অভিযোগ নেই, মামলাও নেই তারপরও জেলে

প্রতারণার শিকার ৮৩ প্রবাসী প্রতারক ম্যান পাওয়ার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন

‘সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ বা মামলা’ ছাড়াই গত ২২ দিন ধরে জেলে আছেন প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরা ভিয়েতনাম ও কাতার প্রবাসী ৮৩ বাংলাদেশি। অথচ এই প্রবাসীদের যাদের মিথ্যে তথ্যে বিদেশ পাঠিয়ে প্রতারিত করেছে সেইসব রিক্রটিং এজেন্সি ও তাদের দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো পুলিশ এসব প্রতরিত হয়ে সর্বোচ্চ হারানো প্রবাসীদের ‘ভয়ঙ্কর অপরাধী ’উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করে পুলিশ। ওই জিডিতে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের বিরুদ্ধে আদালতে যে অভিযোগহীন ফরওয়ার্ডিং দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার সংগঠন এবং প্রতারিত হওয়া প্রবাসীদের স্বজনরা।

অপরদিকে ভিয়েতনাম পাঠিয়ে প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি রিক্রটিং এজেন্ট ও তার দালাল চক্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েও সেই মামলা এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম ও কাতার ফেরত ৮৩ প্রবাসী শ্রমিককে কেন মুক্তির নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন রিগ্যান নামে এক আইনজীবীর করা রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন রিগ্যান। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম ফেরত ৮১ জন এবং কাতার ফেরত দু’জনসহ মোট ৮৩ শ্রমিকের মুক্তি চেয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করেন আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসকের) সিনিয়র সহকারী পরিচালক (পোগ্রাম) নীনা গোস্বামী সংবাদকে বলেন, ভিয়েতনাম ফেরত যে ৮১ বাংলাদেশিসহ ৮৩ প্রবাসীকে পুলিশ ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়েছে এবং তাদের অপরাধী উল্লেখ করে আদালতে তোলা হয়েছে তা স্পষ্টই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ৫৪ ধারায় কাদের আটক করা যাবে তা নিয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে পুলিশ সে নির্দেশনার লঙ্ঘন করেছে। পুলিশ হাস্যকর কিছু বক্তব্য ডিজিতে তুলে ধরেছে যেমন ওইসব প্রবাসী বিভিন্ন অপরাধ করা, অপরাধের কারণে জেলে থাকা ইত্যাদি। সবচেয়ে হাস্যকর বক্তব্য ছিল পুলিশ লিখেছে, তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে পারিবারিক সহিংসতা ঘটাতে পারে। এগুলো কি উদ্দেশ্য পুলিশ লিখেছে তা তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা আইন ও সালিস কেন্দ্র থেকে তাদের আইনি সহয়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এরমধ্যে অন্য একটি সংস্থা তাদের সহয়তা দিচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, এসব ব্যক্তিদের ভিয়েনতাম পাঠিয়ে কাজ না দিয়ে উল্টো নির্যাতন করা হলেও সে বিষয়গুলো তদন্ত না করে উল্টো এদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। এদের জামিনের বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে হাইকোর্ট থেকে একটি রুল জারি করা হয়েছে। আসকের নীনা গোস্বামী আরও বলেন, কোভিডের কারণ দেখিয়ে তাদের আদালতেও হাজির করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যেসব অভিযোগ এনেছে তার কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন মানুষ বাঁচার জন্য অনেক কিছুই করে। ভিয়েতনাম গিয়ে প্রতারিত হয়ে কাজ না পেয়ে এসব মানুষ হয়তো বাংলাদেশি এম্বাসির সামনে বিক্ষোভ করেছে, দু’একজন হয়তো কোন ঝামেলা করেছে তাই বলে সবাইকে তো এভাবে জেলে দেয়া যায় না। এটি চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।

