পিয়াজে সেঞ্চুরি : বিপদে ক্রেতা, নিশ্চিন্ত-নিরুদ্বিগ্ন মজুদদাররা

রণেশ মৈত্র

দাম আগের থেকেই বাড়িয়ে দিচ্ছিল ব্যবসায়ীরা। আমি নিজেই গত ১২ সেপ্টেম্বর অর্ধ কেজি পিয়াজ কিনলাম ৬০ টাকা কেজি দরে। এই দামটাও ছিল অযৌতিকভাবে বেশি। ন্যায্য দাম হলে দুই কেজি কিনতাম। কারণ এখন তো আগের মতো রোজ বাজারে যাই না-বাইরেও না, করোনার কারণে।

হঠাৎ গত ১৪ সেপ্টেম্বর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করল ভারত আকস্মিকভাবে পিয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে। আর যায় কোথায়? এ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা তো ব্যবসায়ী-মজুতদারেরা নন- অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ দোকান বন্ধ করে দিলেন ঘোষণা করলেন, পিয়াজ নেই এতে আরও এক দফা দাম বাড়াল অন্যান্য ব্যবসায়ীরা। সন্ধ্যের আগেই পিয়াজের কেজি ১০০ টাকায় পৌঁছালো। খদ্দেরদের নাভিশ্বাস।

পিয়াজ সেঞ্চুরিটা করেই ফেলল। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রচুর পিয়াজ সারা দেশে মজুত আছে। তাছাড়াও টিসিবি দেশজুড়ে ৩০ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করতে শুরু করেছে।

সত্য কথাই বটে। পিয়াজের যথেষ্ট মজুত আছে। কোটি কোটি মানুষও তা জানে। মানুষ এও জানে যে অসৎ ব্যবসায়ী ও মজুতদারেরা বিপুল পরিমাণ মজুত পিয়াজ লুকিয়ে ফেলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে অস্বাভাবিক হারে মুনাফা করার লক্ষ্যে। এই সত্যটি সরকারের আরও বেশি জানা। সরকার পরিস্থিতি দৃষ্টে হুঁশিয়ারি দেন পিয়াজের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি সরকার চোখ বুঁজে সইবে না। যারা বেশি দামে বিক্রি করবেন, মোবাইল কোর্ট তাদের শাস্তি দেবেন। মোবাইল কোর্টও কোথাও কোথাও বেরোলো-বোকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ শাস্তি পেলেন বেশি দামে পিয়াজ বিক্রি করার জন্য জেল খাটতে গেলেন বা জরিমানা দিলেন বা উভয় শাস্তিই পেলেন।

কিন্তু আসল ক্রিমিনালরা? বড় বড় ব্যবসায়ী মজুতদার মুনাফাখোরেরা? তারা চতুর। তারা দোকান বন্ধ রাখল মোবাইল কোর্ট বেরোনোর খবরে। তাই তারা বেঁচেও গেল। সরকার তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারল নাÑ এ যাবত কোনদিনই পারেওনি। অসহায়ের মতো ক্রেতারা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই শুধু এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।

ভারত পিয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র পিয়াজের দাম বাড়তে শুরু করল। প্রশ্ন থাকে যে মুহূর্তে ভারত ওই ঘোষণা দিল সঙ্গে সঙ্গেই কি প্রদেশে পিয়াজের মজুত নিঃশেষ হয়ে গেল? তা কখনও হতে পারে? পারে- বাংলাদেশে পারে। এখন পারে, অতীতেও পেরেছে। হয়তো বা ভবিষ্যতেও পারবে। পারছে কেন? কারণ এ মজুতদার বড় ব্যবসায়ীদের গুদামে হানা দিতে কখনও পুলিশ পাঠানো হয় না। কেন হয় না? কারণ তাদের পেছনে দামি-দামি নেতারা আছেন। আছেন ছোটবড় আমলারাও। এর পর কে তাদের গায়ে হাত দেবে? নেতা-আমলারা বেয়াকুফ নন। ওই মজুদদারেরা তাদের অনেক দিয়ে থাকেন। তাই নেতা-আমলারা বেঈমানি তো করতে পারেন না? সাধারণ মানুষের কষ্ট? তা হয়েই থাকে। আবারও হলো। তাতে কি? তারা তো মিছিল করবে না। মজুতদারদের গুদামে হামলা করবে না। নেতার বাড়িঘর, কর্তাদের অফিস-বাংলো ঘেরাও করবে না। তাই চিন্তারও কারণ নেই। ছোট ছোট দলের নেতারা হয়তো পত্রিকায় বিবৃতি পাঠাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে-আবার কেউ কেউ হয়তো কোথাও কোথাও মানববন্ধন করবে। ব্যস প্রতিবাদের পালা এভাবেই শেষ। তাই এগুলি ignore করো। কোন গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই।

