বিপর্যস্ত চামড়া শিল্পকে রক্ষা করা সময়ের দাবি

চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য। বহুবছর ধরে এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কিন্তু গত দুই-তিন বছরে চামড়া শিল্পে তৈরি হয়েছে ব্যপক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। মুখ থুবড়ে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা শিল্পটি। আড়তদারদের অভিযোগ ট্যানারি মালিকরা তাদের পাওনা টাকা আঁটকে রেখেছে। যার ফলে তারা পুঁজি হারিয়েছে যেটি চামড়া ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যপক প্রভাব ফেলেছে। আবার ট্যানারি মালিকদেরও সরকারের প্রতি কিছু অভিযোগ রয়েছে, তারা বলছেন অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারি গুলোকে সাভারে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি সরবরাহ ও গ্যাস সংযোগসহ নানাবিধ অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ কাজও এখনো শেষ করা হয়নি। ফলে ট্যানারি মালিকরাও বিপাকে পড়েছে। জমির দলিল হস্তান্তর নিয়েও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হাজারীবাগে ২০৫টি কারখানা থাকলেও সাভারে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫০টি প্লট, যে কারণে ৫৪টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

কোরবানির ইদকে কেন্দ্র করেই চামড়ার মূল ব্যবসা আবর্তিত হয়। আর তাই প্রতিবছরই কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয় এবং সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নানা ধরনের সিন্ডিকেট। তাই প্রতিবছর সরকার কর্তৃক প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো গ-র চামড়া ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা এবং সারাদেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৩ -১৫ এবং বকরির চামড়া ১০-১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দামসহ সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন ও ট্যানারি এসোসিয়েশন এর সঙ্গে কথা বলেই এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা কি নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় করেছে? বা আদৌও কোনকালেই কি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে তারা চামড়া ক্রয় করে? প্রতি বছর দেখা যায় সরকার একটি মূল্য নির্ধারণ করে, ট্যানারি মালিকরা আরেকটি মূল্য নির্ধারণ করে। তাহলে সরকারের মূল্য নির্ধারণের তো কোন মূল্যই থাকলো না। এ বছর ট্যানারি মালিকরা কোন মূল্য নির্ধারণ করেনি যেকারণে ব্যবসয়ীরা চামড়া ক্রয় নিয়ে শঙ্কায় ছিল যে আদৌও তারা চামড়া ক্রয় করে বিক্রি করতে পারবে কিনা। ফলাফল তাই দাঁড়ালো, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রয়কৃত চামড়া ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারেনি।

চামড়া শিল্পের এ বিপর্যয়ের কারণে রাষ্ট্র যেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এর বিরূপ ফল ভোগ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবছর প্রায় সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকার রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এবছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ট্যানারি মালিকদের ৭শ’ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে যাতে এই শিল্প থেকে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই লাভবান হয়। কিন্তু তাতেও কি সুফল মিলেছে? মূল্য বিপর্যয়ের কারণে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় দেশের বিভিন্নস্থানে অনেক ব্যবসায়ী দুঃখ ও ক্ষোভে কাঁচা চামড়া রাস্তায় কিংবা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। কোন কোন ব্যবসায়ীদের গতবছরের ন্যায় মাটির নিচে পুঁতে ফেলতেও দেখা গেছে। আবার কেউবা ভাসিয়ে দিয়েছেন নদীতে। সর্বোপরি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এ দেশের দরিদ্র জনগণ এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো যাদের কোরবানির চামড়ার হকদার বলা হয়ে থাকে।

একটা সময় দেখা যেত আঞ্চলিক ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার জন্য কত প্রতিযোগিতা করতো। একেকজন এসে একেকরকম দাম দর বলে যেত,দরকষাকষি হতো। প্রতি পিস চামড়া গড়ে তখন ২০০০-২২০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হতো। তখন সুদিন ছিল চামড়া শিল্পের, লাভবান হতো সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সর্বোপরি গরীব লোকেরাও লাভবান হতো। কিন্তু এবার পরিস্থিতি এতটাই নাগালের বাইরে চলে গেছে যে দৃশ্যপট আগাম আঁচ করতে পেরে অনেকেই বিনামূল্যে চামড়া মাদ্রাসা বা এতিমখানায় দান করতে চাইলেও অনেক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষই চামড়া নিতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। পনেরো-বিশ লাখ টাকা দিয়ে কেনা গ-র চামড়াও ১ হাজার টাকা বিক্রি করতে পেরেছে এমন নজীর দেখা যায়নি। চামড়া শিল্পে আর কতদিন স্থায়ী হবে এমন পরিস্থিতি? সরকার ট্যানারি মালিক এবং আড়তদারদের যৌথ প্রচেষ্টায় হয়তো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন কারী এ শিল্পটিকে রক্ষা করা যাবে। অন্যথায় সোনালি আঁশ পাটের মতো চামড়া শিল্পও ধ্বংস হয়ে যাবে।

রিফাত মাহদী

রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৮ মহররম ১৪৪২, ০৯ আশ্বিন ১৪২৭

