করোনাভাইরাসের নতুন ধরন নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ড. মো. শফিকুর রহমান

সম্প্রতি ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে করোনার রূপ বদল করে নতুন স্ট্রেনের ছড়িয়ে পড়ার খবরে পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটেনে করোনার একটি নতুন স্ট্রেন ভিইউয়াই-২০২১১২/০১ এর সন্ধান পাওয়া গেছে যা এর পুরাতন স্ট্রেন (কোভিড-১৯) এর চেয়ে ৫০-৭০% বেশি সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। তাছাড়া, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৫০% এর বেশি শরীরে এই করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেনটি পাওয়া যাচ্ছে বলেই বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। করোনার এরূপ ধরন পরিবর্তন কীভাবে হচ্ছে এবং ভ্যাকসিন কি এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে? তাছাড়া, করোনার বারবার ধরন পরিবর্তনে নতুন নতুন মিউটেন্ট সৃষ্টির ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

ভাইরাসের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবর্তন বা মিউটেশন খুবই স্বাভাবিক। করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস হওয়ায় এর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেবে এমন ভ্যাকসিন পাওয়া কিছুটা কঠিন। এর কারণ, ভাইরাস নিউক্লিক এসিড সাধারণত আরএনএ অথবা ডিএনএ দ্বারা গঠিত এবং আরএনএ-এর গাঠনিক স্থায়িত্ব ডিএনএ-এর তুলনায় অনেক কম হওয়ায় সহজেই এর কোন জিন সিকোয়েন্সে হঠাৎ পরিবর্তন আসতে পারে। ফলে নতুন সিরোটাপের ভাইরাস রূপে পরিবর্তিত হতে পারে, যাকে বলা হয় এর মিউটেন্ট স্ট্রেন। কাজেই আরএনএ ভাইরাস ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে মিউটেশন এবং এ ধরনের মিউটেশনের ফলে বেশিরভাগ আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরএনএ ভাইরাস জীবন্ত জীব কোষের ভেতর রেপ্লিকেশনের বা বংশ বৃদ্ধির সময় সময় আরএনএ কপি প্রক্রিয়ায় জিনোম সিকুয়েন্সের কোন কোন জায়গায় মাঝে মধ্যে ভুল হয়ে যায় এবং আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের প্রুফরিডিং কার্যকারিতার অভাবে ভাইরাসটি ডিএনএ ভাইরাসের মতো এ ভুলগুলো সংশোধনে অসমর্থ। তাছাড়া, আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন হার ডিএনএ ভাইরাসের চেয়ে বেশি হওয়ায় আরএনএ ভাইরাসের ভ্যাকসিন সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয় না। তবে, করোনাভাইরাস আরএনএ ভাইরাস হওয়া সত্ত্বেও এর আরডি-আরপি নামক স্বাধীন একটি প্রুফরিডিং ব্যবস্থা থাকায় অন্যান্য আরএনএ ভাইরাসের মতো মিউটেশনে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সহজে আসার কথা নয় এবং সে কারণেই হয়ত কোভিড-১৯ এর কার্যকরী ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। করোনার নতুন মিউটেন্টের এন্টিজেনিক গঠনে তেমন পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন অবশ্যই কাজ করবে।