মজুতার মুনাফাখোরেরা এও জানে যে টিসিবির বিক্রি সাময়িক এবং তার পরিমাণও স্বল্প। বিশাল সংখ্যক ক্রেতার ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর ক্ষমতাও তাদের নেই। তদুপরি বেশিরভাগ ক্রেতা জানতেও পারে না-কবে কোথায় তারা পিয়াজের ট্রাক নিয়ে দাঁড়াবে। যে স্বল্পসংখ্যক ক্রেতা তার হদিস পান-তারাও দীর্ঘ লাইনের পাল্লায় পড়ে হাঁপিয়ে ওঠেন। সারা দিন না হলেও কয়েক ঘণ্টা তো দাঁড়িয়ে থাকতেই হয়। তারপরও লাইন শেষে না-ও পাওয়া যেতে পারে। পেলেও লাভের গুড় পিঁপড়ায়। কারণ সারাদিন কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের দৈনন্দিন রুজি-রোজগার ব্যাহত হয়। ফলে আসলে তারা লাভবান হন না। ট্রাকের চাইতে রিকশা ভ্যানে করে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করলে বাড়ির গিন্নিরাই কিনতে পারেন তবে তা অগ্রিম বা তাৎক্ষণিক জানান দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।

কাঁচা লংকার ট্রিপল সেঞ্চুরি

ভাগিস কাঁচালঙ্কা ভারত থেকে আসে না বা অন্য কোন দেশ থেকেও আমদানি করা হয় না। দেশের কৃষকরাই বিস্তর উৎপাদন করে এই দৈনন্দিন অবশ্য প্রয়োজনীয় মসলার চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। শুধমাত্র অতি বৃষ্টি হলে কাঁচামরিচের ফলন কমে যায়।

এবারে অবশ্য খুব একটা অতিবৃষ্টি না হলেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি একেবারে কমও হয়নি। তাতে উৎপাদন খানিকটা ব্যাহত হয়েছে সত্যি। কিন্তু কাঁচামরিচের মূল্য কেজি প্রতি ৩০০ টাকায় উঠে গেল। ট্রিপল সেঞ্চুরি করল কাঁচামরিচ। এমন মূল্যবৃদ্ধি অতীতে কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে কোন দিন হয়নি। দাম অবশ্য কয়েক বছর আগে বেড়েছিল কাঁচামরিচের তখন পণ্যটি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। মানুষ হাহাকার করছিল-সংবাপত্রগুলোও শিরোনামে ওই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির খবর গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল। কিন্তু এবার ৩০০ টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ বিক্রি হলে তার ঝালের কোন খবর তেমনভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখিনি। ধকলটা ক্রেতদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এখন ৩০০ টাকা ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বাজারে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এটাও অতিরিক্ত খুব বেশি। দেখা যাচ্ছে পত্র-পত্রিকাই না শুধু-সরকারও নির্বিকার। পত্র-পত্রিকা যদি জোরেসোরে খবর প্রকাশ করত-টেলিভিশন চ্যনেলগুলোও যদি পিয়াজের মতো সক্রিয় হতো-তাহলে হয়াতো সরকারও কিছুটা নড়েচড়ে বসতো।

তাই কাঁচামরিচের ট্রিপল সেঞ্চুরি চুপিসারেই সবাইকে সয়ে যেতে হলো।

সবজিগুলোও তো প্রায় সেঞ্চুরি করল

পুরোপুরি দেশেইে উৎপাদিত হয় নানা জাতীয় শাকসবজি। আমাদের দেশের কৃষকরাই তা উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটান। বিদেশ থেকে আমদানি নয়Ñএই পণ্যগুলোর প্রায় সবই পৃথিবীর নানা দেশে রফতানি করে কম-বেশি বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে থাকে বাংলাদেশ প্রতি বছর। দামে শাকসবজি তরিতরকারি সর্বদাই বাংলাদেশে অত্যন্ত সস্তা। কিন্তু সেঞ্চুরির নজর শুধুম পিয়াজ-মরিচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অনেক সবজির দামই কেজি প্রতি সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছিল। টেলিভিশনের কোন কোন চ্যানেল সবজি কেনাবেচা লাইভ দেখিয়েছিল তখন তাদের তালিকায় সবজিও স্থান পেয়েছিল। ইদানীং অবশ্য কিছুটা কমেছে তবে স্বাভাবিক হয় নি এখনও।

