বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের পিতা : জেল থেকে জেলে

মোস্তাফা জব্বার

অতি সাধারণভাবেই যদি পাকিস্তানি শাসকেগোষ্ঠীর আচরণ পর্ববেক্ষণ করা যায় তবে এটি অনুভব করা যায় যে তারা যুবক শেখ মুজিবুর রহমানকেই তাদের সরকার পরিচালনার প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে কারণে-অকারণে জেলে বন্দী করে রাখাটাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাড়ায়।

বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, আমরা দিন কাটাচ্ছি জেলে। তখন আমাদের জন্য কথা বলারও কেউ ছিল বলে মনে হয় নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর থেকে একটা বিবৃতি দিলেন। আমরা খবরের কাগজে দেখলাম। আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও চলছে। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হলো। ম্যাজিস্ট্র্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মাওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। আবদুর রউফ, ফজলুল হক ও আমাকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। শাস্তি দিলেই বা কি, না দিলেই বা কি? আমি তো নিরাপত্তা বন্দী আছিই। মাওলানা সাহেবও জেলে ফিরে এলেন, তিনিও নিরাপত্তা বন্দী। আতাউর রহমান সাহেব, কামরুদ্দিন সাহেব ও আরও অনেকে মামলায় আমাদের পক্ষে ছিলেন। আমাকে ডিভিশন দেয়া হয়েছিল। আপিল দায়ের করলেও আমাকে খাটতে হলো। কিছুদিন পর আমাকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল। মাওলানা সাহেবের কাছে এতদিন থাকলাম। তাকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হলো। কিন্তু উপায় নাই। আমি সাজাও ভোগ করছি এবং নিরাপত্তা বন্দীও আছি। ঢাকা জেলে আমাকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। আমি যা পারতাম, তাই করতাম। আমার খুব ভালো লাগত। বসে বসে খেতে শরীর ও মন দুইটাই খারাপ হয়ে পড়ছিল। আমাকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে খুলনা মেলে নিয়ে চলল। খুলনা মেল বরিশাল হয়ে যায়। অনেক রাতে মানিকদহ স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখান থেকে কয়েক মাইল নৌকায় যেতে হয় গোপালগঞ্জ শহরে। আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশ, একজন হাবিলদার, আর তাদের সঙ্গে আছেন দুজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী, একজন দারোগা আর একজন বোধহয় তার আর্দালি বা বডিগার্ড হবে। আমরা শেষ রাতে গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। আমাকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হলো। সকাল বেলা উঠে হাত মুখ দিয়ে প্রস্তুত হতে লাগলাম। খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। ১০টার সময় আমাকে কোর্টে হাজির করল। অনেক লোক জমা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, আমাকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। গোপালগঞ্জ সাবজেলে ডিভিশন কয়েদি ও নিরাপত্তা বন্দী রাখার কোন ব্যবস্থাই নেই। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল। জেলের মধ্যে এক বৎসর হয়েছে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। বাইরে বসে রইলাম পুলিশ আমাকে পাহারা দিচ্ছে। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলাম, তারিখ পড়ে গেল। কারণ ফরিদপুর থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর এসেছেন। তিনি জানালেন, সরকার পক্ষের থেকে মামলাটা পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং আমাকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হলো। আমাকে ফরিদপুর যেতে হবে, সেখান থেকেই মাসে মাসে আসতে হবে, মামলার তারিখের দিনে। অনেকে আমায় দেখতে আসল। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফরিদপুর জেলে আসলাম। জেল কর্তৃপক্ষ পূর্বেই ডিআইজি থেকে খবর পেয়েছে। জেলগেটে পৌঁছালাম সকাল বেলা। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেব অফিসে। ডেপুটি জেলার সাহেবের কামরায় বসলাম। আমার কাগজপত্র দেখলেন। বললেন আপনার তো সাজাও আছে তিন মাস। আবার নিরাপত্তা আইনেও আটকে আছেন। বললাম, বেশি দিন সাজা নাই, এক মাসের বেশি বোধহয় হয়ে গেছে। আমাকে কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন।

শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের একটি কামরা খালি করতে শুনলাম। আমি এই প্রথম ফরিদপুর জেলে আসলাম। একমাস পার হয়ে গেল। আবার গোপালগঞ্জ যাওয়ার সময় হয়েছে। এইভাবে মামলার জন্য তিন চার মাস আমাকে যাওয়া-আসা করতে হলো ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত।

সরকারের জরুরি আদেশ মোতাবেক (৪ জানুয়ারি ১৯৫১) Inspector General of prisons Zvi Awd‡mi memo No 15-con-14151 -তে লিখেছেন :

তথ্য এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ফরিদপুর জেলের সুপারিনটেনডেন্টকে অনুলিপি প্রেরণ করা হয়েছে। বন্দীকে একবার খুলনা কারাগারে স্থানান্তর করা উচিত। বন্দীর স্থানান্তরের তারিখটি এ অফিসে একবার জানানো উচিত।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই সরকারের কাছে আমি লিখলাম, আমাকে বরিশাল বা খুলনা জেলে রাখলে গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা সুবিধা হবে। সোজা খুলনা বা বরিশাল থেকে জাহাজে উঠলে গোপালগঞ্জ যাওয়া যায়। কোন জায়গায় উঠা-নামা করতে হয় না। সরকার সে মত আদেশ দিল, বরিশাল বা খুলনায় আমাকে রাখতে। কর্তৃপক্ষ আমাকে খুলনা জেলে পাঠিয়ে দিলেন। রাজবাড়ী, যশোর হয়ে খুলনা যেতে হলো। খুলনা জেলে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোন জায়গাই নাই। একটা মাত্র দালান। তার মধ্যেই কয়েদি ও হাজতি সবাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমাকে কোথায় রাখবে? একটা সেল আছে, সেখানে ভীষণ প্রকৃতির কয়েদিদের রাখা হয়। জেলার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। বললেন, ‘দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট সেল।’ আমি আবার রাজনৈতিক বন্দী হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। অন্য কোন রাজনৈতিক বন্দীও এ জেলে নাই। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে কেমন করে পাঠাল এখানে! বোধহয় ছয়টা সেল, সেলগুলোর সামনে ১৪ ফিট দেওয়াল। একদিকে ফাঁসির ঘর, অন্যদিকে ৩২টা পায়খানা। যে তিন চার হাত জায়গা আছে সামনে সেখানেও দাঁড়াবার উপায় নাই দুর্গন্ধে। খাবারেরও কোন আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না, কারণ উপায় নাই। একটা সেলে আমাকে রাখা হলো আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিচ্ছে তাই খেতে হবে, রোগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিঁড়া মুড়ি বিস্কুট আমাকে দিয়েছিল। তাই আমাকে খেয়ে বাঁচতে হবে। আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মামলার তারিখ। প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছি। নিরাপত্তা আইনের বন্দীরা ছয় মাস পরপর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। আমার বোধহয় ১৮ মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন অর্ডার এসে খুলনা জেলে পৌঁছায় নাই। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিক্তি করে জেলে রাখবেন? আমি বললাম, ‘অর্ডার যখন আসে নাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দী রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা করে দেব।’ জেল কর্তৃপক্ষ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সঙ্গে আলাপ করলেন, তারা জানালেন তাদের কাছেও কোন অর্ডার নাই যে আমাকে জেলে বন্দী করে রাখতে বলতে পারেন। তবে আমার ওপরে একটা প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল, গোপালগঞ্জ মামলার। কাস্টডি ওয়ারেন্ট নাই যে জেলে রাখবে। অনেক পরামর্শ করে তারা ঠিক করলেন আমাকে গোপালগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দেবে এবং রেড়িওগ্রাম করবে ঢাকায়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অর্ডার গোপালগঞ্জে পৌঁছাতে পারবে। আমাকে জাহাজে পুলিশ পাহারায় গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দিল। গোপালগঞ্জ কোর্টে আমাকে জামিন দিয়ে দিল পরের দিন। বিরাট শোভাযাত্রা করল জনগণ আমাকে নিয়ে। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। রাতে বাড়িতে পৌঁছাবো। আমার গোপালগঞ্জ বাড়িতে বসে আছি। নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছে। যখন নৌকা এসে গেছে, আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা করব ঠিক করেছি এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা কর্মচারী আমার কাছে এসে বলল, ‘একটা কথা আছে।’ কোন পুলিশ তারা আনে নাই। আমার কাছে তখনও একশতের মতো লোক ছিল। আমি উঠে একটু আলাদা হয়ে ওদের কাছে যাই। তারা আমাকে একটা কাগজ দিল। রেড়িওগ্রামে অর্ডার এসেছে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করতে, নিরাপত্তা আইনে। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে চলুন’। কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে আসতে হবে না। আপনি থানায় গেলেই চলবে।’ কারণ, আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলে একটা গোলমাল হতে পারত। আমি সবাইকে ডেকে বললাম, ‘আপনারা হইচই করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেপ্তার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোন দোষ নেই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি।’ নৌকা বিদায় করে দিতে বললাম।। কয়েকজন কর্মী কেঁদে দিল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো।, ‘না যেতে দেব না, তারা কেড়ে নিয়ে যাক।’ আমি ওদের বুজিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল।

