দুর্যোগকবলিত কয়রা-আশাশুনি

ঘর জমি কাজ হারিয়ে দিশেহারা মানুষ

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বেড়ি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খুলনার কয়রা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনির অসংখ্য বাসিন্দা ঘর-জমি-কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আম্ফানের পর থেকেই চলছে তাদের টানা দুর্দশা। এরই মধ্যে এলাকা ছেড়েছেন অনেকে ।

কয়রা সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আখাতারুল ইসলাম জানান, ভাঙনকবলিত স্থানগুলোতে অস্থায়ী রিং বাঁধ দেয়া হলেও এখনও পানির নিচে গ্রামের পর গ্রাম। এতে সীমাহীন দুর্ভোগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এ জনপদের মানুষ। ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক অবস্থা। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট তো রয়েছেই। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে গৃহহীন পরিবারগুলো উপজেলার হরিণখোলা ও ২ নম্বর কয়রার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আম্ফানে একেবারেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন তারা। মাস খানেক আগে জোয়ারের ধাক্কায় নদী তীরবর্তী ওই এলাকার দুই শতাধিক মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। আম্ফানের পর এসব পরিবার স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত রিং বাঁধের বাইরে পড়ে যাওয়ায় নতুন করে ঘর তুলতে পারেনি। যে কারণে বাধ্য হয়ে ওই এলাকার ৫০টির মতো পরিবার এলাকা ছেড়েছে। তবে তারা কোথায় গেছে এবং তাদের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি তিনি। বেশির ভাগ পরিবারই নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গেছে বলে জানান তিনি। তবে এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, কোন দুর্গত পরিবার এলাকা ছাড়ছে কিনা আমার জানা নেই।

২০০৮ সালের মে মাসে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, সর্বশেষ ২০ মে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।

আম্ফানের তা-বে ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ল-ভ- হয়ে যায়।

স্থানীয় সংবাদকর্মী নিশীথ রঞ্জন মিস্ত্রি জানান, সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদের মানুষ এক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই, নতুন নামে ফের আঘাত হানছে আরেক প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে অনেক মানুষ। এখনও কেউ কেউ এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছেন। টিকে থাকার স্বার্থে মানুষ অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দিয়েছিল। কিন্তু তিন মাস পর ২০ অগাস্টের তীব্র জোয়ারে উপজেলার ২১টিরও বেশি স্থানে বাঁধ আবার ভেঙে যায়। আবারও মানুষ নিরুপায় হয়ে রিং বাঁধ দিয়েছে। কিন্তু টিকে থাকা নিয়ে সংশয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী-২ পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, দাকোপের পশুর নদীতে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক মাত্রা দুই দশমিক ৪৪ মিটার। আম্ফানের একদিন আগে ২০ মে তা বেড়ে হয়েছিল তিন দশমিক ৩৭। আর গত মাসে প্রবাহের মাত্রা তিন দশমিক ৬৩ মিটার। তিনি বলেন, আম্ফানের পর বড় কোন প্রকল্পের কাজ হয়নি। দাকোপের ১২/৪৪ নম্বর পোল্ডারের প্রকল্প প্রস্তাব ঢাকায় পাঠিয়েছি। আশা করছি, খুব শীঘ্রই এটা অনুমোদন হয়ে যাবে।

কয়রা এলাকাটি পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরার আওতাধীন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা-২ নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, যে মুহূর্তে বাঁধগুলো ভেঙেছে, তখন স্থানীয় নদনদীতে পানির চাপ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে বাঁধ মেরামতে বিলম্ব হয়। ইতোমধ্য অনেক স্থানের বেড়িবাঁধ আটকানো গেছে দাবি করে তিনি বলেন, কয়রার ১৪/১ ও ১৪/২ পোল্ডারের দুটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দেয়া হয়েছে। জুলাই মাসে ১৪/১ পোল্ডারের প্রকল্পটি প্ল্যানিং কমিশনে গেছে। এখন একনেকে পাস হলে কাজ শুরুর বিষয়ে বলা যাবে।

কয়রা উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাশিরহাটখোলা এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে আটকাতে পারলেও আতঙ্ক কাটেনি।

হাটখোলার বেড়িবাঁধের উপর কুঁড়েঘরে বসবাসরত সুচিত্রা সরকার, মনোরঞ্জন সরকার, মনোহর গাইন, আবুল মোড়লসহ স্থানীয়রা জানান, বসবাসের ঘরবাড়ি নেই, বড় কষ্টে ওয়াপদার উপর কুঁড়েঘর বেঁধে থাকতে হচ্ছে। তিন বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে না। এক বেলা খেলে দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাদের পরিবারের অনেকেই কাজের সন্ধানে শহরে গেছে।