বিপর্যস্ত চামড়া শিল্পকে রক্ষা করা সময়ের দাবি

চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য। বহুবছর ধরে এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কিন্তু গত দুই-তিন বছরে চামড়া শিল্পে তৈরি হয়েছে ব্যপক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। মুখ থুবড়ে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা শিল্পটি। আড়তদারদের অভিযোগ ট্যানারি মালিকরা তাদের পাওনা টাকা আঁটকে রেখেছে। যার ফলে তারা পুঁজি হারিয়েছে যেটি চামড়া ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যপক প্রভাব ফেলেছে। আবার ট্যানারি মালিকদেরও সরকারের প্রতি কিছু অভিযোগ রয়েছে, তারা বলছেন অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারি গুলোকে সাভারে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি সরবরাহ ও গ্যাস সংযোগসহ নানাবিধ অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ কাজও এখনো শেষ করা হয়নি। ফলে ট্যানারি মালিকরাও বিপাকে পড়েছে। জমির দলিল হস্তান্তর নিয়েও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হাজারীবাগে ২০৫টি কারখানা থাকলেও সাভারে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫০টি প্লট, যে কারণে ৫৪টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

কোরবানির ইদকে কেন্দ্র করেই চামড়ার মূল ব্যবসা আবর্তিত হয়। আর তাই প্রতিবছরই কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয় এবং সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নানা ধরনের সিন্ডিকেট। তাই প্রতিবছর সরকার কর্তৃক প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো গ-র চামড়া ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা এবং সারাদেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৩ -১৫ এবং বকরির চামড়া ১০-১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দামসহ সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন ও ট্যানারি এসোসিয়েশন এর সঙ্গে কথা বলেই এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা কি নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় করেছে? বা আদৌও কোনকালেই কি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে তারা চামড়া ক্রয় করে? প্রতি বছর দেখা যায় সরকার একটি মূল্য নির্ধারণ করে, ট্যানারি মালিকরা আরেকটি মূল্য নির্ধারণ করে। তাহলে সরকারের মূল্য নির্ধারণের তো কোন মূল্যই থাকলো না। এ বছর ট্যানারি মালিকরা কোন মূল্য নির্ধারণ করেনি যেকারণে ব্যবসয়ীরা চামড়া ক্রয় নিয়ে শঙ্কায় ছিল যে আদৌও তারা চামড়া ক্রয় করে বিক্রি করতে পারবে কিনা। ফলাফল তাই দাঁড়ালো, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রয়কৃত চামড়া ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারেনি।

চামড়া শিল্পের এ বিপর্যয়ের কারণে রাষ্ট্র যেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এর বিরূপ ফল ভোগ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবছর প্রায় সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকার রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এবছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ট্যানারি মালিকদের ৭শ’ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে যাতে এই শিল্প থেকে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই লাভবান হয়। কিন্তু তাতেও কি সুফল মিলেছে? মূল্য বিপর্যয়ের কারণে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় দেশের বিভিন্নস্থানে অনেক ব্যবসায়ী দুঃখ ও ক্ষোভে কাঁচা চামড়া রাস্তায় কিংবা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। কোন কোন ব্যবসায়ীদের গতবছরের ন্যায় মাটির নিচে পুঁতে ফেলতেও দেখা গেছে। আবার কেউবা ভাসিয়ে দিয়েছেন নদীতে। সর্বোপরি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এ দেশের দরিদ্র জনগণ এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো যাদের কোরবানির চামড়ার হকদার বলা হয়ে থাকে।

একটা সময় দেখা যেত আঞ্চলিক ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার জন্য কত প্রতিযোগিতা করতো। একেকজন এসে একেকরকম দাম দর বলে যেত,দরকষাকষি হতো। প্রতি পিস চামড়া গড়ে তখন ২০০০-২২০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হতো। তখন সুদিন ছিল চামড়া শিল্পের, লাভবান হতো সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সর্বোপরি গরীব লোকেরাও লাভবান হতো। কিন্তু এবার পরিস্থিতি এতটাই নাগালের বাইরে চলে গেছে যে দৃশ্যপট আগাম আঁচ করতে পেরে অনেকেই বিনামূল্যে চামড়া মাদ্রাসা বা এতিমখানায় দান করতে চাইলেও অনেক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষই চামড়া নিতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। পনেরো-বিশ লাখ টাকা দিয়ে কেনা গ-র চামড়াও ১ হাজার টাকা বিক্রি করতে পেরেছে এমন নজীর দেখা যায়নি। চামড়া শিল্পে আর কতদিন স্থায়ী হবে এমন পরিস্থিতি? সরকার ট্যানারি মালিক এবং আড়তদারদের যৌথ প্রচেষ্টায় হয়তো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন কারী এ শিল্পটিকে রক্ষা করা যাবে। অন্যথায় সোনালি আঁশ পাটের মতো চামড়া শিল্পও ধ্বংস হয়ে যাবে।

রিফাত মাহদী