এইটা কি শেষ ক্রসফায়ার?

নাজমুল হক

চলতি বছরের জুলাই মাসে ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ৪৬, অথচ আগস্টে ক্রসফায়ারে মারা গেছে মাত্র একজন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জুলাইয়ের শেষ দিন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পরই কার্যত সাময়িকভাবে থেমে গেছে ক্রসফায়ার। তারা বলছেন, সিনহার মৃত্যুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায় আপাতত ক্রসফায়ার বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্রসফায়ারের ওপর প্রভাব ফেলবে না এবং সিনহার ক্রসফায়ার ইস্যু থিতিয়ে এলে ফের এটি আবার শুরু হবে। অনেকের ধারণা শেষ মাসের (জুলাইয়ের ৪৬ জন) ক্রসফায়ারের আনুপাতিক হিসাব করলে মেজর সিনহার ইস্যু তৈরি না হলে আজ পর্যন্ত ৫০ দিনে অন্তত ৭৫-৮০ জনের প্রাণহানি হতো ক্রসফায়ারে। এক মেজর সিনহার মৃত্যু ৭৫ -৮০ জনকে সম্ভাব্য প্রাণহানি থেকে রক্ষা করল। ২ আগস্ট থেকে আজ ২১ সেপ্টেম্বর ৫০ দিন পূর্ণ হলো ক্রসফায়ারের কোন ঘটনা ছাড়া। ২০০৪ থেকে চলমান ১৬ বছরের কালো ইতিহাসে (ক্রসফায়ার সংস্কৃতি) ক্রসফায়ারবিহীন টানা ৫০ দিন মনে হয় এই প্রথম। ঈদুল আজহার ছুটি চলাকালীন গত ২ আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন আবদুল মান্নান ওরফে মুন্না (৩৫)। নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মুন্নাকে সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। নিহতের ভাই দাবি করেন আমার ভাই রিকশাচালক, ৯ মাস আগে মুন্নাকে পুলিশ ধরে মাদকের মামলা দেয়। তার রিকশায় আরেকজন মাদক নিয়ে ওঠে কিন্তু সে তা জানত না। সে কারাগারে থাকাবস্থায় তাকে আরও তিনটি মামলায় আসামি করে। আসামি হলে তাকে গ্রেপ্তার করুক। এভাবে মেরে ফেলবে? তার ছোট সন্তানের বয়স ৭ মাস। সন্তানদের দেখবে কে? প্রশ্ন রাখেন তিনি। (তথ্যসূত্র : আমাদের সময়) নিচের টেবিল থেকে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ক্রমহ্রাস (২৬?১৭?১৪) থকে পুনরায় ক্রমবৃদ্ধি (২৭?৪৬) উপরের ধারণাকে সত্যায়িত করে।

২০০৪-০৬ ৩৬ মাসে ৯৫১ গড়ে মাসে ২৬ জন, ২০০৭-০৮ ২৪ মাসে ৪০৪ গড়ে মাসে ১৭ জন, ২০০৯-১৭ ১০৮ মাসে ১৫৩৩* গড়ে মাসে ১৪ জন, ২০১৮-২০ ৩৫ মাসে ৯৪৬* গড়ে মাসে ২৭ জন, জুলাই ২০২০ ১ মাসে ৪৬* গড়ে মাসে ৪৬ জন।

*২০০৯-২০২০ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে মোট মৃত্যু ২৫২৫ জন সেই সংখ্যা থেকে ২০১৮ (৪২১জন), ২০১৯ (১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬১) ও ২০২০ (২১ মে পর্যন্ত ১০৮ জন) পর্যন্ত এবং চলতি বছরের জুলাই মাসের মৃত্যু সংখ্যার গড় আলাদা করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র : বিবিসি, ডয়চে ভেলে ও প্রথম আলো)

সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সত্যিকারের গোলাগুলি হয়। তখন ক্রসফায়ার (crossfire or gunfire from two or more directions passing through the same area)একটি বৈধ শব্দ, কিন্তু আমাদের দেশে ক্রসফায়ার শব্দটি শুনলেই মনে হয় অবৈধ। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই শব্দটিতে একই মিথ্যা বা একই ধাঁচের সাজানো কথা এত বেশি প্রয়োগ করেছে যে তা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ডাহা মিথ্যা মনে হয়। ১৯৭৩ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত এই কৌশলটি প্রয়োগ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এর নাম দিয়েছিল ‘পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু’। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে নিহত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি তাকে আটক অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ সাভারের তালবাগ এলাকায় ফেলে রাখা হয়। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে এই পদ্ধতির পুনঃপ্রয়োগ শুরু হয়। সে সময় দ্রুত সময়ে সন্ত্রাস দমনের জন্য অপারেশন ক্লিনহার্ট চালু করা হয়। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তর্গত হওয়ায় এটি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০০৪ ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনার সময় পুনরায় ‘ক্রসফায়ার’ ব্যবহার শুরু হয়। ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে তিন হাজার ৮৮০ জন কথিত ক্রসফায়ারে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। সেই হিসাবে এই সময়কালে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে ক্রসফায়ারে।

