বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ ও এর তাৎপর্য

মারিয়া আক্তার

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম তাৎপর্যবহ সময় ১৯৭৪ সাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহু প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের পথটি ছিল অধিকতর বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির আবেদন করলেও তৎকালীন বৃহৎ শক্তি এবং পাকিস্তানি স্বার্থ সমর্থিত দেশের বিরোধিতায় তা আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় প্রচেষ্টায়, মাত্র দুই বছরের মধ্যেই বিশ্বমানচিত্রে স্ব-গৌরবে স্থান দখল করে নেয় আমাদের প্রিয় দেশ।

১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশন শুরু হয়েছিল। ২৮তম অধিবেশনের সভাপতি ইকুয়েডর প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। সে বছর আফ্রিকা মহাদেশ থেকে সভাপতি নির্বাচনের কথা ছিল এবং আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আজিজ বুতেখলিফাই ছিলেন একমাত্র মনোনয়ন এবং ২৯তম অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই অধিবেশনেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশ হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করে। ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জনের পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বনেতাদের আহ্বানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। এর ফলে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা পেয়েছিল সম্মান যা বাঙালি জাতির জন্য সৃষ্টি করে গর্ব করার অবকাশ। বঙ্গবন্ধুর পূর্বে বাংলা ভাষায় বিশ্ব সভায় কেউ বক্তব্য রাখেননি। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষা বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করেন ঠিকই কিন্তু বিশ্বের কোথাও তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেননি। পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দ্বিতীয় বাঙালি অমর্ত্য সেনও তার বক্তব্য রেখেছিলেন ইংরেজিতে।

সে দিনের (২৫ সেপ্টেম্বর) ভাষণে বঙ্গবন্ধু আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবেই বাংলায় ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা পরবর্তীতে অধিবেশনে উপস্থিত সৌভাগ্যবানদের বক্তব্যে উদ্ধৃত হয়েছে। ‘বাংলা’ ভাষা এবং ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্য, বাঙালি জাতির ত্যাগের মহিমা বিশ্বনেতাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়াই ছিল তার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কারণ। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মৃতির পাতা থেকে অনেক বিশিষ্টজন বলেন, অধিবেশনে সবার উপস্থিতি থাকেনা কিন্তু হিমালয়সম গুণে গুণান্বিত সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের এক মূর্ত প্রতীক, বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে অধিবেশন কক্ষ ছিল পরিপূর্ণ।

নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধুকে ভাষণ প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। অধিবেশন কক্ষের সভাপতি আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুৎখলিফা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়ে যান গলাবন্ধ কোট, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত আভিজাত্যপূর্ণ সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে যা মুগ্ধ করেছিল বিশ্বনেতাদের আসর।

বাঙালি জাতির বহুলপ্রতীক্ষিত সেই ভাষণের আরম্ভে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন ভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালি জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করিয়াছেন। আমি জানি শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ভাষণে তিনি বাংলার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিলেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যপদ অর্জনে সমর্থন প্রদানকারী দেশসমূহকে বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকা কালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের সদস্যপদ করিয়া নেওয়া হইয়াছে, যা অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক’। তাছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দানকারী সব দেশ ও জনগণের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন বাংলাদেশে বন্যা, খড়াসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছিল। এইরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা ভরে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারী বুমেদিনের নামোল্লেখ করে বলেছেন, জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো যাহাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় তাহার জন্য প্রেসিডেন্ট বুমেদিন বিশেষ আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বুমেদিনের এই অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা ভরে পরবর্তীসময়ে অন্যান্য ভাষণেও উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি তার ভাষণে বার্মাসহ (বর্তমান মিয়ানমার) ‘আঞ্চলিক জোন’ গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি তার চিন্তার কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশে শক্তিকাঠামো তৈরি করিয়াছে। আমরা শান্তি চাই, আর শুধু এইজন্যই অতীতের সব গ্লানি ভুলিয়া যাইয়া পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছি। ইহা শান্তির জন্য আমাদের বিনিয়োগ বলিতে পারেন।’

জাতির জনক সেদিন ভাষণে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ সৃষ্টির পর এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী সময়কালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এর আদর্শ বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। জাতিসংঘ সনদে যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলা হয়েছে তা অর্জনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার লাখো লাখো সেনানিকে আত্মাহুতি দিতে হইয়াছে। বেআইনিভাবে এলাকা দখল, জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার নস্যাত করার জন্য শক্তির ব্যবহার এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে চলছে জাতিসংঘের সংগ্রাম। আমাদের আরব ভাইয়েরা এখনও লড়ছেন তাদের ভূমি থেকে জবরদখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের জন্য। প্যালেস্টানিয়ান জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় এখনও অর্জিত হয়নি। ঔপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছেনি এখনোও। এ কথা আফ্রিকার জন্য আরও বেশি সত্য। যেখানে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার জণগন জাতীয় স্বাধীনতা ও চরম মুক্তির জন্য এখনও সংগ্রামে লিপ্ত। বর্ণবৈষম্য এ পরিষদে চরম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তা অনেকের বিবেক নাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যায়-অবিচারের ধারা উৎখাতের সংগ্রাম ও স্বাধীকার অর্জন আন্দোলনের বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে।’

