করোনা জয়ের অম্ল-মধুর দিনগুলো

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বড়ছেলে উহান থেকে ফিরেছে সেই মার্চে, ওর পিএইচডির গবেষণা শেষ না করেই। কবে যেতে পারবে উহানে তার ঠিক নেই। সবকিছু এখনও বন্ধ রয়েছে সেখানে। এ নিয়ে ভাবনা রয়েছে মনে। আমি মালিবাগে যে বাড়িতে থাকি সেখানে গত চার মাসে আমি পঞ্চমতলা থেকে নিচে নামিনি। ছাদে হেঁটে বেড়ানোও বন্ধ রেখেছি। ঘরের ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে রোজ সকালে কমপক্ষে আধঘণ্টা রোদ গায়ে মেখেছি। বাইরে বেরোতে পারি না বলে সকালের রোদ গায়ে লাগাতে ছোট্ট ব্যালকনিই ভরসা। করোনার বিরুদ্ধে লড়তে শরীরে শক্তি সঞ্চার দরকার। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয় বিস্তর। চিকিৎসক, পুষ্টিবিদরা নিয়ত পরামর্শ দেন। করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পেতে দেহের ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিষেধক শক্তি বাড়ানো প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন ভিটামিন-ডি। সূর্যকিরণে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন-ডি। এজন্য একে ‘সানসাইন ভিটামিন’ বলা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়েছি আমি। সব ধরনের খাবার খেয়েছি নিজে পরিষ্কার করে। বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি। হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে ছয় বছর হলো। স্ট্যান্টিং করা হয়েছে দু-জায়গায়। ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছে তাও বছর ১৫ হবে। কোন রোগই আমাকে ছাড়েনি।

আমার ছোটোছেলে পেশায় স্থপতি। করোনা বিস্তার লাভ করার পর থেকে পাঁচ মাস ঘরে বসে একেবারে কর্মহীন কাটিয়ে দিয়েছে। কোন চাকরি করে না ও। বুয়েট থেকে পাস করে ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে অনেক প্রচেষ্টায়। ও চেয়েছিলে পরিবারের অন্য সবার মতো চাকরি না করে বরং অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে। খানিকটা সফলও হয়েছিল সামান্য ক’বছর কাজ করে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওর কাজ বন্ধ থেকেছে চার মাস। করোনা শিগগির ছেড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই কাজে না নেমে উপায় নেই। সকালে সামান্য কিছু খেয়ে ছেলেটা বেরিয়ে যায়। ওর সারা শরীর, নাক-মুখ ঢাকা। মাথায় ক্যাপ। মনে হয় চন্দ্রাভিযানে যাচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। কী করে বারণ করি ওকে। দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলোর দিকে চেয়ে থাকি অসহায়ের মতো। ওর নেমে যাওয়ার শব্দ অস্পষ্ট হতে থাকে ক্রমশ। ও ঘরে ফিরে না আসা অবধি বুকের ধুকধুকানি থামে না।

জুনের ৩০ তারিখে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো আমার। সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা। মনে হচ্ছে শরীরের জোড়াগুলো খুলে যাচ্ছে। সকালবেলা কথাটা শুনে সবার চোখে-মুখে চিন্তার রেখা। এমনিতেই শরীরের অবস্থা ভালো নয়। সারা দিনে খেতে হয় এক গাদা ওষুধ। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরায় রয়েছে বিধিনিষেধ। এ অবস্থায় করোনার আঘাত সইতে পারা বড্ড কঠিন হয়ে যাবে! ছোটো ছেলেটাকে বাইরে যেতে হয় বলে ওর মাঝে রয়েছে অপরাধবোধ। করোনাভাইরাস বয়ে নিয়ে এসে যদি ঘরের কাউকে সংক্রমিত করে দেয়! ও একা শোয় ওপরের তলার ঘরটায়। বাহির থেকে এসে আলাদা বাথরুমে স্নান করে। কাপড় পাল্টায়, তারপর সবার সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ৩০ জুন আমার মতো অবস্থাই হলো ওর। সকালবেলা প্রচ- জ¦র নিয়ে নিচে নেমে এলো ছেলেটা। ওর চোখ দুটো লাল। বললো, সর্বাঙ্গে ব্যথা। আমার অবস্থা শুনে শঙ্কিত ছেলে। বাবার বয়স হয়েছে অনেক। রয়েছে নানা শারীরিক সমস্যা।

