’৭৫-এর ইনডেমনিটি বিচার ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়েছিল

মোহাম্মদ শাহজাহান

২৬ সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কালো ও কুৎসিত দিন। অমাবস্যার অন্ধকারের চেয়েও কালো এই কলঙ্কিত দিনে শিশু-নারীসহ জাতির পিতার খুনিদের বিচার বন্ধ রাখতে ইনডেমনিটি (অব্যাহতি বা দায়মুক্তি) অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের মদতে সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান (পরে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি) মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের লেলিয়ে দেয়া কুলাঙ্গার ফারুক-রশীদরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুবই নির্মমভাবে হত্যা করে। আর সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট এই ঘাতকচক্র এবং তাদের মদতদাতাদের বিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করতেই ঘাতক অবৈধ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল। জনক হত্যার ২১ বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ আইনের মাধ্যমে বাতিল করে ১৫ আগস্টের জঘন্য হত্যার বিচারের পথ সুগম করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিচারে দণ্ডিত ৫ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয় হত্যার ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে।

যে কোন হত্যাই গর্হিত অপরাধ। পৃথিবীর সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দেয়া হয়। একজন অতিশয় সাধারণ নাগরিকও যাতে অন্যায়ভাবে হত্যা বা নির্যাতনের শিকার না হন, সেই জন্য রয়েছে আইনের বিধান ও এর প্রয়োগের ব্যবস্থা। কোন মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাইকারী জিয়াউর রহমান মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ করেন। আসলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভেতরেই ছিল হত্যাকারীদের অপরাধের আলামত। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এবং তা ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ করাই মোশতাক-জিয়াদের অপরাধ প্রমাণ করে। এটাই প্রমাণ করে মোশতাক জিয়ারা বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন না কোনভাবে অবশ্যই জড়িত ছিল। কথায় আছে, যে কোন অপরাধী তার কৃতকর্মের মাধ্যমে মনের অজান্তেই অপরাধের কথা জানিয়ে দেয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি হচ্ছে আইনের শাসন। সংবিধানের মুখবন্ধে এর উল্লেখ রয়েছে। দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে এতে। আইনের শাসন মানে আদালতের কর্তৃত্ব। আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে ইনডেমনটি অধ্যাদেশ কোন আইন নয়। এটা হত্যাকারীদের অপরাধের একটা আলামত মাত্র। ইনডেমনিটির মধ্যেই অপরাধের ধরন, এর উদ্দেশ্য এবং ভয়াবহতা লুকায়িত রয়েছে। অধ্যাদেশে শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, হত্যাকাণ্ডের পর সরকার পরিবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। বিশ্বের কোনো সভ্য আইন সরকার পরিবর্তনের জন্য এভাবে জঘন্য হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারে না। অবৈধ দখলদার মোশতাকের জারি করা ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর সেই কুখ্যাত অধ্যাদেশের মূল সারসংক্ষেপ হচ্ছে : ‘১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তারিখ ভোরবেলায় তদানিন্তন বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন সাধন এবং সামরিক শাসন প্রবর্তনের প্রয়োজনে কোন ব্যক্তি কোন কার্য করে থাকলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের বা অন্য কোনরূপ আইনগত কার্যক্রম বা শৃঙ্খলামূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কিংবা তৎকর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অন্য কোন ব্যক্তি দায়মুক্তির উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন ব্যক্তিকে কোন সনদপত্র প্রদান করলে উক্ত সনদপত্র উল্লেখিত উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে।’

হত্যার দুই দশক পর ক্ষমতায় এসে কুৎসিত দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করে জনক হত্যার বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কীভাবে বাঙালি জাতিকে দায়মুক্ত করেছিলেন, তা জানতে হলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সুপরিকল্পিতভাবে চক্রান্তের মাধ্যমে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ৩ মাসের মধ্যে মোশতাককে সরিয়ে ১৫ আগস্ট হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসায়। এটা এখন সুস্পষ্ট যে, সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবেই ১৫ আগস্ট জিয়াকে ক্ষমতায় বসানো হয়নি। ১৫ আগস্ট জিয়া রাষ্ট্রপতি হলে সবাই ধরে নিত- হত্যা-ষড়যন্ত্রে তিনি জড়িত। অবশ্য অতি বুদ্ধিমান, ধূর্ত ও চানক্য মোশতাক বুঝতে পারেনি, এভাবে অল্পদিনের মধ্যেই তাকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। বেঈমানদের পরিণতি এমনই হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর মীরজাফরের নবাবীও বেশিদিন টিকেনি।

