বিদ্যাসাগরের জীবনে নারী, নারীর জীবনে বিদ্যাসাগর

দেবাহুতি চক্রবর্তী

ব্যক্তির জৈবিক বিশেষত্ব, ব্যক্তিগত-সামাজিক অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও ঐতিহ্যগত অভিজ্ঞতা’ ... এই তিনের মাঝ দিয়েই ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠা। মানুষের যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি সমাজ নিরাবলম্ব নয়। সময়ের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজকে রূপান্তর করতে গেলে অনেকসময় ব্যক্তির ভূমিকা অগ্রগামী হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগর প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহ্যকে একমাত্র সত্য বলে মেনে নেননি। নিজের বুদ্ধি ও চেতনাজাত শক্তি দিয়ে সমাজকে কালোপযোগী করার জন্য বিশ্বাস করতেন বাস্তব কর্মক্ষেত্রকে। মার্কস যাকে বলেন, Social life is always practical. All mysteries which mislead theory to mysticism find their rational solution in human practice and in the comprehension of this practice.’ ...। সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যাসাগরের এই উপলব্ধি অন্তর্জাত।

তবু, ব্যক্তিজীবনে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কিছু কিছু নারীর সম্পর্ক তার সামাজিক চেতনাবোধকে, দ্বন্দ্বকে আরও শাণিত করে। প্রথমেই আসে মা ভগবতী দেবীর কথা। মা-ছেলের এই সম্পর্ক অনেকটা মিথের মতো অজগ্র কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই নারীর কাছেই বিদ্যাসাগরের মানবিকতা শিক্ষার প্রথম পাঠ। সে যুগের এক নারী হয়ে ভগবতী দেবী জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য নির্ধারিত বড় খরচের অর্থ দরিদ্রদের সেবায় বিতরণের জন্য পুত্রকে বলেন। নিজের জন্য পুত্রের কাছে যে তিনটি গয়না দাবি করেন, তার সবই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে। দাতব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, আর গরিব ছেলেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। মায়ের সব চাওয়াই পূরণ করেন বিদ্যাসাগর। অসহায় বাল্যবিধবাদের দিকেও তার অপরিসীম সহানুভূতি পুত্রকে নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রাণিত করে। বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পরে বিবাহিতা নারীদের সামাজিক ঘৃণার হাত থেকে রক্ষার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভগবতী দেবী তাদের সঙ্গে একপাত্রে খাবার খেয়েছেন। সেই আমলে সব সংস্কারমুক্ত এই নারী বিদ্যাসাগরের অতিথি শেতাঙ্গ হ্যারিসনকে রান্না করে নিজে দাঁড়িয়ে খাবার পরিবেশন করেন। ধনী-দরিদ্র, মূর্খ-বিদ্বান, নিচ বা উচ্চজাতি, নারী-পুরুষ, ধর্ম নির্বিশেষে ভগবতীদেবীর কুসংস্কারবিহীন উদার ও সমদৃষ্টি বিস্ময়কর। বিধবাবিবাহসহ সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলনের জন্য যখন বিদ্যাসাগর শুধু নিন্দা-মন্দ-কটুবাক্যের সম্মুখীন হন নাই, প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছিলেন, ভগবতী দেবীর আশীষ তখনও সঙ্গেই ছিল। ‘জননীজঠরে অভিমন্যুর মতো শিক্ষালাভ’ ... তুলনা করিয়া রবীন্দ্রনাথ লেখেন ....‘এখানে জননীর চরিতে এবং পুত্রের চরিতে প্রভেদ নাই। তাহারা যেন পরস্পরের পুনরাবৃত্তি।’... কত অন্ধবিশ্বাস মুক্ত হলে মায়ের সম্পর্কে ছেলের বক্তব্য ...’ আমার মা বলতেন যে দেবতা আমি নিজ হাতে গড়লাম সে আমাকে উদ্ধার করবে কেমন করে? বাঁশ, খড়, দড়ি, মাটিকে পুজো করে কি ধর্ম হয়? ‘... ধর্মের প্রতি স্বেচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততা বা নীরবতা নিয়ে বিদ্যাসাগর নাস্তিক না আস্তিক পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত আছে। তবে বাহ্যিক ধর্মীয় আচার-আচরণে তার যে কোন বিশ্বাস ছিল না এটা দুপক্ষেই সুপ্রতিষ্ঠিত। ভগবতী দেবী তার প্রশ্রয় ও আশ্রয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মায়ের শেষজীবনে বিদ্যাসাগর কাছে থাকতে পারেননি।

পিতামহীর সঙ্গেও শৈশবে বিদ্যাসাগরের একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। বীরসিংহ গ্রামের পড়াশোনা শেষে ইংরেজি ও উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলকাতায় পিতার সঙ্গে যে বাড়িতে ওঠেন, সেই বাড়ির কর্তার বিধবা ছোট বোন রাইমনি নিজ পুত্রের চেয়েও বিদ্যাসাগরকে যেন বেশি ভালোবাসতেন। বিদ্যাসাগর লেখেন, ...’ এই স্নেহ, দয়া, ... প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে রাইমনির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। ... আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধহয় সে নির্দেশ অসংগত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির স্নেহ, দয়া, সৌজন্য প্রত্যক্ষ করিয়াছে, ... সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে, তাহার তুল্য কৃতঘœ পামর ভূম-লে নাই।’ ... পিতামহীর অভাব রাইমণি নিবারণ করেন এই স্মৃতিচারণে বিদ্যাসাগর নিজেই তা উল্লেখ করেন।