প্রথমে প্যারাসিটামল দু-একটা খেলে জ্বর কমে আসে। কিন্তু কাশি বাড়তেই থাকে ক্রমশ। সঙ্গে খেতে অরুচি। আলাপ করি আমার ছোটোভাইয়ের সঙ্গে। সে পেশায় চিকিৎসক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। কাল বিলম্ব না করে অ্যান্টিবায়োটিক জিম্যাক্স-৫০০ মিলিগ্রাম রোজ একটা করে খেতে বলে। সঙ্গে অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট। এভাবে তিন-চার দিন কেটে যায়। কিন্তু জ্বর থেমে এলেও কাশি কিছুতেই কমছে না। ৫ জুলাই বাসায় লোক আসে। মুখের লালা নিয়ে যায় সবার। পরের দিন রেজাল্ট আসে করোনা পজিটিভ। বাসার সবাই করোনা আক্রান্ত। পুরো বাসাটা রূপ নেয় হাসপাতালে। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। কে রান্না করবে, কে কাকে খাবার তুলে দেবে। অসুস্থতা নিয়েই সবার সক্রিয় সহযোগিতায় ঘরের দৈনন্দিন কজকর্ম চলে। করোনা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই টিকিৎসকের পরামর্শে একই ধরনের ওষুধ খেতে শুরু করে। ‘আইভারমেকটিন’ নামের একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, সঙ্গে এজিত্রোমাইসিন বা ডক্সিসাইক্লিন, আর করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে জিঙ্ক ও ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট। প্রতিদিন তিন-চার বার করে আদা-গরম পানি পান আর ভাপ নেয়া চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পর সবার অক্সিজেন ক্যাপাসিটি মাপা হয়। বড় ছেলে একটি অক্সিজেন কনডেন্সার সেট বাসায় এনে রেখে দেয়। সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে কারও নিঃশ^াসকষ্ট হয়নি। যেতে হয়নি হাসপাতালে। ঘুমের সমস্যার জন্য চা পান বাদ দিয়েছিলাম বেশ ক’বছর থেকে। কিন্তু করোনা আক্রান্তের পর থেকে আদার সঙ্গে সবুজ চা পান শুরু করেছি। আর সারা দিনে এক দু-বার মুরগির স্যুপ, সকালে দুটো সেদ্ধ ডিমের শে^তাংশ। জীবনে অনেক কঠিন অসুখ হয়েছে। কোনোটার কষ্ট কোনোটার চেয়ে কম নয়। তবে এবারকার করোনাভাইরাস নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে। সে এক না-বলা যন্ত্রণা শরীরজুড়ে। কিছুতেই যেন স্বস্তি মিলছিল না। নির্ঘুম কেটে যায় প্রায় ১৫ দিন। শুধু ভয়, শ্বাসকষ্ট হলে বাসায় চিকিৎসা চলবে না। অলস মনে শুধু হাসপাতালের করুণ চিত্র ভেসে উঠেছে। হাসপাতালে চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অব্যবস্থাপনা। জীবন বাজি রেখে চিকিৎসকদের সেবাব্রত রক্ষার মরণপণ প্রচেষ্টা। রোগীকে প্রাণে বাাঁচিয়ে তোলার আকুতি। করোনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণ বিসর্জন- আমাকে অবাক করে দেয়।

অন্য সবার লক্ষণগুলে ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও আমার শরীরের অস্থিরতা, কিছু খেতে না-পারা চলে সপ্তাহ দুয়েক। ১৫ দিনে পরে আবার করোনা টেস্ট করা হলো। সবার নেগেটিভ হলেও আমার রেজাল্ট তখনও পজিটিভ। মাত্রাতিরোক্ত কাশির কারণে গলায় ‘থ্রোট শোর’ হয়েছে। কণ্ঠস্বরের সমস্যার কারণে কথা বলা বন্ধ রেখেছি প্রায় এক মাস ধরে। আত্মীয়, বন্ধু সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছি। আমি যেন এক ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গেছি। করোনা পরীক্ষাকারী সংস্থা জানিয়েছে, ভাইরাসগুলো নির্জীব হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। আমিও টের পাচ্ছি করোনার উপসর্গগুলো কমে যাচ্ছে। অল্প-বিস্তর খেতেও পারছি। হয়তো বা আমি এগিয়ে চলেছি করোনা জয়ের পথে। করোনা আজ মানুষকে নতুন এক পৃথিবীর সামনে দাঁড় করিয়েছে। এ যেন এক অজানা, অচেনা পৃথিবী! করোনা যেন আজ মার্স, সার্স, ইবোলা’র চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে এসেছে। প্রাণঘাতী সেই প্লেগের ভয়াবহ দিনকে কি হার মানাতে যাচ্ছে কোভিড-১৯। করোনাভাইরাস থেকে নিরাময়ের তেমন কোন নির্ভরযোগ্য ওষুধ বেরোয়নি আজও। তবে রেমডেসিভির নামের ওষুধটি বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই বাজারজাত হয়েছে। এটির প্রয়োগও হচ্ছে কোথাও কোথাও। তবে রোগের লক্ষণ দেখে তা নিরাময়ের ওষুধ দেয়া হচ্ছে। তাতেই বেশিরভাগ মানুষ ভালো হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ সেরে উঠছেন আপন শক্তিবলে, ইমিউনিটি সঞ্চার করে। বাংলাদেশে যত মানুষ অদ্যাবধি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে-তাদের মধ্যে নি¤œআয়ের মানুষের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বস্তি এলাকায় ব্যাপক সংক্রমণও দেখা যায়নি। যেন এক অদৃশ্য শক্তি এর পেছনে কাজ করেছে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর ইমিউনিটি কি সত্যিকারে বেশি!

করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বের করতে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রতিযোগিতায় লেগেছে। হয়তো একদিন কার্যকর প্রতিষেধক বেরিয়েও যাবে। তবে এতটুকু ধারণা করা যায়, নিরাপদ ও কার্যকর প্রতিষেধক বিশ্বের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে বেশ সময় লেগে যেতে পারে। এ জন্য আমাদের হয়তো আরও বেশ কিছুকাল অধীর অপেক্ষায় থাকতে হবে। তাই আপতত করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ব্যক্তিগত উদ্যোগই সম্বল। অপ্রয়োজনে বাইরে বেরোনা চলবে না। নিরাপদে থাকতে মাস্ক পরে বাইরে বেরোতে হবে। মানতে হবে সামাজিক দূরত্বের বিধান। হাত ধুতে হবে নিয়মিত। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সাধ্যমতো শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বজায় রাখতে হবে রোগপ্রতিষেধক ক্ষমতা (ইমিউনিটি)। ব্যক্তিগত সুরক্ষাই সামগ্রিকভাবে করোনার মহামারি থেকে বাঁচতে সহায়তা করবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]

বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৫ মহররম ১৪৪২, ০৬ আশ্বিন ১৪২৭

করোনা জয়ের অম্ল-মধুর দিনগুলো

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বড়ছেলে উহান থেকে ফিরেছে সেই মার্চে, ওর পিএইচডির গবেষণা শেষ না করেই। কবে যেতে পারবে উহানে তার ঠিক নেই। সবকিছু এখনও বন্ধ রয়েছে সেখানে। এ নিয়ে ভাবনা রয়েছে মনে। আমি মালিবাগে যে বাড়িতে থাকি সেখানে গত চার মাসে আমি পঞ্চমতলা থেকে নিচে নামিনি। ছাদে হেঁটে বেড়ানোও বন্ধ রেখেছি। ঘরের ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে রোজ সকালে কমপক্ষে আধঘণ্টা রোদ গায়ে মেখেছি। বাইরে বেরোতে পারি না বলে সকালের রোদ গায়ে লাগাতে ছোট্ট ব্যালকনিই ভরসা। করোনার বিরুদ্ধে লড়তে শরীরে শক্তি সঞ্চার দরকার। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয় বিস্তর। চিকিৎসক, পুষ্টিবিদরা নিয়ত পরামর্শ দেন। করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পেতে দেহের ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিষেধক শক্তি বাড়ানো প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন ভিটামিন-ডি। সূর্যকিরণে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন-ডি। এজন্য একে ‘সানসাইন ভিটামিন’ বলা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়েছি আমি। সব ধরনের খাবার খেয়েছি নিজে পরিষ্কার করে। বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি। হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে ছয় বছর হলো। স্ট্যান্টিং করা হয়েছে দু-জায়গায়। ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছে তাও বছর ১৫ হবে। কোন রোগই আমাকে ছাড়েনি।

