জাল আইডি দিয়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ ও আবেদনকারী ২৫ জনের সন্ধান চলছে

জাল জাতীয় পচিয়পত্রে (এনআইডি) বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং আবেদন করেছেন এমন ২৫ ব্যক্তির খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। এরমধ্যে মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হয়েছে যিনি জাল এনআইডি দিয়ে একটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণের চেষ্টা করেছিলেন। জাল বা ডুপ্লিকেট এনআইডিতে ব্যাংক ঋণ নেয়া বা আবেদনকারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপি বা প্রতারক চক্র বলে ধারণা গোয়েন্দা পুলিশের। এসব প্রতারক ঋণগ্রহীদের গ্রেফতার করার জন্য অভিযান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

গত ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে অভিযান চালিয়ে নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি বিভাগে চুক্তিতে কর্মরত ২ কর্মকর্তাসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি লালবাগ) টিম। উপ-পুলিশ কমিশনার রাজীব আল মাসুদের তত্ত্বাবধানে লালবাগ বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়িচুরি প্রতিরোধ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাসের নেতৃত্বে এ অভিযানে গ্রেফতার করা হয় নির্বাচন কমিশন অফিসের ডাটা এন্ট্রি বিভাগের অপারেটন সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর, আনোয়ারুল ইসলাম, তাদের সহযোগী সুমন পারভেজ. মো. মজিদ এবং সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। চক্রের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডুপ্লিকেট কপি, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করার পর তাদের আদালতে হাজির করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ড হেফাজতে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে এ চক্রের কাছ থেকে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে তদন্তকারীরা।

ডিবির উপ-কমিশনার (লালবাগ) রাজীব আলম মাসুদ জানান, এক ব্যক্তি জাল এনআইডি ব্যবহার করে একটি ব্যাংকে ঋণ আবেদন করে। এমন অভিযোগ পেয়ে ওই ব্যক্তিকে ডিবি পুলিশ আটক করে। তার দেয়া তথ্যে জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি চক্রের গ্রুপটিকে আমরা শনাক্ত করতে সক্ষম হই। এরপর তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিয়ে সবকিছু নিশ্চিত হয়ে আমরা অভিযানে যাই। গ্রেফতারকৃতদের ডিবি হেফাজতে ২ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা কিভাবে জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি করতো সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তির নাম ঠিকানা দিয়েছে, যাদের তারা জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি সরবরাহ করেছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। ওইসব ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে ডিবির সদস্যরা অভিযানে নেমেছে। ডিবি ডিসি রাজীব আল মাসুদ জানান, যেকোন ধরনের ব্যাংক ঋণ পেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবির) একটি প্রতিবেদনের প্রয়োজন হয়। সিআইবির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের একটি নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। সিআইবির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সেই প্রতিবেদনে থাকা ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে জাল এনআইডি দিয়ে ঋণ আবেদনকারী অথবা উত্তোলনকারীদের নামের তালিকা মিলিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি ওইসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যাংক কর্মকর্তা বা অন্য কারও বিশেষ সহযোগিতা ছিল কিনা, অথবা জাল এনআইডির বিষয়টি কেন ধরতে পারেনি ব্যাংক কর্মকর্তারা তা নিয়ে তদন্ত করা হবে।

মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস জানান, নির্বাচন কমিশনের ডাটা অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর এবং আনোয়ারুল ইসলাম নির্বাচন কমিশনের মিরপুর অঞ্চলে একসঙ্গে কাজ করতেন। সেখানেই তারা এ জালিয়াতির কাজ শুরু করে। প্রতিটি ডুপ্লিকেট বা জাল এনআইডি তৈরি করে দেয়ার বিনিময়ে ১৫ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে নিতেন। কখনও কখনও রেট আরও বেড়ে যেতো। মিরপুর অঞ্চল থেকে সিদ্ধার্থের বদলি হয় সবুজবাগ থানা এলাকায় আর আনোয়ারুল ইসলামের বদলি হয় গুলশান থানা এলাকায়। করোনার আগে তারা এখানে এলেও একই কাজ শুরু করেন। অফিসে বসে বসে খুব কৌশলে জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি করে তারা গত ২ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। ডিবি এসি মধুসূদন জানান, গ্রেফতার হওয়া সুমন পারভেজ একজন পেশাদার ব্রোকার বা দালাল। বিভিন্ন ব্যাংকে যারা ঋণ পেতে আবেদন করে এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন সুমন পারভেজ। চুক্তিতে ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দেয়ারও আশ্বাস দেন। ব্যাংক ঋণ উত্তোলনে আবেদনকারী যদি আগের ঋণ থেকে থাকে তা যাতে নতুন ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি না করে এ জন্য সে জাল বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরির জন্য মজিদের কাছে যেতেন। মূলত মজিদই নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি অপারেটন সিদ্ধার্থ এবং আনোয়ারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বেশি হলে অথবা গুরুত্ব বুঝে এনআইডি তৈরির রেট কমবেশি ডিমান্ড করতেন আনোয়ারুল এবং সিদ্ধার্থ।

ডিবি জানায়, তদন্ত করতে গিয়ে মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মহিউদ্দিন ওই চক্রের কাছ থেকে জাল এনআইডি তৈরি করে তা ব্যবহার করে একটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। মহিউদ্দিনের মতো এমন আরও ২৫ থেকে ৩০ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে ডিবি অভিযান চালাচ্ছে। চক্রটি ধরা পড়ার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ আসার কারণে এসব চক্রের কাছ থেকে যারা ডুপ্লিকেট এনআইডি নিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন বা আবেদন করেছেন তারা সবাই গাঢাকা দিয়েছে। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই থেকে আড়াই বছর ধরে নির্বাচন কমিশন অফিসের ডাটা এন্ট্রি বিভাগের কর্মকর্তা সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর এবং আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে ভয়াবহ এ জালিয়াতি চলে আসছিল। একটি জাল জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে ৮০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা নিতো। চক্রটি প্রকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের ডুপ্লিকেট তৈরি করে নটিফিকেশন দিয়ে রাখতো। নটিফিকেশনের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে কোন তথ্য পেতো না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আমরা ধারণা করছি, চক্রটি অন্যান্য অপরাধীদের ক্ষেত্রেও এ কাজ করতো। চক্রটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন উত্তোলনে সহায়তায় সবচেয়ে বেশি দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতো। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে কেউ ঋণ খেলাপি হলে তাদের সিআইবি বিপোর্ট খারাপ হয় ফলে পুনরায় তারা ব্যাংকে লোনের জন্য আবেদন করতে পারেন না। গ্রেফতারকৃত সুমন ও মজিদ লোন পাস করে দিবে মর্মে প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ হতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা গ্রহণ করতেন। পরবর্তী সময়ে লোন পাস হলে লোনের সমুদয় টাকার ১০% হারে দিতে হবে মর্মে চুক্তি করতেন। চুক্তিতে একমত হলে তারা প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতেন। পরে লোন পাস হলে চুক্তি অনুযায়ী লোনের সম্পূর্ণ টাকার ১০% হারে নিয়ে নিতেন। এসব টাকা চক্রটি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছে, গ্রেফতারকৃত ৫ জনের মধ্যে ২ দিনের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়াপর পর মধ্যে মজিদ ও আবদুল্লাহ আল মামুন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ডাটা এন্টি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর, আনোয়ারুল ইসলাম ও ব্যাংক দালাল সুমন পারভেজকে আরও দুই দিনের রিমান্ড শেষে সোপর্দ করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিন উপায়ে জাল এনআইডির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনের কাজ করতেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। প্রথমে তারা ঋণ পেতে আগ্রহীদের সঙ্গে তাদের চাকরি ও ব্যবসা সংক্রান্ত পরিচিতি এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ। এরপর মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাল এনআইডি তৈরি করে পরে ব্যাংকেরই অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঋণ পাস করিয়ে নেয়া হয়। সিআইবি রিপোর্ট যাদের খারাপ, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ। এসি মধুসূদন দাস বলেন, গ্রেফতার হওয়া চক্রের অন্যতম সদস্য সুমন ও মজিদ ঋণ পাস করিয়ে দেবে মর্মে প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিতেন। পরবর্তী সময়ে ঋণ পাস হলে মোট ঋণের ১০ শতাংশ হারে দিতে হবে মর্মে চুক্তি করেন। চুক্তিতে একমত হলে তারা প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। পরে ঋণ পাস হলে চুক্তি অনুযায়ী ঋণের সম্পূর্ণ টাকার ১০ শতাংশ হারে আদায় করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের কাছে ইসির সার্ভারের একসেস দেয়া থাকে। সেই সুযোগে নির্বাচন কমিশন অফিসের একটি ফরম পূরণ করে নিয়ে যেতেন প্রতারক মজিদ ও সুমন। সেখানে অনেক তথ্যের সঙ্গে স্বাক্ষর ও কোন এনআইডি নেই এমন ডিকলারেশন থাকতো। সেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ওই ফর্ম যেত থানা নির্বাচন কমিশন অফিসে। মিথ্যা তথ্যের বিষয়টি জেনেও প্রথমে ঋণ পেতে আগ্রহীদের আগের এনআইডি, বিদ্যুৎ বিল ও জন্ম নিবন্ধনের কপির তথ্য দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করেন তারা। এরপর নতুন নম্বরে ভুয়া এনআইডি এন্ট্রি করে সার্ভারে আপলোড দেয়া হতো থানা নির্বাচন অফিস থেকে। নির্বাচন কমিশন এই জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ও এনআইডি শাখার আইটি এক্সপার্টরা ডিবির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এনআইডি জালিয়াতিতে থানা নির্বাচন অফিসারদের ভূমিকা জানতে ইতোমধ্যে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি পুলিশ।

