মসজিদে বিস্ফোরণ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

অতি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায় এক বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেলে এ পর্যন্ত ৩১ জন মুসল্লি দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন; আর যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাদের অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এছাড়াও বিস্ফোরণের কয়েক দিন আগে থেকেই মসজিদের ভেতর গ্যাসের গন্ধ পেলেও তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। আশির দশকে তিনজন গ্রাহকের জন্য টেনে নেয়া পৌনে এক ইঞ্চির পাইপটি পরিত্যক্ত হলেও তাতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল না। মসজিদের উত্তর পাশের একটি পিলারের বেজমেন্ট রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় পরিত্যক্ত এ গ্যাস পাইপটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্রমান্বয়ে ছয়টি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাইরের এ গ্যাস মসজিদের ভেতরে কিভাবে গেল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মসজিদের ভেতর কয়েক জায়গায় মেঝে ভেদ করে গ্যাস উঠতে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দেখেছেন। তাহলে কি মসজিদের নিচেও গ্যাস লাইন রয়েছে? তদন্ত সম্পন্ন হলে এই সবাই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে, তখন আর আমার লেখা হালনাগাদ করার সুযোগ থাকবে না।

ফতুল্লার এ মসজিদ নির্মাণের সময় কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। মসজিদ একটি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর ভবন হওয়ায় এই ক্ষেত্রে ভবনের নকশায় অনুমোদন নেয়া হলো কী, হলো না তা নিয়ে কর্তৃপক্ষও নির্লিপ্ত থাকে। ধর্ম নিয়ে, উপাসনালয় নিয়ে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলে বিতর্কিত হতে চায় না। স্পর্শকাতর ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আইনের কথা, ন্যায়ের কথা বলে মুরতাদ, নাস্তিক হওয়ার ঝুঁকি কেউ নেয় না বলেই অবৈধ জায়গায় উপাসনালয় গড়ে উঠে, অবৈধ পানি ও বৈদ্যুতিক সংযোগ কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই অনবচ্ছিন্ন থাকে। ফতুল্লার এ মসজিদটি নাকি প্রথমে তিন শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করা হয় এবং পরে আরও তিন শতাংশ জমির ওপর অবৈধভাবে সম্প্রসারণ করা হয়। ধ্বংসের এ বিস্ফোরণে আরও একটি অবৈধ কাজ জড়িত ছিল। মসজিদটিতে দুটি বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে, যার একটি বৈধ আরেকটি অবৈধ। এ দুটি লাইনের সংযোগ সম্ভবত দুর্বল ছিল, একটি লাইনের বিদ্যুৎ চলে গেলে দ্বিতীয় লাইনের বৈদ্যুতিক সুইচ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পার্ক হয় এবং জমা থাকা গ্যাসে আগুন জ্বলে উঠে।