আমার ছোটোছেলে পেশায় স্থপতি। করোনা বিস্তার লাভ করার পর থেকে পাঁচ মাস ঘরে বসে একেবারে কর্মহীন কাটিয়ে দিয়েছে। কোন চাকরি করে না ও। বুয়েট থেকে পাস করে ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে অনেক প্রচেষ্টায়। ও চেয়েছিলে পরিবারের অন্য সবার মতো চাকরি না করে বরং অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে। খানিকটা সফলও হয়েছিল সামান্য ক’বছর কাজ করে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওর কাজ বন্ধ থেকেছে চার মাস। করোনা শিগগির ছেড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই কাজে না নেমে উপায় নেই। সকালে সামান্য কিছু খেয়ে ছেলেটা বেরিয়ে যায়। ওর সারা শরীর, নাক-মুখ ঢাকা। মাথায় ক্যাপ। মনে হয় চন্দ্রাভিযানে যাচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। কী করে বারণ করি ওকে। দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলোর দিকে চেয়ে থাকি অসহায়ের মতো। ওর নেমে যাওয়ার শব্দ অস্পষ্ট হতে থাকে ক্রমশ। ও ঘরে ফিরে না আসা অবধি বুকের ধুকধুকানি থামে না।

জুনের ৩০ তারিখে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো আমার। সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা। মনে হচ্ছে শরীরের জোড়াগুলো খুলে যাচ্ছে। সকালবেলা কথাটা শুনে সবার চোখে-মুখে চিন্তার রেখা। এমনিতেই শরীরের অবস্থা ভালো নয়। সারা দিনে খেতে হয় এক গাদা ওষুধ। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরায় রয়েছে বিধিনিষেধ। এ অবস্থায় করোনার আঘাত সইতে পারা বড্ড কঠিন হয়ে যাবে! ছোটো ছেলেটাকে বাইরে যেতে হয় বলে ওর মাঝে রয়েছে অপরাধবোধ। করোনাভাইরাস বয়ে নিয়ে এসে যদি ঘরের কাউকে সংক্রমিত করে দেয়! ও একা শোয় ওপরের তলার ঘরটায়। বাহির থেকে এসে আলাদা বাথরুমে স্নান করে। কাপড় পাল্টায়, তারপর সবার সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ৩০ জুন আমার মতো অবস্থাই হলো ওর। সকালবেলা প্রচ- জ¦র নিয়ে নিচে নেমে এলো ছেলেটা। ওর চোখ দুটো লাল। বললো, সর্বাঙ্গে ব্যথা। আমার অবস্থা শুনে শঙ্কিত ছেলে। বাবার বয়স হয়েছে অনেক। রয়েছে নানা শারীরিক সমস্যা।

প্রথমে প্যারাসিটামল দু-একটা খেলে জ্বর কমে আসে। কিন্তু কাশি বাড়তেই থাকে ক্রমশ। সঙ্গে খেতে অরুচি। আলাপ করি আমার ছোটোভাইয়ের সঙ্গে। সে পেশায় চিকিৎসক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। কাল বিলম্ব না করে অ্যান্টিবায়োটিক জিম্যাক্স-৫০০ মিলিগ্রাম রোজ একটা করে খেতে বলে। সঙ্গে অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট। এভাবে তিন-চার দিন কেটে যায়। কিন্তু জ্বর থেমে এলেও কাশি কিছুতেই কমছে না। ৫ জুলাই বাসায় লোক আসে। মুখের লালা নিয়ে যায় সবার। পরের দিন রেজাল্ট আসে করোনা পজিটিভ। বাসার সবাই করোনা আক্রান্ত। পুরো বাসাটা রূপ নেয় হাসপাতালে। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। কে রান্না করবে, কে কাকে খাবার তুলে দেবে। অসুস্থতা নিয়েই সবার সক্রিয় সহযোগিতায় ঘরের দৈনন্দিন কজকর্ম চলে। করোনা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই টিকিৎসকের পরামর্শে একই ধরনের ওষুধ খেতে শুরু করে। ‘আইভারমেকটিন’ নামের একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, সঙ্গে এজিত্রোমাইসিন বা ডক্সিসাইক্লিন, আর করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে জিঙ্ক ও ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট। প্রতিদিন তিন-চার বার করে আদা-গরম পানি পান আর ভাপ নেয়া চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পর সবার অক্সিজেন ক্যাপাসিটি মাপা হয়। বড় ছেলে একটি অক্সিজেন কনডেন্সার সেট বাসায় এনে রেখে দেয়। সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে কারও নিঃশ^াসকষ্ট হয়নি। যেতে হয়নি হাসপাতালে। ঘুমের সমস্যার জন্য চা পান বাদ দিয়েছিলাম বেশ ক’বছর থেকে। কিন্তু করোনা আক্রান্তের পর থেকে আদার সঙ্গে সবুজ চা পান শুরু করেছি। আর সারা দিনে এক দু-বার মুরগির স্যুপ, সকালে দুটো সেদ্ধ ডিমের শে^তাংশ। জীবনে অনেক কঠিন অসুখ হয়েছে। কোনোটার কষ্ট কোনোটার চেয়ে কম নয়। তবে এবারকার করোনাভাইরাস নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে। সে এক না-বলা যন্ত্রণা শরীরজুড়ে। কিছুতেই যেন স্বস্তি মিলছিল না। নির্ঘুম কেটে যায় প্রায় ১৫ দিন। শুধু ভয়, শ্বাসকষ্ট হলে বাসায় চিকিৎসা চলবে না। অলস মনে শুধু হাসপাতালের করুণ চিত্র ভেসে উঠেছে। হাসপাতালে চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অব্যবস্থাপনা। জীবন বাজি রেখে চিকিৎসকদের সেবাব্রত রক্ষার মরণপণ প্রচেষ্টা। রোগীকে প্রাণে বাাঁচিয়ে তোলার আকুতি। করোনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণ বিসর্জন- আমাকে অবাক করে দেয়।