আরও খবর
সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হবে প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির গোপন বৈঠকের খবর সরকার জানে কাদের
ক্রেডিট কার্ডে সুদের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ
এনু ও রুপনের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ
রেল যোগাযোগ ২০২১ সালের মধ্যে রেলমন্ত্রী
সৌদি এয়ারলাইন্স ৫শ’ টিকিট দেবে
এবার সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগে মামলা করল ঢাবির সেই ছাত্রী
ভেঙে ফেলা হলো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল
ইউপি চেয়ারম্যান ও আ’লীগ নেতাসহ ৪ জন কারাগারে
চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর সন্ত্রাসী হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি
মিজানসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশুনানি ৩০ সেপ্টেম্বর
নগরীর ২০ মহল্লা তলিয়ে গেছে
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর নির্মিত হচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র

শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৬ মহররম ১৪৪২, ০৭ আশ্বিন ১৪২৭

জাল আইডি দিয়ে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ ও আবেদনকারী ২৫ জনের সন্ধান চলছে

সাইফ বাবলু

জাল জাতীয় পচিয়পত্রে (এনআইডি) বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং আবেদন করেছেন এমন ২৫ ব্যক্তির খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। এরমধ্যে মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হয়েছে যিনি জাল এনআইডি দিয়ে একটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণের চেষ্টা করেছিলেন। জাল বা ডুপ্লিকেট এনআইডিতে ব্যাংক ঋণ নেয়া বা আবেদনকারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপি বা প্রতারক চক্র বলে ধারণা গোয়েন্দা পুলিশের। এসব প্রতারক ঋণগ্রহীদের গ্রেফতার করার জন্য অভিযান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

গত ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে অভিযান চালিয়ে নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি বিভাগে চুক্তিতে কর্মরত ২ কর্মকর্তাসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর অপরাধ তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি লালবাগ) টিম। উপ-পুলিশ কমিশনার রাজীব আল মাসুদের তত্ত্বাবধানে লালবাগ বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়িচুরি প্রতিরোধ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাসের নেতৃত্বে এ অভিযানে গ্রেফতার করা হয় নির্বাচন কমিশন অফিসের ডাটা এন্ট্রি বিভাগের অপারেটন সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর, আনোয়ারুল ইসলাম, তাদের সহযোগী সুমন পারভেজ. মো. মজিদ এবং সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। চক্রের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডুপ্লিকেট কপি, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করার পর তাদের আদালতে হাজির করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ড হেফাজতে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে এ চক্রের কাছ থেকে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে তদন্তকারীরা।