ভিয়েতনাম কাতার ফেরত ৮৩ প্রবাসীর বিরুদ্ধে তুরাগ থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে পুলিশ (জিডি নং ১২ তারিখ ১.৯.২০২০) বলেছে, ভিয়েতনাম হতে ৮১ জন এবং কাতার হতে ২ জনসহ ৮৩ জন প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যক্তি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে উল্লেখিত (ভিয়েতনাম এবং কাতার) দেশসমূহে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন মর্মে পত্র পাওয়া গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশ বিশেষ বিবেচনায় তাদের সাজা মওকুফ করে মুক্তি প্রদান করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। বাংলাদেশি এ ৮৩ জন বিদেশি অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। যা শ্রম বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তাদের ছেড়ে দেয়া হইলে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, পারিবারিক সহিংসতা, জঙ্গি নাশকতামূলক কর্মকা-সহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া উল্লেখিত ব্যক্তিরা কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী সলাপরামর্শ করেছে বলে তথ্য রয়েছে। তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়।

জানতে চাইলে তুরাগ থানার এসআই আনোয়ার জানান, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ভিয়েতনাম ফেরত ১০৬ জন প্রবাসীর মধ্যে ৮১ জনসহ ৮৩ প্রবাসী ভিয়েতনাম গিয়ে অবৈধভাবে থেকেছেন। দেশে ফিরতে গিয়ে তারা ভিয়েতনামে বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলা ভাঙচুর করেছেন। তারা এসব কাজ করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। বিদেশে শ্রম বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। এসব কারণে তাদের বিরুদ্ধে জিডি করে আটক করা হয়েছে। ডিজির বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে।

জানতে চাইলে ভিয়েতনাম থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের একজন শরীয়তপুরের আলমগীর হাসান (দালালচক্রের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী) জানান, গত জানুয়ারি মাসে তিনি এবং রাশেল নামে দু’জনকে ভিয়েতনামে একটি ইলেক্টনিক্স কোম্পানি কার্টুন প্যাকেজিং কাজ দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশি দালাল মাসুদ রানা। মাসুদ রানার মাধ্যমে পল্টনের রিক্রটিং এজেন্ট এমআরটির ইন্টান্যাশনালের প্রতিনিধি মতিয়ারের সঙ্গে। তখন তারা বলে ভিয়েতনাম গেলে বেতন ৩০ হাজার টাকা দেয়া হবে এবং থাকা খাওয়া কোম্পানি বহন করবে। এজন্য ৪ লাখ করে টাকা লাগবে। ওই দু’জনের কথা বিশ্বাস করে আমি এবং রাশেল ৪ লাখ টাকা করে ৮ লাখ টাকা দেই। তখন আমাদের কি ভিসায় পাঠানো হচ্ছে আমরা যাচই করিনি। এছাড়া তারা আমাদের জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোতে (বিএমআইইটি) নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের বিএমইটির কার্ড করিয়ে দেয়া হয়। জানুয়ারি মাসে আমাদের একটি ফ্লাইটে প্রথমে কলকাতায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েতনামে। ওই ফ্লাইটে আমরা ৬ জন বাংলাদেশি ছিলাম। ভিয়েতনামে পৌঁছার পর বাংলাদেশি দালাল আবদুর রাজ্জাক, অতিক, সাইফুল, মোস্তফা আমাদের রিসিভ করে। তারা সবাই বাংলাদেশি হলেও ভিয়েতনামে বিয়ে করে তারা সেখানে স্থায়ী হয়েছে। তাদের মূল কাজ হলো বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে যাওয়া লোকদের নিয়ন্ত্রণ করা। এ চক্রে ১০ থেকে ১২ জন রয়েছে, যারা ভিয়েতনামে বিয়েশাদি করে স্থায়ী হয়েছে। এদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে থাকা দালাল চক্র চাকরি দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন লোকজন ভিয়েতনামে পাঠায়।