আদার দামও আকাশচুম্বী মসলা হিসেবে আদার প্রয়োজনীয়তা-রোগ প্রতিরোধে আদার ক্ষমতা এসব কারণে এই করোনার যুগে আদার চাহিদা এখন মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে। স্বাস্থ্য বিষেষজ্ঞরাও বলেছেন, আদার রস করোনা প্রতিরোধে বহুলাংশে সক্ষম। বিশেষ করে সর্দি, কাশি, জ্বরে, গলাব্যথায় আদার প্রয়োজনীয়তা তুলনাহীন। আর ওই সর্দি, কাশি, জ্বর প্রকৃতিই তো, চিকিৎসকদের মতে, করোনার লক্ষণ।

এই অতি প্রয়োজনীয়টির চাহিদা শুধু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাজারে দেশি-বিদেশি দুই ধরনের আদা পাওয়া আয়। দেশিটারই স্বাদ ঝাঁঝ বেশি। বিদেশিটার দামও কম ঝাঁঝও কম। উপকার কোনটার বেশি জানি না। তবে অন্তত: করোনা পরিস্থিতির নির্ভরযোগ্য উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিদেশ থেকে অনেকট বেশি পরিমাণে আদা আমদানি করার জন্য সুপারিশ করছি। এভাবে আমদানি করে দুস্থ ও সঙ্গতিহীন মানুষদের বিনা মূল্যে বা অতি স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে তাদের দেহের পুষ্টি বাড়ানো যেতে পারে, করোনা প্রতিশোধ শক্তিও বাড়তে পারে। বিষয়টা সরকারের ভাবনায় এলো ভালো হয়-তবে তার ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখি না কারণ অভিজ্ঞতা তেমন বলে না।

তবে মধ্যবিত্তরাও তাতে উপকৃত হবেন কারণ আমদানি বাড়লে দামও কমবে নির্ঘাত। তবুও আমাদের ব্যবসায়ী মহলে যে ভয়াবহ অর্থলোলুপ এবং তা প্রতিরোধে সীমাহীন সরকারি নিষ্ক্রিয়তার ফলে আসলে জনগণ সুফল পাবে কিনা জানি না। বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণও সে কারণে নেই।

চালের দামও বাড়ছেই

বাজারে চালের দাম প্রতি সপ্তাহে কেজি প্রতি অন্ততপক্ষে দু’তিন টাকা করে বাড়ছে। বেশি বাড়ছে মোটা চালের দাম কারণ মোটা চাল গরিবের খাদ্য-অর্থাৎ শতকরা কমপক্ষে ৮০ ভাগ মানুষের নিত্যদিনের খাদ্য।

চালের দাম বৃদ্ধির খবরও বহুবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বহুদিন লাইভ প্রচার করেছে। কিন্তু তার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া সরকারি মহল থেকে পাওয়া যায়নি।

চালের দাম বৃদ্ধির এই বিষয়টি দুর্বোধ্য। চাল উৎপাদনে এবার কোথা থেকেও কোন সমস্যা বা ঘাটতির খবর গণমাধ্যমগুলিতে চোখে পড়েনি। সরকার দাবি করে থাকেন আমরা ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। এ কথাতে বিশ্বাসও রয়েছে মানুষের। তারপরও গরিব মানুষের এ দৈনন্দিন অপরিহার্য পণ্যটির দাম কেন বেড়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের কোন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

উৎপাদন ছাড়াও বিদেশ থেকে কিছু কিছু চাল আমদানি আবার ভালো কোয়ালিটির চিকন চাল রফতানির খবরও শুনি। অহরহ এও শুনি যে বিস্তর খাদ্য সরকারি গুদামে মজুত আছে উৎপাদনও হয়েছে প্রচুর। যদি তা সত্য হয় তবে কেন মোটা চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা ভালো করে তদন্ত করে দেখা দরকার। কোন ক্রমেই যাতে গরিবের খাদ্যের দাম সহনশীলতার বাইরে না যায়Ñ তা অবশ্যই দেখতে হবে যে কোন মূল্যে। কারণ ওই গরিবরাই ১৬ কোটি মানুষের নিত্যদিনের আহার জুগিয়ে থাকে।

