করোনা নিয়ে ৪৫ দিনের ঘরবন্দি জীবন যেভাবে কাটল

শুরু হলো জ্বর, হাঁচি, কাশি। ডাক্তার বললেন, নমুনা দিয়ে আইসোলেশনে চলে যান। দেরি না করে নমুনা দিয়ে এসেই ঘরে দরজা দিলাম। রাতেই জানা গেল করোনা পজিটিভ। ডাক্তার কতকগুলো টেস্ট দিলেন সেটাও করিয়ে এলাম সাবধানে গিয়ে। কয়েকটা ওষুধ দিলেন। শুরু করলাম করোনা নিয়ে ঘরবন্দি একাকী এক জীবন। ঘরে আলো-বাতাসের চলাচল খারাপ না। বারান্দা আছে তবে সেদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। কারও মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায় বা আমার দ্বারা কেউ সংক্রমিত হতে পারে এমন কাজ করাই যাবে না। একটা পালস ওক্সিমিটার সঙ্গে রাখতে হলো। ডাক্তার বলে দিলেন, দিনে তিন-চারবার পরীক্ষা করবেন। যদি দেখেন ৯৩% নেমে এসেছে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাবেন’। এটা শেষে আতঙ্কের একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এই বুঝি অক্সিজেনের টান পড়ল। জ্বরের অনুভব বেশি কিন্তু তাপমাত্রা ১০০র বেশি ওঠে না। সাধারণত আমার শরীরের তাপমাত্রা ৯৭র বেশি হয় না। ঘুম হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে ভয়ের। চোখ বুঝলেই কী দেখি, আর কী না দেখি। ভাবলাম এভাবে থাকলে হবে না। কিছু একটা করতে হবে। দেখলাম ঘরের কোনাকুনি যদি হাঁটি তাহলে দুই কদম বেশি হাঁটা যাবে। জিনিসপত্র টেনেটুনে সেটা করে নিলাম। তারপর শুরু করলাম হাঁটা-জগিং দৌড় সবই ওইটুকু জায়গার মধ্যে। ছোটবেলায় পণ্ডিত স্যার স্কুলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক-দুই, তিন-চার বলে ব্যয়াম করা শিখিয়েছিলেন সেটাও শুরু করলাম। ব্যাপারটা ছিল এরকম, এক বলে বাম পা এগিয়ে দিতে হবে, দুই বলে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তিন বলে ডান পাটা এগিয়ে দিতে হবে চার বলে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে তালে তালে। সব মিলিয়ে পাগলামির সে এক চরম যাকে বলে। অসুবিধা কি, কেউ তো দেখছে না। দেখলেই না সমস্যা। এর সঙ্গে ওই হাঁটা জগিং তো আছেই। সকালে নাস্তা খেয়ে একবার বিকালে চা খেয়ে একবার যতক্ষণ পারা যায়। দেখলাম ৮-১০ দিনের মাথায় কাজ হলো। ঘুম ভালো হলো। একটু আশার আলো দেখতে পেলাম যেন। খাবার-দাবার আগে যেমন ছিল তেমনই চললো তবে গরম পানির ব্যবহারটা বাড়ল। এসবের জন্য দরজা যেটুকু ফাঁক না করলে নয় সেটুকু কেবল করে গেছি।

নিজে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগের কথা কিছু বলি। দেশে করোনাকালের শুরুতে আমি ‘করোনাকালের জীবন’ লেখা শুরু করি। কারণ হয়তো হবে করোনাকালের শুরুতেই আমার পরিবার শক্ত একটা ধাক্কা খেয়েছে। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম সদস্য আমার ছেলের চাকরি চলে গেছে। কোম্পানির চাকরি, কিছুই করার নেই। অন্যদিকে করোনাকালের ওই সময় দুইবার মিসেসকে নিয়ে হাসপাতালে থেকে আসতে হয়েছে আমার। উপায় ছিল না। সে ডায়েবেটিকস-প্রেসারের রোগী। তারপর স্ট্রোক করে বসল এ সময়। যে হাসপাতালে থেকে এসেছি সেখানে করোনার চিকিৎসা সবে শুরু হয়েছে তখন। করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে গা ছমছম করেছে। অন্য রোগী তখন ছিল না বললেই চলে। ছিল না ডাক্তার। ফাঁকা হাসপাতাল। জুনিয়র দু’একজন ডাক্তার অনলাইনে সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাপত্র যা দিবার দিয়েছেন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও ভীতসন্ত্রস্ত। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে কত কিছু না দেখতে হলো, শুনতে হলো। মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। এখন যেমন করোনা আছে, মানুষও আছে। মানুষের সাহসও বেড়েছে। তখন সেটা ছিল না। একপর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সঙ্গে পুলিশ এগিয়ে না এলে কী দশা হতো ভাবাই কঠিন।