একই চরিতকথায় তিনি অদেখা-অজানা এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারীর কথা উল্লেখ করেন। পথের পাশে দোকানে তিনি মুড়ি-মুড়কি বেচতেন। ঘটনা পিতা ঠাকুরদাসের কাছ থেকে শোনা। ঠাকুরদাসের তখন চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থা। প্রচ- ক্ষিধায় কাতর অবস্থায় একদিন সেই দোকানি নারীর কাছে শুধু জল চান। কিন্তু তার অবস্থা বুঝতে পেরে সেদিন ওই নারী পেট ভরে তাকে আহার করান। এবং তার আশ্বাসে যেদিন খাবার না জুটত ঠাকুরদাস এই দয়াময়ীর শরণাপন্ন হতেন। পিতার কাছ থেকে শোনা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লেখেন ...’ আমার অন্তকরণে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, স্ত্রীজাতির ওপর প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল। এই দোকানের মালিক, পুরুষ হইলে, ঠাকুরদাসের ওপর কখনই এরূপ দয়াপ্রকাশ ও বাৎসল্য প্রদর্শন করিতেন না।’ ...

বিদ্যাসাগরের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। আট বছরের দীনময়ীর সঙ্গে। পিতার চাপে ছাত্রাবস্থায় এই বিয়ে। কলকাতায় পড়তে যাওয়ার সময় পিতামহীকে বলে গেলেন, ‘এখন নাতির বিয়ে দিলে, নাত বৌ নিয়ে নৃত্যগীত আমোদ আহ্লাদ করো’ ...। বিদ্যাসাগর লেখাপড়া-কর্মজীবন তখন কলকাতায়। দীনময়ী গ্রামের বাড়িতে।...’ ঈশ্বরচন্দ্রের স্ত্রী থেকে বিদ্যাসাগরের স্ত্রী হয়ে ওঠার আলোকিত পর্বে তিনি আড়ালেই ‘... পড়ে রইলেন। তার দিন-রাত যাপনের কোথাও যেন ঈশ্বর নেই। বিয়ের পনেরো বছর পরে প্রথম ও একমাত্র পুত্র নারায়ণের জন্ম। পরে আরও চার কন্যার জন্ম দেন এই দম্পতি। কিন্তু, এই বিখ্যাত মানুষের ব্যস্ত জীবনে দীনময়ী আনত অভিমানে দূর থেকে দেখেন বিশাল সংসার যজ্ঞে নিজেকে সঁপে দেয়া ব্যক্তিটিকে। দীনময়ীর সঙ্গে কোনদিনই বিদ্যাসাগরের দূরত্ব কাটেনি। পুত্র নারায়ণের অতিরিক্ত আদর আর প্রশ্রয় দীনময়ীর অযোগ্যতা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে তার কাছে। সাংসারিক জীবনে নিজে দায়িত্ব পালন করে গেছেন শুধু। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী কালের প্রশ্ন যিনি দেশব্যাপী নারীর ক্রন্দনে বিগলিত হয়েছেন, একান্ত কাছের জনের বোবা কান্না তিনি কতটুকু শুনেছেন? ... দীনময়ীকে তৈরি করে নেবার সময় তিনি পাননি। শেষজীবনের ১২ বছর কলকাতায় বাদুরবাগানের বাড়িতে একসঙ্গে কাটিয়ে দীনময়ী মারা যান। দাম্পত্য জীবনের বোঝাপড়া নিজেদের মধ্যে তেমন করে হয়ে ওঠেনি। একক ভাবে হয়তো এই অভিজ্ঞতাও তাকে বাল্যবিবাহর কুফল আর স্ত্রী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে বেশি তাগিদ দিয়েছে।

এরা ছাড়া পরিবার ও পরিবারের বাইরে অনেক নারীই বিদ্যাসাগরের সহানুভূতি, দয়া, ভালোবাসা, সম্মান বিশেষভাবে পেয়েছে। একমাত্র পুত্র নারায়ণ বিধবা বিয়ে করে পরবর্তীতে তাকে পরিত্যাগ করে, যা মানতে পারেননি বিদ্যাসাগর। তিনি পুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং উইলে কার্যত তাকে বঞ্চিত রাখেন। কিন্তু সেই হতভাগ্য পুত্রবধূ ভবসুন্দরীর প্রতি আজীবন দায়িত্ব পালন করেন এবং উইলে তাকে অংশীদার রাখেন। বিদ্যাসাগরের উইলে বৃত্তিভোগী ৪৫ জনের মধ্যে নিকট ও দূরবর্তী আত্মীয়- এবং ৯ জন অনাত্মীয় বন্ধুর ও পরিচিত জনের অসহায় মা, বোন, স্ত্রী কন্যা মিলিয়ে ৩৫ জনই নারী। এই উইল যে কারও জন্য নারী আর নারীর প্রতি দায়িত্ববোধের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।