৬ বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। খুনি কখনও খুনের বিচার করে না। এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার জেনারেল জিয়া শুধু বন্ধ করেননি, জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১২ খুনিকে নিয়োগ দেয়া হয়। পররাষ্ট্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পরবর্তীকালে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত) শমসের মোবিন চৌধুরী লিবিয়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনিদের হাতে-হাতে তাদের নিয়োগপত্র দিয়ে আসেন। কূটনৈতিক পদে নিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিল লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম- প্রথম সচিব (চীন); লে, কর্নেল আজিজ পাশা- প্রথম সচিব (আর্জেন্টিনা), মেজর মহিউদ্দিন- দ্বিতীয় সচিব (আলজেরিয়া), মেজর শাহরিয়ার- দ্বিতীয় সচিব (ইন্দোনেশিয়া), মেজর বজলুল হুদা- দ্বিতীয় সচিব (পাকিস্তান), মেজর রশীদ চৌধুরী- দ্বিতীয় সচিব (ইরান), মেজর শরিফুল হুসেন- দ্বিতীয় সচিব (কুয়েত), ক্যাপ্টেন কিসমত হোসেন- তৃতীয় সচিব (আবুধাবী), লে. খায়রুজ্জামান- তৃতীয় সচিব (মিসর), লে. নজমুল হোসেন- তৃতীয় সচিব (কানাডা), লে. আবদুল মাজেদ- তৃতীয় সচিব (সেনেগাল)। এই খবরটি ১৫ আগস্টের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনবদ্য, সাহসী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারী ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ১৯৮০ সালের ৮ জুলাই প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়ার বিএনপি সরকার আমলে খুনিদের সবাইকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (ফরেন সার্ভিস ক্যাডার) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে এরা সবাই সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত ছিল। জিয়ার দেয়া চাকরি লে. কর্নেল রশিদ ও লে. কর্নেল ফারুক গ্রহণ করেনি। ১৫ আগস্টের সময় ফারুক, রশিদ ও ডালিম মেজর এবং বজলুল হুদা ক্যাপ্টেন ছিল। হত্যাকাণ্ডের পরপর এই ৪ খুনিকে পদোন্নতি দেয়া হয়। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে বরখাস্ত করে জিয়াকে সেনাপ্রধান নিযুক্তির মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।

স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করেন। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে ১৯৯৬ সালের জুনে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। ২৩ জুন ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরশাদ ও বিএনপি আমলে খুনিরা দেশেই রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। রশিদ-ফারুকরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করেছিল। রশিদের জন্মস্থান চান্দিনায় এবং পাশের দাউদকান্দিতে ফ্রিডম পার্টির উৎপাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা তখন খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। খুনি সর্দার রশিদ ওই সময় দোর্দ-প্রতাপে দাউদকান্দির ওপর দিয়ে ফেরিঘাট হয়ে ঢাকা-চান্দিনা যখন-তখন যাতায়াত করেছে। বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলিবর্ষণকারী মেজর বজলুল হুদা এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঘাতক ফারুককে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয় এরশাদ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বাদ দিয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একতরফা নির্বাচনে সব আসনেই জয়ী হন। শোনা যায়, ঘাতক রশিদকে ওই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করা হয়েছিল। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণআন্দোলনে দেড় মাসের মাথায় ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যাই হোক, ২৩ জুন ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ আগস্ট ঘাতক ফারুক, শাহরিয়ার ও খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে।

