অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

মো. শাহিদুল ইসলাম

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার এখন অনেকেরই হাতের মুঠোয়। বিশ্বায়নের এই যুগে মানবজীবনে প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইন্টারনেটের সম্পৃক্ততা। শিক্ষা, যোগাযোগ, বাণিজ্য, গবেষণা, ভ্রমণ, উৎপাদন, তথ্য সংগ্রহসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই রয়েছে ইন্টারনেট সেবার অনস্বীকার্য অবদান। মোট কথা মানুষের জীবনযাপনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেটের ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তা নেই। সর্বপ্রথম ১৯৯১ সালে জনসাধারণের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার উন্মুক্ত হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু হয় এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। বিটিআরসির দেয়া তথ্যমতে, এপ্রিলে কার্যকর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৩১ লাখ ১ হাজার। এর মধ্যে ৮ কোটি ৪৭ লাখ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং বাকি ৮৩ হাজার ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বায়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলতে হলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। বিআরটিসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা গ্রহণকারীদের প্রায় ৯৫ শতাংশ মোবাইলে ডাটা ব্যবহারকারী। খুবই কমসংখ্যক গ্রাহক ব্রডব্যান্ড ও ওয়াইম্যাক্স ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী যেসব অপারেটর রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রবি, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও টেলিটক। এসব অপারেটরগুলো বিভিন্ন প্যাকেজে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করে থাকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাবল’র জরিপে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেটের প্যাকেজ ও ১ জিবি মূল্য হিসেব করে তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সরবরাহের ক্ষেত্রে ১ নম্বরে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম! ক্যাবলের তথ্যমতে, বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতে ১ জিবি ইন্টারনেটের গড় মূল্য ০.০৯ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশে এর মূল্য ০.৭০ মার্কিন ডলার যা ভারতের তুলনায় অনেক বেশি! HootSuite and We Are Social কর্তৃক ২০১৯ সালে একটি অনলাইন প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী গড় মোবাইল ইন্টারনেট গতি আছে ২৫.৮০ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড। বাংলাদেশ এটি মাত্র ৯.০৬ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড যা বিশ্বব্যাপী গড় গতির তুলনায় অনেক কম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে ইন্টারনেটের গতি সব স্থানে সমানভাবে থাকেনা এবং থাকলে খুবই কম। অথচ বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ডাটার ক্রয়মূল্য অনেক বেশি নিচ্ছে; যা পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সেবা গ্রহণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।

সারাবিশ্ব যখন করোনা নামক ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আক্রান্ত, এরূপ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও করোনার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। সুস্থ্য পৃথিবীতে পুনরায় শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ কিংবা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক দেশসহ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষা কার্যক্রম আগের মতো কখন পরিচালনা করা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মোটকথা, বড় ধরনের একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যমান অনিশ্চয়তার জাল থেকে খানিকটা সরে এসে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমেরর সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়াসে কর্তপক্ষ অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর দৃষ্টির অন্তরালে থাকা প্রতিবন্ধকতাগুলো সামনে আসতে থাকে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডিভাইসের স্বল্পতা, কম গতির ইন্টারনেট এবং ডাটা ক্রয়ে অক্ষমতা। যার ফলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। প্রারম্ভিক সময়ের তুলনায় অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

যেহেতু বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। তাদের অধিকাংশই পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশন করিয়ে নিজ পড়াশুনার খরচ বহন করে থাকে। অনেককে আবার পড়াশুনার ব্যয় বহনের পাশাপাশি নিজ পরিবারের ব্যয়ভারও বহন করতে হয়। করোনাকালীন এ সময়ে অনেক শিক্ষার্থীর উচ্চমূল্যে মোবাইল ডাটা ক্রয়ের আর্থিক সামর্থ্য নেই। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা। ফলে তারা লোডশেডিং, ইন্টারনেটের ধীরগতি ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে; যা শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণে বিমুখ করে তুলছে। বিশেষ করে, দেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে ইন্টারনেটের গতি না থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকেই অনেক কষ্ট করে ডাটা প্যাক কিনেও ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছে না। এক্ষেত্রে তাদের ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা ততটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তারা অনলাইন শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে টেলিটক ইউজিসির প্ল্যাটফর্ম বিডিরেনের মাধ্যমে জুম অ্যাপ ব্যবহার করে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ফ্রি ক্লাসের সুযোগ ও স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেটের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, শুধুমাত্র জেলা পর্যায়ে ছাড়া টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়াই যায় না। উপজেলা, ইউনিয়ন কিংবা গ্রামপর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফোরজি নেটওয়ার্ক প্রদান পরিষেবা শুরু করে। আমরা ফোরজি যুগে প্রবেশ করলেও আক্ষরিক অর্থে ফোরজি ইন্টারনেট সুবিধা কোনভাবেই পাচ্ছি না। দেশে সীমিসংখ্যক টেলিকম কোম্পানি থাকায় অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছেন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা।

পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করতে সরকারের পাশাপাশি মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। টেলিটকের ন্যায় অন্যান্য মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলোর উচিত বিনামূল্যে বা স্বল্পমূলে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা। টেলিটক শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করলেও সারাদেশে টেলিটকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক না থাকায় সুবিধাটি গ্রহণ করতে পারছে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তাছাড়াও আমাদের দেশের বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানিগুলোর ইন্টারনেটের গতি খুবই ধীর, যা শিক্ষার্থীদের বারবার অনলাইন ক্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

এমতাবস্থায় দেশে বিদ্যমান টেলিকম কোম্পানিগুলোর উচিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্য বা স্বল্পমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা। যাতে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। ইন্টারনেটের মূল্য কমিয়ে আনতে অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেটের মূল্য কমাতে হলে অবশ্যই সরকারকে বাজেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের কর এবং খরচ কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার কার্যক্রমকে আরও জোরালো করতে হবে। অন্যথায় দেশ ও জাতির আগামীর কর্ণধারদের একটা বড় অংশ সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। সুতরাং শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে টেলিকম কোম্পানিগুলোর মোবাইল ডাটার মূল্য নির্ধারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান বা বিশেষ সুবিধা প্রদান এবং ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধিতে সরকারের কঠিন আইন প্রণয়নে অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও যুগোপযোগী করা সম্ভব।

shahidulk21ek602a@gmail.com

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৪ মহররম ১৪৪২, ০৫ আশ্বিন ১৪২৭

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

মো. শাহিদুল ইসলাম

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার এখন অনেকেরই হাতের মুঠোয়। বিশ্বায়নের এই যুগে মানবজীবনে প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইন্টারনেটের সম্পৃক্ততা। শিক্ষা, যোগাযোগ, বাণিজ্য, গবেষণা, ভ্রমণ, উৎপাদন, তথ্য সংগ্রহসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই রয়েছে ইন্টারনেট সেবার অনস্বীকার্য অবদান। মোট কথা মানুষের জীবনযাপনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেটের ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তা নেই। সর্বপ্রথম ১৯৯১ সালে জনসাধারণের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার উন্মুক্ত হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু হয় এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। বিটিআরসির দেয়া তথ্যমতে, এপ্রিলে কার্যকর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৩১ লাখ ১ হাজার। এর মধ্যে ৮ কোটি ৪৭ লাখ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং বাকি ৮৩ হাজার ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বায়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলতে হলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। বিআরটিসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা গ্রহণকারীদের প্রায় ৯৫ শতাংশ মোবাইলে ডাটা ব্যবহারকারী। খুবই কমসংখ্যক গ্রাহক ব্রডব্যান্ড ও ওয়াইম্যাক্স ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী যেসব অপারেটর রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রবি, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও টেলিটক। এসব অপারেটরগুলো বিভিন্ন প্যাকেজে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করে থাকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাবল’র জরিপে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেটের প্যাকেজ ও ১ জিবি মূল্য হিসেব করে তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সরবরাহের ক্ষেত্রে ১ নম্বরে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম! ক্যাবলের তথ্যমতে, বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতে ১ জিবি ইন্টারনেটের গড় মূল্য ০.০৯ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশে এর মূল্য ০.৭০ মার্কিন ডলার যা ভারতের তুলনায় অনেক বেশি! HootSuite and We Are Social কর্তৃক ২০১৯ সালে একটি অনলাইন প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী গড় মোবাইল ইন্টারনেট গতি আছে ২৫.৮০ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড। বাংলাদেশ এটি মাত্র ৯.০৬ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড যা বিশ্বব্যাপী গড় গতির তুলনায় অনেক কম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে ইন্টারনেটের গতি সব স্থানে সমানভাবে থাকেনা এবং থাকলে খুবই কম। অথচ বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ডাটার ক্রয়মূল্য অনেক বেশি নিচ্ছে; যা পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সেবা গ্রহণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।

