জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশে কমছে না

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতন সত্ত্বেও দেশে তেলের দাম কমছে না। গত পাঁচ বছর বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিন্মমুখী থাকায়, কম দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ২০১৬ সালে একবার দেশে তেলের দাম কিছুটা কমানো হলেও এরপর আর দাম কমানো হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব বাজার পর্যালোচনা করে সরকার চাইলে ডিজেলের দাম অনেকটাই কমাতে পারে। এছাড়া দেশে উৎপাদিত কেরোসিন, অকটেন, পেট্রোলের দামও হ্রাস করতে পারে। তাদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হলে, পরিবহন ব্যয় কমে যাবে। কৃষি, বিদ্যুৎ, শিল্পসহ সব খাতেই উৎপাদন খরচ কমবে। সুফল পাবে সাধারণ মানুষ। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বর্তমানে জাহাজ ভাড়া এবং আনুসাঙ্গিক খচর কিছুটা বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৮ লিটার) পরিশোধিত ডিজেলের দাম ৭০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হলে বিপিসি ব্রেক ইভেন পয়েন্টে (লাভ লোকসান সমতা বিন্দু) থাকে। গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেলের দাম ছিল ৪১ দশমিক ৮৫ মার্কিন ডলার। এরসঙ্গে প্রিমিয়াম যুক্ত হওয়ার পর দেশে এসে বিপণন পর্যন্ত প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে বিপিসির লাভ থাকবে প্রায় ১১ টাকা। তবে লাভের পরিমাণ গত ছয় মাসে আরও অনেক বেশি ছিল।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম. এম আকাশ সংবাদকে বলেন, সরকার চাইলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমাতে পারে। তা না করে, কম দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে বিপিসির মুনাফা বাড়ানো হচ্ছে। বিপিসি এ মুনাফা কোন খাতে ব্যবহার করছে তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, দেশে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের একটা বড় অংশ পরিবহন খাতে ব্যবহার হয়। তেলের দাম কমানো হলে পণ্য পরিবহণের খরচ হ্রাস পাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমবে। শিল্পোৎপাদনেও সুফল আসবে। এর ইতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতেই পড়বে।

বিপিসি যেসব জ্বালানি তেল বিক্রি করে তার মধ্যে ৭০ শতাংশই দশমিক ১৩ ভাগই ডিজেল। এছাড়া ফার্নেস অয়েল ১০ দশমিক ৪৪ ভাগ, জেট ফুয়েল ৬ দশমিক ৫৭ ভাগ, অকটেন ৪ দশমিক ৮ ভাগ, পেট্রোল ৪ দশমিক ৮৬ ভাগ, কেরোসিন এক দশমিক ৮৬ ভাগ ছাড়াও অন্যান্য সামান্য কিছু পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রি করে। ফলে মূলত ডিজেলের দাম কমা বা বাড়ার ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি চাহিদার ৫৯ মে.টনই আমদানি করা হয়। এরমধ্যে যোগাযোগ (পরিবহন) খাতে ৫৭ শতাংশ, বিদ্যুতে ১৭ শতাংশ, কৃষিতে ১৬ শতাংশ, শিল্প খাতে ৬ শতাংশ এবং গৃহস্থালী ও অন্যান্য খাতে ৪ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহৃত হয়।

