না’গঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণ

দায় তিতাস ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটির

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, পাইপ লাইনের লিকেজ থেকে দীর্ঘদিন যাবত মসজিদের অভ্যন্তরে জমা হচ্ছিল। মসজিদ কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় গ্যাস বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। ঘটনার দিন বিদ্যুতের দ্বিতীয় সংযোগ চালু করতে গিয়ে স্পার্ক থেকে আগুন এবং জমা গ্যাসেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এদিকে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাস কোম্পানি, ডিপিডিসি ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির গাফিলতি পেয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।

গতকাল বিকেল ৫টায় জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের কাছে ৪০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর কাছে আরও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তিতাসের তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এককভাবে দোষী কেউ নয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও মসজিদ কমিটির গাফিলতি আমরা পেয়েছি। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গাফিলতি ছিল। সবগুলো বিষয় প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।’

প্রশাসনের ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার সময় দক্ষ কারিগর নিয়োগ, বিদ্যুৎ বা গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরিসহ ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। মসজিদ কমিটিগুলোকে একটি নীতিমালা তৈরি ও মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মানার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাদিজা তাহেরা ববি বলেন, ‘প্রতিবেদনে ১৮টি সুপারিশ করেছি আমরা। বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগর ব্যবহারের সুপারিশ করেছি। পাশাপাশি গ্যাস বা বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ম্যাপ রাখার কথা বলেছি। যাতে অতি দ্রুত লাইনগুলোকে আইডেন্টিফাই করা যায়।’

গত ৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে এশার নামাজ আদায়ের সময় এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হন ৪২ জন। দগ্ধদের মধ্যে মারা গেছেন ৩১ জন। পাইপ লাইনের লিকেজ থেকে মসজিদের ভেতরে জমা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে বলে শুরু থেকে বিভিন্ন সংস্থা ও মসজিদ কমিটি দাবি করে আসছিল। পরবর্তীতে তিতাস পাইপ লাইন খুঁড়ে তাতে লিকেজ থাকার প্রমাণও পায়। বিস্ফোরণের কয়েকদিন পূর্বে গ্যাস লিকেজের কথা তিতাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেইনি এবং ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিল বলে অভিযোগ করে মসজিদ কমিটির লোকজন। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে তিতাসকে দায়ী করা হলে গত ৭ সেপ্টেম্বর তিতাস গ্যাসের ফতুল্লা অফিসের চার কর্মকর্তা এবং চার কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

দুর্ঘটনার পর তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ৮ সেপ্টেম্বর তিতাসের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের নেতৃত্বে মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুরসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকাল জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ।

তিতাসের তদন্ত প্রতিবেদন

তিতাসের চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, ওই মসজিদে এসি থাকায় সব জানালা দরজা বন্ধ ছিল। মসজিদের পাশেই গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে অল্প অল্প করে মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমতে থাকে। সেদিন এশার নামাজের সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর মসজিদের মুয়াজ্জিন একটি লাইনে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আরেকটি বিদ্যুতের লাইন চালু করতে গেলে সুইচে বিদ্যুৎ স্পার্ক করে। এতে মসজিদের ভেতরে জমে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। মসজিদটি সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় আগুন লেগে যায় মসজিদের প্রায় প্রতিটি কোনায়। এ কারণেই হতাহতের হার অনেক বেশি হয়েছে।