ডিবির উপ-কমিশনার (লালবাগ) রাজীব আলম মাসুদ জানান, এক ব্যক্তি জাল এনআইডি ব্যবহার করে একটি ব্যাংকে ঋণ আবেদন করে। এমন অভিযোগ পেয়ে ওই ব্যক্তিকে ডিবি পুলিশ আটক করে। তার দেয়া তথ্যে জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি চক্রের গ্রুপটিকে আমরা শনাক্ত করতে সক্ষম হই। এরপর তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিয়ে সবকিছু নিশ্চিত হয়ে আমরা অভিযানে যাই। গ্রেফতারকৃতদের ডিবি হেফাজতে ২ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা কিভাবে জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি করতো সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তির নাম ঠিকানা দিয়েছে, যাদের তারা জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি সরবরাহ করেছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। ওইসব ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে ডিবির সদস্যরা অভিযানে নেমেছে। ডিবি ডিসি রাজীব আল মাসুদ জানান, যেকোন ধরনের ব্যাংক ঋণ পেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবির) একটি প্রতিবেদনের প্রয়োজন হয়। সিআইবির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের একটি নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। সিআইবির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সেই প্রতিবেদনে থাকা ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে জাল এনআইডি দিয়ে ঋণ আবেদনকারী অথবা উত্তোলনকারীদের নামের তালিকা মিলিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি ওইসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যাংক কর্মকর্তা বা অন্য কারও বিশেষ সহযোগিতা ছিল কিনা, অথবা জাল এনআইডির বিষয়টি কেন ধরতে পারেনি ব্যাংক কর্মকর্তারা তা নিয়ে তদন্ত করা হবে।

মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস জানান, নির্বাচন কমিশনের ডাটা অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর এবং আনোয়ারুল ইসলাম নির্বাচন কমিশনের মিরপুর অঞ্চলে একসঙ্গে কাজ করতেন। সেখানেই তারা এ জালিয়াতির কাজ শুরু করে। প্রতিটি ডুপ্লিকেট বা জাল এনআইডি তৈরি করে দেয়ার বিনিময়ে ১৫ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে নিতেন। কখনও কখনও রেট আরও বেড়ে যেতো। মিরপুর অঞ্চল থেকে সিদ্ধার্থের বদলি হয় সবুজবাগ থানা এলাকায় আর আনোয়ারুল ইসলামের বদলি হয় গুলশান থানা এলাকায়। করোনার আগে তারা এখানে এলেও একই কাজ শুরু করেন। অফিসে বসে বসে খুব কৌশলে জাল এনআইডি বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি করে তারা গত ২ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। ডিবি এসি মধুসূদন জানান, গ্রেফতার হওয়া সুমন পারভেজ একজন পেশাদার ব্রোকার বা দালাল। বিভিন্ন ব্যাংকে যারা ঋণ পেতে আবেদন করে এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন সুমন পারভেজ। চুক্তিতে ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দেয়ারও আশ্বাস দেন। ব্যাংক ঋণ উত্তোলনে আবেদনকারী যদি আগের ঋণ থেকে থাকে তা যাতে নতুন ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি না করে এ জন্য সে জাল বা ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরির জন্য মজিদের কাছে যেতেন। মূলত মজিদই নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি অপারেটন সিদ্ধার্থ এবং আনোয়ারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বেশি হলে অথবা গুরুত্ব বুঝে এনআইডি তৈরির রেট কমবেশি ডিমান্ড করতেন আনোয়ারুল এবং সিদ্ধার্থ।