‘আঠারো বছর আগে ২০০২ সালে সেনা-পরিচালিত অপারেশন ক্লিন হার্ট এবং ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে চার হাজারের বেশি মানুষ কথিত ক্লিন হার্ট এবং ‘ক্রস ফায়ার’-এ প্রাণ হারিয়েছেন (মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী)। প্রায়ই বলা হয় প্রতিটি ঘটনার দাফতরিক তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু আদালত পর্যন্ত কয়টা পৌঁছেছে? নারায়ণগঞ্জে র?্যাবের হাতে সাত খুনের মামলা (ও মেজর সিনহার মামলা) ছাড়া আর কোন একটিও কি আমাদের মনে পড়ছে? বস্তুত বিষয়টি গোপন করা বা দেখেও না দেখার ভান করার অথবা ক্রসফায়ারে হত্যাকে আইনি রং দেয়ার অপচেষ্টা করার দিন শেষ হয়েছে, এবং ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার অবসান প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ঘটাতে হবে। (বিবিসিতে লেখা এক পাঠকের চিঠি)। সম্প্রতি দৈনিক সমকাল পত্রিকার একটি নিউজ পড়ে শরীরটা শিউরে ওঠে। কীভাবে নামের ভুলে ক্রসফায়ারে একজন নিরীহ দশম শ্রেণীর ছাত্রের প্রাণ গেল। একটি মামলার এজাহারের দুই নম্বর আসামি মো. জয়নাল, পিতা আবদুল জলিল পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তার নিহত হওয়ার সব বিষয় ও কাগজপত্র মামলার কেস ডকেটে (সিডিতে) নোট রাখাছিল। একাধিকবার চিঠি দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) সংগ্রহ করা হয়েছিল। মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরির মামলার আসামি বখাটে মো. জয়নালের মারা যাওয়ার বিষয়টি এভাবে চার্জশিটে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দিপংকর চন্দ্র রায়। নিহত হওয়ায় এ আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে আবেদন করা হয়। পুলিশের তদন্তের প্রেক্ষিতে আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতিও দেন আদালত। তবে এর কিছুদিন পরই মামলার মূল আসামি বখাটে জয়নাল হঠাৎ আদালতে এসে আইনজীবীর মাধ্যমে এ মামলায় হাজিরা দাখিল করে। ফলে মামলাটি অন্যদিকে মোড় নেয়। সামনে আসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজনের জায়গায় অন্যজন মারা যাওয়ার বিষয়টি। আদালত থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে এ তথ্য জানার পর এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বায়েজিদে সরেজমিন অনুসন্ধান করা হয়। এতে বের হয়ে আসতে থাকে আসল ঘটনা। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যে জয়নাল প্রাণ হারিয়েছে, সে আসলে ওই মামলার আসামি নয়। সে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল, পড়ত বায়েজিদে অবস্থিত ভোকেশনাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে। ফলে অভিযোগ উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাম ভুল করায় নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আচ্ছা কে নিবে এই বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়? এর আগেও কয়েকবার ক্রসফায়ার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু যখনি কোন ঘটনা গণঅসন্তোষ তৈরি করে তখন ক্রসফায়ার সাময়িক সময়ের জন্য থমকে যায়। পরবর্তীতে আগের চেয়েও আরও ক্ষিপ্রগতিতে তা পুনরায় শুরু হয়।

২০১১ সালের ২৩ মার্চে ঝালকাঠি লিমনের পা হারানো, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন, ২০১৮ সালের ২৬ মে টেকনাফের একরামুল হত্যা, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড, সংসদে সমাপনী ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি বলেছে অনেক ক্রসফায়ার হয়েছে আর নয়। সংবাদ সম্মেলনে মেজর সিনহার মা নাসিমা আক্তার অঝোরে কেঁদে এবং বুকফাটা আর্তনাদ করে জানায় সিনহার মৃত্যুর ঘটনাই যাতে শেষ ঘটনা হয়, এটাই যেন শেষ হত্যাকাণ্ড (ক্রসফায়ার) হয়। আমরাও সেই প্রত্যাশায় রইলাম।

[লেখক : প্রভাষক, বনানী বিদ্যানিকেতন কলেজ]

রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৮ মহররম ১৪৪২, ০৯ আশ্বিন ১৪২৭

এইটা কি শেষ ক্রসফায়ার?