খবরের কাগজ একটাও বন্ধ থাকেনি। ধন্যবাদ জানাই হকারকে একদিনও সে পত্রিকা দেয়া বন্ধ করেনি। আর সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ও সাংবাদিক ভাইরা অসাধারণ অবদান রেখেছেন ওই সময়, যা দেশবাসী দেখেছে। খবরের কাগজ পড়া টেলিভিশন দেখার সঙ্গে চলে আমার ওই করোনাকালের জীবন লেখা যার থেকে দু’একটা লেখা পত্রিকায়ও পাঠিয়েছি। তারপর এক সময় করোনাকালের পারিপার্শ্বিকতা, হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ নানা বিষয় এসে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আমার পাণ্ডুলিপিখানা। ভালোই লাগল নিজের কাছে। একদিন ফোন করলাম স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের অফিসে। যিনি এদিকটা দেখেন তিনি বললেন, এখন আমরা কোন পাণ্ডুলিপি নিচ্ছি না। তবে যেহেতু ইউপিএল আগে আপনার বই করেছে, পাঠিয়ে দিন, মাস দুই পরে জানিয়ে দেয়া হবে বইটা আমরা করব কিনা। এখন কেউ অফিস করছেন না, বাসায় থেকেই করছেন যে যা করার। কাজেই আপনি সফট কপিও আমাদের মেইলে পাঠিয়ে দিন’। কথা মতো হার্ড কপি সফট কপি দুটোই পাঠিয়ে দিলাম। খুবই ভালো একটা নিয়ম আছে ওদের। পাণ্ডুলিপি গ্রহণযোগ্য কি না- তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য ওদের একটা বিশেষজ্ঞ টিম আছে। সেখানে টিকে গেলে আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। বই হয়ে যাবে। তারপর বছরে কয়টা বই বিক্রি হলো না হলো সে হিসাব চুক্তি মোতাবেক রয়েলটিসহ পেয়ে যাবেন। যা হোক, পাণ্ডুলিপিখানা পাঠিয়ে দিয়ে বেশ খোশমেজাজেই ছিলাম। মনে মনে ভাবতে থাকি যদি ওরা বইটা করে দারুণ হবে। আমার আর কোথাও গিয়ে ধরনা দিতে হবে না পরে।

এর মধ্যে আমি আক্রান্ত হয়ে পড়লাম করোনায় শুরুতে যেটা বলেছি। এর মধ্যেই পত্রিকায় দেখলাম করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নিজে আইসোলেশনে থেকে সংবাদ অফিসে ফোন করে মুনীর ভাইয়ের খবর নিয়েছি প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু অবস্থা সংকটাপন্ন এমন শুনিনি। তারপর যা হবার তা হয়ে গেল। চলে গেলেন মুনীর ভাই না ফেরার দেশে। একবার দেখতে যেতেও পারলাম না। বড় কষ্ট পেলাম। এ সময় একটা ভালো খবর আমার এ কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিল। আহমদ পাবলিশিং হাউসের মাননীয় প্রকাশক মেছবাহউদ্দীন আহমদ ফোন করে জানালেন, তার পাইপলাইনে আমার যে পাণ্ডুলিপিখানা ছিল সেটার কাজ শেষ হয়েছে। বললেন, বইটা এখন আমার হাতে। আপনি এসে আপনার কপি নিয়ে যেতে পারেন’। আমি আইসোলেশনে আছি শুনে দুঃখ প্রকাশ করলেন সাহস দিলেন। বললেন, বইটা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি, দেখলে আপনার ভালো লাগবে। ভালো লেগেছে কিন্তু যে বইয়ের প্রতিটা লেখায় মুনীর ভাইয়ের স্পর্শ রয়েছে সেই বইয়ের একটা কপি তার হাতে তুলে দিতে পারলাম না এ দুঃখ কি করে ঘুচবে আমার। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমার যে লেখাগুলো সংবাদে ছাপা হয়েছে তার থেকে ৩০টা লেখা বেছে নিয়ে বইখানা করা হয়েছে, নাম ‘বিশ্বাসঘাতকেরা মরে না’ যা একটা লেখার শিরোনাম থেকে নেয়া। ‘শিক্ষা ও আজকের শিশু’ নামে আমার একখানা বই আছে বাজারে, এ নামটাও মুনীর ভাইয়ের দেয়া। ‘সবাই যা দেখে’ নামে যে কলাম লিখি এটাও তিনি পছন্দ করেছিলেন।