ডিবি জানায়, তদন্ত করতে গিয়ে মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মহিউদ্দিন ওই চক্রের কাছ থেকে জাল এনআইডি তৈরি করে তা ব্যবহার করে একটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। মহিউদ্দিনের মতো এমন আরও ২৫ থেকে ৩০ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে ডিবি অভিযান চালাচ্ছে। চক্রটি ধরা পড়ার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ আসার কারণে এসব চক্রের কাছ থেকে যারা ডুপ্লিকেট এনআইডি নিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন বা আবেদন করেছেন তারা সবাই গাঢাকা দিয়েছে। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই থেকে আড়াই বছর ধরে নির্বাচন কমিশন অফিসের ডাটা এন্ট্রি বিভাগের কর্মকর্তা সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর এবং আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে ভয়াবহ এ জালিয়াতি চলে আসছিল। একটি জাল জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে ৮০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা নিতো। চক্রটি প্রকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের ডুপ্লিকেট তৈরি করে নটিফিকেশন দিয়ে রাখতো। নটিফিকেশনের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে কোন তথ্য পেতো না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আমরা ধারণা করছি, চক্রটি অন্যান্য অপরাধীদের ক্ষেত্রেও এ কাজ করতো। চক্রটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন উত্তোলনে সহায়তায় সবচেয়ে বেশি দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতো। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে কেউ ঋণ খেলাপি হলে তাদের সিআইবি বিপোর্ট খারাপ হয় ফলে পুনরায় তারা ব্যাংকে লোনের জন্য আবেদন করতে পারেন না। গ্রেফতারকৃত সুমন ও মজিদ লোন পাস করে দিবে মর্মে প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ হতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা গ্রহণ করতেন। পরবর্তী সময়ে লোন পাস হলে লোনের সমুদয় টাকার ১০% হারে দিতে হবে মর্মে চুক্তি করতেন। চুক্তিতে একমত হলে তারা প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতেন। পরে লোন পাস হলে চুক্তি অনুযায়ী লোনের সম্পূর্ণ টাকার ১০% হারে নিয়ে নিতেন। এসব টাকা চক্রটি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছে, গ্রেফতারকৃত ৫ জনের মধ্যে ২ দিনের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়াপর পর মধ্যে মজিদ ও আবদুল্লাহ আল মামুন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ডাটা এন্টি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর, আনোয়ারুল ইসলাম ও ব্যাংক দালাল সুমন পারভেজকে আরও দুই দিনের রিমান্ড শেষে সোপর্দ করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিন উপায়ে জাল এনআইডির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনের কাজ করতেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। প্রথমে তারা ঋণ পেতে আগ্রহীদের সঙ্গে তাদের চাকরি ও ব্যবসা সংক্রান্ত পরিচিতি এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ। এরপর মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাল এনআইডি তৈরি করে পরে ব্যাংকেরই অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঋণ পাস করিয়ে নেয়া হয়। সিআইবি রিপোর্ট যাদের খারাপ, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ। এসি মধুসূদন দাস বলেন, গ্রেফতার হওয়া চক্রের অন্যতম সদস্য সুমন ও মজিদ ঋণ পাস করিয়ে দেবে মর্মে প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিতেন। পরবর্তী সময়ে ঋণ পাস হলে মোট ঋণের ১০ শতাংশ হারে দিতে হবে মর্মে চুক্তি করেন। চুক্তিতে একমত হলে তারা প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। পরে ঋণ পাস হলে চুক্তি অনুযায়ী ঋণের সম্পূর্ণ টাকার ১০ শতাংশ হারে আদায় করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের কাছে ইসির সার্ভারের একসেস দেয়া থাকে। সেই সুযোগে নির্বাচন কমিশন অফিসের একটি ফরম পূরণ করে নিয়ে যেতেন প্রতারক মজিদ ও সুমন। সেখানে অনেক তথ্যের সঙ্গে স্বাক্ষর ও কোন এনআইডি নেই এমন ডিকলারেশন থাকতো। সেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ওই ফর্ম যেত থানা নির্বাচন কমিশন অফিসে। মিথ্যা তথ্যের বিষয়টি জেনেও প্রথমে ঋণ পেতে আগ্রহীদের আগের এনআইডি, বিদ্যুৎ বিল ও জন্ম নিবন্ধনের কপির তথ্য দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করেন তারা। এরপর নতুন নম্বরে ভুয়া এনআইডি এন্ট্রি করে সার্ভারে আপলোড দেয়া হতো থানা নির্বাচন অফিস থেকে। নির্বাচন কমিশন এই জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ও এনআইডি শাখার আইটি এক্সপার্টরা ডিবির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এনআইডি জালিয়াতিতে থানা নির্বাচন অফিসারদের ভূমিকা জানতে ইতোমধ্যে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি পুলিশ।