নাজমুল হক

চলতি বছরের জুলাই মাসে ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ৪৬, অথচ আগস্টে ক্রসফায়ারে মারা গেছে মাত্র একজন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জুলাইয়ের শেষ দিন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পরই কার্যত সাময়িকভাবে থেমে গেছে ক্রসফায়ার। তারা বলছেন, সিনহার মৃত্যুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায় আপাতত ক্রসফায়ার বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্রসফায়ারের ওপর প্রভাব ফেলবে না এবং সিনহার ক্রসফায়ার ইস্যু থিতিয়ে এলে ফের এটি আবার শুরু হবে। অনেকের ধারণা শেষ মাসের (জুলাইয়ের ৪৬ জন) ক্রসফায়ারের আনুপাতিক হিসাব করলে মেজর সিনহার ইস্যু তৈরি না হলে আজ পর্যন্ত ৫০ দিনে অন্তত ৭৫-৮০ জনের প্রাণহানি হতো ক্রসফায়ারে। এক মেজর সিনহার মৃত্যু ৭৫ -৮০ জনকে সম্ভাব্য প্রাণহানি থেকে রক্ষা করল। ২ আগস্ট থেকে আজ ২১ সেপ্টেম্বর ৫০ দিন পূর্ণ হলো ক্রসফায়ারের কোন ঘটনা ছাড়া। ২০০৪ থেকে চলমান ১৬ বছরের কালো ইতিহাসে (ক্রসফায়ার সংস্কৃতি) ক্রসফায়ারবিহীন টানা ৫০ দিন মনে হয় এই প্রথম। ঈদুল আজহার ছুটি চলাকালীন গত ২ আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন আবদুল মান্নান ওরফে মুন্না (৩৫)। নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মুন্নাকে সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। নিহতের ভাই দাবি করেন আমার ভাই রিকশাচালক, ৯ মাস আগে মুন্নাকে পুলিশ ধরে মাদকের মামলা দেয়। তার রিকশায় আরেকজন মাদক নিয়ে ওঠে কিন্তু সে তা জানত না। সে কারাগারে থাকাবস্থায় তাকে আরও তিনটি মামলায় আসামি করে। আসামি হলে তাকে গ্রেপ্তার করুক। এভাবে মেরে ফেলবে? তার ছোট সন্তানের বয়স ৭ মাস। সন্তানদের দেখবে কে? প্রশ্ন রাখেন তিনি। (তথ্যসূত্র : আমাদের সময়) নিচের টেবিল থেকে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ক্রমহ্রাস (২৬?১৭?১৪) থকে পুনরায় ক্রমবৃদ্ধি (২৭?৪৬) উপরের ধারণাকে সত্যায়িত করে।

২০০৪-০৬ ৩৬ মাসে ৯৫১ গড়ে মাসে ২৬ জন, ২০০৭-০৮ ২৪ মাসে ৪০৪ গড়ে মাসে ১৭ জন, ২০০৯-১৭ ১০৮ মাসে ১৫৩৩* গড়ে মাসে ১৪ জন, ২০১৮-২০ ৩৫ মাসে ৯৪৬* গড়ে মাসে ২৭ জন, জুলাই ২০২০ ১ মাসে ৪৬* গড়ে মাসে ৪৬ জন।

*২০০৯-২০২০ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে মোট মৃত্যু ২৫২৫ জন সেই সংখ্যা থেকে ২০১৮ (৪২১জন), ২০১৯ (১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬১) ও ২০২০ (২১ মে পর্যন্ত ১০৮ জন) পর্যন্ত এবং চলতি বছরের জুলাই মাসের মৃত্যু সংখ্যার গড় আলাদা করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র : বিবিসি, ডয়চে ভেলে ও প্রথম আলো)

সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সত্যিকারের গোলাগুলি হয়। তখন ক্রসফায়ার (crossfire or gunfire from two or more directions passing through the same area)একটি বৈধ শব্দ, কিন্তু আমাদের দেশে ক্রসফায়ার শব্দটি শুনলেই মনে হয় অবৈধ। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই শব্দটিতে একই মিথ্যা বা একই ধাঁচের সাজানো কথা এত বেশি প্রয়োগ করেছে যে তা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ডাহা মিথ্যা মনে হয়। ১৯৭৩ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত এই কৌশলটি প্রয়োগ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এর নাম দিয়েছিল ‘পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু’। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে নিহত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি তাকে আটক অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ সাভারের তালবাগ এলাকায় ফেলে রাখা হয়। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে এই পদ্ধতির পুনঃপ্রয়োগ শুরু হয়। সে সময় দ্রুত সময়ে সন্ত্রাস দমনের জন্য অপারেশন ক্লিনহার্ট চালু করা হয়। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তর্গত হওয়ায় এটি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০০৪ ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনার সময় পুনরায় ‘ক্রসফায়ার’ ব্যবহার শুরু হয়। ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে তিন হাজার ৮৮০ জন কথিত ক্রসফায়ারে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। সেই হিসাবে এই সময়কালে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে ক্রসফায়ারে।