শিউলি সরদার বলেন, রাতে ঘুমুতে পারি না। যদি ভাঙনে ভাসিয়ে নেয়, সে কারণে জেগে বসে থাকি। ‘কাজ নেই, আয় নেই, খাওয়ার সংস্থান নেই। ভাঙনে ভিটেমাটিটুকুও চলে যাচ্ছে। এখন আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই।’

উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের পূর্ব হাজতখালী গ্রামের সাবেক মেম্বার মোড়ল শওকত হোসেন মনে করেন, আম্ফান পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ভাঙা বাঁধের স্থানগুলো যদি যথাযথভাবে মেরামত করা যেত, তবে আবারও মানুষ দুর্ভোগে পড়ত না। ঘর-বাড়ি, জমি-কাজ সব হারিয়ে পথে বসা মানুষগুলোর অনেকেই এখন এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, কেউ আমাদের খরব নেয় না।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম কোম্পানি বলেন, লবণ পানিতে পুরো ইউনিয়ন তলিয়ে রয়েছে। এলাকার মানুষের অভাব-অনাটনেই দিন কাটছে।

কাশিরহাটখোলা খেয়াঘাট থেকে বেদকাশি গ্রামের সড়কটির বামপাশে মরে গেছে খেজুর গাছ, তাল গাছ, সিরিশ গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। কয়েকটি বাড়ির মধ্যে দেখা যায়, গাছে পাতা নেই, আছে শুধু শুকনো ডালপালা। বেদকাশী গ্রামের ব্যবসায়ী পলাশ আহমেদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে লবণ পানিবন্দি থাকায় অনেক গাছপালা মরে গেছে। পানি না নামায় গাছ বাঁচানোর কোন উপায় নেই।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান জিএম শামছুর রহমান জানান, তার ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৭ কিলোমিটারসহ উপজেলার সিংহভাগ বেড়িবাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ। জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধ কয়েকবার পরিদর্শন করেছেন। জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে অনেকবার সভা-সেমিনার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু কবে নাগাদ টেকসই বাঁধ নির্মিত হবে তার কোন হদিস নেই।’

হাওলাদারপাড়ার মুনসুর আলী হাওলাদার (৬৫) বলেন, হাওলাদাররা আনুমানিক ছয় পুরুষ আগে বাদা কেটে এখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। বর্তমানে এখানে বাস করা যাচ্ছে না, থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে ২০-২২টি পরিবার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজনের কাছে চলেও গেছে। জোয়ারের পানিতে বাড়ির উঠানে হাঁটুপানি জমে। জোয়ারের ভয়ে থাকি, তখন পানি আরও বাড়ে। মুনসুর আলী জানান, ‘গেল গোনে হঠাৎ পানির চাপে আমাদের ঘরগুলোর মেঝেও পানিতে ডুবে যায়। ঘরের খাট ইটের পর ইট দিয়ে তুলেও পানির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি।’ এখন পানির চাপ সামান্য কমেছে। তবে জোয়ারের পানিতে বাড়ির উঠান, সংলগ্ন ধানের ক্ষেত, রাস্তা সব ডুবে আছে।

মুনসুর আলীর তথ্য মতে, হাওলাদারপাড়া থেকে তমেজ হাওলাদার, রহিম বক্স, শেফা হাওলাদার, সফেদ আলী হাওলাদার, জাহেদ আলী হাওলাদার, রেশাদ হাওলাদার, লালু হাওলাদার, আজিজ হাওলাদারের পরিবারসহ ২০-২২টি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বেশির ভাগ পরিবারই নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গেছে।

হাওলাদারপাড়ার আরেক বাসিন্দা আকবর হোসেন (৪৫) বলেন, পানি একেবারে শুকিয়ে যাবে না। বাড়িগুলোর পাশের পানিতে ডোবা জায়গাটি দেখিয়ে তিনি জানালেন, এটি ধানক্ষেত। তারা ধান-সবজির চাষ করতেন। নদীর দিকে পানিতে ডোবা বিশাল এলাকা দেখিয়ে আকবর হোসেন বলেন, এটা চিংড়ি ঘের ছিল। ওই দূরের বাঁধ দেখা যাচ্ছে, ওইটিই নদীর বাঁধ। আম্ফানে ভেঙে গিয়ে আমরা তিন মাস ডুবে মরছি। তবে আম্ফানে আমাদের যত না ক্ষতি হয়েছে, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে গত জোয়ারে।

জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বাঁধ ভাঙার কারণ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের অতি উচ্চতা। তবে বিশেষজ্ঞ মহলে এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি কারণ, তবে আর ও কারণ আছে। দেশের উপকূলভাগে, বিশেষত পশ্চিম উপকূলে পলি অবক্ষেপণের মাত্রা অনেক বেশি। এতে নদীর গভীরতা কমছে, চর তৈরি হচ্ছে, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় প্লাবনভূমি নিচু হচ্ছে।নদীর বেড়িবাঁধের কারণে এত দিন জোয়ারের তীব্রতা চোখে পড়ত না। যা এখন লক্ষ্য করা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশির দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এ জন্য বাঁধ কেটে লবণ পানি ভেতরে ঢোকানো হয়। এ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা উপকূলীয় এলাকায় এসে চিংড়ি চাষ বাড়াতে থাকেন। এর ফলে চিরসবুজ প্রকৃতি অল্প সময়ের মধ্যে লবণজলের প্রভাবে বৃক্ষহীন ধূসর প্রান্তরে পরিণত হয়। একইসঙ্গে উপকূলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগও বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এ পরিবর্তন আমলে না নিয়ে সেখানে একের পর এক বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণ চলছে, যা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বড় অংশকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, উপকূলের মানুষের নানান ঝুঁকি রয়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে উপকূলের মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। প্রকৃতির এমন আচরণের জন্য উন্নত দেশগুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের কারণে অনেক সভ্যতার পতন হয়েছে, আবার অনেক সভ্যতা টিকে আছে মূলত পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে। যাদের কারণে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে সেসব দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের তাগিত দেন তিনি। একইসঙ্গে উপকূল এলাকায় দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, উপকূলে জোয়ারের তীব্রতা তো আগে থেকেই ছিল। অতি জোয়ার ও নোনা ঠেকানের জন্যই তো ইপি-ওয়াপদা (ইস্ট পাকিস্তান-ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) সিইপির (কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট) আওতায় পোল্ডার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তাতে নদীর দুই তীর বরাবর মাটির বাঁধ দেয়া হয় আর প্লাবনভূমির পানি নিষ্কাশনের জন্যে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধের কারণেই জোয়ারের চাপ বোঝা যেত না। এখন বাঁধ ভেঙেছে, তাই জোয়ারের তোড় বোঝা যাচ্ছে। অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওই প্রকল্পে আমাদের জোয়ারের নদীগুলোর বিপুল পরিমাণ পলির বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনা করছে না।

জোয়ার ভাটাতেই সমাধান

পরিবেশ পরিকল্পনা গবেষক অনিমেষ গাইন, উপকূল ব্যবস্থাপনা গবেষক শিবলী সাদিক ও বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা গবেষক মফিজুর রহমান গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন- উপকূলীয় এলাকাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায়, পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। প্রকৃতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাতেই এর সমাধান। বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় এগোতে হবে। এরমধ্যে উপকূলের পলি ব্যবস্থাপনায় অবাধ জোয়ারভাটা (টিআরএম বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট নামে পরিচিত) অন্যতম। এ পদ্ধতিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাঁধ কেটে দেয়া হয়। এতে নদীর পানি নিচু বিল অঞ্চলে প্রবেশ করে। আর ভাটার টানে সে পানি আবার বেরিয়ে যায়। এতে জলাবদ্ধতা দূর হয়। নদীর নাব্যতাও বাড়ে। পুরো প্রক্রিয়াকে অবাধ জোয়ারভাটা বলা হয়।

image

কয়রা-আশাশুনি বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ -সংবাদ

আরও খবর
সীমান্ত হত্যা বন্ধে বিএসএফের ফের প্রতিশ্রুতি
আ’লীগের সব পর্যায়ে কমিটিতে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে : কাদের
বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনা হবে বিশ্বে রোল মডেল খাদ্যমন্ত্রী
বিআরটিএতে গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের মহোৎসব
বিআরটিএতে গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের মহোৎসব
আ’লীগের প্রস্তাবিত কমিটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
যশোরে ৬টি অ্যাসেম্বল সেন্টার হচ্ছে
পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হামলা ও ছিনতাই অভিযোগ
বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কুদ্দুস মোল্লার জীবন সংগ্রাম
নগরে অগ্নিদুর্ঘটনা সমাধানে সদিচ্ছার অভাব : বিআইপি
প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ৯ বছরে ৯ বিয়ে
দু’বোনকে হত্যা করা হয় ঘাতক রিফাত গ্রেফতার হত্যার কথা স্বীকার
হিলিতে ট্রেন লাইনচ্যুত

রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ৩০ মহররম ১৪৪২, ০২ আশ্বিন ১৪২৭

দুর্যোগকবলিত কয়রা-আশাশুনি

ঘর জমি কাজ হারিয়ে দিশেহারা মানুষ

শুভ্র শচীন, দুর্যোগকবলিত কয়রা-আশাশুনি থেকে ফিরে

image

কয়রা-আশাশুনি বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ -সংবাদ

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বেড়ি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খুলনার কয়রা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনির অসংখ্য বাসিন্দা ঘর-জমি-কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আম্ফানের পর থেকেই চলছে তাদের টানা দুর্দশা। এরই মধ্যে এলাকা ছেড়েছেন অনেকে ।

কয়রা সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আখাতারুল ইসলাম জানান, ভাঙনকবলিত স্থানগুলোতে অস্থায়ী রিং বাঁধ দেয়া হলেও এখনও পানির নিচে গ্রামের পর গ্রাম। এতে সীমাহীন দুর্ভোগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এ জনপদের মানুষ। ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক অবস্থা। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট তো রয়েছেই। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে গৃহহীন পরিবারগুলো উপজেলার হরিণখোলা ও ২ নম্বর কয়রার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আম্ফানে একেবারেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন তারা। মাস খানেক আগে জোয়ারের ধাক্কায় নদী তীরবর্তী ওই এলাকার দুই শতাধিক মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। আম্ফানের পর এসব পরিবার স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত রিং বাঁধের বাইরে পড়ে যাওয়ায় নতুন করে ঘর তুলতে পারেনি। যে কারণে বাধ্য হয়ে ওই এলাকার ৫০টির মতো পরিবার এলাকা ছেড়েছে। তবে তারা কোথায় গেছে এবং তাদের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি তিনি। বেশির ভাগ পরিবারই নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গেছে বলে জানান তিনি। তবে এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, কোন দুর্গত পরিবার এলাকা ছাড়ছে কিনা আমার জানা নেই।

২০০৮ সালের মে মাসে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, সর্বশেষ ২০ মে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।

আম্ফানের তা-বে ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ল-ভ- হয়ে যায়।

স্থানীয় সংবাদকর্মী নিশীথ রঞ্জন মিস্ত্রি জানান, সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদের মানুষ এক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই, নতুন নামে ফের আঘাত হানছে আরেক প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে অনেক মানুষ। এখনও কেউ কেউ এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছেন। টিকে থাকার স্বার্থে মানুষ অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দিয়েছিল। কিন্তু তিন মাস পর ২০ অগাস্টের তীব্র জোয়ারে উপজেলার ২১টিরও বেশি স্থানে বাঁধ আবার ভেঙে যায়। আবারও মানুষ নিরুপায় হয়ে রিং বাঁধ দিয়েছে। কিন্তু টিকে থাকা নিয়ে সংশয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী-২ পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, দাকোপের পশুর নদীতে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক মাত্রা দুই দশমিক ৪৪ মিটার। আম্ফানের একদিন আগে ২০ মে তা বেড়ে হয়েছিল তিন দশমিক ৩৭। আর গত মাসে প্রবাহের মাত্রা তিন দশমিক ৬৩ মিটার। তিনি বলেন, আম্ফানের পর বড় কোন প্রকল্পের কাজ হয়নি। দাকোপের ১২/৪৪ নম্বর পোল্ডারের প্রকল্প প্রস্তাব ঢাকায় পাঠিয়েছি। আশা করছি, খুব শীঘ্রই এটা অনুমোদন হয়ে যাবে।

কয়রা এলাকাটি পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরার আওতাধীন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা-২ নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, যে মুহূর্তে বাঁধগুলো ভেঙেছে, তখন স্থানীয় নদনদীতে পানির চাপ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে বাঁধ মেরামতে বিলম্ব হয়। ইতোমধ্য অনেক স্থানের বেড়িবাঁধ আটকানো গেছে দাবি করে তিনি বলেন, কয়রার ১৪/১ ও ১৪/২ পোল্ডারের দুটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দেয়া হয়েছে। জুলাই মাসে ১৪/১ পোল্ডারের প্রকল্পটি প্ল্যানিং কমিশনে গেছে। এখন একনেকে পাস হলে কাজ শুরুর বিষয়ে বলা যাবে।