শিশু খাদ্য

শিশুখাদ্য এখন তো একমাত্র গরুর দুধই। শারীরিক কারণেই বেশিরভাগ মা ছয় মাস ধরে শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারেন না। তাই গরুর দুধ এর বিকল্প নেই। তার দামও ভয়ানকভাবে বেড়েছে। তবুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই বাজারে যা পাওয়া যায় তাই কিনতে হয়, তাই খাওয়াতে হয়। কিন্তু দাম এতটাই বেশি যে ওই দুধও গরিব মানুষেরা কিনতে পারেন না। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছে ব্যাপকসংখ্যক শিশু। দেশে দুধেল গাইয়ের সংখ্যা স্বল্পতার ফলেই মূলত: এ সংকটের সৃষ্টি। দুর্মূল্যের কারণে প্রাপ্তবয়স্ক, বয়স্ক, সন্তান-সম্ভাবা বধূরাও বহুকাল যাবত দুধকে তাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন।

বস্তুত: বাংলাদেশের সব বাজার দীর্ঘদিন যাবত নিয়ন্ত্রণ করছে অসংখ্য সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিক্টেগুলোর পেছনে মদত ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সরকারি দলের নেতাদেরও কতিপয় আমলার। তাই সিন্ডিকেটগুলো বহাল তবিয়তে তাদের গণবিরোধী ক্রিয়াকলাপ অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে, দেখবার বা এদের নিয়ন্ত্রণ করবার অথবা এদের মুনাফাখোরি-মজুতদারির বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও বাংলাদেশে কেউ রয়েছে সেটা মনে করবার কোন কারণ নেই। সুতরাং ১৬ কোটি মানুষ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি-সরকার নীরব দর্শক। এটাই বাংলাদেশ।

সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে দৃঢ়ভাবে সরকারকি এগিয়ে আসবে? মানুষ বাঁচানোর জন্য তা অপরিহার্য।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com

শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৬ মহররম ১৪৪২, ০৭ আশ্বিন ১৪২৭

পিয়াজে সেঞ্চুরি : বিপদে ক্রেতা, নিশ্চিন্ত-নিরুদ্বিগ্ন মজুদদাররা

রণেশ মৈত্র

দাম আগের থেকেই বাড়িয়ে দিচ্ছিল ব্যবসায়ীরা। আমি নিজেই গত ১২ সেপ্টেম্বর অর্ধ কেজি পিয়াজ কিনলাম ৬০ টাকা কেজি দরে। এই দামটাও ছিল অযৌতিকভাবে বেশি। ন্যায্য দাম হলে দুই কেজি কিনতাম। কারণ এখন তো আগের মতো রোজ বাজারে যাই না-বাইরেও না, করোনার কারণে।

হঠাৎ গত ১৪ সেপ্টেম্বর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করল ভারত আকস্মিকভাবে পিয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে। আর যায় কোথায়? এ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা তো ব্যবসায়ী-মজুতদারেরা নন- অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ দোকান বন্ধ করে দিলেন ঘোষণা করলেন, পিয়াজ নেই এতে আরও এক দফা দাম বাড়াল অন্যান্য ব্যবসায়ীরা। সন্ধ্যের আগেই পিয়াজের কেজি ১০০ টাকায় পৌঁছালো। খদ্দেরদের নাভিশ্বাস।

পিয়াজ সেঞ্চুরিটা করেই ফেলল। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রচুর পিয়াজ সারা দেশে মজুত আছে। তাছাড়াও টিসিবি দেশজুড়ে ৩০ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করতে শুরু করেছে।

সত্য কথাই বটে। পিয়াজের যথেষ্ট মজুত আছে। কোটি কোটি মানুষও তা জানে। মানুষ এও জানে যে অসৎ ব্যবসায়ী ও মজুতদারেরা বিপুল পরিমাণ মজুত পিয়াজ লুকিয়ে ফেলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে অস্বাভাবিক হারে মুনাফা করার লক্ষ্যে। এই সত্যটি সরকারের আরও বেশি জানা। সরকার পরিস্থিতি দৃষ্টে হুঁশিয়ারি দেন পিয়াজের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি সরকার চোখ বুঁজে সইবে না। যারা বেশি দামে বিক্রি করবেন, মোবাইল কোর্ট তাদের শাস্তি দেবেন। মোবাইল কোর্টও কোথাও কোথাও বেরোলো-বোকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ শাস্তি পেলেন বেশি দামে পিয়াজ বিক্রি করার জন্য জেল খাটতে গেলেন বা জরিমানা দিলেন বা উভয় শাস্তিই পেলেন।