এই নির্দেশের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর থেকে খুলনার জেলে স্থানান্তর সম্পর্কে লেখা হয়:

নির্দেশ মোতাবেক আমি কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর কারাগার থেকে খুলনা কারাগারে নিয়ে ১৩-১-৫১ তারিখে উক্ত বন্দীকে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করি। রেফারেন্স : এএসআইয়ের ১৩-১-৫১ তারিখের রিপোর্টেও অনুলিপি। ফরিদপুর ডিআইবি মীর আফসার উদ্দিন, পুলিশ সুপার, ডিআইবি, খুলনা। এফ/এন ৬০৬ -৪৮ পিএফ.পার্ট-৩

শেখ মুজিবকে হয়রানি করতে সরকার সবসময়-ই ব্যস্ত থাকতো দেখা যায়। শেখ মুজিব এমনই এক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যাকে এভাবে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপই সরকার নেয়। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড এক মনস্তাত্তিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, জেলগেটে গ্রেপ্তার, নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার- এসবই এক ধরনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। একই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে তার মুক্তি ও পুনরায় গ্রেপ্তার করার আদেশও লক্ষ্য করা যায়। লক্ষণীয় যে, একই দিন 7th March 1951, Dacca, No- 756, H-S) সংখ্যক স্মারক মারফত শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে দেয়া সরকারি নির্দেশ ছিল:

আশ্চর্যের বিষয় এই আদেশের কপি বিলি করা হলেও Deputy Director, Intelligence Bureau, Government of Pakistan, 8, Kumartali Lane, Dacca, (ডিপুটি ডিরেক্টর, গোয়েন্দা ব্যুরো, পাকিস্তান সরকার, ৮, কুমারটলি লেন, ঢাকা কে নিম্নলিখিত আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবকে পুনরায় ১৮ ধারায় গ্রেপ্তার করা হোক। (৪০) (Ref:F/N-606-48, PF-Part-3) (রেফারেন্স: এফ/এন-৬০৬-৪৮, পিএফ-পার্ট-৩) রেডিও গ্রামের ভাষ্য এ কথাই প্রমাণ করে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারের মনে সবসময়ই ভয়ের উদ্রেক করত। শেখ মুজিবকে বন্দী না করা পর্যন্ত পুলিশ বিভাগের ঘুম হারাম হয়ে যেত। এ কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হতো যে, শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা স্বস্তি পেত না। (৪১) (প্রাগুক্ত) পুলিশ বিভাগ, কারা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য এজেন্সি শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার, পুনরায় গ্রেপ্তার ইত্যাদি কাজ নিয়ে যে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতো তা উপরের রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়। (Ref:F/N-606-48, PF-Part-3)(রেফারেন্স: এফ/এন-৬০৬-৪৮, পিএফ-পার্ট-৩)

