ভাস্কর্য : সরকার : মৌলবাদী : প্রগতিশীল সমাজ

রণেশ মৈত্র

ভাস্কর্য ইস্যুটি বাংলাদেশে নতুন নয়। বহুদিন ধরেই চলে আসছে। ভাস্কর্য ভাঙ্গা, তা গড়তে না দেয়ার হুমকি, এদেশে ভাস্কর্য ও মূর্তির স্থান নেই- এহেন উক্তি, কথাবার্তা, হুমকি-ধামকির সাথে বাস্তবে তা ভেঙ্গে ফেলা চলছে বহুদিন ধরে। যারা ভাস্কর্যগুলো ভাঙ্গে, ভাঙ্গার বিরোধিতা করে, হুমকি দেয় তারা দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে- এতদিনে তারা যথেষ্ট শক্তিও অর্জন করেছে।

মানববন্ধন

এবার নভেম্বরের প্রথম দিকে মুমিনুল নামক এক হেফাজতে ইসলামী নেতা দুঃসাহসী হুমকি দিলেন এই বলে যে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা তারা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে। ক্ষীণকণ্ঠে এবং বিক্ষিপ্তভাবে হলেও নানা মহল থেকে এ উক্তির প্রতিবাদ হতে থাকার পর ডিসেম্বরের প্রথমে এসে দেখা গেল সরকার-সংশ্লিষ্ট নানামহল মিলিতভাবে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার হুমকির বিরুদ্ধে বিশাল বিশাল মানববন্ধন করল। মানববন্ধনগুলোতে তার উদ্যোক্তা নেতারা যা বললেন তা মূলত- ‘বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক’, ‘ভাস্কর্য পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশেই আছে-সুতরাং তা ইসলামবিরোধী নয়’, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে তারা রাজাকার-তারা পাকিস্তানপন্থি’ বলে বক্তব্য দিলেন। টেলিবিশন চ্যানেলগুলো বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই মানববন্ধনগুলোর ছবি দেখিয়েছে টেলিভিশনের সব চ্যানেল। কিন্তু হেফাজতে ইসলামীর নেতা মুমিনুল-বাবুনগরীরা এমন হুমুক দিলেও হেফাজতের নাম কোনো মানববন্ধন থেকেই উল্লেখ করা হয়নি। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়াতে নির্মীয়মান বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তাদের সাকরেদরাই ভেঙ্গে দেয়ার মতো দুঃসাহস দেখালো। তবুও হেফাজতের নাম কোথাও উচ্চারিত হয়নি আজ পর্যন্ত।

মৌলবাদীরা কি ভয় পেল?

দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদ ওঠার পর থেকে, বিশেষ করে যখন সরকারি মহল থেকে উপরে লিখিত ধরনের কথাবার্তা উচ্চারিত হতে থাকলো-মুমিনুল হক ও তার দল (বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন) বলে বসল- ‘তারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী নন, তারা ভাস্কর্য বিরোধী।’ এটুকু বলেই থেমে গেলেন। তবে ইঙ্গিতে বুঝালেন ভাস্কর্য ইসলামবিরোধী, তাই সব ভাস্কর্যই ইসলামবিরোধী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ। ফলে মৌলবাদীদের অবস্থান স্পষ্ট। তারা পশ্চাৎপসরণে রাজি নন।

রাজী যে নন, হাতে-নাতে তার প্রমাণও পাওয়া গেল। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত মধুদার ভাস্কর্যের অঙ্গহানি ঘটালো; ভেঙ্গে ফেললো তার কান। কিন্তু তারা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও ঢুকবার সাহস রাখে তা তারা দেখিয়ে দিল একটি ভাস্কর্যে অঙ্গহানির ঘটনা ঘটিয়ে।

সরকারি তরফের তৎপরতা

সরকারি তরফ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে তৎপর। মন্ত্রীদের বক্তব্যে বিষয়টি খোলাসা করে বারংবার বলা হচ্ছে, যথাস্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হবেই। এ কথা বারকয়েক বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বললেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বেশি বেশি করে দেখানো উচিত মুসলিম দেশগুলোর ভাস্কর্যগুলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়।’