কিন্তু আসল ক্রিমিনালরা? বড় বড় ব্যবসায়ী মজুতদার মুনাফাখোরেরা? তারা চতুর। তারা দোকান বন্ধ রাখল মোবাইল কোর্ট বেরোনোর খবরে। তাই তারা বেঁচেও গেল। সরকার তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারল নাÑ এ যাবত কোনদিনই পারেওনি। অসহায়ের মতো ক্রেতারা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই শুধু এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।

ভারত পিয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র পিয়াজের দাম বাড়তে শুরু করল। প্রশ্ন থাকে যে মুহূর্তে ভারত ওই ঘোষণা দিল সঙ্গে সঙ্গেই কি প্রদেশে পিয়াজের মজুত নিঃশেষ হয়ে গেল? তা কখনও হতে পারে? পারে- বাংলাদেশে পারে। এখন পারে, অতীতেও পেরেছে। হয়তো বা ভবিষ্যতেও পারবে। পারছে কেন? কারণ এ মজুতদার বড় ব্যবসায়ীদের গুদামে হানা দিতে কখনও পুলিশ পাঠানো হয় না। কেন হয় না? কারণ তাদের পেছনে দামি-দামি নেতারা আছেন। আছেন ছোটবড় আমলারাও। এর পর কে তাদের গায়ে হাত দেবে? নেতা-আমলারা বেয়াকুফ নন। ওই মজুদদারেরা তাদের অনেক দিয়ে থাকেন। তাই নেতা-আমলারা বেঈমানি তো করতে পারেন না? সাধারণ মানুষের কষ্ট? তা হয়েই থাকে। আবারও হলো। তাতে কি? তারা তো মিছিল করবে না। মজুতদারদের গুদামে হামলা করবে না। নেতার বাড়িঘর, কর্তাদের অফিস-বাংলো ঘেরাও করবে না। তাই চিন্তারও কারণ নেই। ছোট ছোট দলের নেতারা হয়তো পত্রিকায় বিবৃতি পাঠাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে-আবার কেউ কেউ হয়তো কোথাও কোথাও মানববন্ধন করবে। ব্যস প্রতিবাদের পালা এভাবেই শেষ। তাই এগুলি ignore করো। কোন গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই।

মজুতার মুনাফাখোরেরা এও জানে যে টিসিবির বিক্রি সাময়িক এবং তার পরিমাণও স্বল্প। বিশাল সংখ্যক ক্রেতার ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর ক্ষমতাও তাদের নেই। তদুপরি বেশিরভাগ ক্রেতা জানতেও পারে না-কবে কোথায় তারা পিয়াজের ট্রাক নিয়ে দাঁড়াবে। যে স্বল্পসংখ্যক ক্রেতা তার হদিস পান-তারাও দীর্ঘ লাইনের পাল্লায় পড়ে হাঁপিয়ে ওঠেন। সারা দিন না হলেও কয়েক ঘণ্টা তো দাঁড়িয়ে থাকতেই হয়। তারপরও লাইন শেষে না-ও পাওয়া যেতে পারে। পেলেও লাভের গুড় পিঁপড়ায়। কারণ সারাদিন কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের দৈনন্দিন রুজি-রোজগার ব্যাহত হয়। ফলে আসলে তারা লাভবান হন না। ট্রাকের চাইতে রিকশা ভ্যানে করে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করলে বাড়ির গিন্নিরাই কিনতে পারেন তবে তা অগ্রিম বা তাৎক্ষণিক জানান দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।

কাঁচা লংকার ট্রিপল সেঞ্চুরি

ভাগিস কাঁচালঙ্কা ভারত থেকে আসে না বা অন্য কোন দেশ থেকেও আমদানি করা হয় না। দেশের কৃষকরাই বিস্তর উৎপাদন করে এই দৈনন্দিন অবশ্য প্রয়োজনীয় মসলার চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। শুধমাত্র অতি বৃষ্টি হলে কাঁচামরিচের ফলন কমে যায়।