আলমগীর হাসান বলেন, ভিয়েতনামে পৌঁছার পর ভিয়েতনাম প্রবাসী বাংলাদেশি দালাল আবদুর রাজ্জাক, আতিক সাইফুল ও মোস্তফাসহ কয়েকজন আমাদের পাসপোর্ট এবং সঙ্গে থাকা ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ৬ লাখ হবে তা নিয়ে নেয়। আমরা ভিয়েতনাম গিয়ে জানতে পারি, আমাদের কোন কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হয়নি। আর যাদের কোম্পানি রয়েছে, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোন চুক্তিও নেই। তাই তারা আমাদের কাজে নিতে অস্বীকার করে। দালাল চক্র আমাদের দিয়ে ৩ মাস বিচ্ছিন্নভাবে ৭ থেকে ৮টি কোম্পানিতে কাজ করায়। এ সময় আমাদের কোন বেতন দেয়া হয়নি। আমাদের পাঠানো হয়েছে ভ্রমণ ভিসায়। ওই ভিসায় আমাদের মেয়াদ ছিল ৩ মাস। ৩ মাস পর আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আমরা তাদের বলি, আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কোন কোম্পানিতে স্থায়ীভাবে কাজও দেয়া হয়নি। তখন তারা আমাদের নানাভাবে আশ্বাস দিতে থাকে। কিছুদিন পর আমরা বুঝতে পারি আমরা প্রতারিত হয়েছি। প্রতিবাদ করলে তখন আমাদের মারপিট শুরু করে। আলমগীর হাসান জানান, এ চক্রটি এ পর্যন্ত ভিয়েতনামে ১২শ’ বাংলাদেশিকে এভাবে কাজ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এনেছে। দালাল চক্র আমাদের করোনার কথা জানিয়ে বলে, করনোর কারণে সবকিছু বন্ধ। কিন্ত ভিয়েতনামে কোন করোনা ছিল না। করোনার কারণে কোন লকডাউনও করা হয়নি। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। আমরা এসব কথা তুলে ধরলে দালাল চক্র আমাদের উপর নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়। আমাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে আরও ১৫ থেকে ২০ জন বাংলাদেশি ছিল।

গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যে ৮৩ জন প্রবাসীকে জেলে পাঠানো হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ভিয়েতনামে বাংলাদেশি এম্বাসির অফিস ভাঙচুর করেছে। ওই ৮৩ জনসহ ১০৬ জনের যে গ্রুপটি ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফিরেছে তারা প্রত্যেকে ভিয়েতনামে অবৈধ ছিল। সেখানে তাদের কাজ করার কোন অনুমতি ছিল না। দালাল চক্রের মাধ্যমে কাজ করার জন্য তারা ভিয়েতনাম গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা অবৈধ হয়ে যায়। পরে তারা ভিয়েতনামে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এম্বাসির খরচে তাদের দেশে পাঠানোর দাবি নিয়ে তারা বিক্ষোভ করে। সেখানে তারা এম্বাসিতে ব্যাপক ভাঙচুর করে। একসঙ্গে ১ হাজারের মতো বাংলাদেশি জড়ো হয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের অফিসের সামনে বিক্ষোভ করে। এ ঘটনা নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো সংবাদও প্রচার করে। এতে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।

সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই ভিয়েতনামে মানব পাচার করে আসছিল। ওই চক্রটি গত জানুয়ারি মাস থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশি একটি গ্রুপকে চাকরি দেয়ার কথা বলে ভিয়েতনাম পাচার করে। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে যাদের পাঠানো হয়েছে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়া হলেও তাদের কোন কাজ দেয়া হয়নি। একেকজনকে একেক ধরনের ভিসায় পাঠানো হয়েছে, যেসব ভিসার মেয়াদ ছিল ৩ থেকে ৬ মাস। এরপর তারা সেখানে গিয়ে বিপাকে পড়ে। কাজ না পেয়ে বেতন না থাকায় ওই প্রবাসীরা চরম মানবেতর অবস্থায় পড়ে। বিষয়টি আমরা জানতে পারি, কিন্তু ভিকটিমরা তখন ভিয়েতনাম থাকায় আমরা অপেক্ষা করতে থাকি তারা দেশে আসার। গত আগস্ট মাসে প্রতারণার শিকার ১০৬ জনের বাংলাদেশিদের একটি গ্রুপ ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফিরলে তাদের দিয়াবাড়ি কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। সিআইডির মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা ওই প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলে ওই প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণার আদ্যোপান্ত সবকিছু জানে সিআইডির একটি টিম। সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, কি কারণে ফেরত আসা ভিয়েতনাম প্রবাসীদের জেলে পাঠানো হয়েছে তা বোধগম্য নয়। ওই প্রবাসীরা সম্পূর্ণ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক পাঠানো বা সেখানে কাজের জন্য শ্রমিকদের পাঠানোর কোন বৈধ চুক্তি নেই। কিন্তু একটি সংঘবদ্ধ চালাল চক্র বছরের পর বছর ভিয়েতনামে শ্রমিক পাঠিয়ে প্রতারণা করছে। কাজের কথা বলে অথবা চাকরি দিয়ে ভিয়েতনামে ট্যুরিস্টসহ বিভিন্ন ভিসায় শ্রমিক পাঠায়। ওই শ্রমিকরা সেখানে গিয়ে অবৈধ হয়ে যায়। এরপর কাউকে জেলে যেতে হয় অথবা লুকিয়ে কাজ করতে হয়। জমিজমা বিক্রি করে যাওয়া এসব শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এখনও ভিয়েতনামে অবৈধভাবে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলেও আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এখনও ভিয়েতনামে ১২শ’র বেশি বাংলাদেশি রয়েছে যাদের দালাল চক্র পাঠিয়েছে। তবে যে ৮৩ জনকে পুলিশ জেলে পাঠিয়েছে তারা সে দেশে কোন অপরাধ করেনি বলে আমরা জানতে পেরেছি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটির মহাপরিচালক শামছুল আলম তার কার্যালয়ে সংবাদের এ প্রতিবেদককে জানান, ভিয়েতনামে বাংলাদেশের কোন বৈধ শ্রম বাজার না থাকলেও ডিএম ভিসায় অনেকে সেখানে যান। সেখানে গিয়ে তারা কাজ করেন। মেয়াদ শেষে তারা ভিসার মেয়াদ বাড়ান। তবে যে ১০৬ জন ভিয়েতনাম প্রবাসী ফেরত এসেছে তাদের কিভাবে পাঠানো হয়েছে, কারা পাঠিয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে আমরা তদন্ত করছি।

বিএমইটির পরিচালক (ইমিগ্রেশন এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড অ্যাডমিন) ডিএম আতিকুর রহমান তার কার্যালয়ে সংবাদকে জানান. ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফিরে জেলে যাওয় ৮১ জনসহ ফেরত আসা ১০৬ জন যেসব রিক্রটিং এজেন্টের মাধ্যমে ভিয়েতনাম গিয়েছে তাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব শ্রমিক ১১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভিয়েতনাম গিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এরমধ্যে মেসার্স এ ঝরণা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২১ জন, মেসার্স এবিডি এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ৩ জন, মেসার্স আফিফ ইন্টার ন্যাশনাল ১৫ জন, মেসার্স কমেট ওভারসিজ লিমিটেড ৬ জন, মেসার্স ইস্তেমা ইন্টারন্যাশনাল রিক্রটিং এজেন্সির ১১ জন, মেসার্স মা অ্যান্ড মাম ওভারসিজ ১৩ জন, মেসার্স রেজওয়ান ওভারসিজ ১ জন, মেসার্স সন্ধানী ওভারসিজ ২১ জন এবং মেসার্স এসকে গ্লোবাল ওভারসিজ ৭ জন পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় ওইসব রিক্রটিং এজেন্সির কাছ থেকে তাদের ফেরত আনার খবর পরিশোধ করার জন্য বলা হয়েছে। এ ঘটনায় বিএমইটির ঊর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা নাছির উদ্দিনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৪ মহররম ১৪৪২, ০৫ আশ্বিন ১৪২৭