২৩ দিন আইসোলেশনে থাকার পর নমুনা দিয়ে এলাম যথাস্থানে। রিপোর্ট এলো আবার পজিটিভ। আমি তেমন কোন অসুবিধা আমার দেখছি না। অথচ রিপোর্ট এলো পজিটিভ। ভয় পাওয়ারই কথা। পরিবারের সবাইকে বললাম, এখানে করার কিছু নেই, যা হবার হবে। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অভয় দিলেন। ৩৫ দিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও ফোন করে একজন ডাক্তার খোঁজখবর নিলেন, সাহস দিলেন। একটা ওষুধ চালিয়ে যেত বললেন। বললেন, আরও কিছু দিন সাবধানে থাকুন মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হবেন তারপর আবার পরীক্ষা করাবেন। শেষে ৪৫ দিন পার করে দিয়ে আবার নমুনা দিয়ে এলাম। রিপোর্ট এলো নেগেটিভ। পরিবারের কথা বাদ দিলাম, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন আমি নিজেই। কারণ মৃত্যুকালে কাউকে কাছে পাব না এ কথা ভেবেই যত কষ্ট হচ্ছিল তখন।

শেষ করব ইতালির সেই অশীতিপর বৃদ্ধকে স্মরণ করে। তিনি করোনাযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তার ছবি এসেছিল পত্রিকায়। অটুট মনোবল ও সাহস তাকে শক্তি জুগিয়েছিল করোনা প্রতিরোধে। আমি আক্রান্ত হলে আমার প্রায় সমবয়সী ওই মানুষটির কথা মনে করেছি। ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি মনোবল। শেভ-গোসল একদিনও বাদ দেইনি। পোশাক আশাক যা ছিল ঘরে প্রতিদিন একটা করে বের করেছি আর পরেছি। বইপত্র, খবরের কাগজ, কম্পিউটার, টেলিভিশন সবকিছু নিয়ে ঘরবন্দি এক জগৎ খুলে নিয়েছিলাম আমি। ঘরমোছা বাথরুম সাফ করা সবকিছু নিয়েই ছিল আমার জীবনের এদিনগুলো, যার বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। ভয় ছিল নিজের থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাই বলে রেখেছিলাম, অবস্থা খারাপ দেখলে অ্যাম্বুলেন্স ডাকবে যারা করোনা রোগী বহন করে উঠায়-নামায়, প্রয়োজনে সেবা সংস্থাকে ডাকবে, যারা দাফন-কাফনের যাবতীয় কাজ করে থাকে। তোমরা কেউ ছটুবে না আমার কাছে আসবে না। কষ্ট হয়েছে আমার নাতি দুটোর জন্য বেশি। ভেবেছি ওদের সঙ্গে আর বুঝি দেখা হলো না। আমি আক্রান্ত হওয়ার আগ দিয়ে ওরা যশোর চলে যায়। রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পর তাই প্রথম যে কাজটি করেছি তাহলো নাতিদের বলেছি, আমি ভালো হয়ে গেছি। বউমাকে বলেছি তোমরা চলে এসো। সন্তান সম্ভাবনা মেয়েকে বলেছি আরও কিছুদিন পর তোমাদের সঙ্গে দেখা হোক, কিন্তু কে শোনে সে কথা!