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বললেন নতুন শপথ নেয়া ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। তার কথা হলো- বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আসলে ভুল বোঝাবুঝি চলছে। শীঘ্রই আলাপ-আলোচানার মাধ্যমে তা মীমাংসা করা হবে। সরকার শান্তি চায়।’

এ তৎপরতা ও মানববন্ধনগুলো দেখে আমাদের অনেকের মনে ধারণা জন্মাচ্ছে সরকার মুমিনুল বা হেফাজতের কথা মানবে না-বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ঠিকই নির্মাণ করবে এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিকরা আরেক দফা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হবে।

এখন যদি বিনাবাধায় যথাস্থানে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি নির্মিত হয় এবং ভাস্কর্যটি নিরাপদে স্থায়ীভাবে থাকতে পারেÑ তা এ মুহূর্তে একটা সাফল্য বলেই বিবেচিত হবে।

কিন্তু শেষ বিচারে?

আসলে কি মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকেই টার্গেট করেছে? বিষয়টা ইতিহাস ঐতিহ্যের নিরিখে ভাবা প্রয়োজন। গভীরভাবে সবাইকে তা ভাবতেও হবে।

যতটুকু দেখা যায়, আমাদের শহীদ মিনার বারবার ভাঙ্গা হয়েছে। বিমানবন্দরের কাছে বাউল লালন ফকিরের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়েছে, বলাকা ভাস্কর্যে আঘাত করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনের সম্মুখভাগ থেকে হেফাজতের আমির আল্লামা শফীর হুমকিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে ‘জাস্টিসিয়া’ নামক নারী ভাস্কর্যটি আড়ালে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দফায় দফায় নানাস্থানে বাউলদের অনুষ্ঠান মৌলবাদীদের হুমকিতে বন্ধ করে দিতে দেখা গেছে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালার সংক্ষিপ্তকরণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, নববর্ষে শিল্পীদের আঁকা কার্টুনসহ মিছিল নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে মৌলবাদী হুমকির ফলে। নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে ... ইত্যাদি।

তাহলে যদি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নির্মাণ নির্বিঘে্ন সম্ভব হয়ও (হবে হয়তো ব্যাপক পুলিশ প্রহরায়) এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ যদি নিরাপদ হয় বাঙালি কি তাতেই শতভাগ সন্তুষ্ট হবে? দল-বিশেষ হয়তো হতে পারে।

বিপদাপন্ন আসলে বাঙালি সংস্কৃতি

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সুন্দরভাবে নির্মিত হোক, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবং তার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা হোক, তা সমগ্র বাঙালি জাতির, সমগ্র দেশবাসীর অত্যন্ত আকাক্সিক্ষত। কিন্তু মৌলবাদীদের হুমকি দেয়ার ঔদ্ধত্য এলো কীভাবে? কীভাবে দেখবো এ ঘটনাটি?

