ব্যাংকিং খাতে অসৎ ত্রিভুজশক্তি ভাঙতে হবে

গরিবের টাকা শোষণ করে কিছু লোকের পকেটে যাওয়ার হাতিয়ার ব্যাংকিং খাত এই খাত নিয়ে রাজনীতি করার অবস্থা ভঙ্গুর

দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয় ক্ষমতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনীতির সক্ষমতা বেড়েছে। উল্টোদিকে সরকারের সদিচ্ছার অভাবে ব্যাংক খাতে গত চার বছরে অস্তিরতা সৃষ্টি হয়েছে। শৃঙ্খলা নেই, বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ব্যাংকগুলো। দিন যতই এগোচ্ছে ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদের মতে, করোনার সময়ে স্বাস্থ্যবিভাগের ভূমিকা মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি দেশব্যাপী আলোচনা এসেছে। ঠিক ব্যাংক খাতেও একই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। এই খাতকে নিয়ে অবহেলা করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো ধ্বংসের সর্বনি¤œ পর্যায়ের দিকে ঠেলে দেয়ার আগেই পুনঃনজর দিতে হবে সরকারকে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঋণ অনিয়ম, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

গতকাল ব্যাংকিং খাত সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠনসহ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ১০ সুপারিশ করেছে। যেখানে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা সুপারিশ করেছে। টিআইবির ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ এক গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে, ১. ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে। ২. ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’ এর ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। ৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। ৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির (সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ যেমন আর্থিক খাত ও সুশাসন বিষয়ক) সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। ৫. ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে (যেমন, একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা, পরিচালকের মেয়াদ, পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা হ্রাস করা ইত্যাদি)। ৬. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৭. আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশপ্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে। ৮. বারবার পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ৯. ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি করতে হবে, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সীমিত হলেও পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে। ১০. তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ব্যাংকিং খাত সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠনসহ টিআইবির ১০ সুপারিশ করেছে ও ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ সংবাদকে বলেন, টিআইবি’র প্রতিবেদন সরকারের দেখা উচিত। এই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কারণ ব্যাংকগুলোর দেখভালের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সবচেয়ে বেশি শোষিত হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকে যে পরিমাণ ঋণখেলাপি ও দুর্নীতি হয় বেসরকারি ব্যাংকে ততটা হয় না। রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী এই চার ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি ঋণখেলাপি।

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, সরকার আইন করে ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি ছিল না। আগে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে দু’জন পরিচালক থাকতে পারতেন আর এখন আইন করে সেটি চারজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র আরও পাকাপোক্ত হয়েছে এবং ব্যাংকিং খাত ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে ক্ষমতাসীন দলের সরকার উল্টো পথে চলছে। অর্থনীতি খাত নিয়ে রাজনীতি করলে যা হওয়ার তাই হবে, বাংলাদেশে তাই হয়েছে। টিআইবি ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে (যেমন, একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা, পরিচালকের মেয়াদ, পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা হ্রাস করা ইত্যাদি)। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে ব্যাংক খাতে চাঙ্গাভাব চলে আসবে। গরিব মানুষের টাকা শোষণ করে কিছু লোকের পকেটে চলে যাওয়ার হাতিয়ার ব্যাংকিং খাত।

ঋণখেলাপিদের বারবার ব্যাংক ঋণ দেয়ার বিষয়ে বলেন, ২০১৯ সালে খেলাপিদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এভাবে প্রতিবছর ঋণখেলাপির তালিকা থেকে বের হয়ে যান এবং অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ পান। ব্যাংকে ঘুষ দিয়ে লোন পাওয়া যায়।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলেন, ব্যাংকে ঋণ যারা পরিশোধ করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে টিআইবি, সাংবাদিক কিংবা অর্থনীতিবিদদের কথা বললে কি লাভ? ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা গত বিশ বছর ধরেই ব্যাংক খাতে চলে আসছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেয়নি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ সংবাদকে বলেন, যারা দেশের বৃহৎ ঋণখেলাপি তাদের শাস্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। এটি বহুদিন বলা হচ্ছে, সরকার এটি করবে না। কারণ সরকার নিজেই এসব পদের সঙ্গে জড়িত। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত সঠিকভাবে চলবে না।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে অসৎ রাজনীতিবিদ, অসৎ আমলা এবং অসৎ ব্যবসায়ী জড়িত। অনিয়ম হলেও তাদের শাস্তি হয় না। অসৎ ত্রিভুজ ভেঙে ব্যাংকিং খাতে সৎ রাজনীতিবিদ, সৎ আমলা এবং সৎ ব্যবসায়ীদের আনতে হবে। জনগণকে এটি চাইতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতে বিভিন্ন আইন হবে ঠিকই কিন্তু, কার্যকর হবে না। পুরো ব্যাংকিং খাতে যে ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা ও সংকট চলছে।

অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ আরও বলেন, জনগণ যদি টাকার কাছে, পেশির কাছে, ভয়ের কাছে আত্মসমপর্ণ করে তাহলে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম চলতেই থাকবে। আর যারা ভালো মানুষ তারা অনিয়মের বিরুদ্ধে টিআইবির মতো আওয়াজ করবে, প্রেস কনফারেন্স করবে, বিবৃতি দেবেন, সাংবাদিক অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নেবেন সংবাদমাধ্যমে প্রচার হবে তাতে খুব বেশি লাভ হবে না। তবে মানুষকে রাজপথে নামানোর অনুপ্রেরণা দেবে।

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৪ মহররম ১৪৪২, ০৫ আশ্বিন ১৪২৭