সবাই কমবেশি জানেন যে, বিদ্যাসাগর দেশে শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম প্রচলনের জন্য আজীবন লড়াই করেন। নিজে এজন্য ভাষা সহজীকরণ ও বিজ্ঞানসম্মত করার জন্য একের পর এক বই লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্ণপরিচয়, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ সর্বকালের জন্য আপামর বাঙালির শিক্ষা জীবনের ভিত্তি রচনা করেছে। একইসঙ্গে তার সংগ্রাম শুরু হলো নারী শিক্ষা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৮৪৯ সনে ড্রিঙ্কিওয়াটার বেথুন উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ... হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ে অবৈতনিকের সম্পাদক হিসেবে বিদ্যাসাগর যোগ দেন। মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যানবাহনে লেখা থাকত ...‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতি যতœঃ’...। কয়েক বছরের মধ্যেই চারটি জেলায় বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে পরিশ্রমে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৯০ সনে নিজ গ্রামে মায়ের নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আর্থিক দীনতা, সামাজিক সহযোগিতার অভাব বিদ্যালয়গুলোর সুষ্ঠু চলার প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। কিন্তু, নারীমুক্তির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে নারী শিক্ষায় রামমোহন পরবর্তী বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত এই প্রয়াস চিরস্মরণীয়।

বিদ্যাসাগরের সময় ঋতুপূর্ব কালে কন্যা বিবাহের প্রচলন, কঠিন কৌলিণ্য প্রথা, মৃত্যুর একদিন আগেও বিবাহের অজগ্র ঘটনা, বাল্যবৈধব্যর যন্ত্রণা, পুরুষের বহুবিবাহ ঘরে ঘরে নিত্যদিনের সংস্কার ও অভ্যস্ততায় পরিণত হয়। রাজা রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদ -আইন চালু হওয়ায় হিন্দুসমাজ অধিকতর রক্ষণশীল হয়ে ওঠে। কন্যারা দানের বস্তু এই সমাজে। বাল্যবিবাহের এই সমাজনৈতিক অসারতার সঙ্গে বহুবিবাহের সহজ যোগসাধন বিদ্যাসাগর অনুধাবন করেন অনায়াসেই। একাধিক রচনায় বিজ্ঞানসম্মত মানসিক ও শরীরতাত্তিক চিকিৎসাবিদ্যার যুক্তির সাহায্যে তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। বাল্যবিবাহ আর কৌলীণ্য প্রথার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বাল্যবিধবা, ঘরে ঘরে ব্যভিচার, ভ্রƒণহত্যা, সময়ে নারীহত্যা। অথচ শাস্ত্রের নামে নির্বিকার সমাজ। কন্যাদায়মুক্তির প্রতারণায় আবদ্ধ কঠিন সমাজ। আর এই দায়মুক্তির সঙ্গে জড়িত যৌনকাতর পুরুষতান্ত্রিকতা। শাস্ত্রের বিপরীতে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে শুধু লেখা নয়, আইনের জন্য হাজার হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন। কিন্তু শেষ অবধি বাল্যবিবাহ আর বহুবিবাহ রদ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগর সফল হতে পারেননি। তার অবর্ণনীয় পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ১৮৫৬ এর ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়। এই বছরের ডিসেম্বরে প্রথম বিধবা বিবাহ হয় প-িত শ্রীশচন্দ্র আর কালীমতির সঙ্গে। ১৮৫৬-১৮৬৭ অবধি বিদ্যাসাগর নিজ খরচে ৬০টি বিধবাবিবাহ দেন। যার খরচ হয়েছিল তখনকার দিনে ৮২,০০০ টাকা। যার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা আমৃত্যু তিনি বহন করেন।

