ঢাকায় বাড়ছে জনসমাগম বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু

দেশে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা। সাত বিভাগের তুলনায় ঢাকা বিভাগেই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেক। এরপরও জীবিকার টানে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসছেন মানুষ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে সব উদ্যোগ যেন থমকে গেছে। এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে ঢাকায় এমনটি মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, করোনা সংক্রমণ এবার শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ৯২ হাজার ২৪২ জনের করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। এতে মহানগরীতে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৯৬ জনের। আর চাঁদপুরে ২ হাজার ২১৭ জনের করোনা শনাক্তে মারা গেছেন ১০৬ জন। শনাক্তের হারে মৃত্যুতে প্রথম অবস্থানে চাঁদপুর।

করোনায় দেশে ৪ হাজার ৯১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২ হাজার ৪০৪ জন (৪৮ দশমিক ৮০ শতাংশ), চট্টগ্রামে ১ হাজার ২২ জন (২০ দশমিক ৯২ শতাংশ), রাজশাহীতে ৩২৯ জন (৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ), খুলনায় ৪১৫ জন (৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ), বরিশালে ১৮৪ জন (৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ), সিলেটে ২২১ জন (৪ দশমিক ৫১ শতাংশ), রংপুরে ২৩১ জন (৪ দশমিক ৭১ শতাংশ) এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১০৭ জন (২ দশমিক ১১ শতাংশ) রয়েছেন। সবগুলো বিভাগের চেয়ে ঢাকা বিভাগে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেশি। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণ ও মৃত্যু বিশ্লেষণ করছে। এই সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মৃত্যুর হারের দিকে প্রথম চাঁদপুর, দ্বিতীয় কুমিল্লা এবং তৃতীয় অবস্থানে ঝিনাইদহ রয়েছে। চাঁদপুরে ২ হাজার ২১৭ জনের করোনা শনাক্তে মারা গেছেন ১০৬ জন। শনাক্তের দিক থেকে শেরপুরে ৪৬২ জন। এখানে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। সারাদেশে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪১ শতাংশ আর চাঁদপুরে মৃত্যুর হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

করোনা শনাক্ত মোট ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৭২ জনের। শনাক্তের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম ঢাকা জেলা ৯২ হাজার ২৪২, দ্বিতীয় চট্টগ্রাম জেলা ১৭ হাজার ৯২৫, তৃতীয় বগুড়া ৭ হাজার ১৯৫ জন, চতুর্থ জেলা কুমিল্লা ৭ হাজার ১৬৯। বেশিরভাগ জেলায় প্রায় ৩ হাজারের বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে। সর্বনি¤œ শনাক্তের জেলার মধ্যে শেরপুর ৪৫৪ জন।

গুলিস্তান, ফার্মগেট, পান্থপথ ও কাওরানবাজার কয়েকদিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, করোনার মাঝে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অফিসে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় লাইন ধরছে। বাসে যাত্রী ঠাসা। আগের মতোই বাসের হ্যান্ডলে ঝুঁলে গন্তব্যস্থলে যাচ্ছেন যাত্রীরা। ফুটপাতে হকারদের ভিড়, ইচ্ছে শর্তে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে পারছেন না। হোটেল রেস্তোরাঁ, মার্কেট, অফিস-আদালত সবকিছু আগের মতো হওয়ায় রাস্তায় যানজটের চাপও বাড়ছে। গণপরিবহনে সবাইকে মাস্ক পরে ওঠার সরকার নির্দেশনা দিলেও সেটি মানা হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঢাকা। দেশে যত করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই ঢাকায়। দেশে ছয় মাসেও করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপ শেষ হয়নি। এরমধ্যে ঢাকায় জনসমাগম বাড়ছে, অফিস-আদালত, গণপরিবহন, ট্রেন, মার্কেট, বাজার ও সব ধরনের দোকান খুলছে কিন্তু মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমছে। মানুষের এমন চলাচলে প্রথম ধাপের করোনা সংক্রমণ আরও দীর্ঘ হতে পারে।

