্ক