অভিযোগ নেই, মামলাও নেই তারপরও জেলে

প্রতারণার শিকার ৮৩ প্রবাসী প্রতারক ম্যান পাওয়ার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন

সাইফ বাবলু

‘সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ বা মামলা’ ছাড়াই গত ২২ দিন ধরে জেলে আছেন প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরা ভিয়েতনাম ও কাতার প্রবাসী ৮৩ বাংলাদেশি। অথচ এই প্রবাসীদের যাদের মিথ্যে তথ্যে বিদেশ পাঠিয়ে প্রতারিত করেছে সেইসব রিক্রটিং এজেন্সি ও তাদের দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো পুলিশ এসব প্রতরিত হয়ে সর্বোচ্চ হারানো প্রবাসীদের ‘ভয়ঙ্কর অপরাধী ’উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করে পুলিশ। ওই জিডিতে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের বিরুদ্ধে আদালতে যে অভিযোগহীন ফরওয়ার্ডিং দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার সংগঠন এবং প্রতারিত হওয়া প্রবাসীদের স্বজনরা।

অপরদিকে ভিয়েতনাম পাঠিয়ে প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি রিক্রটিং এজেন্ট ও তার দালাল চক্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েও সেই মামলা এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম ও কাতার ফেরত ৮৩ প্রবাসী শ্রমিককে কেন মুক্তির নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন রিগ্যান নামে এক আইনজীবীর করা রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন রিগ্যান। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম ফেরত ৮১ জন এবং কাতার ফেরত দু’জনসহ মোট ৮৩ শ্রমিকের মুক্তি চেয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করেন আইনজীবী সালাউদ্দিন রিগ্যান।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসকের) সিনিয়র সহকারী পরিচালক (পোগ্রাম) নীনা গোস্বামী সংবাদকে বলেন, ভিয়েতনাম ফেরত যে ৮১ বাংলাদেশিসহ ৮৩ প্রবাসীকে পুলিশ ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়েছে এবং তাদের অপরাধী উল্লেখ করে আদালতে তোলা হয়েছে তা স্পষ্টই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ৫৪ ধারায় কাদের আটক করা যাবে তা নিয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে পুলিশ সে নির্দেশনার লঙ্ঘন করেছে। পুলিশ হাস্যকর কিছু বক্তব্য ডিজিতে তুলে ধরেছে যেমন ওইসব প্রবাসী বিভিন্ন অপরাধ করা, অপরাধের কারণে জেলে থাকা ইত্যাদি। সবচেয়ে হাস্যকর বক্তব্য ছিল পুলিশ লিখেছে, তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে পারিবারিক সহিংসতা ঘটাতে পারে। এগুলো কি উদ্দেশ্য পুলিশ লিখেছে তা তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা আইন ও সালিস কেন্দ্র থেকে তাদের আইনি সহয়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এরমধ্যে অন্য একটি সংস্থা তাদের সহয়তা দিচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, এসব ব্যক্তিদের ভিয়েনতাম পাঠিয়ে কাজ না দিয়ে উল্টো নির্যাতন করা হলেও সে বিষয়গুলো তদন্ত না করে উল্টো এদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। এদের জামিনের বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে হাইকোর্ট থেকে একটি রুল জারি করা হয়েছে। আসকের নীনা গোস্বামী আরও বলেন, কোভিডের কারণ দেখিয়ে তাদের আদালতেও হাজির করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যেসব অভিযোগ এনেছে তার কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন মানুষ বাঁচার জন্য অনেক কিছুই করে। ভিয়েতনাম গিয়ে প্রতারিত হয়ে কাজ না পেয়ে এসব মানুষ হয়তো বাংলাদেশি এম্বাসির সামনে বিক্ষোভ করেছে, দু’একজন হয়তো কোন ঝামেলা করেছে তাই বলে সবাইকে তো এভাবে জেলে দেয়া যায় না। এটি চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।