এর বাইরে অনাথ অসহায়ের জন্য, রোগী পীড়িত জনের জন্য অর্থসহ সর্বপ্রকার সেবা ও দানের শেষ ছিল না বলেই দয়ার সাগর’, করুণাসিন্ধু বিভিন্নভাবে তিনি সাধারণের কাছে পরিচিত হন। জাতি, ধর্ম শ্রেণীভেদ তার ছিল না। হতদরিদ্র নারীদের রুক্ষ চুলের জন্য তিনি তেলের ব্যবস্থা করেন। বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মুচি, হাড়ি, ডোমের স্পর্শ এড়াতে দূর থেকে তেল দিত। ...’ ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য জাতীয় স্ত্রীলোকদিগের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন। ‘... ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্রর লেখায় আমরা পাই। উত্তরাধিকার সূত্রে কোন বিত্ত পাননি তিনি। কঠিন পরিশ্রম, লেখালেখি, শিক্ষকতা, প্রকাশনা ব্যবসা সব মিলিয়ে যেভাবে আয় করেন, তার অধিকাংশই পরোপকারে বিশেষত নারীদের জন্য ব্যয় হয়। পরিবার ও সমাজে নিজের কর্তব্য ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতাই চিরকাল সবার কাছে তাকে একগুঁয়ে হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিদ্যাসাগরের অসুস্থকালীন সময়ে সহবাস-সম্মতি আইনের পক্ষে-বিপক্ষে জোর সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। এই নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া এক প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেন, ...’ দু’দল বানরে দাঁত খিঁচুচ্ছে, ওতে বলবার কি আছে? গোঁড়া হিন্দুর দল কচি কচি মেয়েগুলোকে গলায় পা দিয়ে পরকালের পথ পরিষ্কার করছে ... অন্যদিকে যারা এই আইন পাস করাবার জন্য লাফালাফি করছে, তারা যেন আইন করে ১২ বছর পর্যন্ত মেয়েগুলোকে রক্ষা করবে। কিন্তু, মেয়ের বয়স ১২ বছর একদিন হবেই, তখন তাকে রক্ষা করবে কি করে?’... নারী শিক্ষার বিস্তার হলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ কমে যাবে মূলত এই বিশ্বাস তিনি পোষণ করতেন। প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চন্দ্রমুখী বসুকে তিনি নিজে বই উপহার দেন ও অভিনন্দিত করেন। একজন একা মানুষ ও পূর্ণ মানুষ সমাজের সম্মিলিত অন্ধ শক্তির বিরুদ্ধে যতদূর লড়েছেন সেটা আজও বিস্ময়কর। পরিবার আর সমাজের নিত্য সংঘাতে তিনি ক্লান্ত হয়েছেন। বিশ্রামের জন্য ছুটে গেছেন প্রকৃতির কাছে, ভূমিপুত্র সাঁওতালদের কাছে। সেখানে তিনি সেবা, দান সবই দিয়েছেন। পেয়েছেন অকৃপণ ভালোবাসা। শহর কলকাতার সেদিনের নাগরিক সমাজ তাঁর পাশে খুব কমই দাঁড়িয়েছে। বিরোধিতার ভাগ এতবেশি যে তিনি একপর্যায়ে ক্লান্তই হয়েছেন। ...’ আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে, আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। ...’ এই অসার অপদার্থ ব্যক্তিরা সমাজের মধ্যবিত্তশ্রেণী। স্বশ্রেণীবদ্ধতার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করতে যেয়ে তিনি অধিকতর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। অনেক অসংগতি ও স্ববিরোধিতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু শ্রেণীবদ্ধতা আর ব্যর্থতার অংশবিশেষ বাদ দিয়ে বলা যায়, বিদ্যাসাগর একাই তার সময় ও কালকে অতিক্রম করে আজও প্রাসঙ্গিক এক ব্যক্তিত্ব।

আজ এত বছর পরেও আক্ষরিক অর্থে নারী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার হয়েছে সত্য। কিন্তু আজও বাল্যবিবাহ উপমহাদেশীয় নারীর জীবনে চরম অভিশাপ। আজও বহুবিবাহের অভিশপ্ত ফলাফলে জর্জরিত হাজার হাজার নারী। বিধবাবিবাহ হিন্দু সমাজে আজও কঠিন। অন্যান্য ধর্মীয় সমাজে বিধবা বিবাহ অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানেও অভিজ্ঞতা খুব সন্তোষ বা সম্মানজনক নয়। নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে আজও আমরা লড়ছি। বিদ্যাসাগরের উইল সেক্ষেত্রে কত প্রগতিশীল ভেবে বিস্মিত হতে হয়। নারীই যেখানে মুখ্য। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

নারী আন্দোলন আজ সুস্পষ্টভাবে দেশীয় ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে মনে করে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ নারীর একার দায়িত্ব নয়, সম্মিলিত নারী পুরুষের দায়িত্ব। সেখানে ২০০ বছর আগে বীরসিংহ গ্রামে জন্ম নেয়া খর্বাকৃতি, মাথায় প্রশস্ত টাক, চেহারা ও পোশাকে আকর্ষণহীন এই ব্যক্তিটি আজও নারীমুক্তির সব সংগ্রামে, নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অগ্রগামী পথিক। ...’ তিনি হচ্ছেন অসাধ্য যুগের সাধন সৈনিক। প্রথা অবরুদ্ধ সমাজের সীমা ভাঙবার সম্মুখভাগের অভিমন্যু, আপনার বিজন সাধন পথে গুরুর আশীর্বাদহীন একক একলব্য। ‘... তাকে জানা বোঝা নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার আবশ্য কর্তব্য। বিদ্যাসাগর ‘... উপাধি সেযুগে অনেক কৃতী ছাত্রই পেয়েছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর বলতে একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্রই পরিচিত। এই স্বল্প পরিসরে তাকে জানা সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগর চরিত’... কথায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ...’ তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন, ... আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না ...। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন। ... কিন্তু তাহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালি জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে। ‘... বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষে আমরা যেন এই তীর্থে মিলিত হতে পারি। তাকে দেখে, মূল্যায়ন করে নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয় করতে পারি। স্থান, কাল, পাত্রের ঊর্ধ্বে বৈশ্বিক নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাকে যুক্ত করতে পারি সবার সঙ্গে, সব বন্ধ মুক্ত করে।

শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৭ মহররম ১৪৪২, ০৮ আশ্বিন ১৪২৭

দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদ্যাসাগরের জীবনে নারী, নারীর জীবনে বিদ্যাসাগর

দেবাহুতি চক্রবর্তী

ব্যক্তির জৈবিক বিশেষত্ব, ব্যক্তিগত-সামাজিক অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও ঐতিহ্যগত অভিজ্ঞতা’ ... এই তিনের মাঝ দিয়েই ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠা। মানুষের যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি সমাজ নিরাবলম্ব নয়। সময়ের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজকে রূপান্তর করতে গেলে অনেকসময় ব্যক্তির ভূমিকা অগ্রগামী হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগর প্রাচীন শাস্ত্র ও ঐতিহ্যকে একমাত্র সত্য বলে মেনে নেননি। নিজের বুদ্ধি ও চেতনাজাত শক্তি দিয়ে সমাজকে কালোপযোগী করার জন্য বিশ্বাস করতেন বাস্তব কর্মক্ষেত্রকে। মার্কস যাকে বলেন, Social life is always practical. All mysteries which mislead theory to mysticism find their rational solution in human practice and in the comprehension of this practice.’ ...। সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যাসাগরের এই উপলব্ধি অন্তর্জাত।

তবু, ব্যক্তিজীবনে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কিছু কিছু নারীর সম্পর্ক তার সামাজিক চেতনাবোধকে, দ্বন্দ্বকে আরও শাণিত করে। প্রথমেই আসে মা ভগবতী দেবীর কথা। মা-ছেলের এই সম্পর্ক অনেকটা মিথের মতো অজগ্র কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই নারীর কাছেই বিদ্যাসাগরের মানবিকতা শিক্ষার প্রথম পাঠ। সে যুগের এক নারী হয়ে ভগবতী দেবী জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য নির্ধারিত বড় খরচের অর্থ দরিদ্রদের সেবায় বিতরণের জন্য পুত্রকে বলেন। নিজের জন্য পুত্রের কাছে যে তিনটি গয়না দাবি করেন, তার সবই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে। দাতব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, আর গরিব ছেলেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। মায়ের সব চাওয়াই পূরণ করেন বিদ্যাসাগর। অসহায় বাল্যবিধবাদের দিকেও তার অপরিসীম সহানুভূতি পুত্রকে নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রাণিত করে। বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পরে বিবাহিতা নারীদের সামাজিক ঘৃণার হাত থেকে রক্ষার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভগবতী দেবী তাদের সঙ্গে একপাত্রে খাবার খেয়েছেন। সেই আমলে সব সংস্কারমুক্ত এই নারী বিদ্যাসাগরের অতিথি শেতাঙ্গ হ্যারিসনকে রান্না করে নিজে দাঁড়িয়ে খাবার পরিবেশন করেন। ধনী-দরিদ্র, মূর্খ-বিদ্বান, নিচ বা উচ্চজাতি, নারী-পুরুষ, ধর্ম নির্বিশেষে ভগবতীদেবীর কুসংস্কারবিহীন উদার ও সমদৃষ্টি বিস্ময়কর। বিধবাবিবাহসহ সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলনের জন্য যখন বিদ্যাসাগর শুধু নিন্দা-মন্দ-কটুবাক্যের সম্মুখীন হন নাই, প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছিলেন, ভগবতী দেবীর আশীষ তখনও সঙ্গেই ছিল। ‘জননীজঠরে অভিমন্যুর মতো শিক্ষালাভ’ ... তুলনা করিয়া রবীন্দ্রনাথ লেখেন ....‘এখানে জননীর চরিতে এবং পুত্রের চরিতে প্রভেদ নাই। তাহারা যেন পরস্পরের পুনরাবৃত্তি।’... কত অন্ধবিশ্বাস মুক্ত হলে মায়ের সম্পর্কে ছেলের বক্তব্য ...’ আমার মা বলতেন যে দেবতা আমি নিজ হাতে গড়লাম সে আমাকে উদ্ধার করবে কেমন করে? বাঁশ, খড়, দড়ি, মাটিকে পুজো করে কি ধর্ম হয়? ‘... ধর্মের প্রতি স্বেচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততা বা নীরবতা নিয়ে বিদ্যাসাগর নাস্তিক না আস্তিক পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত আছে। তবে বাহ্যিক ধর্মীয় আচার-আচরণে তার যে কোন বিশ্বাস ছিল না এটা দুপক্ষেই সুপ্রতিষ্ঠিত। ভগবতী দেবী তার প্রশ্রয় ও আশ্রয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মায়ের শেষজীবনে বিদ্যাসাগর কাছে থাকতে পারেননি।

পিতামহীর সঙ্গেও শৈশবে বিদ্যাসাগরের একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। বীরসিংহ গ্রামের পড়াশোনা শেষে ইংরেজি ও উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলকাতায় পিতার সঙ্গে যে বাড়িতে ওঠেন, সেই বাড়ির কর্তার বিধবা ছোট বোন রাইমনি নিজ পুত্রের চেয়েও বিদ্যাসাগরকে যেন বেশি ভালোবাসতেন। বিদ্যাসাগর লেখেন, ...’ এই স্নেহ, দয়া, ... প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে রাইমনির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। ... আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধহয় সে নির্দেশ অসংগত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির স্নেহ, দয়া, সৌজন্য প্রত্যক্ষ করিয়াছে, ... সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে, তাহার তুল্য কৃতঘœ পামর ভূম-লে নাই।’ ... পিতামহীর অভাব রাইমণি নিবারণ করেন এই স্মৃতিচারণে বিদ্যাসাগর নিজেই তা উল্লেখ করেন।