করোনার সংক্রমণ নিয়ে ৯ আগস্ট ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপে ঢাকার দুই সিটিতে ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। দুই সিটির ৩ হাজার ২৭৭ পরিবারের ওপর এ জরিপ চলে। এরমধ্যে ২১১ জন লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়। এসব লক্ষণযুক্ত পরিবারের মধ্যে থেকে ৪৩৫ জন উপসর্গহীন ব্যক্তি শনাক্ত হন। এর মধ্যে ২০১ জনের পরীক্ষা করা হয়। আর উপসর্গহীন পরিবারের মধ্যে থেকে ৮২৭ জন উপসর্গহীন ব্যক্তি শনাক্ত হন। তাদের মধ্যে থেকে ৫৩৮ জনের পরীক্ষা করা হয়। জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পজেটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ সংখ্যা ছিল ১৩ শতাংশ। আর ১৫ থেকে ১৯ বয়সী মধ্যে কোভিড-১৯ এর ১২ শতাংশ হয়। ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৮ শতাংশের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে করোনা নিয়ে জরিপ করলেও গত ছয় মাসে পুরো বাংলাদেশে কত সংখ্যক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সেটি জরিপ হয়নি।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লা সংবাদকে বলেন, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। জনসাধারণকে আরও সচেতন ও কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সেক্টরে টেকনিক্যাল পরামর্শকের মতামত নেয়া হয় না। চীনের উহান শহরে করোনা রোগী শনাক্তের পর অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছিল। হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাড়িয়ে ছিল। এমনকি উহান শহরে লকডাউনের মতো বিশ্বের কোথাও লকডাউন দেয়া হয়নি। চীন সরকার যা বলবে, সেই দেশের জনগণ তাই মেনেছে। আমাদের দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল, এজন্য পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এখন আর লকডাউনে করোনা সংক্রমণ কমানো সম্ভব নয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলী সংবাদকে বলেন, ঢাকায় করোনা সংক্রমণের সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম যখন দেশে মানুষ করোনা আক্রান্ত হলো তখন অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। আবার এখন গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকামুখী হয়েছেন। এতে করোনা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকায় মানুষের সমাগম বাড়লেও সুরক্ষা সামগ্রী কিংবা স্বাস্থ্যবিধি কোনটি মানা হচ্ছ না। করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে হেয়ালিপনা চলে এসেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সংবাদকে বলেন, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত শিল্প কারখানা ও অন্যান্য কাজের দিনমজুর, রিকশাচালক ও অন্যান্য শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কম। এর মূল কারণ কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলে জীবন-জীবিকা চালানোর সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। করোনার মধ্যে কিছু মানুষ গ্রামমুখী হলেও সেখানে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। সেজন্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি জেনেও ঢাকায় সমাগম বাড়ছে। এতে করোনার মহামারীর ভয় ঢাকাবাসী থেকেই যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আল্লাহ মৃত্যু দিলে কেউ ঠেকাতে পারবেন না- করোনা নিয়ে অনেক ধর্মী নেতা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাও বলছেন- করোনা দেশ থেকে চলে গেছে। এসব বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এ থেকে জনগণকে সাবধান হওয়া দরকার।

জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে। এই সময়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কার্যকর লকডাউনের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধের কৌশল নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা-না করে মানুষ যেভাবে গ্রাম থেকে গাদাগাদি করে ঢাকায় আসছেন, তাতে আক্রান্ত ও মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে।

জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা সবাই ভাইরাসটির বিস্তার পর্যালোচনা করে একটি পূর্বাভাস দিয়েছিলাম। মে মাস এবং জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময়কাল বিবেচনা করা হয়েছিল। এর পর ধাপে ভাইরাসটির বিস্তার হ্রাস পাবে বলে ধারণা ছিল। কিন্তু জুলাই ও আগস্টে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রথমে সংক্রমণ ছিল ঢাকা ও মাদারীপুরে। এরপর নারায়ণগঞ্জ যুক্ত হয়। একে একে ৬৪ জেলা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ৩০ মহররম ১৪৪২, ০২ আশ্বিন ১৪২৭