করোনা শরীরে নিয়ে ঘরে থাকার এ দুঃসময়ে আমার শুভাকাক্সক্ষী যারা আমার খোঁজখবর রেখেছেন তাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।

শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ , ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ১০ রবিউস সানি ১৪৪২

সবাই যা দেখে

করোনা নিয়ে ৪৫ দিনের ঘরবন্দি জীবন যেভাবে কাটল

আব্দুল মান্নান খান

শুরু হলো জ্বর, হাঁচি, কাশি। ডাক্তার বললেন, নমুনা দিয়ে আইসোলেশনে চলে যান। দেরি না করে নমুনা দিয়ে এসেই ঘরে দরজা দিলাম। রাতেই জানা গেল করোনা পজিটিভ। ডাক্তার কতকগুলো টেস্ট দিলেন সেটাও করিয়ে এলাম সাবধানে গিয়ে। কয়েকটা ওষুধ দিলেন। শুরু করলাম করোনা নিয়ে ঘরবন্দি একাকী এক জীবন। ঘরে আলো-বাতাসের চলাচল খারাপ না। বারান্দা আছে তবে সেদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। কারও মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায় বা আমার দ্বারা কেউ সংক্রমিত হতে পারে এমন কাজ করাই যাবে না। একটা পালস ওক্সিমিটার সঙ্গে রাখতে হলো। ডাক্তার বলে দিলেন, দিনে তিন-চারবার পরীক্ষা করবেন। যদি দেখেন ৯৩% নেমে এসেছে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাবেন’। এটা শেষে আতঙ্কের একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এই বুঝি অক্সিজেনের টান পড়ল। জ্বরের অনুভব বেশি কিন্তু তাপমাত্রা ১০০র বেশি ওঠে না। সাধারণত আমার শরীরের তাপমাত্রা ৯৭র বেশি হয় না। ঘুম হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে ভয়ের। চোখ বুঝলেই কী দেখি, আর কী না দেখি। ভাবলাম এভাবে থাকলে হবে না। কিছু একটা করতে হবে। দেখলাম ঘরের কোনাকুনি যদি হাঁটি তাহলে দুই কদম বেশি হাঁটা যাবে। জিনিসপত্র টেনেটুনে সেটা করে নিলাম। তারপর শুরু করলাম হাঁটা-জগিং দৌড় সবই ওইটুকু জায়গার মধ্যে। ছোটবেলায় পণ্ডিত স্যার স্কুলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক-দুই, তিন-চার বলে ব্যয়াম করা শিখিয়েছিলেন সেটাও শুরু করলাম। ব্যাপারটা ছিল এরকম, এক বলে বাম পা এগিয়ে দিতে হবে, দুই বলে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তিন বলে ডান পাটা এগিয়ে দিতে হবে চার বলে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে তালে তালে। সব মিলিয়ে পাগলামির সে এক চরম যাকে বলে। অসুবিধা কি, কেউ তো দেখছে না। দেখলেই না সমস্যা। এর সঙ্গে ওই হাঁটা জগিং তো আছেই। সকালে নাস্তা খেয়ে একবার বিকালে চা খেয়ে একবার যতক্ষণ পারা যায়। দেখলাম ৮-১০ দিনের মাথায় কাজ হলো। ঘুম ভালো হলো। একটু আশার আলো দেখতে পেলাম যেন। খাবার-দাবার আগে যেমন ছিল তেমনই চললো তবে গরম পানির ব্যবহারটা বাড়ল। এসবের জন্য দরজা যেটুকু ফাঁক না করলে নয় সেটুকু কেবল করে গেছি।

নিজে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগের কথা কিছু বলি। দেশে করোনাকালের শুরুতে আমি ‘করোনাকালের জীবন’ লেখা শুরু করি। কারণ হয়তো হবে করোনাকালের শুরুতেই আমার পরিবার শক্ত একটা ধাক্কা খেয়েছে। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম সদস্য আমার ছেলের চাকরি চলে গেছে। কোম্পানির চাকরি, কিছুই করার নেই। অন্যদিকে করোনাকালের ওই সময় দুইবার মিসেসকে নিয়ে হাসপাতালে থেকে আসতে হয়েছে আমার। উপায় ছিল না। সে ডায়েবেটিকস-প্রেসারের রোগী। তারপর স্ট্রোক করে বসল এ সময়। যে হাসপাতালে থেকে এসেছি সেখানে করোনার চিকিৎসা সবে শুরু হয়েছে তখন। করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে গা ছমছম করেছে। অন্য রোগী তখন ছিল না বললেই চলে। ছিল না ডাক্তার। ফাঁকা হাসপাতাল। জুনিয়র দু’একজন ডাক্তার অনলাইনে সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাপত্র যা দিবার দিয়েছেন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও ভীতসন্ত্রস্ত। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে কত কিছু না দেখতে হলো, শুনতে হলো। মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। এখন যেমন করোনা আছে, মানুষও আছে। মানুষের সাহসও বেড়েছে। তখন সেটা ছিল না। একপর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সঙ্গে পুলিশ এগিয়ে না এলে কী দশা হতো ভাবাই কঠিন।