একই চরিতকথায় তিনি অদেখা-অজানা এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারীর কথা উল্লেখ করেন। পথের পাশে দোকানে তিনি মুড়ি-মুড়কি বেচতেন। ঘটনা পিতা ঠাকুরদাসের কাছ থেকে শোনা। ঠাকুরদাসের তখন চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থা। প্রচ- ক্ষিধায় কাতর অবস্থায় একদিন সেই দোকানি নারীর কাছে শুধু জল চান। কিন্তু তার অবস্থা বুঝতে পেরে সেদিন ওই নারী পেট ভরে তাকে আহার করান। এবং তার আশ্বাসে যেদিন খাবার না জুটত ঠাকুরদাস এই দয়াময়ীর শরণাপন্ন হতেন। পিতার কাছ থেকে শোনা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লেখেন ...’ আমার অন্তকরণে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, স্ত্রীজাতির ওপর প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল। এই দোকানের মালিক, পুরুষ হইলে, ঠাকুরদাসের ওপর কখনই এরূপ দয়াপ্রকাশ ও বাৎসল্য প্রদর্শন করিতেন না।’ ...

বিদ্যাসাগরের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। আট বছরের দীনময়ীর সঙ্গে। পিতার চাপে ছাত্রাবস্থায় এই বিয়ে। কলকাতায় পড়তে যাওয়ার সময় পিতামহীকে বলে গেলেন, ‘এখন নাতির বিয়ে দিলে, নাত বৌ নিয়ে নৃত্যগীত আমোদ আহ্লাদ করো’ ...। বিদ্যাসাগর লেখাপড়া-কর্মজীবন তখন কলকাতায়। দীনময়ী গ্রামের বাড়িতে।...’ ঈশ্বরচন্দ্রের স্ত্রী থেকে বিদ্যাসাগরের স্ত্রী হয়ে ওঠার আলোকিত পর্বে তিনি আড়ালেই ‘... পড়ে রইলেন। তার দিন-রাত যাপনের কোথাও যেন ঈশ্বর নেই। বিয়ের পনেরো বছর পরে প্রথম ও একমাত্র পুত্র নারায়ণের জন্ম। পরে আরও চার কন্যার জন্ম দেন এই দম্পতি। কিন্তু, এই বিখ্যাত মানুষের ব্যস্ত জীবনে দীনময়ী আনত অভিমানে দূর থেকে দেখেন বিশাল সংসার যজ্ঞে নিজেকে সঁপে দেয়া ব্যক্তিটিকে। দীনময়ীর সঙ্গে কোনদিনই বিদ্যাসাগরের দূরত্ব কাটেনি। পুত্র নারায়ণের অতিরিক্ত আদর আর প্রশ্রয় দীনময়ীর অযোগ্যতা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে তার কাছে। সাংসারিক জীবনে নিজে দায়িত্ব পালন করে গেছেন শুধু। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী কালের প্রশ্ন যিনি দেশব্যাপী নারীর ক্রন্দনে বিগলিত হয়েছেন, একান্ত কাছের জনের বোবা কান্না তিনি কতটুকু শুনেছেন? ... দীনময়ীকে তৈরি করে নেবার সময় তিনি পাননি। শেষজীবনের ১২ বছর কলকাতায় বাদুরবাগানের বাড়িতে একসঙ্গে কাটিয়ে দীনময়ী মারা যান। দাম্পত্য জীবনের বোঝাপড়া নিজেদের মধ্যে তেমন করে হয়ে ওঠেনি। একক ভাবে হয়তো এই অভিজ্ঞতাও তাকে বাল্যবিবাহর কুফল আর স্ত্রী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে বেশি তাগিদ দিয়েছে।

এরা ছাড়া পরিবার ও পরিবারের বাইরে অনেক নারীই বিদ্যাসাগরের সহানুভূতি, দয়া, ভালোবাসা, সম্মান বিশেষভাবে পেয়েছে। একমাত্র পুত্র নারায়ণ বিধবা বিয়ে করে পরবর্তীতে তাকে পরিত্যাগ করে, যা মানতে পারেননি বিদ্যাসাগর। তিনি পুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং উইলে কার্যত তাকে বঞ্চিত রাখেন। কিন্তু সেই হতভাগ্য পুত্রবধূ ভবসুন্দরীর প্রতি আজীবন দায়িত্ব পালন করেন এবং উইলে তাকে অংশীদার রাখেন। বিদ্যাসাগরের উইলে বৃত্তিভোগী ৪৫ জনের মধ্যে নিকট ও দূরবর্তী আত্মীয়- এবং ৯ জন অনাত্মীয় বন্ধুর ও পরিচিত জনের অসহায় মা, বোন, স্ত্রী কন্যা মিলিয়ে ৩৫ জনই নারী। এই উইল যে কারও জন্য নারী আর নারীর প্রতি দায়িত্ববোধের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।