বিপিসির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম দেড় মাসে ডিজেল আমদানি করে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এ সময় বিপিসি পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করেছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার মে.টন (৭ দশমিক ৪৬ ব্যারেল)। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম নিম্নমুখী হয়ে পড়ে এবং ফেব্রুয়ারিতে তা ৬৫ ডলারে নেমে আসায় (ব্রেক ইভেন পয়েন্ট ৭৭ ডলার) এ পরিমাণ লাভ হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলেও এ লাভ অব্যহত ছিল। গত মার্চ থেকে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ায় জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যায়। তেল উত্তোলন অব্যাহত থাকায় বিশ্বব্যাপী রিজার্ভারগুলোও ভরে যায়। চাহিদা না থাকায় এবং রিজার্ভে জায়গা না থাকার ফলে গত ২২ এপ্রিলে ওপেকভিত্তিক প্রতি ব্রেন্ট ব্যারেল (অপরিশোধিত জ্বালানি) তেলের দাম ২০ থেকে ২২ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। এদিকে ২০ এপ্রিল মার্কিনভিত্তিক ক্রুড তেলের দাম শূন্যের নিচে যায়। এ দিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল হয়েছে মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলার। এ দামকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় ‘মাইনাস প্রাইসিং’ কিংবা ‘ডিসকাউন্ট প্রাইস’ বলা হয়। এর অর্থ হলো- উৎপাদকরা তেল কেনার জন্য উল্টো ক্রেতাদের অর্থ দিচ্ছেন। আসলে ওই সময় অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আদতে বিনামূল্যে দেয়া হলেও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওপেক এবং নন-ওপেক দেশগুলোর মধ্যে চলমান আলোচনাও দুই পরাশক্তি আমেরিকা-রাশিয়ার কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকা- ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করায় তেলের মূল্য কিছুটা বেড়েছে। তবে এখনও তা সর্বোচ্চ মূল্যের অর্ধেকেও পৌঁছায়নি।

আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২-১৩ সালে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ছিল ৯৬ মার্কিন ডলার। সে সময় বাংলাদেশে (৪ জানুয়ারি, ২০১৩) পেট্রোল-অকটেনের দাম লিটার প্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৯ টাকা এবং ডিজেল-কেরোসিনে ৭ টাকা বৃদ্ধি করে ৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ৪৮ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। তবে দেশে তেলের দাম কমেনি। সব মহলের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল দেশে অকটেন, পেট্রলে লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেল, করোসিনে লিটার প্রতি ৩ টাকা কমানো হয়; যে দাম এখনও অব্যহত আছে। দেশে বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন ৮৯ টাকায়, পেট্রোল ৮৬ টাকায়, ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৬৫ টাকায়। এ বছর এখন পর্যন্ত বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের গড় মূল্য হচ্ছে ৩৮ মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে গড়ে প্রতি লিটার অকটেন-পেট্রলে প্রায় ৩৫ টাকা এবং ডিজেল-করোসিনে ১৫ টাকা লাভ করছে বিপিসি।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে দেশে প্রায় ৬১ লাখ মেট্রিক টন বিভিন্ন পেট্রলিয়াম পণ্যের চাহিদা হবে। এরমধ্যে ৪৯ দশমিক ৮ লাখ মে. টন পেট্রলিয়াম জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ দেশীয় উৎস থেকে বিপিসি প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন পেট্রলিয়াম পাওয়া যাবে। আমদানির প্রায় ৫০ শতাংশ বা ২৪ দশমিক ৯ লাখ মে. টন সরকারিভাবে (জি-টু-জি) আলোচনার মাধ্যমে আটটি দেশ থেকে কেনা হবে এবং বাকি ৫০ শতাংশ খোলা দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানা গেছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এ প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোন পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। গত ১৯ আগস্ট সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটির বৈঠকে দেড় লাখ মে.টন পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা জানান। তিনি বলেন, এ বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণায় এবং প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। দাম কমানো উচিত কি না- অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি কী মনে করেন, এই প্রশ্নের জবাবে মুস্তফা কামাল বলেন, আমার কোনো মতামত নেই।

