জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে জনজীবন

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, লকডাউনের ফলে মানুষ বাইরে কম যাওয়ায় এবং কলকারখানা বন্ধ থাকায় পরিবেশ দূষণের হার অনেকটা কমে গিয়েছিল ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে একটা ইতিবাচক দিক ফুটে উঠেছিল বটে কিন্তু লকডাউন খুলে দেয়ায় পূর্বের নেতিবাচক অবস্থা আবারো ফুটে উঠছে।

‘তীব্র নদী ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে কৃষকের আবাদি জমি ও বসতভিটা, প্রচন্ড তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। বন্যার করাল গ্রাস সর্বস্বান্ত করেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গ্রামবাসীদের। অতিরিক্ত লবণাক্ততায় ফসল ফলাতে পারছে না উপকূলের কৃষকরা। প্রতিনিয়ত এরকম হাজারো সংবাদ আমাদের দিনগুলো বিষাদময় করে তুলছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, রাশিয়া, চীন, কানাডা, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী কারণ এ দেশগুলো অধিকমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রকট আকার ধারণ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে আজ এই বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা গত ১০০ বছরে গড়ে প্রায় ০.৭৪ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির দরুন দুই মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। ১৮ আগস্ট ২০২০ ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের এক তথ্যানুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে বরফ গলার যে মডেল আশঙ্কা করা হয়েছিল, আর্কটিক সাগরের বরফ তার চেয়েও অনেক বেশি দ্রুত গলছে। আশংকা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এক-দশমাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন, গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ততা। আমরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫২০০০ একর বনভূমি ধংস করে ফেলছি, যার ফলে কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার ০.১৭ হলেও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি বেশি হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে অনাবৃষ্টিতে খরার প্রকোপ বেড়েই চলেছে, ফলে প্রতি বছর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে,দেশের উত্তর - পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪০০০ বর্গ কিমি ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১৪০০ বর্গ কিমি এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি বন্যাকবলিত হচ্ছে। জোয়ারের কারণে জমিতে লবণাক্ত পানির জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।দেশে বর্তমানে নদীভাঙন যেন এক নতুন অভিশাপ রুপে আবির্ভূত হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপে জানা যায়, প্রায় ১২০০ কিমি নদীতীর ভেঙে গেছে এবং ৫০০ কিমি ভাঙনের সম্মুখীন, জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ভাঙনের পরিমাণ প্রকট আকার ধারণ করবে। এছাড়াও বাড়ছে বজ্রপাত ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ। চলতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৭০ ছাড়িয়েছে, প্রতি বছর এতে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটছে; যা কখনোই কাম্য নয়। এছাড়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা ধরনের দুর্যোগ যা জনজীবনকে আতংকিত করছে। এই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে আমাদের এখনই সচেতন হয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বৈশ্বিক দরবারে জলবায়ুর এই পরিবর্তনকে জোরালোভাবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাতে হবে, যদিও ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার জন্য ৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তবুও এর মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

তাই আমাদের নিজেদের তৃণমূল পযার্য়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচিকে সফল করার জোরদার প্রয়াস চালাতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে এবং নদীভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বনাঞ্চলের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং সবুজ অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্যোগ তহবিল গঠন করতে হবে। ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগে খাদ্য শস্য মজুদ করা এবং কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সর্বোপরি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। এভাবে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা জরুরি।

রুবাইয়া খাতুন

আরও খবর

বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৫ মহররম ১৪৪২, ০৬ আশ্বিন ১৪২৭

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে জনজীবন

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, লকডাউনের ফলে মানুষ বাইরে কম যাওয়ায় এবং কলকারখানা বন্ধ থাকায় পরিবেশ দূষণের হার অনেকটা কমে গিয়েছিল ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে একটা ইতিবাচক দিক ফুটে উঠেছিল বটে কিন্তু লকডাউন খুলে দেয়ায় পূর্বের নেতিবাচক অবস্থা আবারো ফুটে উঠছে।

‘তীব্র নদী ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে কৃষকের আবাদি জমি ও বসতভিটা, প্রচন্ড তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। বন্যার করাল গ্রাস সর্বস্বান্ত করেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গ্রামবাসীদের। অতিরিক্ত লবণাক্ততায় ফসল ফলাতে পারছে না উপকূলের কৃষকরা। প্রতিনিয়ত এরকম হাজারো সংবাদ আমাদের দিনগুলো বিষাদময় করে তুলছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, রাশিয়া, চীন, কানাডা, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী কারণ এ দেশগুলো অধিকমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রকট আকার ধারণ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে আজ এই বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা গত ১০০ বছরে গড়ে প্রায় ০.৭৪ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির দরুন দুই মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। ১৮ আগস্ট ২০২০ ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের এক তথ্যানুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে বরফ গলার যে মডেল আশঙ্কা করা হয়েছিল, আর্কটিক সাগরের বরফ তার চেয়েও অনেক বেশি দ্রুত গলছে। আশংকা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এক-দশমাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন, গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ততা। আমরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫২০০০ একর বনভূমি ধংস করে ফেলছি, যার ফলে কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার ০.১৭ হলেও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি বেশি হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে অনাবৃষ্টিতে খরার প্রকোপ বেড়েই চলেছে, ফলে প্রতি বছর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে,দেশের উত্তর - পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪০০০ বর্গ কিমি ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১৪০০ বর্গ কিমি এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি বন্যাকবলিত হচ্ছে। জোয়ারের কারণে জমিতে লবণাক্ত পানির জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।দেশে বর্তমানে নদীভাঙন যেন এক নতুন অভিশাপ রুপে আবির্ভূত হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপে জানা যায়, প্রায় ১২০০ কিমি নদীতীর ভেঙে গেছে এবং ৫০০ কিমি ভাঙনের সম্মুখীন, জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ভাঙনের পরিমাণ প্রকট আকার ধারণ করবে। এছাড়াও বাড়ছে বজ্রপাত ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ। চলতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৭০ ছাড়িয়েছে, প্রতি বছর এতে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটছে; যা কখনোই কাম্য নয়। এছাড়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা ধরনের দুর্যোগ যা জনজীবনকে আতংকিত করছে। এই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে আমাদের এখনই সচেতন হয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বৈশ্বিক দরবারে জলবায়ুর এই পরিবর্তনকে জোরালোভাবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাতে হবে, যদিও ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার জন্য ৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তবুও এর মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

তাই আমাদের নিজেদের তৃণমূল পযার্য়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচিকে সফল করার জোরদার প্রয়াস চালাতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে এবং নদীভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বনাঞ্চলের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং সবুজ অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্যোগ তহবিল গঠন করতে হবে। ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগে খাদ্য শস্য মজুদ করা এবং কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সর্বোপরি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। এভাবে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা জরুরি।

রুবাইয়া খাতুন