প্রকৃতপক্ষে ১৫ আগস্টের পর জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা দূরে থাক, বিচার চাওয়াটাও খুব সহজ ছিল না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে আসা বঙ্গবন্ধু কন্যার জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। ওই তিন কুচক্রীই আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করেছে। ২১ আগস্টের (২০০৪) গ্রেনেড হামলা দেশের মানুষসহ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে চিরতরে শেষ করতে জিয়া পরিবার কতটা হিংস্র হতে পারে। তাছাড়া এমন একটা অপপ্রচার ছিল যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এবং দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন ছাড়া এটাকে বাদ দেয়া যাবে না এবং বিচারও করা যাবে না। এখন মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক আইন বিশেষজ্ঞরা ওই সময় বিষয়টি তলিয়ে দেখেননি। কারণ, ১৯৯৬-এর পূর্বে ওই ২১ বছরের অন্ধকার সময়ে কেউ স্পষ্ট করে বলেননি যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথে বড় কোন বাধা নয়। জিয়ার আমলে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল মাত্র। অবশেষে বিলম্বে হলেও আওয়ামী লীগ সরকার এই সত্যটি উদ্ঘাটন ও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেই এই কুখ্যাত অর্ডিন্যান্স বাতিল করা সম্ভব।

এর পরের ইতিহাস সবার জানা। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট গড়িয়ে মামলায় ১২ জনের ফাঁসির রায় বহাল থাকে। এ পর্যন্ত ৬ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছে আর বাকি পাঁচজন বিদেশে চোর-ছেচ্চরের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সাধারণ আদালতে মামলার বিচার হয়েছে। আসামিপক্ষ সব আইনগত সুবিধা ভোগ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনেক গুণাবলির আরেকটি গুণ হলো তিনি প্রতিশোধ পরায়ন নন। ইচ্ছা করলে বিশেষ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার করতে পারতেন। বিলম্বে হলেও জাতির জনক হত্যার বিচার করে শেখ হাসিনা বাঙালি জাতিকে দায়মুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের অনেক ঋণ। বঙ্গবন্ধু অমর ও অবিনশ্বর। কবির ভাষায়- যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান- ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

২০ সেপ্টেম্বও, ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০২ মহররম ১৪৪২, ০৪ আশ্বিন ১৪২৭

’৭৫-এর ইনডেমনিটি বিচার ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়েছিল

মোহাম্মদ শাহজাহান

২৬ সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কালো ও কুৎসিত দিন। অমাবস্যার অন্ধকারের চেয়েও কালো এই কলঙ্কিত দিনে শিশু-নারীসহ জাতির পিতার খুনিদের বিচার বন্ধ রাখতে ইনডেমনিটি (অব্যাহতি বা দায়মুক্তি) অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের মদতে সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান (পরে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি) মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের লেলিয়ে দেয়া কুলাঙ্গার ফারুক-রশীদরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুবই নির্মমভাবে হত্যা করে। আর সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট এই ঘাতকচক্র এবং তাদের মদতদাতাদের বিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করতেই ঘাতক অবৈধ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল। জনক হত্যার ২১ বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ আইনের মাধ্যমে বাতিল করে ১৫ আগস্টের জঘন্য হত্যার বিচারের পথ সুগম করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিচারে দণ্ডিত ৫ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয় হত্যার ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে।