তিতাস বলছে, মসজিদের আশপাশে খোঁড়াখুঁড়ির পর তারা পাইপ লাইনে ৬টি লিকেজ পেয়েছেন তারা। যে লাইনে লিকেজটি পাওয়া যায় সেটি মসজিদের উত্তর পাশের চার নম্বর পিলারসংলগ্ন। মসজিদটির পাকা ভবন নির্মাণের সময় তিতাসের পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া মসজিদটি নির্মাণের সময় ভবন নির্মাণের নিময় মানা হয়নি। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদনের কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি মসজিদ কমিটি। এমনকি বিদ্যুতের একটি অবৈধ সংযোগের বিষয়েও ডিপিডিসির কোন অনুমতি ছিল না বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে তিতাসের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির একটি বিষয়ও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৭ সালে মসজিদসংলগ্ন ১ ইঞ্চি ব্যাসের একটি বিতরণ লাইন নির্মাণ করে তিতাস। ওই লাইন থেকে ১৯৯৬ সালে মসজিদের উত্তর পাশে জনৈক বারেক দেওয়ান ও শওকত আলী নামে দুই ব্যক্তিকে আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়। গ্রাহক বাড়াতে দুই বছর পর ১৯৯৮ সালে একই পাশে ৩ ইঞ্চির আরও একটি বিতরণ লাইন নির্মাণ করে তিতাস। এই লাইন নির্মাণের পর বারেক দেওয়ান ও শওকত আলী তাদের সংযোগ ১ ইঞ্চি লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে ৩ ইঞ্চি লাইনে স্থাপন করে। পূর্বের লাইনটি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। ঠিকাদারের মাধ্যমে বন সকেট প্ল্যাক দিয়ে লাইনের মুখ বন্ধ করা হলেও ওই লাইনে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত ছিল। ওই পাইপ লাইনেই ছয়টি লিকেজ পাওয়া যায়। তবে ওই দুই গ্রাহক সংযোগ বিচ্ছিন্নের বিষয়ে তিতাসকে অবহিত করা হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন তবে প্রায় দুই যুগ সময় পেরিয়ে গেলেও এই বিষয়ে কোন খোঁজ নেয়নি তিতাস কর্তৃপক্ষ। বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্তের পরই প্রথম এই বিষয়টি সামনে এসেছে।

এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ দিয়েছে তিতাসের তদন্ত কমিটি। সেখানে বলা হয়েছে, এখন থেকে তিতাসের পাইপ লাইনের উপর কোন ধরনের স্থাপনা করা যাবে না। কারণ, এতে গ্যাসের পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে লিকেজ হতে পারে। আর লিকেজের সমস্যা পেলে সঙ্গে সঙ্গে যেন তিতাসকে জানানো হয়। পাশাপাশি অতি দ্রুত বিভিন্ন নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্ত ও মেরামতের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি অফিস স্বল্প সময় অন্তর তাদের নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

এদিকে তিতাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরও লিকেজ মেরামত না করার যে অভিযোগ উঠেছে, তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে তিতাস। এর কোন তথ্য-প্রমাণ তদন্ত কমিটিকে কেউ দেখাতে পারেনি বলে দাবি তিতাসের।

এদিকে মসজিদে দুটি বৈদ্যুতিক লাইন থাকলেও একটি ছিল মিটারবিহীন অবৈধ। গত বছর রমজানের সময় মসজিদে দ্বিতীয় এবং অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগটি সিঙ্গেল ফেস থেকে নেয়া হয়। যা এখন পর্যন্ত চলছে। এর জন্য ডিপিডিসির পক্ষ থেকে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোন খোঁজ নেয়নি ডিপিডিসির সংশ্লিষ্টরা। বিস্ফোরণের পূর্বে এ বিষয়ে কোন তথ্য ডিপিডিসির কাছে ছিল না বলে জানায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। ঘটনার দিন একটি ফিডারের সংযোগ চলে যাওয়ায় ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড থেকে চেঞ্জ ওভার ব্যবহার করে অন্য ফিডারে যাওয়ার সময় স্পার্ক করে। সেই স্পার্ক থেকেই উৎসারিত আগুন এবং মসজিদের অভ্যন্তরে জমা হওয়া গ্যাসেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে তদন্ত প্রতিবেদেনে এমনটাই উল্লেখ করেছে তিতাস।

বিস্ফোরণের ঘটনার পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফতুল্লা মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হলেও বিদ্যুৎ, গ্যাস কর্মকর্তাসহ মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে অবহেলা গাফিলতির অভিযোগ করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ইতোমধ্যে বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র জব্দ তালিকায় সংযুক্ত ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সিআইডির পরিদর্শক বাবুল হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘এই ঘটনার শুরু থেকেই আমরা ছায়া তদন্ত করছিলাম। পরে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তরের পর সব বিষয় খতিয়ে দেখছি। এ ঘটনায় যতগুলো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেসব কমিটির প্রতিবেদন আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখব। এছাড়া আমাদের নিজেদের তদন্ত তো চলছেই। তদন্ত শেষে অপরাধী চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনব।’

image
আরও খবর
ছয় মাসেও দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র নেই
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ার প্রত্যয় প্রধানমন্ত্রীর
পিয়াজের দাম কমছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
পিয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় অনুতপ্ত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অর্থনীতি সম্পর্কে এডিবির মূল্যায়ন নিয়ে অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন
‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের ভূমিকায় বাংলাদেশ হতাশ’
মৃত্যু ৩৬, নতুন শনাক্ত ১,৫৯৩
কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে তরুণীকে গণধর্ষণ
চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা
ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হয়নি
৯৩ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরল ৭২ হাজার
রবিউল জবানবন্দি দেয়নি, ফের রিমান্ডে
অস্ত্র মামলায় সাহেদের যাবজ্জীবন চায় রাষ্ট্রপক্ষ
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ার প্রত্যয় প্রধানমন্ত্রীর