১৪ মার্চ ১৯৫৪ সালে ফরিদপুর পুলিশ সুপার SDPO গোপালগঞ্জ Dintell জেলা আইবি Dacca and Supdt, Police DIB Khulna কে -লেখা Radiogram (রেডিওগ্রাম) দ্বারা শেখ মুজিবকে গ্রহণ ও গ্রেপ্তার করার কথা জানানো হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন তারিখে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর ইত্যাদি কাজ এত ঘন ঘন করার মূল লক্ষ্যই ছিল তার মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব কখনোই ভেঙে পড়েননি। (প্রাগুক্ত)। শেখ মুজিবকে নিয়ে জেলের অভ্যন্তরে এ ধরনের আদেশ-নির্দেশ জারি, চালাচালি দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। খুলনা পুলিশ সুপার ডিআইবি ১৪-৩-৫১ তারিখ এসব সরকারি আদেশ নির্দেশের সার-সংক্ষেপ করেছেন নিম্নোক্তভাবে।

সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে তাকে জড়ানোর চক্রান্ত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই করা হয়েছে। যে কোন উপায়ে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংহার করতে বদ্ধপরিকর ছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ এরকম, রাতে আবার থানায় রইলাম, সতের- আঠার মাস পরে ছেড়ে দিয়েও আবার গ্রেপ্তার করার কি কারণ থাকতে পারে? পরের দিন লোক এসে বলল, রাতভর সকলে জেগেছিল বাড়িতে, আমি যে কোন সময় পৌঁছাতে পারি ভেবে। মা অনেক কেঁদেছিল, খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হলো। দু’দিন গোপালগঞ্জ থানায় আমায় থাকতে হল। দু’দিন পর খবর এলো, আমাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যেতে। আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হলো রাজবন্দীদের ওয়ার্ডে।

ঢাকা। প্রথম লেখা : ২৩ জানুয়ারি, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২০ সেপ্টেম্বও, ২০২০।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০২ মহররম ১৪৪২, ০৪ আশ্বিন ১৪২৭

বাঙালির ভাষা রাষ্ট্রের পিতা : জেল থেকে জেলে

মোস্তাফা জব্বার

অতি সাধারণভাবেই যদি পাকিস্তানি শাসকেগোষ্ঠীর আচরণ পর্ববেক্ষণ করা যায় তবে এটি অনুভব করা যায় যে তারা যুবক শেখ মুজিবুর রহমানকেই তাদের সরকার পরিচালনার প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে কারণে-অকারণে জেলে বন্দী করে রাখাটাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাড়ায়।

বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, আমরা দিন কাটাচ্ছি জেলে। তখন আমাদের জন্য কথা বলারও কেউ ছিল বলে মনে হয় নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর থেকে একটা বিবৃতি দিলেন। আমরা খবরের কাগজে দেখলাম। আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও চলছে। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হলো। ম্যাজিস্ট্র্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মাওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। আবদুর রউফ, ফজলুল হক ও আমাকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। শাস্তি দিলেই বা কি, না দিলেই বা কি? আমি তো নিরাপত্তা বন্দী আছিই। মাওলানা সাহেবও জেলে ফিরে এলেন, তিনিও নিরাপত্তা বন্দী। আতাউর রহমান সাহেব, কামরুদ্দিন সাহেব ও আরও অনেকে মামলায় আমাদের পক্ষে ছিলেন। আমাকে ডিভিশন দেয়া হয়েছিল। আপিল দায়ের করলেও আমাকে খাটতে হলো। কিছুদিন পর আমাকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল। মাওলানা সাহেবের কাছে এতদিন থাকলাম। তাকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হলো। কিন্তু উপায় নাই। আমি সাজাও ভোগ করছি এবং নিরাপত্তা বন্দীও আছি। ঢাকা জেলে আমাকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। আমি যা পারতাম, তাই করতাম। আমার খুব ভালো লাগত। বসে বসে খেতে শরীর ও মন দুইটাই খারাপ হয়ে পড়ছিল। আমাকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে খুলনা মেলে নিয়ে চলল। খুলনা মেল বরিশাল হয়ে যায়। অনেক রাতে মানিকদহ স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখান থেকে কয়েক মাইল নৌকায় যেতে হয় গোপালগঞ্জ শহরে। আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশ, একজন হাবিলদার, আর তাদের সঙ্গে আছেন দুজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী, একজন দারোগা আর একজন বোধহয় তার আর্দালি বা বডিগার্ড হবে। আমরা শেষ রাতে গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। আমাকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হলো। সকাল বেলা উঠে হাত মুখ দিয়ে প্রস্তুত হতে লাগলাম। খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। ১০টার সময় আমাকে কোর্টে হাজির করল। অনেক লোক জমা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, আমাকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। গোপালগঞ্জ সাবজেলে ডিভিশন কয়েদি ও নিরাপত্তা বন্দী রাখার কোন ব্যবস্থাই নেই। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল। জেলের মধ্যে এক বৎসর হয়েছে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। বাইরে বসে রইলাম পুলিশ আমাকে পাহারা দিচ্ছে। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলাম, তারিখ পড়ে গেল। কারণ ফরিদপুর থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর এসেছেন। তিনি জানালেন, সরকার পক্ষের থেকে মামলাটা পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং আমাকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হলো। আমাকে ফরিদপুর যেতে হবে, সেখান থেকেই মাসে মাসে আসতে হবে, মামলার তারিখের দিনে। অনেকে আমায় দেখতে আসল। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফরিদপুর জেলে আসলাম। জেল কর্তৃপক্ষ পূর্বেই ডিআইজি থেকে খবর পেয়েছে। জেলগেটে পৌঁছালাম সকাল বেলা। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেব অফিসে। ডেপুটি জেলার সাহেবের কামরায় বসলাম। আমার কাগজপত্র দেখলেন। বললেন আপনার তো সাজাও আছে তিন মাস। আবার নিরাপত্তা আইনেও আটকে আছেন। বললাম, বেশি দিন সাজা নাই, এক মাসের বেশি বোধহয় হয়ে গেছে। আমাকে কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন।

শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের একটি কামরা খালি করতে শুনলাম। আমি এই প্রথম ফরিদপুর জেলে আসলাম। একমাস পার হয়ে গেল। আবার গোপালগঞ্জ যাওয়ার সময় হয়েছে। এইভাবে মামলার জন্য তিন চার মাস আমাকে যাওয়া-আসা করতে হলো ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত।

সরকারের জরুরি আদেশ মোতাবেক (৪ জানুয়ারি ১৯৫১) Inspector General of prisons Zvi Awd‡mi memo No 15-con-14151 -তে লিখেছেন :