সবাই কমবেশি জানেন যে, বিদ্যাসাগর দেশে শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম প্রচলনের জন্য আজীবন লড়াই করেন। নিজে এজন্য ভাষা সহজীকরণ ও বিজ্ঞানসম্মত করার জন্য একের পর এক বই লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্ণপরিচয়, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ সর্বকালের জন্য আপামর বাঙালির শিক্ষা জীবনের ভিত্তি রচনা করেছে। একইসঙ্গে তার সংগ্রাম শুরু হলো নারী শিক্ষা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৮৪৯ সনে ড্রিঙ্কিওয়াটার বেথুন উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ... হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ে অবৈতনিকের সম্পাদক হিসেবে বিদ্যাসাগর যোগ দেন। মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যানবাহনে লেখা থাকত ...‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতি যতœঃ’...। কয়েক বছরের মধ্যেই চারটি জেলায় বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে পরিশ্রমে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৯০ সনে নিজ গ্রামে মায়ের নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আর্থিক দীনতা, সামাজিক সহযোগিতার অভাব বিদ্যালয়গুলোর সুষ্ঠু চলার প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। কিন্তু, নারীমুক্তির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে নারী শিক্ষায় রামমোহন পরবর্তী বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত এই প্রয়াস চিরস্মরণীয়।

বিদ্যাসাগরের সময় ঋতুপূর্ব কালে কন্যা বিবাহের প্রচলন, কঠিন কৌলিণ্য প্রথা, মৃত্যুর একদিন আগেও বিবাহের অজগ্র ঘটনা, বাল্যবৈধব্যর যন্ত্রণা, পুরুষের বহুবিবাহ ঘরে ঘরে নিত্যদিনের সংস্কার ও অভ্যস্ততায় পরিণত হয়। রাজা রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদ -আইন চালু হওয়ায় হিন্দুসমাজ অধিকতর রক্ষণশীল হয়ে ওঠে। কন্যারা দানের বস্তু এই সমাজে। বাল্যবিবাহের এই সমাজনৈতিক অসারতার সঙ্গে বহুবিবাহের সহজ যোগসাধন বিদ্যাসাগর অনুধাবন করেন অনায়াসেই। একাধিক রচনায় বিজ্ঞানসম্মত মানসিক ও শরীরতাত্তিক চিকিৎসাবিদ্যার যুক্তির সাহায্যে তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। বাল্যবিবাহ আর কৌলীণ্য প্রথার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বাল্যবিধবা, ঘরে ঘরে ব্যভিচার, ভ্রƒণহত্যা, সময়ে নারীহত্যা। অথচ শাস্ত্রের নামে নির্বিকার সমাজ। কন্যাদায়মুক্তির প্রতারণায় আবদ্ধ কঠিন সমাজ। আর এই দায়মুক্তির সঙ্গে জড়িত যৌনকাতর পুরুষতান্ত্রিকতা। শাস্ত্রের বিপরীতে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে শুধু লেখা নয়, আইনের জন্য হাজার হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন। কিন্তু শেষ অবধি বাল্যবিবাহ আর বহুবিবাহ রদ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগর সফল হতে পারেননি। তার অবর্ণনীয় পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ১৮৫৬ এর ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়। এই বছরের ডিসেম্বরে প্রথম বিধবা বিবাহ হয় প-িত শ্রীশচন্দ্র আর কালীমতির সঙ্গে। ১৮৫৬-১৮৬৭ অবধি বিদ্যাসাগর নিজ খরচে ৬০টি বিধবাবিবাহ দেন। যার খরচ হয়েছিল তখনকার দিনে ৮২,০০০ টাকা। যার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা আমৃত্যু তিনি বহন করেন।