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৮ মহররম ১৪৪২, ৩০ ভাদ্র ১৪২৭

না’গঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণ

দায় তিতাস ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটির

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

image

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, পাইপ লাইনের লিকেজ থেকে দীর্ঘদিন যাবত মসজিদের অভ্যন্তরে জমা হচ্ছিল। মসজিদ কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় গ্যাস বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। ঘটনার দিন বিদ্যুতের দ্বিতীয় সংযোগ চালু করতে গিয়ে স্পার্ক থেকে আগুন এবং জমা গ্যাসেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এদিকে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাস কোম্পানি, ডিপিডিসি ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির গাফিলতি পেয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।

গতকাল বিকেল ৫টায় জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের কাছে ৪০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর কাছে আরও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তিতাসের তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এককভাবে দোষী কেউ নয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও মসজিদ কমিটির গাফিলতি আমরা পেয়েছি। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গাফিলতি ছিল। সবগুলো বিষয় প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।’

প্রশাসনের ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার সময় দক্ষ কারিগর নিয়োগ, বিদ্যুৎ বা গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরিসহ ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। মসজিদ কমিটিগুলোকে একটি নীতিমালা তৈরি ও মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মানার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাদিজা তাহেরা ববি বলেন, ‘প্রতিবেদনে ১৮টি সুপারিশ করেছি আমরা। বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগর ব্যবহারের সুপারিশ করেছি। পাশাপাশি গ্যাস বা বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ম্যাপ রাখার কথা বলেছি। যাতে অতি দ্রুত লাইনগুলোকে আইডেন্টিফাই করা যায়।’

গত ৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে এশার নামাজ আদায়ের সময় এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হন ৪২ জন। দগ্ধদের মধ্যে মারা গেছেন ৩১ জন। পাইপ লাইনের লিকেজ থেকে মসজিদের ভেতরে জমা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে বলে শুরু থেকে বিভিন্ন সংস্থা ও মসজিদ কমিটি দাবি করে আসছিল। পরবর্তীতে তিতাস পাইপ লাইন খুঁড়ে তাতে লিকেজ থাকার প্রমাণও পায়। বিস্ফোরণের কয়েকদিন পূর্বে গ্যাস লিকেজের কথা তিতাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেইনি এবং ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিল বলে অভিযোগ করে মসজিদ কমিটির লোকজন। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে তিতাসকে দায়ী করা হলে গত ৭ সেপ্টেম্বর তিতাস গ্যাসের ফতুল্লা অফিসের চার কর্মকর্তা এবং চার কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

দুর্ঘটনার পর তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ৮ সেপ্টেম্বর তিতাসের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের নেতৃত্বে মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুরসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকাল জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ।

তিতাসের তদন্ত প্রতিবেদন

তিতাসের চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, ওই মসজিদে এসি থাকায় সব জানালা দরজা বন্ধ ছিল। মসজিদের পাশেই গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে অল্প অল্প করে মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমতে থাকে। সেদিন এশার নামাজের সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর মসজিদের মুয়াজ্জিন একটি লাইনে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আরেকটি বিদ্যুতের লাইন চালু করতে গেলে সুইচে বিদ্যুৎ স্পার্ক করে। এতে মসজিদের ভেতরে জমে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। মসজিদটি সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় আগুন লেগে যায় মসজিদের প্রায় প্রতিটি কোনায়। এ কারণেই হতাহতের হার অনেক বেশি হয়েছে।