ঢাকা মসজিদের শহর আর বাংলাদেশ মসজিদের দেশ। ভূখণ্ড বিচারে এত বেশি মসজিদ পৃথিবীর আর কোন দেশে সম্ভবত নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সচরাচর কোন মসজিদ পূর্ণ হয় না, কিন্তু শুক্রবারে জুমার নামাজে প্রতিটি মসজিদ পূর্ণ হয়ে যায় এবং এই নামাজে স্থান সংকুলান করতে প্রতিদিন নতুন নতুন মসজিদ হচ্ছে; পুরাতন মসজিদ ভেঙে একই জায়গায় বহুতলা বিশিষ্ট নতুন মসজিদ হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। এ সবাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মসজিদে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হয় না। কারণ দুর্নীতি আর ঘুষের টাকায় অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। মসজিদ নির্মাণের জন্য চাঁদা নেয়ার সময় সাধারণত চাঁদার অর্থের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। কারণ প্রশ্ন তুললে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের টাকায় সুদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, রয়েছে দুর্নীতি আর ঘুষের সংশ্লেষ। এছাড়াও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা কম-বেশি সবার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বাড়ি ভাড়ার সঠিক তথ্য আয়কর বিবরণীতে খুব কম লোকই প্রকাশ করেন, ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার নজির প্রায় সবাই ব্যবসায়ীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, ব্যবসায় লাভ-ক্ষতির প্রকৃত হিসাব লুকানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে বিনা কারণেও আমরা মিথ্যা বলি। মসজিদে আমার দু’বার জুতা চুরি হয়েছে; মসজিদকে এরা ভয় করে না, ভয় করলে মসজিদের ভেতর থেকে জুতা চুরির সাহস করত না। এরা পেটের দায়ে পুরনো জুতা চুরি করে। একদিন এক জুতা চোরকে চুরি করতে দেখেও নীরব ছিলাম। কারণ এদের মেরে নিজের দুর্নীতি ঢাকা দেয়ার জন্য আরও বড় বড় চোর নামাজ পড়তে যায়। অপরাধী লোকগুলো বাদ দিলে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও মাদ্রাসায় দান করার লোক পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ বিমান ব্যতীত অন্য কোন বিদেশি বিমানে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগত; এই অনুমোদন নিতে যারা পাসপোর্ট নিয়ে আসতেন তাদের কাছ থেকে পাগড়ি পরা এক কর্মকর্তা রশিদ দিয়ে মসজিদের জন্য চাঁদা আদায় করতেন। অন্য বিদেশি সংস্থার বিমানে ভ্রমণের অনুমোদন নিতে হলে তাকে চাঁদা দিতেই হতো। কিন্তু আদায় করা এ টাকা সত্যি সত্যি মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা হতো কী না তা কেউ জানতেও চাইত না। কোন বড় অফিসার তার এ অপকর্মে বাধা দিয়েছে বলে শুনিনি। বাসে, ট্রেনে, পার্কে, রাস্তার পাশে বসে চাঁদার বই হাতে নিয়ে মসজিদ নির্মাণের কথা বলে যারা চাঁদা তোলেন তাদের অধিকাংশ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এ কাজটি করে থাকেন; এ টাকা মসজিদ নির্মাণে আদৌ ব্যয় হয় কীনা তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। পরকালের প্রাপ্তি ছাড়াও ইহকালে নগদ প্রাপ্তির জন্যও কিছু লোক মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসায় টাকা দিয়ে থাকেন। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা মসজিদ মাদ্রাসার জন্য দুই হাতে টাকা বিলিয়ে থাকেন; অবশ্য মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটির লোকজনও চাঁদার জন্য প্রার্থীর কাছে ধরনা দিয়ে থাকেন। চাঁদার বিনিময়ে ইমাম, পুরোহিত আর মাদ্রাসার শিক্ষকেরা প্রার্থীর জয় লাভের জন্য দোয়া করার প্রতিশ্রুতি দেন, অবশ্য এই দোয়া টাকার জন্য সব প্রার্থীকে করা হয়।

অবৈধ জমিতে মসজিদ আর মাদ্রাসা নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সরকার অবৈধ জমি দখলমুক্ত করার অভিযানে নামে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদ-নদীর পাড়ে ১৩১টি মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে। নদী দখল করে গড়ে তোলা মসজিদ-মাদ্রাসার এসব ভবন উচ্ছেদে বাধা এসেছে প্রচণ্ডভাবে; ধর্মপ্রাণ লোক ছাড়াও অবৈধ স্থাপনার অন্য মালিকেরাও এ বাধা প্রদানে ইন্ধন জুগিয়েছেন। এই সবাই অবৈধ মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে তোলার পেছনে একদল আলেমের সমর্থন রয়েছে।তাদের মতে, আল্লাহ পাকের পবিত্র ঘরকে উত্তমরূপে সংরক্ষণের অপরিহার্যতার কথা ধর্মে বলা হয়েছে; তাই মসজিদ একবার হয়ে গেলে তা আর ভাঙা যাবে না, অপসারণ করা যাবে না, উচ্ছেদ করা যাবে নাÑ এমন কী সরকারের খাস জমিতে নির্মিত মসজিদও ভাঙা যাবে না। তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, রাজতন্ত্রে জমির মালিক জনগণ নয় বিধায় রাজতন্ত্রে খাস জমিতে মসজিদ করা বৈধ না হলেও ইযনে আম অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় খাস জমিতে মসজিদ বানানো যায়। এক্ষেত্রে মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্যে খাস জমিতে দাঁড়িয়ে আজান দিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করা হলেই সরকারের সেই খাস জমি মসজিদের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওয়াকফ হয়ে যাবে, এজন্য সরকারের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন নেই।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি জায়গা পছন্দ হলে তিনি মসজিদ করতে মনস্থির করেন; জমির মালিক দুই ভাই তাদের জমি মসজিদের জন্য দান করতে চাইলেও নবী করিম (সা.) এতিম দুই ভাইকে জমির ন্যায্য মূল্য দিয়েই তাতে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। জবরদখল জমিতে মসজিদ নির্মাণ করলে সেটি শরিয়তের বিধান মতে মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে না মর্মে অধিকাংশ আলেম অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ওয়াকফ করা নির্ভেজাল জমিতেই শুধু মসজিদ করা যায়। এর ব্যত্যয় হলে জেনে-শুনে তাতে নামাজ আদায় করা জায়েজ নয় বলে বেশিরভাগ আলেম মত ব্যক্ত করেছেন। কোন কোন আলেমের মতে খাস জায়গায় বিনা অনুমোদনে মসজিদ করা হলে সরকার ইচ্ছে করলে তা ভেঙে দিতে পারবে। এ আলমরা এমনও বলেন যে, রাস্তার জন্য বা অন্য যে কোন জনস্বার্থে সরকার ওয়াকফ করা জমিতে থাকা মসজিদও অপসারণ করতে পারবে। বিএনপির আমলে বগুড়া শহরের প্রতিটি রাস্তা প্রশস্ত করা হয়। রাস্তা প্রশস্ত করার প্রয়োজনে ভাই পাগলা মাজারের মসজিদটির মেহরাবসহ কিছু অংশ ভাঙতে হয়েছিল; আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়া অফিসে কর্মরত, রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য মসজিদের অংশ বিশেষ ভাঙার ক্ষেত্রে কাউকে বিরোধিতা করতে দেখিনি।