ঢাকায় বাড়ছে জনসমাগম বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু

ফারুক আলম

দেশে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা। সাত বিভাগের তুলনায় ঢাকা বিভাগেই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেক। এরপরও জীবিকার টানে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসছেন মানুষ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে সব উদ্যোগ যেন থমকে গেছে। এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে ঢাকায় এমনটি মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, করোনা সংক্রমণ এবার শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ৯২ হাজার ২৪২ জনের করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। এতে মহানগরীতে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৯৬ জনের। আর চাঁদপুরে ২ হাজার ২১৭ জনের করোনা শনাক্তে মারা গেছেন ১০৬ জন। শনাক্তের হারে মৃত্যুতে প্রথম অবস্থানে চাঁদপুর।

করোনায় দেশে ৪ হাজার ৯১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২ হাজার ৪০৪ জন (৪৮ দশমিক ৮০ শতাংশ), চট্টগ্রামে ১ হাজার ২২ জন (২০ দশমিক ৯২ শতাংশ), রাজশাহীতে ৩২৯ জন (৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ), খুলনায় ৪১৫ জন (৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ), বরিশালে ১৮৪ জন (৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ), সিলেটে ২২১ জন (৪ দশমিক ৫১ শতাংশ), রংপুরে ২৩১ জন (৪ দশমিক ৭১ শতাংশ) এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১০৭ জন (২ দশমিক ১১ শতাংশ) রয়েছেন। সবগুলো বিভাগের চেয়ে ঢাকা বিভাগে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেশি। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণ ও মৃত্যু বিশ্লেষণ করছে। এই সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মৃত্যুর হারের দিকে প্রথম চাঁদপুর, দ্বিতীয় কুমিল্লা এবং তৃতীয় অবস্থানে ঝিনাইদহ রয়েছে। চাঁদপুরে ২ হাজার ২১৭ জনের করোনা শনাক্তে মারা গেছেন ১০৬ জন। শনাক্তের দিক থেকে শেরপুরে ৪৬২ জন। এখানে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। সারাদেশে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪১ শতাংশ আর চাঁদপুরে মৃত্যুর হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

করোনা শনাক্ত মোট ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৭২ জনের। শনাক্তের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম ঢাকা জেলা ৯২ হাজার ২৪২, দ্বিতীয় চট্টগ্রাম জেলা ১৭ হাজার ৯২৫, তৃতীয় বগুড়া ৭ হাজার ১৯৫ জন, চতুর্থ জেলা কুমিল্লা ৭ হাজার ১৬৯। বেশিরভাগ জেলায় প্রায় ৩ হাজারের বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে। সর্বনি¤œ শনাক্তের জেলার মধ্যে শেরপুর ৪৫৪ জন।

গুলিস্তান, ফার্মগেট, পান্থপথ ও কাওরানবাজার কয়েকদিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, করোনার মাঝে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অফিসে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় লাইন ধরছে। বাসে যাত্রী ঠাসা। আগের মতোই বাসের হ্যান্ডলে ঝুঁলে গন্তব্যস্থলে যাচ্ছেন যাত্রীরা। ফুটপাতে হকারদের ভিড়, ইচ্ছে শর্তে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে পারছেন না। হোটেল রেস্তোরাঁ, মার্কেট, অফিস-আদালত সবকিছু আগের মতো হওয়ায় রাস্তায় যানজটের চাপও বাড়ছে। গণপরিবহনে সবাইকে মাস্ক পরে ওঠার সরকার নির্দেশনা দিলেও সেটি মানা হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঢাকা। দেশে যত করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই ঢাকায়। দেশে ছয় মাসেও করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপ শেষ হয়নি। এরমধ্যে ঢাকায় জনসমাগম বাড়ছে, অফিস-আদালত, গণপরিবহন, ট্রেন, মার্কেট, বাজার ও সব ধরনের দোকান খুলছে কিন্তু মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমছে। মানুষের এমন চলাচলে প্রথম ধাপের করোনা সংক্রমণ আরও দীর্ঘ হতে পারে।