এখন প্রশ্ন হলো, ফাইজার বা অন্যান্য ভ্যাকসিন কি যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনের মিউটেন্ট ভিইউয়াই-২০২১১২/০১ স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কাজ করবে? এ ধরনের ভ্যাকসিন সাধারণত করোনার স্পাইক এন্টিজেনকে টার্গেট (লক্ষ্য) করেই তৈরি করা হয়। এন্টিজেনের এমাইনো এসিড সিকুয়েন্সের মতো এমাইনো এসিড দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় যা সুস্থ শরীরে করোনা এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনটি করোনা এন্টিজেনের প্রোটিন শনাক্ত করে একাধিক প্রতিরোধ তৈরিতে কাজ করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ফাইজার বিএনটি১৬২ ভ্যাকসিনের কথা, যা ১২৭০ টি এমাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনের মিউটেন্টে মাত্র ৯টি এমাইনো এসিডে রূপান্তর ঘটেছে যা ফাইজার ভ্যাকসিনের ১% এর কম। এ থেকে বোঝা যায়, ফাইজার ও অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলো বর্তমানে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশে সৃষ্ট নতুন ধরনের করোনা মিউটেন্ট স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কাজ করবে যতক্ষণ না এর এন্টিজেনের এমাইনো এসিড রূপান্তরের হার অনেক বেশি হবে। আর যদি নতুন ধরনের করোনার এন্টিজেনের এমাইনো এসিড রূপান্তরের হার অনেক বেড়ে যায় তবে এসব ভ্যাকসিন কাজ করবে না এবং তখন পরিবর্তিত ধরনের করোনার এন্টিজেনের অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্সের ওপর মিল রেখে ভ্যাকসিনের অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্সেও পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনটি কয়েক মাস বা বছর পরপর আপডেট করতে হবে। তাছাড়া, এসব ভ্যাকসিন হয়ত অন্যান্য আরএনএ ভাইরাস ভ্যাকসিনের মতো কয়েক মাস বা মাত্র ১ বছর পর্যন্ত কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে।

কাজেই, ফাইজারসহ অন্যান্য ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ কার্যকারিতা, সুরক্ষা ও কতদিন সুরক্ষা দেবে তা জানার জন্য অপেক্ষাও করতে হবে। উল্লেখ্য যে, করোনাভাইরাসের সারফেস (স্পাইক) এন্টিজেন যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপক পরিবর্তন বা মিউটেশন না ঘটে ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো কাজ করবে এবং এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পরিশেষে বলতে চাই, করোনাভাইরাসের রূপ পরিবর্তন করলেও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের কার্যকর সুরক্ষা দেবে এবং পৃথিবীর মানুষ এ মহামারী থেকে রেহাই পাবে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ০৯ রবিউস সানি ১৪৪২

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ড. মো. শফিকুর রহমান

সম্প্রতি ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে করোনার রূপ বদল করে নতুন স্ট্রেনের ছড়িয়ে পড়ার খবরে পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটেনে করোনার একটি নতুন স্ট্রেন ভিইউয়াই-২০২১১২/০১ এর সন্ধান পাওয়া গেছে যা এর পুরাতন স্ট্রেন (কোভিড-১৯) এর চেয়ে ৫০-৭০% বেশি সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। তাছাড়া, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৫০% এর বেশি শরীরে এই করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেনটি পাওয়া যাচ্ছে বলেই বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। করোনার এরূপ ধরন পরিবর্তন কীভাবে হচ্ছে এবং ভ্যাকসিন কি এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে? তাছাড়া, করোনার বারবার ধরন পরিবর্তনে নতুন নতুন মিউটেন্ট সৃষ্টির ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