অপরাধ সর্বত্র। পরিত্যক্ত গ্যাস লাইন সরানোর দায়িত্ব নিরূপণে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে, নির্গত গ্যাস বন্ধ করার ব্যাপারে মসজিদ কমিটির আবেদনে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, গ্যাসের অবৈধ সংযোগের জন্য তিতাসের লোকেরা দায়ী থাকবে না বলে তিতাসের এক বড় কর্মকর্তা মিডিয়াতে ঘোষণা দিয়েছেন। এ লোকগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ভণ্ড ধার্মিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে দলীয় সরকারের ভোট কমে যাবে। এ সুযোগে লেবাস পরে ধার্মিক সেজে কিছু লোক অবৈধ জায়গায় মসজিদ বানিয়ে, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে মুসল্লিদের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন। অপরাধীদের জানা উচিত, বাহ্যিক লেবাস দিয়ে মানুষ ঠকানো যায়, কিন্তু এ কপটতা সৃষ্টিকর্তার কাছে গোপন করা যাবে না। পোশাক-পরিচ্ছদ, টুপি-পাগড়ি পরে নেকসুরত হয়ে আম জনতাকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব, কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে নয়।

[ লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ৩০ মহররম ১৪৪২, ০২ আশ্বিন ১৪২৭

মসজিদে বিস্ফোরণ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

অতি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায় এক বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেলে এ পর্যন্ত ৩১ জন মুসল্লি দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন; আর যারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাদের অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এছাড়াও বিস্ফোরণের কয়েক দিন আগে থেকেই মসজিদের ভেতর গ্যাসের গন্ধ পেলেও তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। আশির দশকে তিনজন গ্রাহকের জন্য টেনে নেয়া পৌনে এক ইঞ্চির পাইপটি পরিত্যক্ত হলেও তাতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল না। মসজিদের উত্তর পাশের একটি পিলারের বেজমেন্ট রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় পরিত্যক্ত এ গ্যাস পাইপটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্রমান্বয়ে ছয়টি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাইরের এ গ্যাস মসজিদের ভেতরে কিভাবে গেল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মসজিদের ভেতর কয়েক জায়গায় মেঝে ভেদ করে গ্যাস উঠতে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দেখেছেন। তাহলে কি মসজিদের নিচেও গ্যাস লাইন রয়েছে? তদন্ত সম্পন্ন হলে এই সবাই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে, তখন আর আমার লেখা হালনাগাদ করার সুযোগ থাকবে না।

ফতুল্লার এ মসজিদ নির্মাণের সময় কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। মসজিদ একটি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর ভবন হওয়ায় এই ক্ষেত্রে ভবনের নকশায় অনুমোদন নেয়া হলো কী, হলো না তা নিয়ে কর্তৃপক্ষও নির্লিপ্ত থাকে। ধর্ম নিয়ে, উপাসনালয় নিয়ে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলে বিতর্কিত হতে চায় না। স্পর্শকাতর ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আইনের কথা, ন্যায়ের কথা বলে মুরতাদ, নাস্তিক হওয়ার ঝুঁকি কেউ নেয় না বলেই অবৈধ জায়গায় উপাসনালয় গড়ে উঠে, অবৈধ পানি ও বৈদ্যুতিক সংযোগ কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই অনবচ্ছিন্ন থাকে। ফতুল্লার এ মসজিদটি নাকি প্রথমে তিন শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করা হয় এবং পরে আরও তিন শতাংশ জমির ওপর অবৈধভাবে সম্প্রসারণ করা হয়। ধ্বংসের এ বিস্ফোরণে আরও একটি অবৈধ কাজ জড়িত ছিল। মসজিদটিতে দুটি বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে, যার একটি বৈধ আরেকটি অবৈধ। এ দুটি লাইনের সংযোগ সম্ভবত দুর্বল ছিল, একটি লাইনের বিদ্যুৎ চলে গেলে দ্বিতীয় লাইনের বৈদ্যুতিক সুইচ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পার্ক হয় এবং জমা থাকা গ্যাসে আগুন জ্বলে উঠে।