এবারে অবশ্য খুব একটা অতিবৃষ্টি না হলেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি একেবারে কমও হয়নি। তাতে উৎপাদন খানিকটা ব্যাহত হয়েছে সত্যি। কিন্তু কাঁচামরিচের মূল্য কেজি প্রতি ৩০০ টাকায় উঠে গেল। ট্রিপল সেঞ্চুরি করল কাঁচামরিচ। এমন মূল্যবৃদ্ধি অতীতে কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে কোন দিন হয়নি। দাম অবশ্য কয়েক বছর আগে বেড়েছিল কাঁচামরিচের তখন পণ্যটি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। মানুষ হাহাকার করছিল-সংবাপত্রগুলোও শিরোনামে ওই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির খবর গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল। কিন্তু এবার ৩০০ টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ বিক্রি হলে তার ঝালের কোন খবর তেমনভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখিনি। ধকলটা ক্রেতদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এখন ৩০০ টাকা ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বাজারে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এটাও অতিরিক্ত খুব বেশি। দেখা যাচ্ছে পত্র-পত্রিকাই না শুধু-সরকারও নির্বিকার। পত্র-পত্রিকা যদি জোরেসোরে খবর প্রকাশ করত-টেলিভিশন চ্যনেলগুলোও যদি পিয়াজের মতো সক্রিয় হতো-তাহলে হয়াতো সরকারও কিছুটা নড়েচড়ে বসতো।

তাই কাঁচামরিচের ট্রিপল সেঞ্চুরি চুপিসারেই সবাইকে সয়ে যেতে হলো।

সবজিগুলোও তো প্রায় সেঞ্চুরি করল

পুরোপুরি দেশেইে উৎপাদিত হয় নানা জাতীয় শাকসবজি। আমাদের দেশের কৃষকরাই তা উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটান। বিদেশ থেকে আমদানি নয়Ñএই পণ্যগুলোর প্রায় সবই পৃথিবীর নানা দেশে রফতানি করে কম-বেশি বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে থাকে বাংলাদেশ প্রতি বছর। দামে শাকসবজি তরিতরকারি সর্বদাই বাংলাদেশে অত্যন্ত সস্তা। কিন্তু সেঞ্চুরির নজর শুধুম পিয়াজ-মরিচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অনেক সবজির দামই কেজি প্রতি সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছিল। টেলিভিশনের কোন কোন চ্যানেল সবজি কেনাবেচা লাইভ দেখিয়েছিল তখন তাদের তালিকায় সবজিও স্থান পেয়েছিল। ইদানীং অবশ্য কিছুটা কমেছে তবে স্বাভাবিক হয় নি এখনও।

আদার দামও আকাশচুম্বী মসলা হিসেবে আদার প্রয়োজনীয়তা-রোগ প্রতিরোধে আদার ক্ষমতা এসব কারণে এই করোনার যুগে আদার চাহিদা এখন মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে। স্বাস্থ্য বিষেষজ্ঞরাও বলেছেন, আদার রস করোনা প্রতিরোধে বহুলাংশে সক্ষম। বিশেষ করে সর্দি, কাশি, জ্বরে, গলাব্যথায় আদার প্রয়োজনীয়তা তুলনাহীন। আর ওই সর্দি, কাশি, জ্বর প্রকৃতিই তো, চিকিৎসকদের মতে, করোনার লক্ষণ।

এই অতি প্রয়োজনীয়টির চাহিদা শুধু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাজারে দেশি-বিদেশি দুই ধরনের আদা পাওয়া আয়। দেশিটারই স্বাদ ঝাঁঝ বেশি। বিদেশিটার দামও কম ঝাঁঝও কম। উপকার কোনটার বেশি জানি না। তবে অন্তত: করোনা পরিস্থিতির নির্ভরযোগ্য উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিদেশ থেকে অনেকট বেশি পরিমাণে আদা আমদানি করার জন্য সুপারিশ করছি। এভাবে আমদানি করে দুস্থ ও সঙ্গতিহীন মানুষদের বিনা মূল্যে বা অতি স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে তাদের দেহের পুষ্টি বাড়ানো যেতে পারে, করোনা প্রতিশোধ শক্তিও বাড়তে পারে। বিষয়টা সরকারের ভাবনায় এলো ভালো হয়-তবে তার ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখি না কারণ অভিজ্ঞতা তেমন বলে না।