তথ্য এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ফরিদপুর জেলের সুপারিনটেনডেন্টকে অনুলিপি প্রেরণ করা হয়েছে। বন্দীকে একবার খুলনা কারাগারে স্থানান্তর করা উচিত। বন্দীর স্থানান্তরের তারিখটি এ অফিসে একবার জানানো উচিত।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই সরকারের কাছে আমি লিখলাম, আমাকে বরিশাল বা খুলনা জেলে রাখলে গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা সুবিধা হবে। সোজা খুলনা বা বরিশাল থেকে জাহাজে উঠলে গোপালগঞ্জ যাওয়া যায়। কোন জায়গায় উঠা-নামা করতে হয় না। সরকার সে মত আদেশ দিল, বরিশাল বা খুলনায় আমাকে রাখতে। কর্তৃপক্ষ আমাকে খুলনা জেলে পাঠিয়ে দিলেন। রাজবাড়ী, যশোর হয়ে খুলনা যেতে হলো। খুলনা জেলে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোন জায়গাই নাই। একটা মাত্র দালান। তার মধ্যেই কয়েদি ও হাজতি সবাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমাকে কোথায় রাখবে? একটা সেল আছে, সেখানে ভীষণ প্রকৃতির কয়েদিদের রাখা হয়। জেলার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। বললেন, ‘দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট সেল।’ আমি আবার রাজনৈতিক বন্দী হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। অন্য কোন রাজনৈতিক বন্দীও এ জেলে নাই। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে কেমন করে পাঠাল এখানে! বোধহয় ছয়টা সেল, সেলগুলোর সামনে ১৪ ফিট দেওয়াল। একদিকে ফাঁসির ঘর, অন্যদিকে ৩২টা পায়খানা। যে তিন চার হাত জায়গা আছে সামনে সেখানেও দাঁড়াবার উপায় নাই দুর্গন্ধে। খাবারেরও কোন আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না, কারণ উপায় নাই। একটা সেলে আমাকে রাখা হলো আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিচ্ছে তাই খেতে হবে, রোগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিঁড়া মুড়ি বিস্কুট আমাকে দিয়েছিল। তাই আমাকে খেয়ে বাঁচতে হবে। আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মামলার তারিখ। প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছি। নিরাপত্তা আইনের বন্দীরা ছয় মাস পরপর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। আমার বোধহয় ১৮ মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন অর্ডার এসে খুলনা জেলে পৌঁছায় নাই। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিক্তি করে জেলে রাখবেন? আমি বললাম, ‘অর্ডার যখন আসে নাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দী রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা করে দেব।’ জেল কর্তৃপক্ষ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সঙ্গে আলাপ করলেন, তারা জানালেন তাদের কাছেও কোন অর্ডার নাই যে আমাকে জেলে বন্দী করে রাখতে বলতে পারেন। তবে আমার ওপরে একটা প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল, গোপালগঞ্জ মামলার। কাস্টডি ওয়ারেন্ট নাই যে জেলে রাখবে। অনেক পরামর্শ করে তারা ঠিক করলেন আমাকে গোপালগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দেবে এবং রেড়িওগ্রাম করবে ঢাকায়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অর্ডার গোপালগঞ্জে পৌঁছাতে পারবে। আমাকে জাহাজে পুলিশ পাহারায় গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দিল। গোপালগঞ্জ কোর্টে আমাকে জামিন দিয়ে দিল পরের দিন। বিরাট শোভাযাত্রা করল জনগণ আমাকে নিয়ে। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। রাতে বাড়িতে পৌঁছাবো। আমার গোপালগঞ্জ বাড়িতে বসে আছি। নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছে। যখন নৌকা এসে গেছে, আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা করব ঠিক করেছি এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা কর্মচারী আমার কাছে এসে বলল, ‘একটা কথা আছে।’ কোন পুলিশ তারা আনে নাই। আমার কাছে তখনও একশতের মতো লোক ছিল। আমি উঠে একটু আলাদা হয়ে ওদের কাছে যাই। তারা আমাকে একটা কাগজ দিল। রেড়িওগ্রামে অর্ডার এসেছে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করতে, নিরাপত্তা আইনে। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে চলুন’। কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে আসতে হবে না। আপনি থানায় গেলেই চলবে।’ কারণ, আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলে একটা গোলমাল হতে পারত। আমি সবাইকে ডেকে বললাম, ‘আপনারা হইচই করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেপ্তার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোন দোষ নেই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি।’ নৌকা বিদায় করে দিতে বললাম।। কয়েকজন কর্মী কেঁদে দিল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো।, ‘না যেতে দেব না, তারা কেড়ে নিয়ে যাক।’ আমি ওদের বুজিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল।

এই নির্দেশের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর থেকে খুলনার জেলে স্থানান্তর সম্পর্কে লেখা হয়:

নির্দেশ মোতাবেক আমি কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর কারাগার থেকে খুলনা কারাগারে নিয়ে ১৩-১-৫১ তারিখে উক্ত বন্দীকে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করি। রেফারেন্স : এএসআইয়ের ১৩-১-৫১ তারিখের রিপোর্টেও অনুলিপি। ফরিদপুর ডিআইবি মীর আফসার উদ্দিন, পুলিশ সুপার, ডিআইবি, খুলনা। এফ/এন ৬০৬ -৪৮ পিএফ.পার্ট-৩