কয়রা উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাশিরহাটখোলা এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে আটকাতে পারলেও আতঙ্ক কাটেনি।

হাটখোলার বেড়িবাঁধের উপর কুঁড়েঘরে বসবাসরত সুচিত্রা সরকার, মনোরঞ্জন সরকার, মনোহর গাইন, আবুল মোড়লসহ স্থানীয়রা জানান, বসবাসের ঘরবাড়ি নেই, বড় কষ্টে ওয়াপদার উপর কুঁড়েঘর বেঁধে থাকতে হচ্ছে। তিন বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে না। এক বেলা খেলে দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাদের পরিবারের অনেকেই কাজের সন্ধানে শহরে গেছে।

শিউলি সরদার বলেন, রাতে ঘুমুতে পারি না। যদি ভাঙনে ভাসিয়ে নেয়, সে কারণে জেগে বসে থাকি। ‘কাজ নেই, আয় নেই, খাওয়ার সংস্থান নেই। ভাঙনে ভিটেমাটিটুকুও চলে যাচ্ছে। এখন আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই।’

উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের পূর্ব হাজতখালী গ্রামের সাবেক মেম্বার মোড়ল শওকত হোসেন মনে করেন, আম্ফান পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ভাঙা বাঁধের স্থানগুলো যদি যথাযথভাবে মেরামত করা যেত, তবে আবারও মানুষ দুর্ভোগে পড়ত না। ঘর-বাড়ি, জমি-কাজ সব হারিয়ে পথে বসা মানুষগুলোর অনেকেই এখন এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, কেউ আমাদের খরব নেয় না।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম কোম্পানি বলেন, লবণ পানিতে পুরো ইউনিয়ন তলিয়ে রয়েছে। এলাকার মানুষের অভাব-অনাটনেই দিন কাটছে।

কাশিরহাটখোলা খেয়াঘাট থেকে বেদকাশি গ্রামের সড়কটির বামপাশে মরে গেছে খেজুর গাছ, তাল গাছ, সিরিশ গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। কয়েকটি বাড়ির মধ্যে দেখা যায়, গাছে পাতা নেই, আছে শুধু শুকনো ডালপালা। বেদকাশী গ্রামের ব্যবসায়ী পলাশ আহমেদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে লবণ পানিবন্দি থাকায় অনেক গাছপালা মরে গেছে। পানি না নামায় গাছ বাঁচানোর কোন উপায় নেই।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান জিএম শামছুর রহমান জানান, তার ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৭ কিলোমিটারসহ উপজেলার সিংহভাগ বেড়িবাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ। জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধ কয়েকবার পরিদর্শন করেছেন। জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে অনেকবার সভা-সেমিনার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু কবে নাগাদ টেকসই বাঁধ নির্মিত হবে তার কোন হদিস নেই।’

হাওলাদারপাড়ার মুনসুর আলী হাওলাদার (৬৫) বলেন, হাওলাদাররা আনুমানিক ছয় পুরুষ আগে বাদা কেটে এখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। বর্তমানে এখানে বাস করা যাচ্ছে না, থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে ২০-২২টি পরিবার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজনের কাছে চলেও গেছে। জোয়ারের পানিতে বাড়ির উঠানে হাঁটুপানি জমে। জোয়ারের ভয়ে থাকি, তখন পানি আরও বাড়ে। মুনসুর আলী জানান, ‘গেল গোনে হঠাৎ পানির চাপে আমাদের ঘরগুলোর মেঝেও পানিতে ডুবে যায়। ঘরের খাট ইটের পর ইট দিয়ে তুলেও পানির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি।’ এখন পানির চাপ সামান্য কমেছে। তবে জোয়ারের পানিতে বাড়ির উঠান, সংলগ্ন ধানের ক্ষেত, রাস্তা সব ডুবে আছে।

মুনসুর আলীর তথ্য মতে, হাওলাদারপাড়া থেকে তমেজ হাওলাদার, রহিম বক্স, শেফা হাওলাদার, সফেদ আলী হাওলাদার, জাহেদ আলী হাওলাদার, রেশাদ হাওলাদার, লালু হাওলাদার, আজিজ হাওলাদারের পরিবারসহ ২০-২২টি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বেশির ভাগ পরিবারই নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গেছে।