বস্তুত তারা যখন দেখলো বাউল ভাস্কর্য ভেঙ্গে নিরাপদ থাকা গেল, যখন দেখলো ‘বলাকা’ ভাস্কর্যটিও ভাঙ্গা গেল, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন থেকে ‘জাস্টিশিয়া’ ভাস্কর্যটি অপসারণ করানো গেল। যখন দেখলো বাউলদের অনুষ্ঠান বন্ধ করানো যায়, পহেলা বৈশাখের মতো সম্প্রীতিমূলক ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলযাত্রার অনুষ্ঠানকে নানাভাবে সংকুচিত করে আনা গেল, যখন দেখলো ব্লগারদের হত্যা করেও মোটামুটি নিরাপদে থাকা যায়, যখন দেখলো বেশ কিছু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান তরুণদের বিনাপ্রমাণে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো প্রতিক্রিয়াশীল আইনে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন আটক করে রাখা যায়Ñ যখন তারা দেখে এসব কার্যকলাপের পারও দেশ মোটামুটি প্রতিবাদহীন; তখনই কেবল তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মিত হলে তা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত করার ঘোষণা দিতে সাহসী হয়। দেশজুড়ে মসজিদগুলোতে, ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ওই মৌলবাদী আলেমরাই ভাস্কর্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সব দিককেই আক্রমণ করতে আজও সাহস পাচ্ছে। নির্বিবাদে নির্বিঘেœ তারা দিব্যি তা করেও চলেছে দীর্ঘকাল যাবত। এভাবে নানা ভাষায়, নানা উদ্ধৃতি দিয়ে তারা চল্লিশের দশকের মতো মুসলিম মানসকে ভিন্নমুখী পশ্চাৎমুখী করে তুলতে অনেকটাই সফল হয়েছে। পাঠ্যসূচির সাম্প্রদায়িকীকরণের ফলে ওই শিক্ষায় গড়ে ওঠা আজকের তরুণ-তরুণীরাও ওই পশ্চাৎমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। বিপদটা ধীরে ধীরে সর্বগ্রাসী রূপধারণ করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেও পড়ছেন বিভ্রান্তিতে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী শক্তি, বাঙালি সংস্কৃতি মনেপ্রাণে ধারণ ও লালন এবং বিকশিত করার শক্তি, যাদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বামশক্তিগুলো দীর্ঘকাল যাবত আন্দোলন সংগ্রাম চালাতে চালাতে একাত্তরে এসে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে এনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গড়তে সক্ষম হয়েছিল, আজ বাংলাদেশে ওই শক্তিগুলো নিষ্ক্রিয় এবং সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। আদর্শিক জায়গায় লড়াই না চালিয়ে মৌলবাদী শক্তির ক্রমবিকাশকে এবং তাদের ধৃষ্টতা বৃদ্ধিকে প্রকারান্তরে সহযোগিতাই করা হচ্ছে। এ লড়াই দলের মধ্যেও চালাতে হয় দলকে আদর্শিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখার লক্ষ্যে। তা না করাতে অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর আদর্শের জায়গাটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। লড়াই করার মতো সংকল্প, উদ্যোগ, উদ্যম, উৎসাহ সবই অতীতের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর মৌলবাদ এবং মৌলবাদী শক্তিসমূহই তার বেনিফিশিয়ারি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

যে পরিস্থিতি সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে মৌলবাদীরা অগ্রসর হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও ঐতিহ্যবিরোধী। ফলে আদর্শিক চেতনার ক্ষেত্রে ভয়াবহ শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং তা দখল করে নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিসমূহ। ফলে সামগ্রিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আজ যেন পশ্চাৎপসরণ করছে। পরাজিত পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শক্তি তার স্থান দখল করে নিচ্ছে। মুমিনুলরা তারই ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

হেফাজতে ভাঙ্গন

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবেই বিভক্ত হয়েছে। দৃশত বাবুনগরী মুমিনুলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থনপুষ্ট। অনেককে বলতে শুনিÑ এই গ্রুপটি জামায়াতী আদর্শপুষ্ট। তা হলে কী দাঁড়ায়? প্রয়াত আল্লামা শফীর নেতৃত্বে থাকা হেফাজতে ইসলামের গরিষ্ঠ অংশ যদি জামায়াত অনুসারী হয়ে থাকে তবে তার দায় কি আল্লামা শফীর ওপরই বর্তায় না?

এখন আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন আল্লামা শফীর ছেলে। এরা কি তাহলে জামায়াত-বিএনপি বিরোধী? এরা কি তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ও বাঙালি সংস্কৃতির অনুসারী? কী বক্তব্য এদের ভাস্কর্যের ব্যাপারে? এরা কি মুমিনুলের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সংক্রান্ত ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন? তার বিরোধিতা করেন?

মনে রাখা দরকার- আল্লামা শফীই সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন থেকে ভাস্কর্য অপসারণের, পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের, বাঙালি সংস্কৃতির মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানগুলোর, শাহবাগ চত্বরের গণজমায়েতে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলায় তাদের বিরোধী ভূমিকা স্পষ্টভাবেই নিয়েছিলেন। তাই এ দ্বন্দ্ব, এ বিরোধ, এ বিভক্তি কোন মতাদর্শগত অমিলের কারণে নয়, পুরোপুরি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বপ্রসূত। সুতরাং বাবুনগরী মুমিনুলদের জামায়াত-বিএনপি বলে আল্লামা শফীর ছেলে গ্রুপের প্রতি মমত্ববোধ বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে প্রাণিত এমন উদ্ভট ধারণা সৃষ্টি বালসুলভ এবং ক্ষতিকর।

কোথায় বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তি?

দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যে মৌলবাদী হুমকি তা আগামী দিনের জাতীয় বিপদের ইঙ্গিতবহ। তাদের মূল এজেন্ডা বঙ্গবন্ধুও নন, ভাস্কর্যও নয়। তার মূল এবং অঘোষিত এজেন্ডা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল। একথা আল্লামা শফী ঢাকা অবরোধের কথা বলতে গিয়ে গোপন রাখেননি। তখন তারা প্রস্তুত ছিল না তাই বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করেনি; করেছে তার আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাকে, অসাম্প্রদায়িকতাকে, নারী অধিকারকে, শিক্ষানীতিকে। কোন অরাজনৈতিক বা বিচ্ছিন্ন উদ্দেশ্যে নয়। শক্তির পরিমাপ যথার্থভাবে করেই ক্ষমতা নয় আদর্শকে আঘাত করেছিল সেদিন। এখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে মূল এজেন্ডা বাস্তবায়নে।

তাই দরকার প্রতিরোধের, শক্তিশালী ধাক্কার। যেহেতু ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন মৌলবাদীদের মূল উদ্দেশ্য, তাই তারা ইরানের তুদেহ পার্টির মতো, ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মতো বিশাল পার্টিগুলোকে যেমন নির্মমভাবে নিশ্চিহ্ন করেছে, বাংলাদেশে তার বিপরীত কিছু ঘটবে বা নিরাপদ থেকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া যাবে- এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে যখন এদেশের প্রধান জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের সাথে আপস করে ফেলেছে।

তাই এখন ভিন্ন বলয়ে অবস্থানরত বাম প্রগতিশীল, উদার গণতন্ত্রীর একত্র সমাবেশ ঘটানো, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনকে প্রধান আন্দোলনে পরিণত করা সময়ের প্রধান দাবি।

[লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com

শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ , ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ১০ রবিউস সানি ১৪৪২

ভাস্কর্য : সরকার : মৌলবাদী : প্রগতিশীল সমাজ

রণেশ মৈত্র

ভাস্কর্য ইস্যুটি বাংলাদেশে নতুন নয়। বহুদিন ধরেই চলে আসছে। ভাস্কর্য ভাঙ্গা, তা গড়তে না দেয়ার হুমকি, এদেশে ভাস্কর্য ও মূর্তির স্থান নেই- এহেন উক্তি, কথাবার্তা, হুমকি-ধামকির সাথে বাস্তবে তা ভেঙ্গে ফেলা চলছে বহুদিন ধরে। যারা ভাস্কর্যগুলো ভাঙ্গে, ভাঙ্গার বিরোধিতা করে, হুমকি দেয় তারা দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে- এতদিনে তারা যথেষ্ট শক্তিও অর্জন করেছে।

মানববন্ধন

এবার নভেম্বরের প্রথম দিকে মুমিনুল নামক এক হেফাজতে ইসলামী নেতা দুঃসাহসী হুমকি দিলেন এই বলে যে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা তারা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে। ক্ষীণকণ্ঠে এবং বিক্ষিপ্তভাবে হলেও নানা মহল থেকে এ উক্তির প্রতিবাদ হতে থাকার পর ডিসেম্বরের প্রথমে এসে দেখা গেল সরকার-সংশ্লিষ্ট নানামহল মিলিতভাবে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার হুমকির বিরুদ্ধে বিশাল বিশাল মানববন্ধন করল। মানববন্ধনগুলোতে তার উদ্যোক্তা নেতারা যা বললেন তা মূলত- ‘বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক’, ‘ভাস্কর্য পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশেই আছে-সুতরাং তা ইসলামবিরোধী নয়’, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে তারা রাজাকার-তারা পাকিস্তানপন্থি’ বলে বক্তব্য দিলেন। টেলিবিশন চ্যানেলগুলো বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই মানববন্ধনগুলোর ছবি দেখিয়েছে টেলিভিশনের সব চ্যানেল। কিন্তু হেফাজতে ইসলামীর নেতা মুমিনুল-বাবুনগরীরা এমন হুমুক দিলেও হেফাজতের নাম কোনো মানববন্ধন থেকেই উল্লেখ করা হয়নি। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়াতে নির্মীয়মান বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তাদের সাকরেদরাই ভেঙ্গে দেয়ার মতো দুঃসাহস দেখালো। তবুও হেফাজতের নাম কোথাও উচ্চারিত হয়নি আজ পর্যন্ত।

মৌলবাদীরা কি ভয় পেল?

দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদ ওঠার পর থেকে, বিশেষ করে যখন সরকারি মহল থেকে উপরে লিখিত ধরনের কথাবার্তা উচ্চারিত হতে থাকলো-মুমিনুল হক ও তার দল (বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন) বলে বসল- ‘তারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী নন, তারা ভাস্কর্য বিরোধী।’ এটুকু বলেই থেমে গেলেন। তবে ইঙ্গিতে বুঝালেন ভাস্কর্য ইসলামবিরোধী, তাই সব ভাস্কর্যই ইসলামবিরোধী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ। ফলে মৌলবাদীদের অবস্থান স্পষ্ট। তারা পশ্চাৎপসরণে রাজি নন।

রাজী যে নন, হাতে-নাতে তার প্রমাণও পাওয়া গেল। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত মধুদার ভাস্কর্যের অঙ্গহানি ঘটালো; ভেঙ্গে ফেললো তার কান। কিন্তু তারা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও ঢুকবার সাহস রাখে তা তারা দেখিয়ে দিল একটি ভাস্কর্যে অঙ্গহানির ঘটনা ঘটিয়ে।

সরকারি তরফের তৎপরতা

সরকারি তরফ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে তৎপর। মন্ত্রীদের বক্তব্যে বিষয়টি খোলাসা করে বারংবার বলা হচ্ছে, যথাস্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হবেই। এ কথা বারকয়েক বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বললেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বেশি বেশি করে দেখানো উচিত মুসলিম দেশগুলোর ভাস্কর্যগুলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়।’

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বললেন নতুন শপথ নেয়া ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। তার কথা হলো- বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আসলে ভুল বোঝাবুঝি চলছে। শীঘ্রই আলাপ-আলোচানার মাধ্যমে তা মীমাংসা করা হবে। সরকার শান্তি চায়।’

এ তৎপরতা ও মানববন্ধনগুলো দেখে আমাদের অনেকের মনে ধারণা জন্মাচ্ছে সরকার মুমিনুল বা হেফাজতের কথা মানবে না-বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ঠিকই নির্মাণ করবে এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিকরা আরেক দফা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হবে।

এখন যদি বিনাবাধায় যথাস্থানে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি নির্মিত হয় এবং ভাস্কর্যটি নিরাপদে স্থায়ীভাবে থাকতে পারেÑ তা এ মুহূর্তে একটা সাফল্য বলেই বিবেচিত হবে।

কিন্তু শেষ বিচারে?

আসলে কি মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকেই টার্গেট করেছে? বিষয়টা ইতিহাস ঐতিহ্যের নিরিখে ভাবা প্রয়োজন। গভীরভাবে সবাইকে তা ভাবতেও হবে।

যতটুকু দেখা যায়, আমাদের শহীদ মিনার বারবার ভাঙ্গা হয়েছে। বিমানবন্দরের কাছে বাউল লালন ফকিরের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়েছে, বলাকা ভাস্কর্যে আঘাত করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনের সম্মুখভাগ থেকে হেফাজতের আমির আল্লামা শফীর হুমকিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে ‘জাস্টিসিয়া’ নামক নারী ভাস্কর্যটি আড়ালে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দফায় দফায় নানাস্থানে বাউলদের অনুষ্ঠান মৌলবাদীদের হুমকিতে বন্ধ করে দিতে দেখা গেছে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালার সংক্ষিপ্তকরণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, নববর্ষে শিল্পীদের আঁকা কার্টুনসহ মিছিল নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে মৌলবাদী হুমকির ফলে। নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে ... ইত্যাদি।