ঢাকা মসজিদের শহর আর বাংলাদেশ মসজিদের দেশ। ভূখণ্ড বিচারে এত বেশি মসজিদ পৃথিবীর আর কোন দেশে সম্ভবত নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সচরাচর কোন মসজিদ পূর্ণ হয় না, কিন্তু শুক্রবারে জুমার নামাজে প্রতিটি মসজিদ পূর্ণ হয়ে যায় এবং এই নামাজে স্থান সংকুলান করতে প্রতিদিন নতুন নতুন মসজিদ হচ্ছে; পুরাতন মসজিদ ভেঙে একই জায়গায় বহুতলা বিশিষ্ট নতুন মসজিদ হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। এ সবাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মসজিদে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হয় না। কারণ দুর্নীতি আর ঘুষের টাকায় অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। মসজিদ নির্মাণের জন্য চাঁদা নেয়ার সময় সাধারণত চাঁদার অর্থের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। কারণ প্রশ্ন তুললে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের টাকায় সুদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, রয়েছে দুর্নীতি আর ঘুষের সংশ্লেষ। এছাড়াও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা কম-বেশি সবার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বাড়ি ভাড়ার সঠিক তথ্য আয়কর বিবরণীতে খুব কম লোকই প্রকাশ করেন, ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার নজির প্রায় সবাই ব্যবসায়ীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, ব্যবসায় লাভ-ক্ষতির প্রকৃত হিসাব লুকানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে বিনা কারণেও আমরা মিথ্যা বলি। মসজিদে আমার দু’বার জুতা চুরি হয়েছে; মসজিদকে এরা ভয় করে না, ভয় করলে মসজিদের ভেতর থেকে জুতা চুরির সাহস করত না। এরা পেটের দায়ে পুরনো জুতা চুরি করে। একদিন এক জুতা চোরকে চুরি করতে দেখেও নীরব ছিলাম। কারণ এদের মেরে নিজের দুর্নীতি ঢাকা দেয়ার জন্য আরও বড় বড় চোর নামাজ পড়তে যায়। অপরাধী লোকগুলো বাদ দিলে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও মাদ্রাসায় দান করার লোক পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ বিমান ব্যতীত অন্য কোন বিদেশি বিমানে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগত; এই অনুমোদন নিতে যারা পাসপোর্ট নিয়ে আসতেন তাদের কাছ থেকে পাগড়ি পরা এক কর্মকর্তা রশিদ দিয়ে মসজিদের জন্য চাঁদা আদায় করতেন। অন্য বিদেশি সংস্থার বিমানে ভ্রমণের অনুমোদন নিতে হলে তাকে চাঁদা দিতেই হতো। কিন্তু আদায় করা এ টাকা সত্যি সত্যি মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা হতো কী না তা কেউ জানতেও চাইত না। কোন বড় অফিসার তার এ অপকর্মে বাধা দিয়েছে বলে শুনিনি। বাসে, ট্রেনে, পার্কে, রাস্তার পাশে বসে চাঁদার বই হাতে নিয়ে মসজিদ নির্মাণের কথা বলে যারা চাঁদা তোলেন তাদের অধিকাংশ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এ কাজটি করে থাকেন; এ টাকা মসজিদ নির্মাণে আদৌ ব্যয় হয় কীনা তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। পরকালের প্রাপ্তি ছাড়াও ইহকালে নগদ প্রাপ্তির জন্যও কিছু লোক মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসায় টাকা দিয়ে থাকেন। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা মসজিদ মাদ্রাসার জন্য দুই হাতে টাকা বিলিয়ে থাকেন; অবশ্য মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটির লোকজনও চাঁদার জন্য প্রার্থীর কাছে ধরনা দিয়ে থাকেন। চাঁদার বিনিময়ে ইমাম, পুরোহিত আর মাদ্রাসার শিক্ষকেরা প্রার্থীর জয় লাভের জন্য দোয়া করার প্রতিশ্রুতি দেন, অবশ্য এই দোয়া টাকার জন্য সব প্রার্থীকে করা হয়।