অন্য সবার লক্ষণগুলে ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও আমার শরীরের অস্থিরতা, কিছু খেতে না-পারা চলে সপ্তাহ দুয়েক। ১৫ দিনে পরে আবার করোনা টেস্ট করা হলো। সবার নেগেটিভ হলেও আমার রেজাল্ট তখনও পজিটিভ। মাত্রাতিরোক্ত কাশির কারণে গলায় ‘থ্রোট শোর’ হয়েছে। কণ্ঠস্বরের সমস্যার কারণে কথা বলা বন্ধ রেখেছি প্রায় এক মাস ধরে। আত্মীয়, বন্ধু সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছি। আমি যেন এক ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গেছি। করোনা পরীক্ষাকারী সংস্থা জানিয়েছে, ভাইরাসগুলো নির্জীব হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। আমিও টের পাচ্ছি করোনার উপসর্গগুলো কমে যাচ্ছে। অল্প-বিস্তর খেতেও পারছি। হয়তো বা আমি এগিয়ে চলেছি করোনা জয়ের পথে। করোনা আজ মানুষকে নতুন এক পৃথিবীর সামনে দাঁড় করিয়েছে। এ যেন এক অজানা, অচেনা পৃথিবী! করোনা যেন আজ মার্স, সার্স, ইবোলা’র চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে এসেছে। প্রাণঘাতী সেই প্লেগের ভয়াবহ দিনকে কি হার মানাতে যাচ্ছে কোভিড-১৯। করোনাভাইরাস থেকে নিরাময়ের তেমন কোন নির্ভরযোগ্য ওষুধ বেরোয়নি আজও। তবে রেমডেসিভির নামের ওষুধটি বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই বাজারজাত হয়েছে। এটির প্রয়োগও হচ্ছে কোথাও কোথাও। তবে রোগের লক্ষণ দেখে তা নিরাময়ের ওষুধ দেয়া হচ্ছে। তাতেই বেশিরভাগ মানুষ ভালো হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ সেরে উঠছেন আপন শক্তিবলে, ইমিউনিটি সঞ্চার করে। বাংলাদেশে যত মানুষ অদ্যাবধি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে-তাদের মধ্যে নি¤œআয়ের মানুষের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বস্তি এলাকায় ব্যাপক সংক্রমণও দেখা যায়নি। যেন এক অদৃশ্য শক্তি এর পেছনে কাজ করেছে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর ইমিউনিটি কি সত্যিকারে বেশি!

করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বের করতে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রতিযোগিতায় লেগেছে। হয়তো একদিন কার্যকর প্রতিষেধক বেরিয়েও যাবে। তবে এতটুকু ধারণা করা যায়, নিরাপদ ও কার্যকর প্রতিষেধক বিশ্বের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে বেশ সময় লেগে যেতে পারে। এ জন্য আমাদের হয়তো আরও বেশ কিছুকাল অধীর অপেক্ষায় থাকতে হবে। তাই আপতত করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ব্যক্তিগত উদ্যোগই সম্বল। অপ্রয়োজনে বাইরে বেরোনা চলবে না। নিরাপদে থাকতে মাস্ক পরে বাইরে বেরোতে হবে। মানতে হবে সামাজিক দূরত্বের বিধান। হাত ধুতে হবে নিয়মিত। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সাধ্যমতো শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বজায় রাখতে হবে রোগপ্রতিষেধক ক্ষমতা (ইমিউনিটি)। ব্যক্তিগত সুরক্ষাই সামগ্রিকভাবে করোনার মহামারি থেকে বাঁচতে সহায়তা করবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]