তাহলে যদি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নির্মাণ নির্বিঘে্ন সম্ভব হয়ও (হবে হয়তো ব্যাপক পুলিশ প্রহরায়) এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ যদি নিরাপদ হয় বাঙালি কি তাতেই শতভাগ সন্তুষ্ট হবে? দল-বিশেষ হয়তো হতে পারে।

বিপদাপন্ন আসলে বাঙালি সংস্কৃতি

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সুন্দরভাবে নির্মিত হোক, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবং তার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা হোক, তা সমগ্র বাঙালি জাতির, সমগ্র দেশবাসীর অত্যন্ত আকাক্সিক্ষত। কিন্তু মৌলবাদীদের হুমকি দেয়ার ঔদ্ধত্য এলো কীভাবে? কীভাবে দেখবো এ ঘটনাটি?

বস্তুত তারা যখন দেখলো বাউল ভাস্কর্য ভেঙ্গে নিরাপদ থাকা গেল, যখন দেখলো ‘বলাকা’ ভাস্কর্যটিও ভাঙ্গা গেল, সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন থেকে ‘জাস্টিশিয়া’ ভাস্কর্যটি অপসারণ করানো গেল। যখন দেখলো বাউলদের অনুষ্ঠান বন্ধ করানো যায়, পহেলা বৈশাখের মতো সম্প্রীতিমূলক ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলযাত্রার অনুষ্ঠানকে নানাভাবে সংকুচিত করে আনা গেল, যখন দেখলো ব্লগারদের হত্যা করেও মোটামুটি নিরাপদে থাকা যায়, যখন দেখলো বেশ কিছু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান তরুণদের বিনাপ্রমাণে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো প্রতিক্রিয়াশীল আইনে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন আটক করে রাখা যায়Ñ যখন তারা দেখে এসব কার্যকলাপের পারও দেশ মোটামুটি প্রতিবাদহীন; তখনই কেবল তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মিত হলে তা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত করার ঘোষণা দিতে সাহসী হয়। দেশজুড়ে মসজিদগুলোতে, ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ওই মৌলবাদী আলেমরাই ভাস্কর্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সব দিককেই আক্রমণ করতে আজও সাহস পাচ্ছে। নির্বিবাদে নির্বিঘেœ তারা দিব্যি তা করেও চলেছে দীর্ঘকাল যাবত। এভাবে নানা ভাষায়, নানা উদ্ধৃতি দিয়ে তারা চল্লিশের দশকের মতো মুসলিম মানসকে ভিন্নমুখী পশ্চাৎমুখী করে তুলতে অনেকটাই সফল হয়েছে। পাঠ্যসূচির সাম্প্রদায়িকীকরণের ফলে ওই শিক্ষায় গড়ে ওঠা আজকের তরুণ-তরুণীরাও ওই পশ্চাৎমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। বিপদটা ধীরে ধীরে সর্বগ্রাসী রূপধারণ করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেও পড়ছেন বিভ্রান্তিতে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী শক্তি, বাঙালি সংস্কৃতি মনেপ্রাণে ধারণ ও লালন এবং বিকশিত করার শক্তি, যাদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বামশক্তিগুলো দীর্ঘকাল যাবত আন্দোলন সংগ্রাম চালাতে চালাতে একাত্তরে এসে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে এনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গড়তে সক্ষম হয়েছিল, আজ বাংলাদেশে ওই শক্তিগুলো নিষ্ক্রিয় এবং সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। আদর্শিক জায়গায় লড়াই না চালিয়ে মৌলবাদী শক্তির ক্রমবিকাশকে এবং তাদের ধৃষ্টতা বৃদ্ধিকে প্রকারান্তরে সহযোগিতাই করা হচ্ছে। এ লড়াই দলের মধ্যেও চালাতে হয় দলকে আদর্শিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখার লক্ষ্যে। তা না করাতে অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর আদর্শের জায়গাটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। লড়াই করার মতো সংকল্প, উদ্যোগ, উদ্যম, উৎসাহ সবই অতীতের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর মৌলবাদ এবং মৌলবাদী শক্তিসমূহই তার বেনিফিশিয়ারি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