অবৈধ জমিতে মসজিদ আর মাদ্রাসা নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সরকার অবৈধ জমি দখলমুক্ত করার অভিযানে নামে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদ-নদীর পাড়ে ১৩১টি মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে। নদী দখল করে গড়ে তোলা মসজিদ-মাদ্রাসার এসব ভবন উচ্ছেদে বাধা এসেছে প্রচণ্ডভাবে; ধর্মপ্রাণ লোক ছাড়াও অবৈধ স্থাপনার অন্য মালিকেরাও এ বাধা প্রদানে ইন্ধন জুগিয়েছেন। এই সবাই অবৈধ মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে তোলার পেছনে একদল আলেমের সমর্থন রয়েছে।তাদের মতে, আল্লাহ পাকের পবিত্র ঘরকে উত্তমরূপে সংরক্ষণের অপরিহার্যতার কথা ধর্মে বলা হয়েছে; তাই মসজিদ একবার হয়ে গেলে তা আর ভাঙা যাবে না, অপসারণ করা যাবে না, উচ্ছেদ করা যাবে নাÑ এমন কী সরকারের খাস জমিতে নির্মিত মসজিদও ভাঙা যাবে না। তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, রাজতন্ত্রে জমির মালিক জনগণ নয় বিধায় রাজতন্ত্রে খাস জমিতে মসজিদ করা বৈধ না হলেও ইযনে আম অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় খাস জমিতে মসজিদ বানানো যায়। এক্ষেত্রে মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্যে খাস জমিতে দাঁড়িয়ে আজান দিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করা হলেই সরকারের সেই খাস জমি মসজিদের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওয়াকফ হয়ে যাবে, এজন্য সরকারের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন নেই।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি জায়গা পছন্দ হলে তিনি মসজিদ করতে মনস্থির করেন; জমির মালিক দুই ভাই তাদের জমি মসজিদের জন্য দান করতে চাইলেও নবী করিম (সা.) এতিম দুই ভাইকে জমির ন্যায্য মূল্য দিয়েই তাতে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। জবরদখল জমিতে মসজিদ নির্মাণ করলে সেটি শরিয়তের বিধান মতে মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে না মর্মে অধিকাংশ আলেম অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ওয়াকফ করা নির্ভেজাল জমিতেই শুধু মসজিদ করা যায়। এর ব্যত্যয় হলে জেনে-শুনে তাতে নামাজ আদায় করা জায়েজ নয় বলে বেশিরভাগ আলেম মত ব্যক্ত করেছেন। কোন কোন আলেমের মতে খাস জায়গায় বিনা অনুমোদনে মসজিদ করা হলে সরকার ইচ্ছে করলে তা ভেঙে দিতে পারবে। এ আলমরা এমনও বলেন যে, রাস্তার জন্য বা অন্য যে কোন জনস্বার্থে সরকার ওয়াকফ করা জমিতে থাকা মসজিদও অপসারণ করতে পারবে। বিএনপির আমলে বগুড়া শহরের প্রতিটি রাস্তা প্রশস্ত করা হয়। রাস্তা প্রশস্ত করার প্রয়োজনে ভাই পাগলা মাজারের মসজিদটির মেহরাবসহ কিছু অংশ ভাঙতে হয়েছিল; আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়া অফিসে কর্মরত, রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য মসজিদের অংশ বিশেষ ভাঙার ক্ষেত্রে কাউকে বিরোধিতা করতে দেখিনি।

অপরাধ সর্বত্র। পরিত্যক্ত গ্যাস লাইন সরানোর দায়িত্ব নিরূপণে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে, নির্গত গ্যাস বন্ধ করার ব্যাপারে মসজিদ কমিটির আবেদনে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, গ্যাসের অবৈধ সংযোগের জন্য তিতাসের লোকেরা দায়ী থাকবে না বলে তিতাসের এক বড় কর্মকর্তা মিডিয়াতে ঘোষণা দিয়েছেন। এ লোকগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ভণ্ড ধার্মিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে দলীয় সরকারের ভোট কমে যাবে। এ সুযোগে লেবাস পরে ধার্মিক সেজে কিছু লোক অবৈধ জায়গায় মসজিদ বানিয়ে, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে মুসল্লিদের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন। অপরাধীদের জানা উচিত, বাহ্যিক লেবাস দিয়ে মানুষ ঠকানো যায়, কিন্তু এ কপটতা সৃষ্টিকর্তার কাছে গোপন করা যাবে না। পোশাক-পরিচ্ছদ, টুপি-পাগড়ি পরে নেকসুরত হয়ে আম জনতাকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব, কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে নয়।

[ লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com