খবরের কাগজ একটাও বন্ধ থাকেনি। ধন্যবাদ জানাই হকারকে একদিনও সে পত্রিকা দেয়া বন্ধ করেনি। আর সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ও সাংবাদিক ভাইরা অসাধারণ অবদান রেখেছেন ওই সময়, যা দেশবাসী দেখেছে। খবরের কাগজ পড়া টেলিভিশন দেখার সঙ্গে চলে আমার ওই করোনাকালের জীবন লেখা যার থেকে দু’একটা লেখা পত্রিকায়ও পাঠিয়েছি। তারপর এক সময় করোনাকালের পারিপার্শ্বিকতা, হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ নানা বিষয় এসে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আমার পাণ্ডুলিপিখানা। ভালোই লাগল নিজের কাছে। একদিন ফোন করলাম স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের অফিসে। যিনি এদিকটা দেখেন তিনি বললেন, এখন আমরা কোন পাণ্ডুলিপি নিচ্ছি না। তবে যেহেতু ইউপিএল আগে আপনার বই করেছে, পাঠিয়ে দিন, মাস দুই পরে জানিয়ে দেয়া হবে বইটা আমরা করব কিনা। এখন কেউ অফিস করছেন না, বাসায় থেকেই করছেন যে যা করার। কাজেই আপনি সফট কপিও আমাদের মেইলে পাঠিয়ে দিন’। কথা মতো হার্ড কপি সফট কপি দুটোই পাঠিয়ে দিলাম। খুবই ভালো একটা নিয়ম আছে ওদের। পাণ্ডুলিপি গ্রহণযোগ্য কি না- তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য ওদের একটা বিশেষজ্ঞ টিম আছে। সেখানে টিকে গেলে আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। বই হয়ে যাবে। তারপর বছরে কয়টা বই বিক্রি হলো না হলো সে হিসাব চুক্তি মোতাবেক রয়েলটিসহ পেয়ে যাবেন। যা হোক, পাণ্ডুলিপিখানা পাঠিয়ে দিয়ে বেশ খোশমেজাজেই ছিলাম। মনে মনে ভাবতে থাকি যদি ওরা বইটা করে দারুণ হবে। আমার আর কোথাও গিয়ে ধরনা দিতে হবে না পরে।

এর মধ্যে আমি আক্রান্ত হয়ে পড়লাম করোনায় শুরুতে যেটা বলেছি। এর মধ্যেই পত্রিকায় দেখলাম করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নিজে আইসোলেশনে থেকে সংবাদ অফিসে ফোন করে মুনীর ভাইয়ের খবর নিয়েছি প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু অবস্থা সংকটাপন্ন এমন শুনিনি। তারপর যা হবার তা হয়ে গেল। চলে গেলেন মুনীর ভাই না ফেরার দেশে। একবার দেখতে যেতেও পারলাম না। বড় কষ্ট পেলাম। এ সময় একটা ভালো খবর আমার এ কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিল। আহমদ পাবলিশিং হাউসের মাননীয় প্রকাশক মেছবাহউদ্দীন আহমদ ফোন করে জানালেন, তার পাইপলাইনে আমার যে পাণ্ডুলিপিখানা ছিল সেটার কাজ শেষ হয়েছে। বললেন, বইটা এখন আমার হাতে। আপনি এসে আপনার কপি নিয়ে যেতে পারেন’। আমি আইসোলেশনে আছি শুনে দুঃখ প্রকাশ করলেন সাহস দিলেন। বললেন, বইটা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি, দেখলে আপনার ভালো লাগবে। ভালো লেগেছে কিন্তু যে বইয়ের প্রতিটা লেখায় মুনীর ভাইয়ের স্পর্শ রয়েছে সেই বইয়ের একটা কপি তার হাতে তুলে দিতে পারলাম না এ দুঃখ কি করে ঘুচবে আমার। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমার যে লেখাগুলো সংবাদে ছাপা হয়েছে তার থেকে ৩০টা লেখা বেছে নিয়ে বইখানা করা হয়েছে, নাম ‘বিশ্বাসঘাতকেরা মরে না’ যা একটা লেখার শিরোনাম থেকে নেয়া। ‘শিক্ষা ও আজকের শিশু’ নামে আমার একখানা বই আছে বাজারে, এ নামটাও মুনীর ভাইয়ের দেয়া। ‘সবাই যা দেখে’ নামে যে কলাম লিখি এটাও তিনি পছন্দ করেছিলেন।