টিআইবির সুপারিশ কাজে লাগানোর তাগিদ অর্থনীতিবিদদের

ব্যাংকিং খাতে অসৎ ত্রিভুজশক্তি ভাঙতে হবে

গরিবের টাকা শোষণ করে কিছু লোকের পকেটে যাওয়ার হাতিয়ার ব্যাংকিং খাত এই খাত নিয়ে রাজনীতি করার অবস্থা ভঙ্গুর

ফারুক আলম

দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয় ক্ষমতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনীতির সক্ষমতা বেড়েছে। উল্টোদিকে সরকারের সদিচ্ছার অভাবে ব্যাংক খাতে গত চার বছরে অস্তিরতা সৃষ্টি হয়েছে। শৃঙ্খলা নেই, বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ব্যাংকগুলো। দিন যতই এগোচ্ছে ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদের মতে, করোনার সময়ে স্বাস্থ্যবিভাগের ভূমিকা মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি দেশব্যাপী আলোচনা এসেছে। ঠিক ব্যাংক খাতেও একই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। এই খাতকে নিয়ে অবহেলা করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো ধ্বংসের সর্বনি¤œ পর্যায়ের দিকে ঠেলে দেয়ার আগেই পুনঃনজর দিতে হবে সরকারকে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঋণ অনিয়ম, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

গতকাল ব্যাংকিং খাত সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠনসহ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ১০ সুপারিশ করেছে। যেখানে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা সুপারিশ করেছে। টিআইবির ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ এক গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে, ১. ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে। ২. ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’ এর ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। ৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। ৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির (সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ যেমন আর্থিক খাত ও সুশাসন বিষয়ক) সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। ৫. ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে (যেমন, একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা, পরিচালকের মেয়াদ, পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা হ্রাস করা ইত্যাদি)। ৬. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৭. আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশপ্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে। ৮. বারবার পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ৯. ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি করতে হবে, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সীমিত হলেও পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে। ১০. তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ব্যাংকিং খাত সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠনসহ টিআইবির ১০ সুপারিশ করেছে ও ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ সংবাদকে বলেন, টিআইবি’র প্রতিবেদন সরকারের দেখা উচিত। এই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কারণ ব্যাংকগুলোর দেখভালের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সবচেয়ে বেশি শোষিত হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকে যে পরিমাণ ঋণখেলাপি ও দুর্নীতি হয় বেসরকারি ব্যাংকে ততটা হয় না। রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী এই চার ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি ঋণখেলাপি।

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, সরকার আইন করে ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি ছিল না। আগে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে দু’জন পরিচালক থাকতে পারতেন আর এখন আইন করে সেটি চারজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র আরও পাকাপোক্ত হয়েছে এবং ব্যাংকিং খাত ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে ক্ষমতাসীন দলের সরকার উল্টো পথে চলছে। অর্থনীতি খাত নিয়ে রাজনীতি করলে যা হওয়ার তাই হবে, বাংলাদেশে তাই হয়েছে। টিআইবি ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে (যেমন, একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা, পরিচালকের মেয়াদ, পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা হ্রাস করা ইত্যাদি)। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে ব্যাংক খাতে চাঙ্গাভাব চলে আসবে। গরিব মানুষের টাকা শোষণ করে কিছু লোকের পকেটে চলে যাওয়ার হাতিয়ার ব্যাংকিং খাত।

ঋণখেলাপিদের বারবার ব্যাংক ঋণ দেয়ার বিষয়ে বলেন, ২০১৯ সালে খেলাপিদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এভাবে প্রতিবছর ঋণখেলাপির তালিকা থেকে বের হয়ে যান এবং অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ পান। ব্যাংকে ঘুষ দিয়ে লোন পাওয়া যায়।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলেন, ব্যাংকে ঋণ যারা পরিশোধ করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে টিআইবি, সাংবাদিক কিংবা অর্থনীতিবিদদের কথা বললে কি লাভ? ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা গত বিশ বছর ধরেই ব্যাংক খাতে চলে আসছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেয়নি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ সংবাদকে বলেন, যারা দেশের বৃহৎ ঋণখেলাপি তাদের শাস্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। এটি বহুদিন বলা হচ্ছে, সরকার এটি করবে না। কারণ সরকার নিজেই এসব পদের সঙ্গে জড়িত। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত সঠিকভাবে চলবে না।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে অসৎ রাজনীতিবিদ, অসৎ আমলা এবং অসৎ ব্যবসায়ী জড়িত। অনিয়ম হলেও তাদের শাস্তি হয় না। অসৎ ত্রিভুজ ভেঙে ব্যাংকিং খাতে সৎ রাজনীতিবিদ, সৎ আমলা এবং সৎ ব্যবসায়ীদের আনতে হবে। জনগণকে এটি চাইতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতে বিভিন্ন আইন হবে ঠিকই কিন্তু, কার্যকর হবে না। পুরো ব্যাংকিং খাতে যে ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা ও সংকট চলছে।

অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ আরও বলেন, জনগণ যদি টাকার কাছে, পেশির কাছে, ভয়ের কাছে আত্মসমপর্ণ করে তাহলে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম চলতেই থাকবে। আর যারা ভালো মানুষ তারা অনিয়মের বিরুদ্ধে টিআইবির মতো আওয়াজ করবে, প্রেস কনফারেন্স করবে, বিবৃতি দেবেন, সাংবাদিক অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নেবেন সংবাদমাধ্যমে প্রচার হবে তাতে খুব বেশি লাভ হবে না। তবে মানুষকে রাজপথে নামানোর অনুপ্রেরণা দেবে।