বিপিসির চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দাম কমানো-বাড়ানোর বিষয়টি বিপিসির নয়। এটা সরকারের এখতিয়ার। ভর্তুকি দেয়ার কারণে বিপিসি দীর্ঘদিন লোকসান করছে। এখন কিছুটা লাভ করছে। লোকসান উঠে আসলে, তখন তেলের দাম কমানো যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক বাজারে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণ ক্রেতাদের বেশি দামেই জ্বালানি তেল কিনতে হয়েছে। ওই সময় ব্যবসায়ী সংগঠন, বেসরকারি গবেষণা সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় কয়েক দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জন্য উদ্যোগও নিয়েছিল। অর্থমন্ত্রী নিজেই জ্বালানি বিভাগে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও একাধিকবার জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছিল। কিন্তু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, আগে ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করায় সরকার লোকসান দিয়েছে। বিশ্ববাজারে তেলে দাম বেশি থাকায় ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২৯ হাজার ৪১৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে বিপিসি। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে লাভ করা প্রয়োজন। বিপিসিও তেলের দাম কমানোর বিরোধিতা করেছিল। সে সময় শুধু ২০১৬ সালে একবার তেলের মূল্য কিছুটা কমানো হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিপিসি সময়ে সময়ে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করে। কারণে এ দেশে জেট ফুয়েলের দাম বেশি হলে উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো অন্য দেশ থেকে তেল নেয়। ফলে চাইলেও এটির দাম বেশি রাখা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোম্পানিগুলোকে সরাসরি ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দিয়েছে। ফলে চাইলেও এখানে নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম হাঁকতে পারে না বিপিসি। বাজার ধরে রাখতে ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ লিটার ৬০ টাকা থেকে ৪২ টাকায় নামিয়ে আনে সরকার। এ বছর ২৬ জুন আবার দাম কমিয়ে ৩৪ টাকা ৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ। যার পুরো নিয়ন্ত্রণই বিপিসির হাতে। বিপিসির বেঁধে দেওয়া দামেই সবাইকে তা কিনতে হয়। এর মধ্যে ডিজেল বাইরে থেকে আমদানি করা হলেও পেট্রল-অকটেনের প্রায় পুরোটাই আমাদের নিজস্ব কনডেনসেট প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হয়।

২০১৭ সালের শেষের দিকে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় টানা চার বছর লাভে থাকার বিপিসি সাময়িক লোকসানে পড়ে। সে সময় সংস্থাটি প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সাত টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের দাম ১৩ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তা আমলে নেয়নি সরকার। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অনেক কম। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ছয় মাস প্রতিদিন সাত থেকে দশ কোটি টাকা লাভ করছে বিপিসি।

বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বিগত তিন অর্থবছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০) বিপিসি মোট ১ কোটি ৭৯ লাখ ৭৭ হাজার ২২৮ মে.টন জ্বালানি তেল আমদানী করেছে। এরমধ্যে ৩৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৪ মে.টন অপরিশোধিত এবং ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৪ মে.টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল। গত তিন অর্থবছরে বিপিসির মোট জ্বালানি তেল বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ৯৩ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬৩ মে.টন। সূত্র জানায়, বিপিসি ২০২১ সালে প্রায় ৪৯ লাখ মে.টন তেল আমদানী করবে। বিভিন্ন দেশের সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে-কুয়েতের কেপিসি থেকে সর্বাধিক ১২ দশমিক ৩ লাখ মে. টন পেট্রোলিয়াম আমদানি করা হবে এবং এ তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী হিসেবে চীনের ইউএনআইপিইসি ও পেট্রোচায়না থেকে যথাক্রমে ২ দশমিক ৪ লাখ মেট্রি টন ও ১ দশমিক ৪ লাখ মে.টন পেট্রোলিয়াম আমদানি হবে। এছাড়া, ২০২১ সালে মালয়েশিয়ার পিটিএলসিএল থেকে প্রায় ২ দশমিক ৬ লাখ মে.টন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইএনওসি থেকে ১ দশমিক ৬ লাখ মে.টন, ইন্দোনেশিয়ার বুমি সিয়াক থেকে ৩ লাখ মে.টন, থাইল্যান্ডের পিটিটিটি থেকে ১ লাখ মে.টন এবং ভারত থেকে ৬০ হাজার মে.টন পেট্রলিয়াম আমদানি করা হবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছর থেকে বিদেশ থেকে কোনো পেট্রোল ও কেরোসিন আমদানি করবে না সরকার। দেশের সরকারি ও বেসরকারি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ দুটি পণ্য যে পরিমাণ উপাদান হয়, তাতেই চাহিদা প্রায় মিটে যায়। নতুন পণ্য হিসেবে পেট্রোলিয়াম আমদানির তালিকায় আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমপিও) মান অনুযায়ি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম সালফার যুক্ত ফার্নেস তেল (জাহাজের জ্বালানি) যুক্ত করেছে বিপিসি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে দেশে প্রথমবারের মতো লো-সালফারযুক্ত জ্বালানি নিয়ে একটি তেলবাহী জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের ভিড়ে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরগুলোর সমমানের জ্বালানি তেল সংগ্রহের সুবিধা নিশ্চিত হবে।

এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড থেকে জ্বালানি (পেট্রল) ক্রয় বন্ধ রেখেছে বিপিসি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের জ্বালানি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মান অনুযায়ী উৎপাদিত নয়। তবে বিষয়টিকে বিপিসি কর্তৃপক্ষের অজুহাত দাবি করে গত মঙ্গলবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় একটি হোটেলে সম্মেলনকক্ষে যৌথসভা ডাকেন বাংলাদেশ ট্যাংক-লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ, বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটরস অ্যান্ড পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ এবং ট্যাংক-লরি শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট বিভাগের নেতারা। বিপিসির এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, গত ৩০ বছর ধরে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের পেট্রল বাজারে বিপণন হচ্ছে, কোন অভিযোগ ওঠেনি। বিপিসি কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এই পেট্রোল ক্রয় বন্ধ করে, নিম্নমানের পেট্রল আমদানি করে তা বাজারে সরবরাহ করছে।

রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৮ মহররম ১৪৪২, ০৯ আশ্বিন ১৪২৭

জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশে কমছে না

ফয়েজ আহমেদ তুষার |

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতন সত্ত্বেও দেশে তেলের দাম কমছে না। গত পাঁচ বছর বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিন্মমুখী থাকায়, কম দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ২০১৬ সালে একবার দেশে তেলের দাম কিছুটা কমানো হলেও এরপর আর দাম কমানো হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব বাজার পর্যালোচনা করে সরকার চাইলে ডিজেলের দাম অনেকটাই কমাতে পারে। এছাড়া দেশে উৎপাদিত কেরোসিন, অকটেন, পেট্রোলের দামও হ্রাস করতে পারে। তাদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হলে, পরিবহন ব্যয় কমে যাবে। কৃষি, বিদ্যুৎ, শিল্পসহ সব খাতেই উৎপাদন খরচ কমবে। সুফল পাবে সাধারণ মানুষ। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বর্তমানে জাহাজ ভাড়া এবং আনুসাঙ্গিক খচর কিছুটা বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৮ লিটার) পরিশোধিত ডিজেলের দাম ৭০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হলে বিপিসি ব্রেক ইভেন পয়েন্টে (লাভ লোকসান সমতা বিন্দু) থাকে। গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেলের দাম ছিল ৪১ দশমিক ৮৫ মার্কিন ডলার। এরসঙ্গে প্রিমিয়াম যুক্ত হওয়ার পর দেশে এসে বিপণন পর্যন্ত প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে বিপিসির লাভ থাকবে প্রায় ১১ টাকা। তবে লাভের পরিমাণ গত ছয় মাসে আরও অনেক বেশি ছিল।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম. এম আকাশ সংবাদকে বলেন, সরকার চাইলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমাতে পারে। তা না করে, কম দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে বিপিসির মুনাফা বাড়ানো হচ্ছে। বিপিসি এ মুনাফা কোন খাতে ব্যবহার করছে তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, দেশে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের একটা বড় অংশ পরিবহন খাতে ব্যবহার হয়। তেলের দাম কমানো হলে পণ্য পরিবহণের খরচ হ্রাস পাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমবে। শিল্পোৎপাদনেও সুফল আসবে। এর ইতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতেই পড়বে।