২৩ দিন আইসোলেশনে থাকার পর নমুনা দিয়ে এলাম যথাস্থানে। রিপোর্ট এলো আবার পজিটিভ। আমি তেমন কোন অসুবিধা আমার দেখছি না। অথচ রিপোর্ট এলো পজিটিভ। ভয় পাওয়ারই কথা। পরিবারের সবাইকে বললাম, এখানে করার কিছু নেই, যা হবার হবে। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অভয় দিলেন। ৩৫ দিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও ফোন করে একজন ডাক্তার খোঁজখবর নিলেন, সাহস দিলেন। একটা ওষুধ চালিয়ে যেত বললেন। বললেন, আরও কিছু দিন সাবধানে থাকুন মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হবেন তারপর আবার পরীক্ষা করাবেন। শেষে ৪৫ দিন পার করে দিয়ে আবার নমুনা দিয়ে এলাম। রিপোর্ট এলো নেগেটিভ। পরিবারের কথা বাদ দিলাম, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন আমি নিজেই। কারণ মৃত্যুকালে কাউকে কাছে পাব না এ কথা ভেবেই যত কষ্ট হচ্ছিল তখন।

শেষ করব ইতালির সেই অশীতিপর বৃদ্ধকে স্মরণ করে। তিনি করোনাযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তার ছবি এসেছিল পত্রিকায়। অটুট মনোবল ও সাহস তাকে শক্তি জুগিয়েছিল করোনা প্রতিরোধে। আমি আক্রান্ত হলে আমার প্রায় সমবয়সী ওই মানুষটির কথা মনে করেছি। ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি মনোবল। শেভ-গোসল একদিনও বাদ দেইনি। পোশাক আশাক যা ছিল ঘরে প্রতিদিন একটা করে বের করেছি আর পরেছি। বইপত্র, খবরের কাগজ, কম্পিউটার, টেলিভিশন সবকিছু নিয়ে ঘরবন্দি এক জগৎ খুলে নিয়েছিলাম আমি। ঘরমোছা বাথরুম সাফ করা সবকিছু নিয়েই ছিল আমার জীবনের এদিনগুলো, যার বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। ভয় ছিল নিজের থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাই বলে রেখেছিলাম, অবস্থা খারাপ দেখলে অ্যাম্বুলেন্স ডাকবে যারা করোনা রোগী বহন করে উঠায়-নামায়, প্রয়োজনে সেবা সংস্থাকে ডাকবে, যারা দাফন-কাফনের যাবতীয় কাজ করে থাকে। তোমরা কেউ ছটুবে না আমার কাছে আসবে না। কষ্ট হয়েছে আমার নাতি দুটোর জন্য বেশি। ভেবেছি ওদের সঙ্গে আর বুঝি দেখা হলো না। আমি আক্রান্ত হওয়ার আগ দিয়ে ওরা যশোর চলে যায়। রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পর তাই প্রথম যে কাজটি করেছি তাহলো নাতিদের বলেছি, আমি ভালো হয়ে গেছি। বউমাকে বলেছি তোমরা চলে এসো। সন্তান সম্ভাবনা মেয়েকে বলেছি আরও কিছুদিন পর তোমাদের সঙ্গে দেখা হোক, কিন্তু কে শোনে সে কথা!

করোনা শরীরে নিয়ে ঘরে থাকার এ দুঃসময়ে আমার শুভাকাক্সক্ষী যারা আমার খোঁজখবর রেখেছেন তাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।