শেখ মুজিবকে হয়রানি করতে সরকার সবসময়-ই ব্যস্ত থাকতো দেখা যায়। শেখ মুজিব এমনই এক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যাকে এভাবে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপই সরকার নেয়। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড এক মনস্তাত্তিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, জেলগেটে গ্রেপ্তার, নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার- এসবই এক ধরনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। একই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে তার মুক্তি ও পুনরায় গ্রেপ্তার করার আদেশও লক্ষ্য করা যায়। লক্ষণীয় যে, একই দিন 7th March 1951, Dacca, No- 756, H-S) সংখ্যক স্মারক মারফত শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে দেয়া সরকারি নির্দেশ ছিল:

আশ্চর্যের বিষয় এই আদেশের কপি বিলি করা হলেও Deputy Director, Intelligence Bureau, Government of Pakistan, 8, Kumartali Lane, Dacca, (ডিপুটি ডিরেক্টর, গোয়েন্দা ব্যুরো, পাকিস্তান সরকার, ৮, কুমারটলি লেন, ঢাকা কে নিম্নলিখিত আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবকে পুনরায় ১৮ ধারায় গ্রেপ্তার করা হোক। (৪০) (Ref:F/N-606-48, PF-Part-3) (রেফারেন্স: এফ/এন-৬০৬-৪৮, পিএফ-পার্ট-৩) রেডিও গ্রামের ভাষ্য এ কথাই প্রমাণ করে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারের মনে সবসময়ই ভয়ের উদ্রেক করত। শেখ মুজিবকে বন্দী না করা পর্যন্ত পুলিশ বিভাগের ঘুম হারাম হয়ে যেত। এ কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হতো যে, শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা স্বস্তি পেত না। (৪১) (প্রাগুক্ত) পুলিশ বিভাগ, কারা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য এজেন্সি শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার, পুনরায় গ্রেপ্তার ইত্যাদি কাজ নিয়ে যে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতো তা উপরের রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়। (Ref:F/N-606-48, PF-Part-3)(রেফারেন্স: এফ/এন-৬০৬-৪৮, পিএফ-পার্ট-৩)

১৪ মার্চ ১৯৫৪ সালে ফরিদপুর পুলিশ সুপার SDPO গোপালগঞ্জ Dintell জেলা আইবি Dacca and Supdt, Police DIB Khulna কে -লেখা Radiogram (রেডিওগ্রাম) দ্বারা শেখ মুজিবকে গ্রহণ ও গ্রেপ্তার করার কথা জানানো হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন তারিখে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর ইত্যাদি কাজ এত ঘন ঘন করার মূল লক্ষ্যই ছিল তার মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব কখনোই ভেঙে পড়েননি। (প্রাগুক্ত)। শেখ মুজিবকে নিয়ে জেলের অভ্যন্তরে এ ধরনের আদেশ-নির্দেশ জারি, চালাচালি দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। খুলনা পুলিশ সুপার ডিআইবি ১৪-৩-৫১ তারিখ এসব সরকারি আদেশ নির্দেশের সার-সংক্ষেপ করেছেন নিম্নোক্তভাবে।

সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে তাকে জড়ানোর চক্রান্ত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই করা হয়েছে। যে কোন উপায়ে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংহার করতে বদ্ধপরিকর ছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ এরকম, রাতে আবার থানায় রইলাম, সতের- আঠার মাস পরে ছেড়ে দিয়েও আবার গ্রেপ্তার করার কি কারণ থাকতে পারে? পরের দিন লোক এসে বলল, রাতভর সকলে জেগেছিল বাড়িতে, আমি যে কোন সময় পৌঁছাতে পারি ভেবে। মা অনেক কেঁদেছিল, খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হলো। দু’দিন গোপালগঞ্জ থানায় আমায় থাকতে হল। দু’দিন পর খবর এলো, আমাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যেতে। আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হলো রাজবন্দীদের ওয়ার্ডে।

ঢাকা। প্রথম লেখা : ২৩ জানুয়ারি, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২০ সেপ্টেম্বও, ২০২০।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com