যে কোন হত্যাই গর্হিত অপরাধ। পৃথিবীর সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দেয়া হয়। একজন অতিশয় সাধারণ নাগরিকও যাতে অন্যায়ভাবে হত্যা বা নির্যাতনের শিকার না হন, সেই জন্য রয়েছে আইনের বিধান ও এর প্রয়োগের ব্যবস্থা। কোন মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাইকারী জিয়াউর রহমান মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ করেন। আসলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভেতরেই ছিল হত্যাকারীদের অপরাধের আলামত। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এবং তা ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ করাই মোশতাক-জিয়াদের অপরাধ প্রমাণ করে। এটাই প্রমাণ করে মোশতাক জিয়ারা বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন না কোনভাবে অবশ্যই জড়িত ছিল। কথায় আছে, যে কোন অপরাধী তার কৃতকর্মের মাধ্যমে মনের অজান্তেই অপরাধের কথা জানিয়ে দেয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি হচ্ছে আইনের শাসন। সংবিধানের মুখবন্ধে এর উল্লেখ রয়েছে। দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে এতে। আইনের শাসন মানে আদালতের কর্তৃত্ব। আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে ইনডেমনটি অধ্যাদেশ কোন আইন নয়। এটা হত্যাকারীদের অপরাধের একটা আলামত মাত্র। ইনডেমনিটির মধ্যেই অপরাধের ধরন, এর উদ্দেশ্য এবং ভয়াবহতা লুকায়িত রয়েছে। অধ্যাদেশে শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, হত্যাকাণ্ডের পর সরকার পরিবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। বিশ্বের কোনো সভ্য আইন সরকার পরিবর্তনের জন্য এভাবে জঘন্য হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারে না। অবৈধ দখলদার মোশতাকের জারি করা ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর সেই কুখ্যাত অধ্যাদেশের মূল সারসংক্ষেপ হচ্ছে : ‘১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তারিখ ভোরবেলায় তদানিন্তন বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন সাধন এবং সামরিক শাসন প্রবর্তনের প্রয়োজনে কোন ব্যক্তি কোন কার্য করে থাকলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের বা অন্য কোনরূপ আইনগত কার্যক্রম বা শৃঙ্খলামূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কিংবা তৎকর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অন্য কোন ব্যক্তি দায়মুক্তির উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন ব্যক্তিকে কোন সনদপত্র প্রদান করলে উক্ত সনদপত্র উল্লেখিত উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে।’

হত্যার দুই দশক পর ক্ষমতায় এসে কুৎসিত দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করে জনক হত্যার বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কীভাবে বাঙালি জাতিকে দায়মুক্ত করেছিলেন, তা জানতে হলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সুপরিকল্পিতভাবে চক্রান্তের মাধ্যমে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ৩ মাসের মধ্যে মোশতাককে সরিয়ে ১৫ আগস্ট হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসায়। এটা এখন সুস্পষ্ট যে, সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবেই ১৫ আগস্ট জিয়াকে ক্ষমতায় বসানো হয়নি। ১৫ আগস্ট জিয়া রাষ্ট্রপতি হলে সবাই ধরে নিত- হত্যা-ষড়যন্ত্রে তিনি জড়িত। অবশ্য অতি বুদ্ধিমান, ধূর্ত ও চানক্য মোশতাক বুঝতে পারেনি, এভাবে অল্পদিনের মধ্যেই তাকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। বেঈমানদের পরিণতি এমনই হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর মীরজাফরের নবাবীও বেশিদিন টিকেনি।

৬ বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। খুনি কখনও খুনের বিচার করে না। এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার জেনারেল জিয়া শুধু বন্ধ করেননি, জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১২ খুনিকে নিয়োগ দেয়া হয়। পররাষ্ট্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পরবর্তীকালে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত) শমসের মোবিন চৌধুরী লিবিয়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনিদের হাতে-হাতে তাদের নিয়োগপত্র দিয়ে আসেন। কূটনৈতিক পদে নিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিল লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম- প্রথম সচিব (চীন); লে, কর্নেল আজিজ পাশা- প্রথম সচিব (আর্জেন্টিনা), মেজর মহিউদ্দিন- দ্বিতীয় সচিব (আলজেরিয়া), মেজর শাহরিয়ার- দ্বিতীয় সচিব (ইন্দোনেশিয়া), মেজর বজলুল হুদা- দ্বিতীয় সচিব (পাকিস্তান), মেজর রশীদ চৌধুরী- দ্বিতীয় সচিব (ইরান), মেজর শরিফুল হুসেন- দ্বিতীয় সচিব (কুয়েত), ক্যাপ্টেন কিসমত হোসেন- তৃতীয় সচিব (আবুধাবী), লে. খায়রুজ্জামান- তৃতীয় সচিব (মিসর), লে. নজমুল হোসেন- তৃতীয় সচিব (কানাডা), লে. আবদুল মাজেদ- তৃতীয় সচিব (সেনেগাল)। এই খবরটি ১৫ আগস্টের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনবদ্য, সাহসী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারী ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ১৯৮০ সালের ৮ জুলাই প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়ার বিএনপি সরকার আমলে খুনিদের সবাইকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (ফরেন সার্ভিস ক্যাডার) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে এরা সবাই সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত ছিল। জিয়ার দেয়া চাকরি লে. কর্নেল রশিদ ও লে. কর্নেল ফারুক গ্রহণ করেনি। ১৫ আগস্টের সময় ফারুক, রশিদ ও ডালিম মেজর এবং বজলুল হুদা ক্যাপ্টেন ছিল। হত্যাকাণ্ডের পরপর এই ৪ খুনিকে পদোন্নতি দেয়া হয়। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে বরখাস্ত করে জিয়াকে সেনাপ্রধান নিযুক্তির মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।