করোনার সংক্রমণ নিয়ে ৯ আগস্ট ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপে ঢাকার দুই সিটিতে ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। দুই সিটির ৩ হাজার ২৭৭ পরিবারের ওপর এ জরিপ চলে। এরমধ্যে ২১১ জন লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়। এসব লক্ষণযুক্ত পরিবারের মধ্যে থেকে ৪৩৫ জন উপসর্গহীন ব্যক্তি শনাক্ত হন। এর মধ্যে ২০১ জনের পরীক্ষা করা হয়। আর উপসর্গহীন পরিবারের মধ্যে থেকে ৮২৭ জন উপসর্গহীন ব্যক্তি শনাক্ত হন। তাদের মধ্যে থেকে ৫৩৮ জনের পরীক্ষা করা হয়। জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পজেটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ সংখ্যা ছিল ১৩ শতাংশ। আর ১৫ থেকে ১৯ বয়সী মধ্যে কোভিড-১৯ এর ১২ শতাংশ হয়। ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৮ শতাংশের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে করোনা নিয়ে জরিপ করলেও গত ছয় মাসে পুরো বাংলাদেশে কত সংখ্যক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সেটি জরিপ হয়নি।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লা সংবাদকে বলেন, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। জনসাধারণকে আরও সচেতন ও কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সেক্টরে টেকনিক্যাল পরামর্শকের মতামত নেয়া হয় না। চীনের উহান শহরে করোনা রোগী শনাক্তের পর অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছিল। হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাড়িয়ে ছিল। এমনকি উহান শহরে লকডাউনের মতো বিশ্বের কোথাও লকডাউন দেয়া হয়নি। চীন সরকার যা বলবে, সেই দেশের জনগণ তাই মেনেছে। আমাদের দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল, এজন্য পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এখন আর লকডাউনে করোনা সংক্রমণ কমানো সম্ভব নয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলী সংবাদকে বলেন, ঢাকায় করোনা সংক্রমণের সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম যখন দেশে মানুষ করোনা আক্রান্ত হলো তখন অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। আবার এখন গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকামুখী হয়েছেন। এতে করোনা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকায় মানুষের সমাগম বাড়লেও সুরক্ষা সামগ্রী কিংবা স্বাস্থ্যবিধি কোনটি মানা হচ্ছ না। করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে হেয়ালিপনা চলে এসেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সংবাদকে বলেন, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত শিল্প কারখানা ও অন্যান্য কাজের দিনমজুর, রিকশাচালক ও অন্যান্য শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কম। এর মূল কারণ কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলে জীবন-জীবিকা চালানোর সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। করোনার মধ্যে কিছু মানুষ গ্রামমুখী হলেও সেখানে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। সেজন্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি জেনেও ঢাকায় সমাগম বাড়ছে। এতে করোনার মহামারীর ভয় ঢাকাবাসী থেকেই যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আল্লাহ মৃত্যু দিলে কেউ ঠেকাতে পারবেন না- করোনা নিয়ে অনেক ধর্মী নেতা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাও বলছেন- করোনা দেশ থেকে চলে গেছে। এসব বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এ থেকে জনগণকে সাবধান হওয়া দরকার।

জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে। এই সময়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কার্যকর লকডাউনের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধের কৌশল নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা-না করে মানুষ যেভাবে গ্রাম থেকে গাদাগাদি করে ঢাকায় আসছেন, তাতে আক্রান্ত ও মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে।

জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা সবাই ভাইরাসটির বিস্তার পর্যালোচনা করে একটি পূর্বাভাস দিয়েছিলাম। মে মাস এবং জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময়কাল বিবেচনা করা হয়েছিল। এর পর ধাপে ভাইরাসটির বিস্তার হ্রাস পাবে বলে ধারণা ছিল। কিন্তু জুলাই ও আগস্টে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রথমে সংক্রমণ ছিল ঢাকা ও মাদারীপুরে। এরপর নারায়ণগঞ্জ যুক্ত হয়। একে একে ৬৪ জেলা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।