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত অধিকার-হারা মানুষদের কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা মুক্ত, শান্তিময় এক পৃথিবী গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষের তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় পৃথিবীর দিকে আমরা এগুবো না, আমরা তাকাবো এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম। পৃথিবীর সব সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে এমন এক পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে। ফ্যাসিবাদ ও ঔপনিবেশবাদবিরোধী চমৎকার এ ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকার অধিকারী। জাতিসংঘে বাংলাভাষায় প্রথম বক্তৃতা বাঙালি জাতির সংগ্রাম কে অন্যতম মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। জাতির জনকের এই ভাষণ সম্পর্কে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান জাতিসংঘে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এই ভাষণ ছিল একটি শক্তিশালী ভাষণ।’ কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভাষণ কে ‘ইতিহাসের এক অবিচ্ছিন্ন দলিল’ হিসেবে অভিধা করেছিলেন।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, নানা ভাষা-ভাষী ও জাতি-গোষ্ঠীর সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণ বাঙালি জাতিকে জগতসভায় স্ব-আসনে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিল। দীর্ঘ এই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের কথা বিশ্বসভায় উপস্থাপন করে বাঙালি জাতিকে করেছেন গৌরবোজ্জ্বল ও সম্মানিত। চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর এই সময়ে নতুনভাবে সৃষ্ট ‘নিউ নরমাল’ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে না উঠতেই এ বছরের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সময় দরজায় কড়া নাড়ছে। ভার্চুয়াল কানেক্টিভিটির সাহায্যে বিশ্বনেতাদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগদান করার কথা রয়েছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ছিল তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু কন্যা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং তার প্রচেষ্টায় বিশ্বব্যবস্থার উচ্চতর স্তরে পৌঁছে যাবে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৫ মহররম ১৪৪২, ০৬ আশ্বিন ১৪২৭

বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ ও এর তাৎপর্য

মারিয়া আক্তার

image

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম তাৎপর্যবহ সময় ১৯৭৪ সাল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহু প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের পথটি ছিল অধিকতর বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির আবেদন করলেও তৎকালীন বৃহৎ শক্তি এবং পাকিস্তানি স্বার্থ সমর্থিত দেশের বিরোধিতায় তা আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় প্রচেষ্টায়, মাত্র দুই বছরের মধ্যেই বিশ্বমানচিত্রে স্ব-গৌরবে স্থান দখল করে নেয় আমাদের প্রিয় দেশ।

১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশন শুরু হয়েছিল। ২৮তম অধিবেশনের সভাপতি ইকুয়েডর প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। সে বছর আফ্রিকা মহাদেশ থেকে সভাপতি নির্বাচনের কথা ছিল এবং আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আজিজ বুতেখলিফাই ছিলেন একমাত্র মনোনয়ন এবং ২৯তম অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই অধিবেশনেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশ হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করে। ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জনের পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বনেতাদের আহ্বানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। এর ফলে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা পেয়েছিল সম্মান যা বাঙালি জাতির জন্য সৃষ্টি করে গর্ব করার অবকাশ। বঙ্গবন্ধুর পূর্বে বাংলা ভাষায় বিশ্ব সভায় কেউ বক্তব্য রাখেননি। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষা বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করেন ঠিকই কিন্তু বিশ্বের কোথাও তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেননি। পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দ্বিতীয় বাঙালি অমর্ত্য সেনও তার বক্তব্য রেখেছিলেন ইংরেজিতে।

সে দিনের (২৫ সেপ্টেম্বর) ভাষণে বঙ্গবন্ধু আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবেই বাংলায় ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা পরবর্তীতে অধিবেশনে উপস্থিত সৌভাগ্যবানদের বক্তব্যে উদ্ধৃত হয়েছে। ‘বাংলা’ ভাষা এবং ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্য, বাঙালি জাতির ত্যাগের মহিমা বিশ্বনেতাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়াই ছিল তার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কারণ। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মৃতির পাতা থেকে অনেক বিশিষ্টজন বলেন, অধিবেশনে সবার উপস্থিতি থাকেনা কিন্তু হিমালয়সম গুণে গুণান্বিত সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের এক মূর্ত প্রতীক, বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে অধিবেশন কক্ষ ছিল পরিপূর্ণ।

নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধুকে ভাষণ প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। অধিবেশন কক্ষের সভাপতি আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুৎখলিফা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়ে যান গলাবন্ধ কোট, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত আভিজাত্যপূর্ণ সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে যা মুগ্ধ করেছিল বিশ্বনেতাদের আসর।

বাঙালি জাতির বহুলপ্রতীক্ষিত সেই ভাষণের আরম্ভে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন ভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালি জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করিয়াছেন। আমি জানি শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ভাষণে তিনি বাংলার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিলেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যপদ অর্জনে সমর্থন প্রদানকারী দেশসমূহকে বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকা কালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের সদস্যপদ করিয়া নেওয়া হইয়াছে, যা অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক’। তাছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দানকারী সব দেশ ও জনগণের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন বাংলাদেশে বন্যা, খড়াসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছিল। এইরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা ভরে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারী বুমেদিনের নামোল্লেখ করে বলেছেন, জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো যাহাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় তাহার জন্য প্রেসিডেন্ট বুমেদিন বিশেষ আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বুমেদিনের এই অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা ভরে পরবর্তীসময়ে অন্যান্য ভাষণেও উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি তার ভাষণে বার্মাসহ (বর্তমান মিয়ানমার) ‘আঞ্চলিক জোন’ গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি তার চিন্তার কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশে শক্তিকাঠামো তৈরি করিয়াছে। আমরা শান্তি চাই, আর শুধু এইজন্যই অতীতের সব গ্লানি ভুলিয়া যাইয়া পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছি। ইহা শান্তির জন্য আমাদের বিনিয়োগ বলিতে পারেন।’

জাতির জনক সেদিন ভাষণে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ সৃষ্টির পর এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী সময়কালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এর আদর্শ বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। জাতিসংঘ সনদে যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলা হয়েছে তা অর্জনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার লাখো লাখো সেনানিকে আত্মাহুতি দিতে হইয়াছে। বেআইনিভাবে এলাকা দখল, জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার নস্যাত করার জন্য শক্তির ব্যবহার এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে চলছে জাতিসংঘের সংগ্রাম। আমাদের আরব ভাইয়েরা এখনও লড়ছেন তাদের ভূমি থেকে জবরদখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের জন্য। প্যালেস্টানিয়ান জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় এখনও অর্জিত হয়নি। ঔপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছেনি এখনোও। এ কথা আফ্রিকার জন্য আরও বেশি সত্য। যেখানে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার জণগন জাতীয় স্বাধীনতা ও চরম মুক্তির জন্য এখনও সংগ্রামে লিপ্ত। বর্ণবৈষম্য এ পরিষদে চরম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তা অনেকের বিবেক নাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যায়-অবিচারের ধারা উৎখাতের সংগ্রাম ও স্বাধীকার অর্জন আন্দোলনের বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে।’

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত অধিকার-হারা মানুষদের কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা মুক্ত, শান্তিময় এক পৃথিবী গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষের তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় পৃথিবীর দিকে আমরা এগুবো না, আমরা তাকাবো এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম। পৃথিবীর সব সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে এমন এক পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে। ফ্যাসিবাদ ও ঔপনিবেশবাদবিরোধী চমৎকার এ ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকার অধিকারী। জাতিসংঘে বাংলাভাষায় প্রথম বক্তৃতা বাঙালি জাতির সংগ্রাম কে অন্যতম মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। জাতির জনকের এই ভাষণ সম্পর্কে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান জাতিসংঘে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এই ভাষণ ছিল একটি শক্তিশালী ভাষণ।’ কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভাষণ কে ‘ইতিহাসের এক অবিচ্ছিন্ন দলিল’ হিসেবে অভিধা করেছিলেন।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, নানা ভাষা-ভাষী ও জাতি-গোষ্ঠীর সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণ বাঙালি জাতিকে জগতসভায় স্ব-আসনে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিল। দীর্ঘ এই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের কথা বিশ্বসভায় উপস্থাপন করে বাঙালি জাতিকে করেছেন গৌরবোজ্জ্বল ও সম্মানিত। চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর এই সময়ে নতুনভাবে সৃষ্ট ‘নিউ নরমাল’ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে না উঠতেই এ বছরের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সময় দরজায় কড়া নাড়ছে। ভার্চুয়াল কানেক্টিভিটির সাহায্যে বিশ্বনেতাদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগদান করার কথা রয়েছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ছিল তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু কন্যা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং তার প্রচেষ্টায় বিশ্বব্যবস্থার উচ্চতর স্তরে পৌঁছে যাবে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়