যে পরিস্থিতি সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে মৌলবাদীরা অগ্রসর হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও ঐতিহ্যবিরোধী। ফলে আদর্শিক চেতনার ক্ষেত্রে ভয়াবহ শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং তা দখল করে নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিসমূহ। ফলে সামগ্রিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আজ যেন পশ্চাৎপসরণ করছে। পরাজিত পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শক্তি তার স্থান দখল করে নিচ্ছে। মুমিনুলরা তারই ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

হেফাজতে ভাঙ্গন

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবেই বিভক্ত হয়েছে। দৃশত বাবুনগরী মুমিনুলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থনপুষ্ট। অনেককে বলতে শুনিÑ এই গ্রুপটি জামায়াতী আদর্শপুষ্ট। তা হলে কী দাঁড়ায়? প্রয়াত আল্লামা শফীর নেতৃত্বে থাকা হেফাজতে ইসলামের গরিষ্ঠ অংশ যদি জামায়াত অনুসারী হয়ে থাকে তবে তার দায় কি আল্লামা শফীর ওপরই বর্তায় না?

এখন আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন আল্লামা শফীর ছেলে। এরা কি তাহলে জামায়াত-বিএনপি বিরোধী? এরা কি তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ও বাঙালি সংস্কৃতির অনুসারী? কী বক্তব্য এদের ভাস্কর্যের ব্যাপারে? এরা কি মুমিনুলের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সংক্রান্ত ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন? তার বিরোধিতা করেন?

মনে রাখা দরকার- আল্লামা শফীই সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন থেকে ভাস্কর্য অপসারণের, পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের, বাঙালি সংস্কৃতির মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানগুলোর, শাহবাগ চত্বরের গণজমায়েতে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলায় তাদের বিরোধী ভূমিকা স্পষ্টভাবেই নিয়েছিলেন। তাই এ দ্বন্দ্ব, এ বিরোধ, এ বিভক্তি কোন মতাদর্শগত অমিলের কারণে নয়, পুরোপুরি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বপ্রসূত। সুতরাং বাবুনগরী মুমিনুলদের জামায়াত-বিএনপি বলে আল্লামা শফীর ছেলে গ্রুপের প্রতি মমত্ববোধ বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে প্রাণিত এমন উদ্ভট ধারণা সৃষ্টি বালসুলভ এবং ক্ষতিকর।

কোথায় বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তি?

দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যে মৌলবাদী হুমকি তা আগামী দিনের জাতীয় বিপদের ইঙ্গিতবহ। তাদের মূল এজেন্ডা বঙ্গবন্ধুও নন, ভাস্কর্যও নয়। তার মূল এবং অঘোষিত এজেন্ডা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল। একথা আল্লামা শফী ঢাকা অবরোধের কথা বলতে গিয়ে গোপন রাখেননি। তখন তারা প্রস্তুত ছিল না তাই বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করেনি; করেছে তার আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাকে, অসাম্প্রদায়িকতাকে, নারী অধিকারকে, শিক্ষানীতিকে। কোন অরাজনৈতিক বা বিচ্ছিন্ন উদ্দেশ্যে নয়। শক্তির পরিমাপ যথার্থভাবে করেই ক্ষমতা নয় আদর্শকে আঘাত করেছিল সেদিন। এখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে মূল এজেন্ডা বাস্তবায়নে।

তাই দরকার প্রতিরোধের, শক্তিশালী ধাক্কার। যেহেতু ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন মৌলবাদীদের মূল উদ্দেশ্য, তাই তারা ইরানের তুদেহ পার্টির মতো, ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মতো বিশাল পার্টিগুলোকে যেমন নির্মমভাবে নিশ্চিহ্ন করেছে, বাংলাদেশে তার বিপরীত কিছু ঘটবে বা নিরাপদ থেকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া যাবে- এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে যখন এদেশের প্রধান জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের সাথে আপস করে ফেলেছে।

তাই এখন ভিন্ন বলয়ে অবস্থানরত বাম প্রগতিশীল, উদার গণতন্ত্রীর একত্র সমাবেশ ঘটানো, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনকে প্রধান আন্দোলনে পরিণত করা সময়ের প্রধান দাবি।

[লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com