তিতাস বলছে, মসজিদের আশপাশে খোঁড়াখুঁড়ির পর তারা পাইপ লাইনে ৬টি লিকেজ পেয়েছেন তারা। যে লাইনে লিকেজটি পাওয়া যায় সেটি মসজিদের উত্তর পাশের চার নম্বর পিলারসংলগ্ন। মসজিদটির পাকা ভবন নির্মাণের সময় তিতাসের পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া মসজিদটি নির্মাণের সময় ভবন নির্মাণের নিময় মানা হয়নি। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদনের কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি মসজিদ কমিটি। এমনকি বিদ্যুতের একটি অবৈধ সংযোগের বিষয়েও ডিপিডিসির কোন অনুমতি ছিল না বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে তিতাসের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির একটি বিষয়ও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৭ সালে মসজিদসংলগ্ন ১ ইঞ্চি ব্যাসের একটি বিতরণ লাইন নির্মাণ করে তিতাস। ওই লাইন থেকে ১৯৯৬ সালে মসজিদের উত্তর পাশে জনৈক বারেক দেওয়ান ও শওকত আলী নামে দুই ব্যক্তিকে আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়। গ্রাহক বাড়াতে দুই বছর পর ১৯৯৮ সালে একই পাশে ৩ ইঞ্চির আরও একটি বিতরণ লাইন নির্মাণ করে তিতাস। এই লাইন নির্মাণের পর বারেক দেওয়ান ও শওকত আলী তাদের সংযোগ ১ ইঞ্চি লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে ৩ ইঞ্চি লাইনে স্থাপন করে। পূর্বের লাইনটি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। ঠিকাদারের মাধ্যমে বন সকেট প্ল্যাক দিয়ে লাইনের মুখ বন্ধ করা হলেও ওই লাইনে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত ছিল। ওই পাইপ লাইনেই ছয়টি লিকেজ পাওয়া যায়। তবে ওই দুই গ্রাহক সংযোগ বিচ্ছিন্নের বিষয়ে তিতাসকে অবহিত করা হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন তবে প্রায় দুই যুগ সময় পেরিয়ে গেলেও এই বিষয়ে কোন খোঁজ নেয়নি তিতাস কর্তৃপক্ষ। বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্তের পরই প্রথম এই বিষয়টি সামনে এসেছে।

এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ দিয়েছে তিতাসের তদন্ত কমিটি। সেখানে বলা হয়েছে, এখন থেকে তিতাসের পাইপ লাইনের উপর কোন ধরনের স্থাপনা করা যাবে না। কারণ, এতে গ্যাসের পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে লিকেজ হতে পারে। আর লিকেজের সমস্যা পেলে সঙ্গে সঙ্গে যেন তিতাসকে জানানো হয়। পাশাপাশি অতি দ্রুত বিভিন্ন নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্ত ও মেরামতের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি অফিস স্বল্প সময় অন্তর তাদের নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

এদিকে তিতাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরও লিকেজ মেরামত না করার যে অভিযোগ উঠেছে, তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে তিতাস। এর কোন তথ্য-প্রমাণ তদন্ত কমিটিকে কেউ দেখাতে পারেনি বলে দাবি তিতাসের।

এদিকে মসজিদে দুটি বৈদ্যুতিক লাইন থাকলেও একটি ছিল মিটারবিহীন অবৈধ। গত বছর রমজানের সময় মসজিদে দ্বিতীয় এবং অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগটি সিঙ্গেল ফেস থেকে নেয়া হয়। যা এখন পর্যন্ত চলছে। এর জন্য ডিপিডিসির পক্ষ থেকে কোন অনুমতি নেয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোন খোঁজ নেয়নি ডিপিডিসির সংশ্লিষ্টরা। বিস্ফোরণের পূর্বে এ বিষয়ে কোন তথ্য ডিপিডিসির কাছে ছিল না বলে জানায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। ঘটনার দিন একটি ফিডারের সংযোগ চলে যাওয়ায় ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড থেকে চেঞ্জ ওভার ব্যবহার করে অন্য ফিডারে যাওয়ার সময় স্পার্ক করে। সেই স্পার্ক থেকেই উৎসারিত আগুন এবং মসজিদের অভ্যন্তরে জমা হওয়া গ্যাসেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে তদন্ত প্রতিবেদেনে এমনটাই উল্লেখ করেছে তিতাস।

বিস্ফোরণের ঘটনার পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফতুল্লা মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হলেও বিদ্যুৎ, গ্যাস কর্মকর্তাসহ মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে অবহেলা গাফিলতির অভিযোগ করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ইতোমধ্যে বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র জব্দ তালিকায় সংযুক্ত ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সিআইডির পরিদর্শক বাবুল হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘এই ঘটনার শুরু থেকেই আমরা ছায়া তদন্ত করছিলাম। পরে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তরের পর সব বিষয় খতিয়ে দেখছি। এ ঘটনায় যতগুলো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেসব কমিটির প্রতিবেদন আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখব। এছাড়া আমাদের নিজেদের তদন্ত তো চলছেই। তদন্ত শেষে অপরাধী চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনব।’