বিপিসি যেসব জ্বালানি তেল বিক্রি করে তার মধ্যে ৭০ শতাংশই দশমিক ১৩ ভাগই ডিজেল। এছাড়া ফার্নেস অয়েল ১০ দশমিক ৪৪ ভাগ, জেট ফুয়েল ৬ দশমিক ৫৭ ভাগ, অকটেন ৪ দশমিক ৮ ভাগ, পেট্রোল ৪ দশমিক ৮৬ ভাগ, কেরোসিন এক দশমিক ৮৬ ভাগ ছাড়াও অন্যান্য সামান্য কিছু পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রি করে। ফলে মূলত ডিজেলের দাম কমা বা বাড়ার ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি চাহিদার ৫৯ মে.টনই আমদানি করা হয়। এরমধ্যে যোগাযোগ (পরিবহন) খাতে ৫৭ শতাংশ, বিদ্যুতে ১৭ শতাংশ, কৃষিতে ১৬ শতাংশ, শিল্প খাতে ৬ শতাংশ এবং গৃহস্থালী ও অন্যান্য খাতে ৪ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহৃত হয়।

বিপিসির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম দেড় মাসে ডিজেল আমদানি করে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এ সময় বিপিসি পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করেছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার মে.টন (৭ দশমিক ৪৬ ব্যারেল)। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম নিম্নমুখী হয়ে পড়ে এবং ফেব্রুয়ারিতে তা ৬৫ ডলারে নেমে আসায় (ব্রেক ইভেন পয়েন্ট ৭৭ ডলার) এ পরিমাণ লাভ হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলেও এ লাভ অব্যহত ছিল। গত মার্চ থেকে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ায় জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যায়। তেল উত্তোলন অব্যাহত থাকায় বিশ্বব্যাপী রিজার্ভারগুলোও ভরে যায়। চাহিদা না থাকায় এবং রিজার্ভে জায়গা না থাকার ফলে গত ২২ এপ্রিলে ওপেকভিত্তিক প্রতি ব্রেন্ট ব্যারেল (অপরিশোধিত জ্বালানি) তেলের দাম ২০ থেকে ২২ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। এদিকে ২০ এপ্রিল মার্কিনভিত্তিক ক্রুড তেলের দাম শূন্যের নিচে যায়। এ দিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল হয়েছে মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলার। এ দামকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় ‘মাইনাস প্রাইসিং’ কিংবা ‘ডিসকাউন্ট প্রাইস’ বলা হয়। এর অর্থ হলো- উৎপাদকরা তেল কেনার জন্য উল্টো ক্রেতাদের অর্থ দিচ্ছেন। আসলে ওই সময় অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আদতে বিনামূল্যে দেয়া হলেও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওপেক এবং নন-ওপেক দেশগুলোর মধ্যে চলমান আলোচনাও দুই পরাশক্তি আমেরিকা-রাশিয়ার কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকা- ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করায় তেলের মূল্য কিছুটা বেড়েছে। তবে এখনও তা সর্বোচ্চ মূল্যের অর্ধেকেও পৌঁছায়নি।

আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২-১৩ সালে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ছিল ৯৬ মার্কিন ডলার। সে সময় বাংলাদেশে (৪ জানুয়ারি, ২০১৩) পেট্রোল-অকটেনের দাম লিটার প্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৯ টাকা এবং ডিজেল-কেরোসিনে ৭ টাকা বৃদ্ধি করে ৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ৪৮ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। তবে দেশে তেলের দাম কমেনি। সব মহলের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল দেশে অকটেন, পেট্রলে লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেল, করোসিনে লিটার প্রতি ৩ টাকা কমানো হয়; যে দাম এখনও অব্যহত আছে। দেশে বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন ৮৯ টাকায়, পেট্রোল ৮৬ টাকায়, ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৬৫ টাকায়। এ বছর এখন পর্যন্ত বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের গড় মূল্য হচ্ছে ৩৮ মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে গড়ে প্রতি লিটার অকটেন-পেট্রলে প্রায় ৩৫ টাকা এবং ডিজেল-করোসিনে ১৫ টাকা লাভ করছে বিপিসি।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে দেশে প্রায় ৬১ লাখ মেট্রিক টন বিভিন্ন পেট্রলিয়াম পণ্যের চাহিদা হবে। এরমধ্যে ৪৯ দশমিক ৮ লাখ মে. টন পেট্রলিয়াম জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ দেশীয় উৎস থেকে বিপিসি প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন পেট্রলিয়াম পাওয়া যাবে। আমদানির প্রায় ৫০ শতাংশ বা ২৪ দশমিক ৯ লাখ মে. টন সরকারিভাবে (জি-টু-জি) আলোচনার মাধ্যমে আটটি দেশ থেকে কেনা হবে এবং বাকি ৫০ শতাংশ খোলা দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানা গেছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এ প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোন পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। গত ১৯ আগস্ট সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটির বৈঠকে দেড় লাখ মে.টন পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা জানান। তিনি বলেন, এ বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণায় এবং প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। দাম কমানো উচিত কি না- অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি কী মনে করেন, এই প্রশ্নের জবাবে মুস্তফা কামাল বলেন, আমার কোনো মতামত নেই।

বিপিসির চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দাম কমানো-বাড়ানোর বিষয়টি বিপিসির নয়। এটা সরকারের এখতিয়ার। ভর্তুকি দেয়ার কারণে বিপিসি দীর্ঘদিন লোকসান করছে। এখন কিছুটা লাভ করছে। লোকসান উঠে আসলে, তখন তেলের দাম কমানো যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক বাজারে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণ ক্রেতাদের বেশি দামেই জ্বালানি তেল কিনতে হয়েছে। ওই সময় ব্যবসায়ী সংগঠন, বেসরকারি গবেষণা সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় কয়েক দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জন্য উদ্যোগও নিয়েছিল। অর্থমন্ত্রী নিজেই জ্বালানি বিভাগে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও একাধিকবার জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছিল। কিন্তু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, আগে ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করায় সরকার লোকসান দিয়েছে। বিশ্ববাজারে তেলে দাম বেশি থাকায় ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২৯ হাজার ৪১৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে বিপিসি। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে লাভ করা প্রয়োজন। বিপিসিও তেলের দাম কমানোর বিরোধিতা করেছিল। সে সময় শুধু ২০১৬ সালে একবার তেলের মূল্য কিছুটা কমানো হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিপিসি সময়ে সময়ে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করে। কারণে এ দেশে জেট ফুয়েলের দাম বেশি হলে উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো অন্য দেশ থেকে তেল নেয়। ফলে চাইলেও এটির দাম বেশি রাখা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোম্পানিগুলোকে সরাসরি ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দিয়েছে। ফলে চাইলেও এখানে নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম হাঁকতে পারে না বিপিসি। বাজার ধরে রাখতে ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ লিটার ৬০ টাকা থেকে ৪২ টাকায় নামিয়ে আনে সরকার। এ বছর ২৬ জুন আবার দাম কমিয়ে ৩৪ টাকা ৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ। যার পুরো নিয়ন্ত্রণই বিপিসির হাতে। বিপিসির বেঁধে দেওয়া দামেই সবাইকে তা কিনতে হয়। এর মধ্যে ডিজেল বাইরে থেকে আমদানি করা হলেও পেট্রল-অকটেনের প্রায় পুরোটাই আমাদের নিজস্ব কনডেনসেট প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হয়।