সারাবিশ্ব যখন করোনা নামক ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আক্রান্ত, এরূপ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও করোনার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। সুস্থ্য পৃথিবীতে পুনরায় শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ কিংবা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক দেশসহ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষা কার্যক্রম আগের মতো কখন পরিচালনা করা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মোটকথা, বড় ধরনের একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যমান অনিশ্চয়তার জাল থেকে খানিকটা সরে এসে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমেরর সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়াসে কর্তপক্ষ অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর দৃষ্টির অন্তরালে থাকা প্রতিবন্ধকতাগুলো সামনে আসতে থাকে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডিভাইসের স্বল্পতা, কম গতির ইন্টারনেট এবং ডাটা ক্রয়ে অক্ষমতা। যার ফলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। প্রারম্ভিক সময়ের তুলনায় অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

যেহেতু বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। তাদের অধিকাংশই পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশন করিয়ে নিজ পড়াশুনার খরচ বহন করে থাকে। অনেককে আবার পড়াশুনার ব্যয় বহনের পাশাপাশি নিজ পরিবারের ব্যয়ভারও বহন করতে হয়। করোনাকালীন এ সময়ে অনেক শিক্ষার্থীর উচ্চমূল্যে মোবাইল ডাটা ক্রয়ের আর্থিক সামর্থ্য নেই। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা। ফলে তারা লোডশেডিং, ইন্টারনেটের ধীরগতি ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে; যা শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণে বিমুখ করে তুলছে। বিশেষ করে, দেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে ইন্টারনেটের গতি না থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকেই অনেক কষ্ট করে ডাটা প্যাক কিনেও ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছে না। এক্ষেত্রে তাদের ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা ততটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তারা অনলাইন শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে টেলিটক ইউজিসির প্ল্যাটফর্ম বিডিরেনের মাধ্যমে জুম অ্যাপ ব্যবহার করে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ফ্রি ক্লাসের সুযোগ ও স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেটের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, শুধুমাত্র জেলা পর্যায়ে ছাড়া টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়াই যায় না। উপজেলা, ইউনিয়ন কিংবা গ্রামপর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফোরজি নেটওয়ার্ক প্রদান পরিষেবা শুরু করে। আমরা ফোরজি যুগে প্রবেশ করলেও আক্ষরিক অর্থে ফোরজি ইন্টারনেট সুবিধা কোনভাবেই পাচ্ছি না। দেশে সীমিসংখ্যক টেলিকম কোম্পানি থাকায় অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছেন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা।

পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করতে সরকারের পাশাপাশি মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। টেলিটকের ন্যায় অন্যান্য মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলোর উচিত বিনামূল্যে বা স্বল্পমূলে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা। টেলিটক শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করলেও সারাদেশে টেলিটকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক না থাকায় সুবিধাটি গ্রহণ করতে পারছে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তাছাড়াও আমাদের দেশের বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানিগুলোর ইন্টারনেটের গতি খুবই ধীর, যা শিক্ষার্থীদের বারবার অনলাইন ক্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

এমতাবস্থায় দেশে বিদ্যমান টেলিকম কোম্পানিগুলোর উচিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্য বা স্বল্পমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা। যাতে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। ইন্টারনেটের মূল্য কমিয়ে আনতে অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেটের মূল্য কমাতে হলে অবশ্যই সরকারকে বাজেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের কর এবং খরচ কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার কার্যক্রমকে আরও জোরালো করতে হবে। অন্যথায় দেশ ও জাতির আগামীর কর্ণধারদের একটা বড় অংশ সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। সুতরাং শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে টেলিকম কোম্পানিগুলোর মোবাইল ডাটার মূল্য নির্ধারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান বা বিশেষ সুবিধা প্রদান এবং ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধিতে সরকারের কঠিন আইন প্রণয়নে অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও যুগোপযোগী করা সম্ভব।

shahidulk21ek602a@gmail.com