এর বাইরে অনাথ অসহায়ের জন্য, রোগী পীড়িত জনের জন্য অর্থসহ সর্বপ্রকার সেবা ও দানের শেষ ছিল না বলেই দয়ার সাগর’, করুণাসিন্ধু বিভিন্নভাবে তিনি সাধারণের কাছে পরিচিত হন। জাতি, ধর্ম শ্রেণীভেদ তার ছিল না। হতদরিদ্র নারীদের রুক্ষ চুলের জন্য তিনি তেলের ব্যবস্থা করেন। বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মুচি, হাড়ি, ডোমের স্পর্শ এড়াতে দূর থেকে তেল দিত। ...’ ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য জাতীয় স্ত্রীলোকদিগের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন। ‘... ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্রর লেখায় আমরা পাই। উত্তরাধিকার সূত্রে কোন বিত্ত পাননি তিনি। কঠিন পরিশ্রম, লেখালেখি, শিক্ষকতা, প্রকাশনা ব্যবসা সব মিলিয়ে যেভাবে আয় করেন, তার অধিকাংশই পরোপকারে বিশেষত নারীদের জন্য ব্যয় হয়। পরিবার ও সমাজে নিজের কর্তব্য ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতাই চিরকাল সবার কাছে তাকে একগুঁয়ে হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিদ্যাসাগরের অসুস্থকালীন সময়ে সহবাস-সম্মতি আইনের পক্ষে-বিপক্ষে জোর সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। এই নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া এক প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেন, ...’ দু’দল বানরে দাঁত খিঁচুচ্ছে, ওতে বলবার কি আছে? গোঁড়া হিন্দুর দল কচি কচি মেয়েগুলোকে গলায় পা দিয়ে পরকালের পথ পরিষ্কার করছে ... অন্যদিকে যারা এই আইন পাস করাবার জন্য লাফালাফি করছে, তারা যেন আইন করে ১২ বছর পর্যন্ত মেয়েগুলোকে রক্ষা করবে। কিন্তু, মেয়ের বয়স ১২ বছর একদিন হবেই, তখন তাকে রক্ষা করবে কি করে?’... নারী শিক্ষার বিস্তার হলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ কমে যাবে মূলত এই বিশ্বাস তিনি পোষণ করতেন। প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চন্দ্রমুখী বসুকে তিনি নিজে বই উপহার দেন ও অভিনন্দিত করেন। একজন একা মানুষ ও পূর্ণ মানুষ সমাজের সম্মিলিত অন্ধ শক্তির বিরুদ্ধে যতদূর লড়েছেন সেটা আজও বিস্ময়কর। পরিবার আর সমাজের নিত্য সংঘাতে তিনি ক্লান্ত হয়েছেন। বিশ্রামের জন্য ছুটে গেছেন প্রকৃতির কাছে, ভূমিপুত্র সাঁওতালদের কাছে। সেখানে তিনি সেবা, দান সবই দিয়েছেন। পেয়েছেন অকৃপণ ভালোবাসা। শহর কলকাতার সেদিনের নাগরিক সমাজ তাঁর পাশে খুব কমই দাঁড়িয়েছে। বিরোধিতার ভাগ এতবেশি যে তিনি একপর্যায়ে ক্লান্তই হয়েছেন। ...’ আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে, আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। ...’ এই অসার অপদার্থ ব্যক্তিরা সমাজের মধ্যবিত্তশ্রেণী। স্বশ্রেণীবদ্ধতার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করতে যেয়ে তিনি অধিকতর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। অনেক অসংগতি ও স্ববিরোধিতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু শ্রেণীবদ্ধতা আর ব্যর্থতার অংশবিশেষ বাদ দিয়ে বলা যায়, বিদ্যাসাগর একাই তার সময় ও কালকে অতিক্রম করে আজও প্রাসঙ্গিক এক ব্যক্তিত্ব।

আজ এত বছর পরেও আক্ষরিক অর্থে নারী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার হয়েছে সত্য। কিন্তু আজও বাল্যবিবাহ উপমহাদেশীয় নারীর জীবনে চরম অভিশাপ। আজও বহুবিবাহের অভিশপ্ত ফলাফলে জর্জরিত হাজার হাজার নারী। বিধবাবিবাহ হিন্দু সমাজে আজও কঠিন। অন্যান্য ধর্মীয় সমাজে বিধবা বিবাহ অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানেও অভিজ্ঞতা খুব সন্তোষ বা সম্মানজনক নয়। নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে আজও আমরা লড়ছি। বিদ্যাসাগরের উইল সেক্ষেত্রে কত প্রগতিশীল ভেবে বিস্মিত হতে হয়। নারীই যেখানে মুখ্য। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

নারী আন্দোলন আজ সুস্পষ্টভাবে দেশীয় ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে মনে করে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ নারীর একার দায়িত্ব নয়, সম্মিলিত নারী পুরুষের দায়িত্ব। সেখানে ২০০ বছর আগে বীরসিংহ গ্রামে জন্ম নেয়া খর্বাকৃতি, মাথায় প্রশস্ত টাক, চেহারা ও পোশাকে আকর্ষণহীন এই ব্যক্তিটি আজও নারীমুক্তির সব সংগ্রামে, নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অগ্রগামী পথিক। ...’ তিনি হচ্ছেন অসাধ্য যুগের সাধন সৈনিক। প্রথা অবরুদ্ধ সমাজের সীমা ভাঙবার সম্মুখভাগের অভিমন্যু, আপনার বিজন সাধন পথে গুরুর আশীর্বাদহীন একক একলব্য। ‘... তাকে জানা বোঝা নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার আবশ্য কর্তব্য। বিদ্যাসাগর ‘... উপাধি সেযুগে অনেক কৃতী ছাত্রই পেয়েছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর বলতে একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্রই পরিচিত। এই স্বল্প পরিসরে তাকে জানা সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগর চরিত’... কথায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ...’ তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন, ... আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না ...। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন। ... কিন্তু তাহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালি জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে। ‘... বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষে আমরা যেন এই তীর্থে মিলিত হতে পারি। তাকে দেখে, মূল্যায়ন করে নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয় করতে পারি। স্থান, কাল, পাত্রের ঊর্ধ্বে বৈশ্বিক নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাকে যুক্ত করতে পারি সবার সঙ্গে, সব বন্ধ মুক্ত করে।