ভিয়েতনাম কাতার ফেরত ৮৩ প্রবাসীর বিরুদ্ধে তুরাগ থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে পুলিশ (জিডি নং ১২ তারিখ ১.৯.২০২০) বলেছে, ভিয়েতনাম হতে ৮১ জন এবং কাতার হতে ২ জনসহ ৮৩ জন প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যক্তি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে উল্লেখিত (ভিয়েতনাম এবং কাতার) দেশসমূহে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন মর্মে পত্র পাওয়া গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশ বিশেষ বিবেচনায় তাদের সাজা মওকুফ করে মুক্তি প্রদান করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। বাংলাদেশি এ ৮৩ জন বিদেশি অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। যা শ্রম বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তাদের ছেড়ে দেয়া হইলে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, পারিবারিক সহিংসতা, জঙ্গি নাশকতামূলক কর্মকা-সহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া উল্লেখিত ব্যক্তিরা কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী সলাপরামর্শ করেছে বলে তথ্য রয়েছে। তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়।

জানতে চাইলে তুরাগ থানার এসআই আনোয়ার জানান, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ভিয়েতনাম ফেরত ১০৬ জন প্রবাসীর মধ্যে ৮১ জনসহ ৮৩ প্রবাসী ভিয়েতনাম গিয়ে অবৈধভাবে থেকেছেন। দেশে ফিরতে গিয়ে তারা ভিয়েতনামে বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলা ভাঙচুর করেছেন। তারা এসব কাজ করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। বিদেশে শ্রম বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। এসব কারণে তাদের বিরুদ্ধে জিডি করে আটক করা হয়েছে। ডিজির বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে।

জানতে চাইলে ভিয়েতনাম থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের একজন শরীয়তপুরের আলমগীর হাসান (দালালচক্রের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী) জানান, গত জানুয়ারি মাসে তিনি এবং রাশেল নামে দু’জনকে ভিয়েতনামে একটি ইলেক্টনিক্স কোম্পানি কার্টুন প্যাকেজিং কাজ দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশি দালাল মাসুদ রানা। মাসুদ রানার মাধ্যমে পল্টনের রিক্রটিং এজেন্ট এমআরটির ইন্টান্যাশনালের প্রতিনিধি মতিয়ারের সঙ্গে। তখন তারা বলে ভিয়েতনাম গেলে বেতন ৩০ হাজার টাকা দেয়া হবে এবং থাকা খাওয়া কোম্পানি বহন করবে। এজন্য ৪ লাখ করে টাকা লাগবে। ওই দু’জনের কথা বিশ্বাস করে আমি এবং রাশেল ৪ লাখ টাকা করে ৮ লাখ টাকা দেই। তখন আমাদের কি ভিসায় পাঠানো হচ্ছে আমরা যাচই করিনি। এছাড়া তারা আমাদের জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোতে (বিএমআইইটি) নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের বিএমইটির কার্ড করিয়ে দেয়া হয়। জানুয়ারি মাসে আমাদের একটি ফ্লাইটে প্রথমে কলকাতায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েতনামে। ওই ফ্লাইটে আমরা ৬ জন বাংলাদেশি ছিলাম। ভিয়েতনামে পৌঁছার পর বাংলাদেশি দালাল আবদুর রাজ্জাক, অতিক, সাইফুল, মোস্তফা আমাদের রিসিভ করে। তারা সবাই বাংলাদেশি হলেও ভিয়েতনামে বিয়ে করে তারা সেখানে স্থায়ী হয়েছে। তাদের মূল কাজ হলো বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে যাওয়া লোকদের নিয়ন্ত্রণ করা। এ চক্রে ১০ থেকে ১২ জন রয়েছে, যারা ভিয়েতনামে বিয়েশাদি করে স্থায়ী হয়েছে। এদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে থাকা দালাল চক্র চাকরি দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন লোকজন ভিয়েতনামে পাঠায়।