২০১৭ সালের শেষের দিকে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় টানা চার বছর লাভে থাকার বিপিসি সাময়িক লোকসানে পড়ে। সে সময় সংস্থাটি প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সাত টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের দাম ১৩ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তা আমলে নেয়নি সরকার। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অনেক কম। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ছয় মাস প্রতিদিন সাত থেকে দশ কোটি টাকা লাভ করছে বিপিসি।

বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বিগত তিন অর্থবছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০) বিপিসি মোট ১ কোটি ৭৯ লাখ ৭৭ হাজার ২২৮ মে.টন জ্বালানি তেল আমদানী করেছে। এরমধ্যে ৩৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৪ মে.টন অপরিশোধিত এবং ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৪ মে.টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল। গত তিন অর্থবছরে বিপিসির মোট জ্বালানি তেল বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ৯৩ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬৩ মে.টন। সূত্র জানায়, বিপিসি ২০২১ সালে প্রায় ৪৯ লাখ মে.টন তেল আমদানী করবে। বিভিন্ন দেশের সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে-কুয়েতের কেপিসি থেকে সর্বাধিক ১২ দশমিক ৩ লাখ মে. টন পেট্রোলিয়াম আমদানি করা হবে এবং এ তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী হিসেবে চীনের ইউএনআইপিইসি ও পেট্রোচায়না থেকে যথাক্রমে ২ দশমিক ৪ লাখ মেট্রি টন ও ১ দশমিক ৪ লাখ মে.টন পেট্রোলিয়াম আমদানি হবে। এছাড়া, ২০২১ সালে মালয়েশিয়ার পিটিএলসিএল থেকে প্রায় ২ দশমিক ৬ লাখ মে.টন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইএনওসি থেকে ১ দশমিক ৬ লাখ মে.টন, ইন্দোনেশিয়ার বুমি সিয়াক থেকে ৩ লাখ মে.টন, থাইল্যান্ডের পিটিটিটি থেকে ১ লাখ মে.টন এবং ভারত থেকে ৬০ হাজার মে.টন পেট্রলিয়াম আমদানি করা হবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছর থেকে বিদেশ থেকে কোনো পেট্রোল ও কেরোসিন আমদানি করবে না সরকার। দেশের সরকারি ও বেসরকারি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ দুটি পণ্য যে পরিমাণ উপাদান হয়, তাতেই চাহিদা প্রায় মিটে যায়। নতুন পণ্য হিসেবে পেট্রোলিয়াম আমদানির তালিকায় আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমপিও) মান অনুযায়ি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম সালফার যুক্ত ফার্নেস তেল (জাহাজের জ্বালানি) যুক্ত করেছে বিপিসি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে দেশে প্রথমবারের মতো লো-সালফারযুক্ত জ্বালানি নিয়ে একটি তেলবাহী জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের ভিড়ে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরগুলোর সমমানের জ্বালানি তেল সংগ্রহের সুবিধা নিশ্চিত হবে।

এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড থেকে জ্বালানি (পেট্রল) ক্রয় বন্ধ রেখেছে বিপিসি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের জ্বালানি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মান অনুযায়ী উৎপাদিত নয়। তবে বিষয়টিকে বিপিসি কর্তৃপক্ষের অজুহাত দাবি করে গত মঙ্গলবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় একটি হোটেলে সম্মেলনকক্ষে যৌথসভা ডাকেন বাংলাদেশ ট্যাংক-লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ, বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটরস অ্যান্ড পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ এবং ট্যাংক-লরি শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট বিভাগের নেতারা। বিপিসির এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, গত ৩০ বছর ধরে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের পেট্রল বাজারে বিপণন হচ্ছে, কোন অভিযোগ ওঠেনি। বিপিসি কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এই পেট্রোল ক্রয় বন্ধ করে, নিম্নমানের পেট্রল আমদানি করে তা বাজারে সরবরাহ করছে।