হাওলাদারপাড়ার আরেক বাসিন্দা আকবর হোসেন (৪৫) বলেন, পানি একেবারে শুকিয়ে যাবে না। বাড়িগুলোর পাশের পানিতে ডোবা জায়গাটি দেখিয়ে তিনি জানালেন, এটি ধানক্ষেত। তারা ধান-সবজির চাষ করতেন। নদীর দিকে পানিতে ডোবা বিশাল এলাকা দেখিয়ে আকবর হোসেন বলেন, এটা চিংড়ি ঘের ছিল। ওই দূরের বাঁধ দেখা যাচ্ছে, ওইটিই নদীর বাঁধ। আম্ফানে ভেঙে গিয়ে আমরা তিন মাস ডুবে মরছি। তবে আম্ফানে আমাদের যত না ক্ষতি হয়েছে, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে গত জোয়ারে।

জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বাঁধ ভাঙার কারণ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের অতি উচ্চতা। তবে বিশেষজ্ঞ মহলে এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি কারণ, তবে আর ও কারণ আছে। দেশের উপকূলভাগে, বিশেষত পশ্চিম উপকূলে পলি অবক্ষেপণের মাত্রা অনেক বেশি। এতে নদীর গভীরতা কমছে, চর তৈরি হচ্ছে, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় প্লাবনভূমি নিচু হচ্ছে।নদীর বেড়িবাঁধের কারণে এত দিন জোয়ারের তীব্রতা চোখে পড়ত না। যা এখন লক্ষ্য করা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশির দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এ জন্য বাঁধ কেটে লবণ পানি ভেতরে ঢোকানো হয়। এ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা উপকূলীয় এলাকায় এসে চিংড়ি চাষ বাড়াতে থাকেন। এর ফলে চিরসবুজ প্রকৃতি অল্প সময়ের মধ্যে লবণজলের প্রভাবে বৃক্ষহীন ধূসর প্রান্তরে পরিণত হয়। একইসঙ্গে উপকূলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগও বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এ পরিবর্তন আমলে না নিয়ে সেখানে একের পর এক বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণ চলছে, যা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বড় অংশকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, উপকূলের মানুষের নানান ঝুঁকি রয়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে উপকূলের মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। প্রকৃতির এমন আচরণের জন্য উন্নত দেশগুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের কারণে অনেক সভ্যতার পতন হয়েছে, আবার অনেক সভ্যতা টিকে আছে মূলত পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে। যাদের কারণে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে সেসব দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের তাগিত দেন তিনি। একইসঙ্গে উপকূল এলাকায় দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, উপকূলে জোয়ারের তীব্রতা তো আগে থেকেই ছিল। অতি জোয়ার ও নোনা ঠেকানের জন্যই তো ইপি-ওয়াপদা (ইস্ট পাকিস্তান-ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) সিইপির (কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট) আওতায় পোল্ডার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তাতে নদীর দুই তীর বরাবর মাটির বাঁধ দেয়া হয় আর প্লাবনভূমির পানি নিষ্কাশনের জন্যে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধের কারণেই জোয়ারের চাপ বোঝা যেত না। এখন বাঁধ ভেঙেছে, তাই জোয়ারের তোড় বোঝা যাচ্ছে। অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওই প্রকল্পে আমাদের জোয়ারের নদীগুলোর বিপুল পরিমাণ পলির বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনা করছে না।

জোয়ার ভাটাতেই সমাধান

পরিবেশ পরিকল্পনা গবেষক অনিমেষ গাইন, উপকূল ব্যবস্থাপনা গবেষক শিবলী সাদিক ও বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা গবেষক মফিজুর রহমান গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন- উপকূলীয় এলাকাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায়, পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। প্রকৃতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাতেই এর সমাধান। বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় এগোতে হবে। এরমধ্যে উপকূলের পলি ব্যবস্থাপনায় অবাধ জোয়ারভাটা (টিআরএম বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট নামে পরিচিত) অন্যতম। এ পদ্ধতিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাঁধ কেটে দেয়া হয়। এতে নদীর পানি নিচু বিল অঞ্চলে প্রবেশ করে। আর ভাটার টানে সে পানি আবার বেরিয়ে যায়। এতে জলাবদ্ধতা দূর হয়। নদীর নাব্যতাও বাড়ে। পুরো প্রক্রিয়াকে অবাধ জোয়ারভাটা বলা হয়।