ভাইরাসের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবর্তন বা মিউটেশন খুবই স্বাভাবিক। করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস হওয়ায় এর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেবে এমন ভ্যাকসিন পাওয়া কিছুটা কঠিন। এর কারণ, ভাইরাস নিউক্লিক এসিড সাধারণত আরএনএ অথবা ডিএনএ দ্বারা গঠিত এবং আরএনএ-এর গাঠনিক স্থায়িত্ব ডিএনএ-এর তুলনায় অনেক কম হওয়ায় সহজেই এর কোন জিন সিকোয়েন্সে হঠাৎ পরিবর্তন আসতে পারে। ফলে নতুন সিরোটাপের ভাইরাস রূপে পরিবর্তিত হতে পারে, যাকে বলা হয় এর মিউটেন্ট স্ট্রেন। কাজেই আরএনএ ভাইরাস ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে মিউটেশন এবং এ ধরনের মিউটেশনের ফলে বেশিরভাগ আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরএনএ ভাইরাস জীবন্ত জীব কোষের ভেতর রেপ্লিকেশনের বা বংশ বৃদ্ধির সময় সময় আরএনএ কপি প্রক্রিয়ায় জিনোম সিকুয়েন্সের কোন কোন জায়গায় মাঝে মধ্যে ভুল হয়ে যায় এবং আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের প্রুফরিডিং কার্যকারিতার অভাবে ভাইরাসটি ডিএনএ ভাইরাসের মতো এ ভুলগুলো সংশোধনে অসমর্থ। তাছাড়া, আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন হার ডিএনএ ভাইরাসের চেয়ে বেশি হওয়ায় আরএনএ ভাইরাসের ভ্যাকসিন সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয় না। তবে, করোনাভাইরাস আরএনএ ভাইরাস হওয়া সত্ত্বেও এর আরডি-আরপি নামক স্বাধীন একটি প্রুফরিডিং ব্যবস্থা থাকায় অন্যান্য আরএনএ ভাইরাসের মতো মিউটেশনে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সহজে আসার কথা নয় এবং সে কারণেই হয়ত কোভিড-১৯ এর কার্যকরী ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। করোনার নতুন মিউটেন্টের এন্টিজেনিক গঠনে তেমন পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন অবশ্যই কাজ করবে।

এখন প্রশ্ন হলো, ফাইজার বা অন্যান্য ভ্যাকসিন কি যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনের মিউটেন্ট ভিইউয়াই-২০২১১২/০১ স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কাজ করবে? এ ধরনের ভ্যাকসিন সাধারণত করোনার স্পাইক এন্টিজেনকে টার্গেট (লক্ষ্য) করেই তৈরি করা হয়। এন্টিজেনের এমাইনো এসিড সিকুয়েন্সের মতো এমাইনো এসিড দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় যা সুস্থ শরীরে করোনা এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনটি করোনা এন্টিজেনের প্রোটিন শনাক্ত করে একাধিক প্রতিরোধ তৈরিতে কাজ করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ফাইজার বিএনটি১৬২ ভ্যাকসিনের কথা, যা ১২৭০ টি এমাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনের মিউটেন্টে মাত্র ৯টি এমাইনো এসিডে রূপান্তর ঘটেছে যা ফাইজার ভ্যাকসিনের ১% এর কম। এ থেকে বোঝা যায়, ফাইজার ও অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলো বর্তমানে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশে সৃষ্ট নতুন ধরনের করোনা মিউটেন্ট স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কাজ করবে যতক্ষণ না এর এন্টিজেনের এমাইনো এসিড রূপান্তরের হার অনেক বেশি হবে। আর যদি নতুন ধরনের করোনার এন্টিজেনের এমাইনো এসিড রূপান্তরের হার অনেক বেড়ে যায় তবে এসব ভ্যাকসিন কাজ করবে না এবং তখন পরিবর্তিত ধরনের করোনার এন্টিজেনের অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্সের ওপর মিল রেখে ভ্যাকসিনের অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্সেও পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনটি কয়েক মাস বা বছর পরপর আপডেট করতে হবে। তাছাড়া, এসব ভ্যাকসিন হয়ত অন্যান্য আরএনএ ভাইরাস ভ্যাকসিনের মতো কয়েক মাস বা মাত্র ১ বছর পর্যন্ত কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে।

কাজেই, ফাইজারসহ অন্যান্য ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ কার্যকারিতা, সুরক্ষা ও কতদিন সুরক্ষা দেবে তা জানার জন্য অপেক্ষাও করতে হবে। উল্লেখ্য যে, করোনাভাইরাসের সারফেস (স্পাইক) এন্টিজেন যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপক পরিবর্তন বা মিউটেশন না ঘটে ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো কাজ করবে এবং এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পরিশেষে বলতে চাই, করোনাভাইরাসের রূপ পরিবর্তন করলেও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের কার্যকর সুরক্ষা দেবে এবং পৃথিবীর মানুষ এ মহামারী থেকে রেহাই পাবে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]