‘আঠারো বছর আগে ২০০২ সালে সেনা-পরিচালিত অপারেশন ক্লিন হার্ট এবং ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে চার হাজারের বেশি মানুষ কথিত ক্লিন হার্ট এবং ‘ক্রস ফায়ার’-এ প্রাণ হারিয়েছেন (মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী)। প্রায়ই বলা হয় প্রতিটি ঘটনার দাফতরিক তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু আদালত পর্যন্ত কয়টা পৌঁছেছে? নারায়ণগঞ্জে র?্যাবের হাতে সাত খুনের মামলা (ও মেজর সিনহার মামলা) ছাড়া আর কোন একটিও কি আমাদের মনে পড়ছে? বস্তুত বিষয়টি গোপন করা বা দেখেও না দেখার ভান করার অথবা ক্রসফায়ারে হত্যাকে আইনি রং দেয়ার অপচেষ্টা করার দিন শেষ হয়েছে, এবং ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার অবসান প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ঘটাতে হবে। (বিবিসিতে লেখা এক পাঠকের চিঠি)। সম্প্রতি দৈনিক সমকাল পত্রিকার একটি নিউজ পড়ে শরীরটা শিউরে ওঠে। কীভাবে নামের ভুলে ক্রসফায়ারে একজন নিরীহ দশম শ্রেণীর ছাত্রের প্রাণ গেল। একটি মামলার এজাহারের দুই নম্বর আসামি মো. জয়নাল, পিতা আবদুল জলিল পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তার নিহত হওয়ার সব বিষয় ও কাগজপত্র মামলার কেস ডকেটে (সিডিতে) নোট রাখাছিল। একাধিকবার চিঠি দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) সংগ্রহ করা হয়েছিল। মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরির মামলার আসামি বখাটে মো. জয়নালের মারা যাওয়ার বিষয়টি এভাবে চার্জশিটে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দিপংকর চন্দ্র রায়। নিহত হওয়ায় এ আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে আবেদন করা হয়। পুলিশের তদন্তের প্রেক্ষিতে আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতিও দেন আদালত। তবে এর কিছুদিন পরই মামলার মূল আসামি বখাটে জয়নাল হঠাৎ আদালতে এসে আইনজীবীর মাধ্যমে এ মামলায় হাজিরা দাখিল করে। ফলে মামলাটি অন্যদিকে মোড় নেয়। সামনে আসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজনের জায়গায় অন্যজন মারা যাওয়ার বিষয়টি। আদালত থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে এ তথ্য জানার পর এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বায়েজিদে সরেজমিন অনুসন্ধান করা হয়। এতে বের হয়ে আসতে থাকে আসল ঘটনা। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যে জয়নাল প্রাণ হারিয়েছে, সে আসলে ওই মামলার আসামি নয়। সে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল, পড়ত বায়েজিদে অবস্থিত ভোকেশনাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে। ফলে অভিযোগ উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাম ভুল করায় নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আচ্ছা কে নিবে এই বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়? এর আগেও কয়েকবার ক্রসফায়ার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু যখনি কোন ঘটনা গণঅসন্তোষ তৈরি করে তখন ক্রসফায়ার সাময়িক সময়ের জন্য থমকে যায়। পরবর্তীতে আগের চেয়েও আরও ক্ষিপ্রগতিতে তা পুনরায় শুরু হয়।

২০১১ সালের ২৩ মার্চে ঝালকাঠি লিমনের পা হারানো, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন, ২০১৮ সালের ২৬ মে টেকনাফের একরামুল হত্যা, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড, সংসদে সমাপনী ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি বলেছে অনেক ক্রসফায়ার হয়েছে আর নয়। সংবাদ সম্মেলনে মেজর সিনহার মা নাসিমা আক্তার অঝোরে কেঁদে এবং বুকফাটা আর্তনাদ করে জানায় সিনহার মৃত্যুর ঘটনাই যাতে শেষ ঘটনা হয়, এটাই যেন শেষ হত্যাকাণ্ড (ক্রসফায়ার) হয়। আমরাও সেই প্রত্যাশায় রইলাম।

[লেখক : প্রভাষক, বনানী বিদ্যানিকেতন কলেজ]