তবে মধ্যবিত্তরাও তাতে উপকৃত হবেন কারণ আমদানি বাড়লে দামও কমবে নির্ঘাত। তবুও আমাদের ব্যবসায়ী মহলে যে ভয়াবহ অর্থলোলুপ এবং তা প্রতিরোধে সীমাহীন সরকারি নিষ্ক্রিয়তার ফলে আসলে জনগণ সুফল পাবে কিনা জানি না। বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণও সে কারণে নেই।

চালের দামও বাড়ছেই

বাজারে চালের দাম প্রতি সপ্তাহে কেজি প্রতি অন্ততপক্ষে দু’তিন টাকা করে বাড়ছে। বেশি বাড়ছে মোটা চালের দাম কারণ মোটা চাল গরিবের খাদ্য-অর্থাৎ শতকরা কমপক্ষে ৮০ ভাগ মানুষের নিত্যদিনের খাদ্য।

চালের দাম বৃদ্ধির খবরও বহুবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বহুদিন লাইভ প্রচার করেছে। কিন্তু তার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া সরকারি মহল থেকে পাওয়া যায়নি।

চালের দাম বৃদ্ধির এই বিষয়টি দুর্বোধ্য। চাল উৎপাদনে এবার কোথা থেকেও কোন সমস্যা বা ঘাটতির খবর গণমাধ্যমগুলিতে চোখে পড়েনি। সরকার দাবি করে থাকেন আমরা ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। এ কথাতে বিশ্বাসও রয়েছে মানুষের। তারপরও গরিব মানুষের এ দৈনন্দিন অপরিহার্য পণ্যটির দাম কেন বেড়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের কোন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

উৎপাদন ছাড়াও বিদেশ থেকে কিছু কিছু চাল আমদানি আবার ভালো কোয়ালিটির চিকন চাল রফতানির খবরও শুনি। অহরহ এও শুনি যে বিস্তর খাদ্য সরকারি গুদামে মজুত আছে উৎপাদনও হয়েছে প্রচুর। যদি তা সত্য হয় তবে কেন মোটা চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা ভালো করে তদন্ত করে দেখা দরকার। কোন ক্রমেই যাতে গরিবের খাদ্যের দাম সহনশীলতার বাইরে না যায়Ñ তা অবশ্যই দেখতে হবে যে কোন মূল্যে। কারণ ওই গরিবরাই ১৬ কোটি মানুষের নিত্যদিনের আহার জুগিয়ে থাকে।

শিশু খাদ্য

শিশুখাদ্য এখন তো একমাত্র গরুর দুধই। শারীরিক কারণেই বেশিরভাগ মা ছয় মাস ধরে শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারেন না। তাই গরুর দুধ এর বিকল্প নেই। তার দামও ভয়ানকভাবে বেড়েছে। তবুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই বাজারে যা পাওয়া যায় তাই কিনতে হয়, তাই খাওয়াতে হয়। কিন্তু দাম এতটাই বেশি যে ওই দুধও গরিব মানুষেরা কিনতে পারেন না। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছে ব্যাপকসংখ্যক শিশু। দেশে দুধেল গাইয়ের সংখ্যা স্বল্পতার ফলেই মূলত: এ সংকটের সৃষ্টি। দুর্মূল্যের কারণে প্রাপ্তবয়স্ক, বয়স্ক, সন্তান-সম্ভাবা বধূরাও বহুকাল যাবত দুধকে তাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন।

বস্তুত: বাংলাদেশের সব বাজার দীর্ঘদিন যাবত নিয়ন্ত্রণ করছে অসংখ্য সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিক্টেগুলোর পেছনে মদত ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সরকারি দলের নেতাদেরও কতিপয় আমলার। তাই সিন্ডিকেটগুলো বহাল তবিয়তে তাদের গণবিরোধী ক্রিয়াকলাপ অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে, দেখবার বা এদের নিয়ন্ত্রণ করবার অথবা এদের মুনাফাখোরি-মজুতদারির বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও বাংলাদেশে কেউ রয়েছে সেটা মনে করবার কোন কারণ নেই। সুতরাং ১৬ কোটি মানুষ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি-সরকার নীরব দর্শক। এটাই বাংলাদেশ।

সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে দৃঢ়ভাবে সরকারকি এগিয়ে আসবে? মানুষ বাঁচানোর জন্য তা অপরিহার্য।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com