স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করেন। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে ১৯৯৬ সালের জুনে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। ২৩ জুন ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরশাদ ও বিএনপি আমলে খুনিরা দেশেই রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। রশিদ-ফারুকরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করেছিল। রশিদের জন্মস্থান চান্দিনায় এবং পাশের দাউদকান্দিতে ফ্রিডম পার্টির উৎপাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা তখন খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। খুনি সর্দার রশিদ ওই সময় দোর্দ-প্রতাপে দাউদকান্দির ওপর দিয়ে ফেরিঘাট হয়ে ঢাকা-চান্দিনা যখন-তখন যাতায়াত করেছে। বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলিবর্ষণকারী মেজর বজলুল হুদা এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঘাতক ফারুককে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয় এরশাদ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বাদ দিয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একতরফা নির্বাচনে সব আসনেই জয়ী হন। শোনা যায়, ঘাতক রশিদকে ওই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করা হয়েছিল। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণআন্দোলনে দেড় মাসের মাথায় ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যাই হোক, ২৩ জুন ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ আগস্ট ঘাতক ফারুক, শাহরিয়ার ও খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে।

প্রকৃতপক্ষে ১৫ আগস্টের পর জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা দূরে থাক, বিচার চাওয়াটাও খুব সহজ ছিল না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে আসা বঙ্গবন্ধু কন্যার জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। ওই তিন কুচক্রীই আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করেছে। ২১ আগস্টের (২০০৪) গ্রেনেড হামলা দেশের মানুষসহ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে চিরতরে শেষ করতে জিয়া পরিবার কতটা হিংস্র হতে পারে। তাছাড়া এমন একটা অপপ্রচার ছিল যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এবং দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন ছাড়া এটাকে বাদ দেয়া যাবে না এবং বিচারও করা যাবে না। এখন মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক আইন বিশেষজ্ঞরা ওই সময় বিষয়টি তলিয়ে দেখেননি। কারণ, ১৯৯৬-এর পূর্বে ওই ২১ বছরের অন্ধকার সময়ে কেউ স্পষ্ট করে বলেননি যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথে বড় কোন বাধা নয়। জিয়ার আমলে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল মাত্র। অবশেষে বিলম্বে হলেও আওয়ামী লীগ সরকার এই সত্যটি উদ্ঘাটন ও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেই এই কুখ্যাত অর্ডিন্যান্স বাতিল করা সম্ভব।

এর পরের ইতিহাস সবার জানা। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট গড়িয়ে মামলায় ১২ জনের ফাঁসির রায় বহাল থাকে। এ পর্যন্ত ৬ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছে আর বাকি পাঁচজন বিদেশে চোর-ছেচ্চরের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সাধারণ আদালতে মামলার বিচার হয়েছে। আসামিপক্ষ সব আইনগত সুবিধা ভোগ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনেক গুণাবলির আরেকটি গুণ হলো তিনি প্রতিশোধ পরায়ন নন। ইচ্ছা করলে বিশেষ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার করতে পারতেন। বিলম্বে হলেও জাতির জনক হত্যার বিচার করে শেখ হাসিনা বাঙালি জাতিকে দায়মুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের অনেক ঋণ। বঙ্গবন্ধু অমর ও অবিনশ্বর। কবির ভাষায়- যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান- ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

২০ সেপ্টেম্বও, ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com