আলমগীর হাসান বলেন, ভিয়েতনামে পৌঁছার পর ভিয়েতনাম প্রবাসী বাংলাদেশি দালাল আবদুর রাজ্জাক, আতিক সাইফুল ও মোস্তফাসহ কয়েকজন আমাদের পাসপোর্ট এবং সঙ্গে থাকা ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ৬ লাখ হবে তা নিয়ে নেয়। আমরা ভিয়েতনাম গিয়ে জানতে পারি, আমাদের কোন কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হয়নি। আর যাদের কোম্পানি রয়েছে, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোন চুক্তিও নেই। তাই তারা আমাদের কাজে নিতে অস্বীকার করে। দালাল চক্র আমাদের দিয়ে ৩ মাস বিচ্ছিন্নভাবে ৭ থেকে ৮টি কোম্পানিতে কাজ করায়। এ সময় আমাদের কোন বেতন দেয়া হয়নি। আমাদের পাঠানো হয়েছে ভ্রমণ ভিসায়। ওই ভিসায় আমাদের মেয়াদ ছিল ৩ মাস। ৩ মাস পর আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আমরা তাদের বলি, আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কোন কোম্পানিতে স্থায়ীভাবে কাজও দেয়া হয়নি। তখন তারা আমাদের নানাভাবে আশ্বাস দিতে থাকে। কিছুদিন পর আমরা বুঝতে পারি আমরা প্রতারিত হয়েছি। প্রতিবাদ করলে তখন আমাদের মারপিট শুরু করে। আলমগীর হাসান জানান, এ চক্রটি এ পর্যন্ত ভিয়েতনামে ১২শ’ বাংলাদেশিকে এভাবে কাজ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এনেছে। দালাল চক্র আমাদের করোনার কথা জানিয়ে বলে, করনোর কারণে সবকিছু বন্ধ। কিন্ত ভিয়েতনামে কোন করোনা ছিল না। করোনার কারণে কোন লকডাউনও করা হয়নি। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। আমরা এসব কথা তুলে ধরলে দালাল চক্র আমাদের উপর নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়। আমাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে আরও ১৫ থেকে ২০ জন বাংলাদেশি ছিল।

গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যে ৮৩ জন প্রবাসীকে জেলে পাঠানো হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ভিয়েতনামে বাংলাদেশি এম্বাসির অফিস ভাঙচুর করেছে। ওই ৮৩ জনসহ ১০৬ জনের যে গ্রুপটি ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফিরেছে তারা প্রত্যেকে ভিয়েতনামে অবৈধ ছিল। সেখানে তাদের কাজ করার কোন অনুমতি ছিল না। দালাল চক্রের মাধ্যমে কাজ করার জন্য তারা ভিয়েতনাম গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা অবৈধ হয়ে যায়। পরে তারা ভিয়েতনামে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এম্বাসির খরচে তাদের দেশে পাঠানোর দাবি নিয়ে তারা বিক্ষোভ করে। সেখানে তারা এম্বাসিতে ব্যাপক ভাঙচুর করে। একসঙ্গে ১ হাজারের মতো বাংলাদেশি জড়ো হয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের অফিসের সামনে বিক্ষোভ করে। এ ঘটনা নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো সংবাদও প্রচার করে। এতে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।

সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই ভিয়েতনামে মানব পাচার করে আসছিল। ওই চক্রটি গত জানুয়ারি মাস থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশি একটি গ্রুপকে চাকরি দেয়ার কথা বলে ভিয়েতনাম পাচার করে। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে যাদের পাঠানো হয়েছে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়া হলেও তাদের কোন কাজ দেয়া হয়নি। একেকজনকে একেক ধরনের ভিসায় পাঠানো হয়েছে, যেসব ভিসার মেয়াদ ছিল ৩ থেকে ৬ মাস। এরপর তারা সেখানে গিয়ে বিপাকে পড়ে। কাজ না পেয়ে বেতন না থাকায় ওই প্রবাসীরা চরম মানবেতর অবস্থায় পড়ে। বিষয়টি আমরা জানতে পারি, কিন্তু ভিকটিমরা তখন ভিয়েতনাম থাকায় আমরা অপেক্ষা করতে থাকি তারা দেশে আসার। গত আগস্ট মাসে প্রতারণার শিকার ১০৬ জনের বাংলাদেশিদের একটি গ্রুপ ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফিরলে তাদের দিয়াবাড়ি কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। সিআইডির মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা ওই প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলে ওই প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণার আদ্যোপান্ত সবকিছু জানে সিআইডির একটি টিম। সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, কি কারণে ফেরত আসা ভিয়েতনাম প্রবাসীদের জেলে পাঠানো হয়েছে তা বোধগম্য নয়। ওই প্রবাসীরা সম্পূর্ণ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক পাঠানো বা সেখানে কাজের জন্য শ্রমিকদের পাঠানোর কোন বৈধ চুক্তি নেই। কিন্তু একটি সংঘবদ্ধ চালাল চক্র বছরের পর বছর ভিয়েতনামে শ্রমিক পাঠিয়ে প্রতারণা করছে। কাজের কথা বলে অথবা চাকরি দিয়ে ভিয়েতনামে ট্যুরিস্টসহ বিভিন্ন ভিসায় শ্রমিক পাঠায়। ওই শ্রমিকরা সেখানে গিয়ে অবৈধ হয়ে যায়। এরপর কাউকে জেলে যেতে হয় অথবা লুকিয়ে কাজ করতে হয়। জমিজমা বিক্রি করে যাওয়া এসব শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এখনও ভিয়েতনামে অবৈধভাবে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলেও আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এখনও ভিয়েতনামে ১২শ’র বেশি বাংলাদেশি রয়েছে যাদের দালাল চক্র পাঠিয়েছে। তবে যে ৮৩ জনকে পুলিশ জেলে পাঠিয়েছে তারা সে দেশে কোন অপরাধ করেনি বলে আমরা জানতে পেরেছি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটির মহাপরিচালক শামছুল আলম তার কার্যালয়ে সংবাদের এ প্রতিবেদককে জানান, ভিয়েতনামে বাংলাদেশের কোন বৈধ শ্রম বাজার না থাকলেও ডিএম ভিসায় অনেকে সেখানে যান। সেখানে গিয়ে তারা কাজ করেন। মেয়াদ শেষে তারা ভিসার মেয়াদ বাড়ান। তবে যে ১০৬ জন ভিয়েতনাম প্রবাসী ফেরত এসেছে তাদের কিভাবে পাঠানো হয়েছে, কারা পাঠিয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে আমরা তদন্ত করছি।

বিএমইটির পরিচালক (ইমিগ্রেশন এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড অ্যাডমিন) ডিএম আতিকুর রহমান তার কার্যালয়ে সংবাদকে জানান. ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফিরে জেলে যাওয় ৮১ জনসহ ফেরত আসা ১০৬ জন যেসব রিক্রটিং এজেন্টের মাধ্যমে ভিয়েতনাম গিয়েছে তাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব শ্রমিক ১১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভিয়েতনাম গিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এরমধ্যে মেসার্স এ ঝরণা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২১ জন, মেসার্স এবিডি এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ৩ জন, মেসার্স আফিফ ইন্টার ন্যাশনাল ১৫ জন, মেসার্স কমেট ওভারসিজ লিমিটেড ৬ জন, মেসার্স ইস্তেমা ইন্টারন্যাশনাল রিক্রটিং এজেন্সির ১১ জন, মেসার্স মা অ্যান্ড মাম ওভারসিজ ১৩ জন, মেসার্স রেজওয়ান ওভারসিজ ১ জন, মেসার্স সন্ধানী ওভারসিজ ২১ জন এবং মেসার্স এসকে গ্লোবাল ওভারসিজ ৭ জন পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় ওইসব রিক্রটিং এজেন্সির কাছ থেকে তাদের ফেরত আনার খবর পরিশোধ করার জন্য বলা হয়েছে। এ ঘটনায় বিএমইটির ঊর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা নাছির উদ্দিনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।